আর্তনাদ

চিত্রা দাশগুপ্ত #

আমরা চার পুরনো বন্ধুরা মিলে হঠাৎ মাথায় কি খেয়াল এলো দুম করে চলে গেলাম তারাপীঠ। সবাই তখন মধ্য গগনে মানে অর্ধশতক পার করেছি।  স্কুল কলেজের সময় থেকে আমরা এক সাথে, অজয়, সুনীল, দয়াল আর আমি চন্দন। অনেক ভালো মন্দ কুকীর্তির সঙ্গী আমরা। বিড়ি টানা থেকে, লালজল পানের হাতে-খড়ি আমাদের এক সাথে হয়েছে। আর্থিক সঙ্গতি সবার এক ছিল না, কোনও কোনও ব্যাপারে আমাদের মতভেদও ছিল, তবু তা আমাদের বন্ধুত্বে কোনও ফাটল ধরাতে পারেনি বা আমাদের তার জন্য কোনও সমস্যা হয়নি। 

আমাদের তারাপীঠ যাবার উদ্দেশ্যটা ঠিক “ধম্মকম্ম”র জন্য ছিলনা, নেহাতই একটু আলাদা একটু ভিন্ন সাধের জীবন পরখ করে দেখাটাই ছিল আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আগে থেকে হোটেল বুক করা ছিল, ওখানে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া সেরে মন্দির চত্বরটা ঘুরে ফিরে গুটিগুটি পায়ে আমরা পৌছে গেলাম তারাপীঠের রহস্যময় মহা-শ্মশানে। প্রথমে আমরা গেলাম সাধক বামাক্ষেপার স্মৃতিমন্দিরের দিকে, দ্বারকা নদের ধারে বসে সাধনা করতেন তিনি।

অনেক অলৌকিক গল্প ও ভক্তিগীতি আছে তাঁর নামে। কথিত আছে মা তারা নাকি স্বয়ং তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন। ছোট বড় অনেক থান দেখলাম, কত অজানা সব সাধকের নাম শুনলাম, বিচিত্র তাদের গল্প  ….

সেটা ছিলো অমাবশ্যার রাত, বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে, চট করেই চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এদিক ওদিকে ধুনি জ্বেলে সাধু সন্ন্যাসীরা বসে আছে, তাদের পাশে ঘিরে বসে আছে তাদের চেলা-চামুন্ডার দল। হাতে হাতে ফিরছে ছিলিমের কল্কে, উগ্র গন্ধ সাথে ধোয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে বাতাসটা ভারি করে দিচ্ছে, শ্বাস নিতে চাপা কষ্টই হচ্ছে। একটু দূরে চিতা জ্বলছে, কোনটা দাউ দাউ করে, কোনটা ধিক-ধিক করে। কেউ বা দাহ শেষে দেহাবশেষ, অস্থি  সংগ্রহ করে জল ঢেলে চিতা ঠান্ডা করে নতমুখে ক্লান্ত পায়ে বিদায় নিচ্ছে। 

একটা জ্বলন্ত চিতার সামনে এক দল লোক একটু দুরে দাঁড়িয়ে, এক মহিলা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে, বুক ভাঙা সে কান্না …হঠাৎ চিতায় জ্বলন্ত শব নড়েচড়ে উঠে বসল, ভেঙে পড়ল চিতার জ্বলন্ত কিছু কাঠ, আগুনের ফুলকিগুলো হাওয়ায়ে দুলে দুলে শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে …দেখলাম এক ডোম বাঁশ হাতে এগিয়ে এসে সজোরে বারিমেরে সেই শবটাকে আবর চিতায় শুইয়ে দিল। সেই দৃশ্য দেখে অনেকে জোরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। যদি ও জানি মানুষের শরীরের শিরা বা ধমনী যাকে রগ বলি আগুনে পুড়ে সেই রাগে টান লাগে বলে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে তবু চমকে উঠেছিলাম।গাটা গুলিয়ে উঠেছিল আমি ওয়াক তুলে সরে গেলাম ।

“বল হরি হরি বোল” নতুন শব-যাত্রী আসছে, বিরাম নেই। দূরে গাছে একটা রাত জাগা-পাখি একটানা ডেকে চলেছে, তার সাথে রয়েছে ভক্তদের 

“জঅঅয় মাতারা” ”জয় মাত্তারা” উল্লাস ধ্বনী।  মদ-মাতালের গিটকিরি মারা হাসি খিস্তি-খেউরে,  অল্প পয়সায় খেপ খাটতে আসা রং মাখা, ঝলমলে পোষাকে সজ্জিত দেহ পসারিনীর দল, আবার গেরুয়া বসনা, রুদ্রাক্ষ-মালা গলায়, জটা ধারিণী অথবা এলোকেশি ভৈরবী সাধন সঙ্গিনীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র, হাত বাড়ালেই হল, নরকগুলজার যাকে বলে! চোখ-কান খোলা রেখে পায়ে পায়ে ইতিউতি হেঁটে বেড়াচ্ছি। রাত যত বাড়ছে পরিবেশটা যেন ততই রহস্যঘন হয়ে উঠছে। 

এক রক্ত-বসন ধারি তান্ত্রিক, কপালে সিঁদুরের তিলক, গলায় হাতে রুদ্রাক্ষর মালা সামনে ধুনি জ্বলছে,  এক পাশে সিঁদুর মাখা একটা ত্রিশূল অন্যপাশে একটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ভক্তবৃন্দ ঘিরে বসে আছে, তিনি সবাইকে মরার করোটিতে ঢেলে কারণ-বারি বিলি করছেন, নিজেও খাচ্ছেন।

এক ভক্ত চোখ-বুজে বসে দরাজ গলায় শ্যামা-সঙ্গীত গাইছে, বড় দরদী গলা।তান্ত্রিকের চেহারাটাতে কিছু ছিল আমরা ও দাঁড়িয়ে পড়লাম।আশপাশ থেকে টুকরো টুকরো কথা কানে আসছিল, সত্যি-মিথ্যা জানিনা শুনলাম তিনি নাকি কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিজ্ঞাণ বিভাগের স্নতকত্তর ছাত্র ছিলেন ….সত্যি মনের আর নদীর গতি বোঝাভার।

শ্মশান, মানুষের সব দর্প, সব কীর্তি, সব দৌড়-ঝাঁপ, হম্বি-তম্বির ইতি এখানে!  

চিতার আগুনে পুড়ে শব একমুঠো ছাই হয়ে মাটিতে মিলিয়ে যায়, রাজা-রং সব একাকার। আমাদের মুখে কথা নেই, কেমন যেন হাওয়ায় ভেসে চলেছি আমরা, কিসের সংসার, কিসের মোহ, কে কার? বিষাদে মনটা ভরে উঠছে। আজ আমরা এক লাগাম ছাড়া রাত, যা প্রাণ চায় তাই করব ভেবে এই নির্জন শ্মশানে এসেছি। আজ আমাদের মধ্যে যে আসল আমিটা লুকিয়ে আছে তাকে আটকাব না। ভেতরের বিবেকটাকে আজ সমাজের ভয়ে গলা টিপে চুপ করিয়ে রাখব না।  একটা রাত তাকে এই শ্মশানে আকাশের নিচে নির্ভয়ে বেরিয়ে আসতে দেব। যার যা অপরাধের বোঝা আজ এই শ্মশানে উগরে দেবো। 

এখানে কেউ তো আমাদের চেনে না, তাই সন্ধ্যে থেকে সবাই হাতে করে একটা বাংলা নিয়ে দিব্য বুক ফুলিয়ে হাঁটছি মাঝে মাঝে ঢুকু-ঢুকু গলায় ঢালছি। কাঁধের ঝোলা-ব্যাগটাতে স্টকে আর একটা করে বোতল রাখা আছে। তাছাড়া একটা মাঙ্কি-টুপি, একটা টর্চ, একটা পুরনো পত্রিকা আর বেশ কিছু তেলেভাজা ও মুড়ি। এখানে পৌঁছে অজয় আর সুনীল বাড়িতে পৌঁছানোর সংবাদ দিয়ে ফোন অফ করে দিয়েছে, বলেছে মন্দিরে ফোন নিয়ে ঢুকতে দেবে না তাই যেন কেউ ফোন না করে। দয়াল আর আমার তো কাউকে খবর দেবার বালাই নেই। একটু শীত শীত করছিল, আলোয়ানটা গায়ে ভাল  করে জড়িয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হাঁটছি। সবার মনটা যেন কয়েক ঘন্টায় বদলে গেছে এক এক জন যেন দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল ….

হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে কোথা থেকে ছম্-ছম্ পায়ে মল বাজিয়ে ঠমক ঠমক তালে এগিয়ে আসছে এক নারী মূর্তি।  ধূনির আলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠল,

বর্ষার নদীর মতো ভরা যৌবনা, কাঞ্চন-বর্ণা এলোকেশি। পরনে লাল শাড়ি, কপালে উদীয়মান সূর্য়ের মত টকটকে লাল সিঁদুরের ফোঁটা। 

বড় টানাটানা চোখ দুটিতে যেন রহস্যের হাতছানি গলায় জবার মালা, হাতে বিশাল এক ত্রিশূল ….কোন দিকে ভ্রক্ষেপ নেই এগিয়ে চলেছে, নিজের মনে হাসছে। ওর পিছনে একটা কুকুর হঠাৎ দেখলে শিয়াল বলে ভুল হয়, লেজ নেড়ে ছুটছে। আশপাশ থেকে অনেকে মা, মাআআ, মা গো বলে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করছে। কোত্থেকে এক মলিন-বসন, গাল ভরা দাড়ি, লুলা-ল্যাংড়া পাগলা হাসতে হাসতে ছুটে এলো —- মা, মাগো তুই এয়চিস, আমি জানতাম আজ তুই ঠিক আসবি …আয় মা আয়, তোর থানে আজ কত “নোক” এয়েচে। 

নিশুতি-রাতে এই ভয়াল মহাশ্মশানে কে এই সুন্দরী রমনী? প্রাণে ভয়-ডর কি কিছু নেই! আমরাও কি এক অমোঘ আকর্ষণে দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু নিলাম। সামনে সেই পাগলাটা হাত তালি দিয়ে গান গেয়ে নাচতে নাচতে চলেছে। পৌঁছে গেলাম শ্মশানের শেষ প্রান্তে। পাশে বয়ে চলেছে দ্বারকা নদ, শীতের মরা নদ। এই দ্বারকা বা বাবলার উৎপত্তি ঝাড়খন্ডে, পশ্চিম বাংলা বীরভূম হয়ে রামপুর দিয়ে মুর্শিদাবাদে ভাগীরথীতে গিয়ে মিশেছে।দ্বারকার তীরে ছড়ানো ছিটানো কিছু গাছপালা ঝোপঝাড়,পরিবেশটাকে আরো ভৌতিক করে তুলেছে। কিছু লোক শবদাহ শেষে ঐ হাঁটুজলে ডুব দিচ্ছে, অন্ধকারে তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন কতগুলো প্রেতাত্মা ….

এক ঝাঁক-শিয়াল ডেকে উঠল, আশপাশ ঝোপঝাড় থেকে নারী কন্ঠের হাস্য-লাস্য, শীৎকার, কোথাও বা নারী পুরুষের মিলিত কামনা তৃপ্তির উল্লাস ধ্বনী। হঠাৎ নির্জন শ্মশানের বুক চিরে এক কিশোরী কন্ঠের তীক্ষ্ণ করুণ আর্তনাদ দূর থেকে ভেসে এল বাঁচাআআওওও… প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো সেই আর্তনাদ শ্মশানের এক প্রান্ত থেকে ও অপর প্রান্তে…

নিমিষে জয় মা, জয় মাত্তারা রবে ঢেকে গেলো সেই আর্তনাদ। যে মা জগত-তারিনী, বিপদনাশিনী সেই মার পীঠ-স্থানে মহাতীর্থে এ কেমন অনাচার। আমরা ছটফট করে চারদিকে তাকিয়ে খুঁজলাম, শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে, ব্যর্থ চেষ্টা, ঘন কাল অন্ধকার। আঁধার গ্রাস করে নিল ক্রন্দসীকে।  

ছম্-ছম্ শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, কোথায় গেল সামনের সেই রহস্যময়ী?  গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমাদের লাগাম ছাড়া রাত কাটাবার বাসনায় ইতি-টেনে আমরা জীবন্ত-লাশের মত ফিরে গেলাম হোটেলে। আমাদের কানে তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই আর্তনাদ বাঁচাওওও….

আমাদের ভিতরের আমিটা তাহলে এখনও অন্তঃসার শূন্য হয় নি, আমরা এখনও বধির হয় নি! শুধু প্রতিবাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা।  

আজও রাতের আঁধারে আমি শুনতে পাই সেই করুণ আর্তনাদ।

2 thoughts on “আর্তনাদ

  • January 9, 2021 at 4:56 am
    Permalink

    অমার লেখা আর্তনাদ এত সুন্দর করে ছবি দিয়ে ইলাসট্রেশন করে আবেক্ষণের পেজে দেখে খুব আনন্দ পেলাম ! অনেক ধন্যবাদ অবেক্ষণ টিমের সব সদস্য বৃন্দকে ।

    Reply
  • January 25, 2021 at 5:22 pm
    Permalink

    সুন্দর। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।
    বিশ্বজিৎ রায়
    ( “কৈকেয়ী” প্রবন্ধের লেখক)
    ২৫/০১/২০২১

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × one =

preload imagepreload image