এক নারী আর একটি আন্দোলন
ইন্দ্রদীপ দত্ত গুপ্ত, সিউড়ী, বীরভূম
কোনও কোনও মানুষ আছেন যারা পথপ্রদর্শক হয়ে কোনও কাজ শুরু করলেও পরবর্তী কালে ইতিহাস তাদের আর সেভাবে মনে রাখেনি। এমনই একজন হলেন গউরা দেবী। যিনি এক সময় পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের ধারা প্রায় একা হাতে বদলে দিয়েছিলেন।
গাড়োয়াল হিমালয়ের নন্দাদেবী শৃঙ্গের কোলে এক ছোট্ট গ্রাম লতা। এখানেই ১৯২৫ সালে এক দরিদ্র উপজাতি পরিবারে জন্মেছিলেন গউরা দেবী। অত্যন্ত অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেলেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁর স্বামী মারা যান। জীবনযুদ্ধে ভেঙ্গে না পড়ে আড়াই বছরের সন্তান সহ গাড়োয়ালের রেনি নামে এক গ্রামের কাছেই থাকতে শুরু করেন।
এদিকে গাড়োয়ালিদের অরণ্য নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় গাছ তাদের ধার্মিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। অরণ্যর কাঠ, পাতা, রবার ইত্যাদি বিক্রি করেই তাদের জীবননির্বাহ হত। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যায় তারা উপলব্ধি করেছিল – পাহাড়ের ঢালে যত গাছ থাকবে, ধ্বস নামার প্রবণতাও তত কমবে। গাড়োয়ালিরা শতাব্দী প্রাচীন সংস্কার থেকেই মন্দিরের চারপাশ ঘিরে দেবদারু গাছ লাগাতো। ধর্মীয় সংস্কারের সাথে এভাবেই মিশে গিয়েছিল দৈনন্দিন জীবনযাপন।
১৯৭৪ সাল নাগাদ রাস্তা তৈরির জন্য রেনি গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় প্রায় ২৪৫১ টি গাছ কাটার প্রয়োজন দেখা দিল। ওই বছরের ২৫ শে মার্চ সকালে ঠিকেদারের লোকেরা গাছ কাটতে এল। দারিদ্রতার কারণে এমনিতেই এই সব অঞ্চলের পুরুষরা বাধ্য হয় সমতলে নেমে কাজ খুঁজতে। তাই বেশির ভাগ গ্রামই দিনের পর দিন থাকে পুরুষ শূন্য। ঠিকেদারের লোকেরা কয়েকদিন আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিল যে ওইদিন শহরে চিন-ভারত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ফলে বেশির ভাগ গ্রামের পুরুষরাই ততক্ষণে শহরে নেমে গিয়েছেন।
চল্লিশোদ্ধ গউরা দেবী ততদিনে গ্রাম পঞ্চায়েত এর মহিলাদের নিয়ে তৈরি ‘মহিলা মঙ্গল দল’ এর সভাপতি। তাঁর কাছে খবর গেল। মাত্র ২৭ জন মহিলা নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন তিনি । গউরা দেবী ও তার সঙ্গীরা গাছগুলি জড়িয়ে ধরে ঘোষণা করলেন যদি গাছ কাটতেই হয়, তাদেরকে সহ কাটতে হবে। আজ আমরা চিপকো আন্দোলন বলতে যা বুঝি তার সার্থক রূপ পেল। পিছু হটল ঠিকেদারের দল। টানা তিন দিন তিন রাত মহিলারা গাছগুলি পাহারা দিলেন। খবর পেয়ে প্রবীণ গান্ধীবাদী নেতা সুন্দরলাল বহুগুণা লাগাতার আন্দোলন আর অনশনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করলেন ওই অঞ্চলে আগামী ১০ বছরের জন্য গাছ কাটা বন্ধ রাখতে। কালক্রমে চিপকো আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠলেন সুন্দরলাল বহুগুণা আর নিরক্ষর হওয়ার কারণেই হয়ত বা গউরা দেবী বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেন। ১৯৯১ সালে ৬৬ বছর বয়সে কর্পদকহীন অবস্থায় মারা যান গউরা দেবী। পরবর্তী সময়ে সেখানে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে রাস্তা থেকে জনপদ সবই হয়েছে। গউরা দেবীর দেখানো পথ ভুলে যাওয়ার মাশুল দিল গাড়োয়াল ১৭ই জুন ২০১৩ সালে। ভয়াবহ বন্যা আর ধ্বসে প্রাণ হারালেন হাজার হাজার মানুষ। কেদারনাথ মন্দির সংলগ্ন জনপদ হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে। প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করার ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে।
সময়োপযোগী বিষয়, মনোগ্রাহী লেখা। ধন্যবাদ লেখককে।
খুব ভাল লাগল, অজানাকে আলোয় আনার জন্য ধন্যবাদ
ভালো লাগল এমন নাতিদীর্ঘ তথ্য বহুল লেখা পড়ে।