কি বলি!
সুকান্ত মিশ্র
##
বিয়েটা আমি করি নি । হয়ে গেছে । যেমন করে একটা বয়সে দাড়ি গোঁফ বেরোয়, যেমন করে একটা সময় পলাশ,শিমুল সেজে ওঠে পৃথিবীতে তাদের স্মৃতি রেখে যাওয়ার জন্য , সেভাবেই একদিন আমার বিয়ে হয়ে গেল । শ খানেক লোকের উপস্থিতি , উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, লাইট, খাওয়া-দাওয়া এ সবের মধ্যেই আমার মইয়ে করে গাছে চড়া ।
আমাদের সময মোটামুটি তিন ধরনের ম্যারেজ সিষ্টেম চালু ছিল । মা-বাবার দেখে দেওয়া পিউর অ্যারেন্জড ম্যারেজ ।
ছেলে মেয়ে প্রেম করেছে । একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবে না । বিয়ে করবে । মা-বাবাকে বলা হল । তাঁরা কিছুতেই রাজি নন । বিস্তর টানা-পোড়েনের পর তাঁরা রাজি হলেন । অনুষ্ঠান করেই বিয়ে হল । এটা সেমি-অ্যারেন্জড ম্যারেজ ।
আবার ছেলে মেয়ে প্রেম করেছে । রাতের অন্ধকারে বেপাত্তা । চারদিকে খোঁজ খোঁজ । পরে জানা গেল ওরা বিয়ে করেছে । একটা মফস্বল শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছে । ছেলে মেয়ে দুজনেই বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসেছিল কিছু কিছু । সেগুলো শেষ । তাই অগত্যা বাড়ি প্রত্যাবর্তন । বাড়ির লোক তো ছেলেকে ফেলে দিতে পারে না । তাই বিয়ে মেনে নেওয়া হল । লাভ ম্যারেজ ।
বিযে করার সময় আমার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স মাত্র দেড় হাজার টাকা । তাই বিয়ে করার পর পরই যতটা ভয় পাচ্ছিলাম বা যতটা ভয়ংকর ভেবেছিলাম , দেখলাম ততটা ভয়ংকর নয় । বরং বিয়ে করে বেশ সুখ আছে । প্রেম করার জন্য যে এলেম দরকার তার বিন্দুমাত্র আমার ছিল না । তাই জীবনে প্রেমের স্বাদ পেয়েছিলাম না । বিয়ের পরে পরেই প্রেমের স্বাদ পেলাম । দুজন দুজনের কথা ভাবি । কিরকম একটা অদৃশ্য টান অনুভব করি দুজনেই । সে সময় ল্যান্ড লাইনের যুগ । বাড়িতে অবশ্য ল্যান্ড লাইন ছিল না । ও বাইরে গেলে টেলিফোন বুথ থেকে আমাকে ফোন করতো । একদিন কথায় কথায় বললাম-কাজে মন বসছে না । শুধু তোমার কথাই মনে পড়ছে ।
-ও রকম করলে চলবে না । মন দিয়ে কাজ কর । ধম’গ্রন্থ পড় মাঝে মাঝে । মন শান্ত হবে ।
টাকা কম বলে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারি না । স্ত্রী অপি’তা পুরুলিয়ার গ্রামের বাড়িতেই থাকে । শনি রবি ছুটি । তাই শুক্রবার রাত্রে বাড়ি যাই । রবিবার রাত্রে ফিরি । আমরা দুজন এমনিতে সুখী তবে টাকা কম আছে বলে চারপাশের কিছু হিংস্র জন্তুকে সুকৌশলে ম্যানেজ করতে হয় ।
আজ শুক্রবার । ডিসেম্বরের মাঝামাঝি । বেশ ঠান্ডা । আমি ধম’তলায় খেয়ে দেয়ে রাত নটার রাহুল বাসে উঠলাম । বাসে বক্সে গান বাজে । এখন প্রেমের গান বাজলে অপি’তার মুখ মনে করে গানগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগে । রোমান্টিক ডুয়েটস হচ্ছিল । “কে প্রথম কাছে এসেছি ” । আমি অপি’তার কথা মনে করে মন দিয়ে গান শুনছিলাম । এই বাসটি আমাদের গ্রামে পৌঁছায় ভোর চারটে, সাড়ে চারটের সময় । শীতকালে রাত থাকে । কেউ কোথাও থাকে না । শুনশান । মাঝে মাঝে ভয় করে । যখন বিয়ে হয় নি গ্রামের ষ্টপেজে নামতাম না । পুরুলিয়া শহর চলে যেতাম । তারপরে সকাল সাতটা ,সাড়ে সাতটায় ওখান থেকে আবার বাস ধরে বাড়ি ফিরতাম । কিন্তু বিয়ের পর সে ধৈর্য্যটুকু থাকে না । কখন অপি’তার মুখ দেখবো, কখন ওর সাথে গল্প করবো,শীতে এক লেপের তলায় শুয়ে থাকবো , এগুলোয় মুখ্য হয়ে ওঠে ।
হ্যাঁ , আর ঐ লেপটার কথা খুব মনে পড়ে । শ্বসুর বাড়ি থেকেই লেপটা দিয়েছিল । ওপরটা ফুল ফুল কাপড় দিয়ে ঢাকা । প্রচুর তুলো দেওয়ার জন্য বেশ মোটা । পুরুলিয়ার শীতে এই লেপ ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতে ভীষণ ভালো লাগতো ।
বাড়ি পৌঁছানোর চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট আগে থেকে এই লেপটার কথা খুব মনে পড়তো । বাড়ি গিয়ে হাত পা ধুয়ে ,প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে কখন যে লেপের তলায় ঢুকবো এই নিয়ে মন উতলা হয়ে থাকতো ।
ভোর সাড়ে তিনটের সময় বাস লালপুর পৌঁছালো । মানে বিশ পঁচিশ মিনিট পরে বাসটি গ্রামের ষ্টপেজে ঢুকে যাবে । বেশ রাত আছে । আকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের সমাবেশ । রাস্তা থেকে বাড়ি যাওয়ার রাস্তাতে একটা ভৌতিক পুকুর আছে । একটু ভয় ভয় করছে । কেউ একটা থাকলে ভালো হত । বেশ কয়েকবার বাস থেকে নেমে অভিকাকার সাথে দেখা হয়েছে । অভিকাকা আমাদের ভাগ চাষী । বাস ষ্টপেজে রাস্তার ধারে ওর বাড়ি । বাড়ির সামনে কুড়ি বাইশ হাত লম্বা বাগান বাড়ি । দেখতাম ঐ সকালে অভিকাকা পাতকুয়া থেকে জল তুলে বাগানবাড়ির আলু বেগুন গাছে জল দিচ্ছে । আজও যদি অভিকাকা থাকে ওকে বলবো বাড়ি পৌঁছে দিতে ।
বাস জয়নগর পার হয়ে গেল । মানে আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গ্রামের ষ্টপেজ এসে যাবে । রাতটা বেশ অন্ধকার ও ভয় ভয় করছে । একবার ভাবলাম গ্রামের ষ্টপেজে নামবো না । কিন্তু অপি’তার দুনিবা’র আকষ’ণ এড়াতে পারলাম না । নেমে পড়লাম । ষ্টপেজে ইলেকট্রিক পোলে বালব জ্বলছে । মোটামুটি একশো মিটার রেডিয়াসে আলো যাচ্ছে । দেখি ওর খামারবাড়ির গেটের কাছে অভিকাকা দাঁড়িয়ে ।
-কেমন আছ অভিকাকা ? চল না আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে ।
অভিকাকা কিছু উত্তর দিল না । হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে চলে গেল । হাঁটাটাও কিরকম একটু অস্বাভাবিক ।
মনে মনে খুব দুঃখ পেলাম । অভিকাকা কথা বললো না । কি আর করা যায় কথা না বললে !
বাড়ি পৌঁছালাম । জুতো খুলে , প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপি’তার লেপে ঢুকে পড়লাম । কোনো গুরুত্ব্ পুন’ খবর থাকলে অপি’তা প্রথমেই বলে দেয় ।
-বুঝলে ,ভেবেছিলাম আজ দুপুরেই ফোন করে তোমাকে খবরটা দিয়ে দিই । কিন্তু তুমি আজই আসবে আর গ্রামের ষ্টপেজে নামবে বলে দিই নি।
-কি খবর ?
-অভিকাকা আজ সকালে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে । রাস্তা থেকে অন্তত দশ ফুট দুরে বসে বসে খড় দিয়ে দড়ি বানাচ্ছিল । একটি সরকারি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওকে পিষে দেয় । একেবারে স্পট ডেথ । এই তো সন্ধ্যার সময় পোড়ানো হল ।
খবরটা শুনে আমি নিথর হয়ে গেলাম ।
অনেকক্ষন কথা বলছি না দেখে অপি’তা ওর মুখ আমার মুখের কাছে নিয়ে এল । দুহাতে আমার দুই গাল চেপে বললো – ধমে’র বই পড়ে বেশ শান্ত, গুড বয় হয়ে গেছ ।
কি বলি !