ক্ষত 

বিশ্বদীপ মুখোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদীয়া 

পর্ব – ১

বেশ কিছু দিন হলো পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বিহারে ঠাঁই নিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়। নিজের প্রায় বারো বছরের কর্মজীবনে বলতে গেলে কোনো দিনই মানসিক শান্তি পায়নি সে। চারিদিকে রহস্য নিজের ডালপালা গজিয়ে রাখলে শান্তি জুটবেই বা কোত্থেকে ? চব্বিশ বছর বয়স ছিলো মৃত্যুঞ্জয়ের যখন সে আই পি এস – এর চাকরীটা পায়ে। তার পর থেকে শুধু আর শুধু কাজ। এক বিয়ের বাড়িতে প্রভার সাথে তার আলাপ, তার পর বন্ধুত্ব…. প্রেম, অবশেষে বিয়ে। তাদের সাংসারিক জীবন মাত্র দু’  বছরের। প্রভা ছেড়ে চলে যায় তাকে। বহু দূরে, এতো দূরে যেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব হয়ে না। তার পর চাকরী থেকে ত্যাগপত্র দেওয়া, কোলকাতা ছেড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের চলে যাওয়া, সে অনেক ঘটনা। এখন সে পছন্দ করে একাকীত্ব। সে থাকতে চায় রহস্যের জটিল দুনিয়া থেকে বহু দূর। কিন্তু যেটা সে চায়, সেটা পায়ে না। মৃত্যুঞ্জয় খুব ভালোই বুঝতে পেরেছিল যে পশ্চিম বঙ্গে থাকলে সে মানসিক শান্তি পাবে না। তাই আপাতত কিছু দিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদায় নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সুপ্রতীক অধিকারী মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাচমেট। এখনও সে সি আই ডি তে কার্যরত। মৃত্যুঞ্জয় জানে সুপ্রতীকের পৈতৃক ভিটে বিহারে। সেখানে কিছু দিন গিয়ে থাকলে কেমন হয়ে ? সেখানে সর্বক্ষণ তাকে রহস্য তো আর তাড়া করে বেড়াবে না। সেখানে মৃত্যুঞ্জয়ক কেউ চেনে না। থাকা যাবে বেশ কিছু দিন নিশ্চিন্তে। সুপ্রতীককে  ফোন করে জিজ্ঞেস করতে সে বলল -’  যত দিন খুশি সেখানে থাক। কিন্তু নিরিবিলি পাবি না।’
‘কেন ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আসলে সেই বাড়িতে কেয়ারটেকার ছাড়া ভাড়াটেও থাকে। দুটো পরিবার। এক পরিবার অবাঙালী আর এক পরিবার বাঙালী।’
‘ অসুবিধে হবে না।’
‘ ঠিক আছে। কেয়ারটেকারকে আমার ঘরটা পরিস্কার করে দিতে বলছি।’
দশ দিনের ওপর হয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয় পাটনাতে আছে,  সুপ্রতীকের পৈতৃক বাড়িতে। বাড়িটা যেখানে, সেখানে বাঙালীদের সংখ্যা বেশ ভালোই। বাড়ি থেকে অল্প দূরেই মা কালীর এক প্রাচীন বড় মন্দির, যেটা ইয়ারপুর কালী বাড়ির নামে বিখ্যাত। মন্দির থেকে একটু এগিয়ে গেলেই এক বড় পুকুর, কচ্চি তালাব নামে লোকেরা সেই পুকুরকে চেনে। আশেপাশে বাজারে ভরা। বলতে গেলে বাড়িটা খুব ভালো জায়গায় অবস্থিত।
বাড়িটা দু’  তলা। নীচের তলায় ভাড়াটে থাকে এবং ওপর তলায় বেশ অনেক গুলো ঘরের মধ্যে একটা ঘরে মৃত্যুঞ্জয়, বাকি ঘর গুলো তালা দেওয়া। পুরনো আমলের বাড়ি, কিন্তু যত্নে আছে সেটা দেখেই মনে হয়ে। নীচের ভাড়াটের মধ্যে এক শ্রীবাস্তব পরিবার এবং এক সান্যাল পরিবার। শ্রীবাস্তব পরিবারে স্বামী – স্ত্রী এবং তাদের পাঁচ বছরের এক ছেলে। আলোক শ্রীবাস্তব পাটনাতেই এক ব্যাংকে কাজ করে। বলতে গেলে মিশুকে নয় তারা। মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে যেচে পরিচয় করেছিলেন সন্দীপ সান্যাল। সান্যাল পরিবারে সন্দীপ সান্যাল ছাড়া সদস্য আরও দুজন, তাঁর স্ত্রী মালতী সান্যাল এবং চব্বিশ – পঁচিশ বছরের তাঁদের কন্যা অন্বেষা সান্যাল। বেশ হাসিখুশি মিশুকে পরিবার। সন্দীপ সান্যাল কাজ করেন পাটনার জেনারাল পোস্ট অফিসে। অবসরের এখনও দু’  বছর আছে। ছুটির দিনে প্রায় মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে এসে জমিয়ে আড্ডা দেন। আলোচনা হয়ে বিহারের পুরাতন ইতিহাস নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয় নিজের পরিচয় দিয়েছিল এক রিসার্চ স্কলার বলে। সে বিহারে এসেছে বিহারের প্রাচীন ইতিহাসের বিষয় রিসার্চ করতে। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পেরেছিল সান্যাল বাবুর প্রাচীন ইতিহাসের বিষয় জ্ঞান অনেক।

রবিবার। আজ দুপুরে মৃত্যুঞ্জয়ের নেমন্তন্ন। অন্বেষার জন্মদিন আজ। সান্যাল বাবু গতকালই মৃত্যুঞ্জয়কে  নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিলেন। এতো দিনে মৃত্যুঞ্জয় একটা জিনিস লক্ষ করেছিল যে অন্বেষার ডিটেকটিভ গল্প পড়ার খুব শখ। তাই সন্ধ্যে বেলায় বেরিয়ে অনেক খুঁজে অন্বেষাকে দেওয়ার জন্য শার্লক হোমসের এক রচনা সমগ্র কিনে এনেছিল। বইটা অন্বেষাকে দিতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো সে।
‘ থ্যাংক ইউ মৃত্যুঞ্জয়দা। থ্যাংক ইউ সো মাচ। আসলে জানো, আমার কাছে অনেক বই আছে, কিন্তু শার্লক হোমসের স্টোরি কালেকশন নেই। আজ সেটাও হয়ে গেলো।’  আনন্দের স্বরে অন্বেষা বলল।
‘ জানি। লক্ষ্য করেছিলাম। তোমার বুক সেল্ফে অনেক বই দেখেছি, শুধু এটাই দেখিনি।’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ বাঃ, তোমার দৃষ্টি তো প্রখর। জাস্ট লাইক এ ডিটেকটিভ।’
অন্বেষার কথায় অট্টহাস্য করলো মৃত্যুঞ্জয়।
দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। অন্বেষাকে  দেখতে সুন্দর, স্মার্ট এবং এক বেসরকারী কোম্পানীতে কাজ করে সে। অসুবিধে এটাই হলো যে, সে কথা বলে একটু বেশি। খাবার টেবিলে বসেও রহস্য গল্পের বিষয় মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে অনেক আলোচনা হলো। তার পর নিজের বই দেখাতে মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। বইগুলো দেখতে – দেখতে মৃত্যুঞ্জয় তাকে জিজ্ঞেস করলো -’  তোমার দেখছি খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি অনেক টান আছে ?’
অন্বেষা খাটে বসে মৃত্যুঞ্জয়ের দেওয়া শার্লক হোমসের বইটা ঘেঁটে দেখছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চোখ তুলে বলল -’  বলতে পারো টানটা ইদানিং হয়েছে।’
বইটা খাটে রেখে মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে এসে বলল -’  আসলে বলতে পারো জানার আগ্রহ। একটা বিশেষ জিনিস জানার আগ্রহ।’
‘ কী সেটা ?’
‘ স্টিগমাটা।’
‘ স্টিগমাটা ! হঠাৎ!’  চমকে উঠল মৃত্যুঞ্জয়। তার হাতে খ্রিস্টান ধর্ম বিষয়ক একটা বই।
দুজনেই খাটে এসে বসলো। আচমকাই অন্বেষার মুখটাকে মন যেন গম্ভীর হয়ে গেলো।
‘ ব্যাপার কি অন্বেষা ?’  মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ আসলে বেশ কিছু দিন ধরে স্টিগমাটার বিষয় জানার ইচ্ছে হয়েছে। আগে স্টিগমাটার নাম শুনেছিলাম, কিন্তু ডিটেলস জানতাম না। জানার ইচ্ছেটা হলো আমাদের অফিসের এক ছেলের কারণে।’
‘ কোন ছেলে ?’
‘ প্রায় ছ’  মাস হলো ছেলেটা আমাদের অফিসে জয়েন করেছে। নাম, প্রতীক নেলসন। খ্রিস্টান। চুপচাপ থাকে বেশিরভাগ। নিজের কাজের সাথে মতলব রাখে। কিন্তু ছেলেটা বাকি পাঁচটা ছেলের মতো সাধারণ নয়। ছেলেটার মুখে, হাতে কাটা – ছেঁড়ার অজস্রদাগ। প্রায় রোজ দেখি কখনও তার হাতে ব্যান্ডেজ কিম্বা কপালে স্টিচ। অফিসে এটা নিয়ে খুব আলোচনা হয়ে। তাকে বহু বার এমন চটের কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছে। কিন্তু সে একটি কথা বলে যে এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক যেন মনে হয়ে তাকে রোজকে উ মারধর করে। আমাদের বস বলেছে যে কারণ না বললে তাকে চাকরী তে রাখা মুশকিল হবে। কিন্তু সে তাও কিছু বলেনি। বস তাকে রাখতে বাধ্য, কেননা সে কাজ ভালো করে। তার শরীরের আঘাতের দাগ গুলো সত্যি রহস্যময়।’
মৃত্যুঞ্জয় ভ্রুকুটি করে কথা গুলো শুনছিলো। খানিক বিরতি নিয়ে অন্বেষা আবার বলতে শুরু করলো -’  আমি এক বার শুনেছিলাম যে কিছু – কিছু খ্রিস্টানদের শরীরে আপনিই আঘাত লাগে। শরীরে অনেক জায়গায় নাকি কেটে যায়, রক্তক্ষয় হয়ে। সেটাকেই নাকি স্টিগমাটা বলে। ডিটেলস জানতাম না। তাই ডিটেলস জানার জন্য কিছু বই কিনলাম। কিন্তু এখনও পড়বার সুযোগ করতে পারিনি।’
এক দীর্ঘস্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  এখন পর্যন্ত স্টিগমাটাকে একটা মিথ বলেই মানা হয়। এর বিষয় যা কিছু তথ্য পাওয়া গেছে সেটার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে স্টিগমাটা সাধারণ লোকের হয় না। যারা প্রিস্ট অথবা যীশুর পরম ভক্ত হয়, তাদের শরীরে নাকি স্টিগমাটা দেখা দিয়েছে। স্টিগমাটার ঘায়ের এক রকম বিশেষত্ব থাকে। যীশুকে ক্রুসিফাই করার সময় তাঁর সর্বাঙ্গে যেমন প্রকারের ঘা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনই ঘা স্টিগমাটাইজ লোকেদের আসে। যেমন দুটো হাতের এবং দুটো পায়ের চেটোতে পেরেক ঠুকবারদাগ। আসলে এখানেও একটা ভুল ধারনা আছে। হাতের চেটোতে পেরেক ঠুকে কাউকে ক্রুসে ঝোলানো সম্ভব না। পেরেকের আঘাত দেওয়া হয়েছিল যীশুর দুই রিস্টে। স্টিগমাটাটা আসলে রিস্টে আসে। তার পর পিঠে চাবুকের ঘায়েরদাগ, মাথায় কাঁটার মুকুট পরানোর ঘায়েরদাগ। স্টিগমাটার বিষয় একটা কথা সবসময় মনে রাখবে অন্বেষা, শেষ স্টিগমাটা যীশুর কোনো ভক্তের অথবা প্রিস্টের আসে না।’
‘ শেষ স্টিগমাটা মানে ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ মানে, যীশুর শরীরের শেষ আঘাত। যে আঘাত তাঁর পেটের কাছে দেওয়া হয়েছিল, বল্লম দিয়ে। যে আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়ে। বলা হয় নাকি সেই স্টিগমাটা প্রভু নিজের ভক্তদের দেন না। সেটা দিলে ভক্তের প্রাণ চলে যেতে পারে।’
খানিক কি সব চিন্তা করে অন্বেষা বলল -’  না, প্রতীক নেলসনের ঘায়ে কোনো বিশেষত্ব আছে বলে তো মনে হয় না। সাধারণ মাথা ফাটা, হাত কাটা, গাল কাটা যেমন হয়ে, তেমনই। তাহলে সেটা স্টিগমাটা নয় ?’
মাথা নেড়ে না বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ তাহলে কি কেউ তার ওপরে কন্টিনিউ টর্চার করছে? কিন্তু সে সেটাকে এক নাগাড়ে সহ্য করবেই বা কেন? না মৃত্যুঞ্জয়দা, কিছু একটা রহস্য তো আছেই এর ভেতর।’
এখানেও রহস্য! অন্বেষার কথায় মৃত্যুঞ্জয় শুধু মৃদু হাসলো, বলল না কিছু।
‘ না মৃত্যুঞ্জয়দা, এই ব্যাপারটাকে  এমন ভাবে ফেলে দেওয়া চলে না।’  বলল অন্বেষা।
‘ কী করতে চাও তুমি ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ জানি না আমি কী করতে পারবো। কিন্তু প্রতীককে  সেই অজানা লোকের টর্চারের হাত থেকে বাঁচানো উচিত। কম করে মনুষত্বের খাতিরেও। আর, তোমার কী মনে হয়ে মৃত্যুঞ্জয়দা, সেই অজানা লোকটার শাস্তি হওয়া উচিত নয় ? দিনের পর দিন এক জনের ওপর সে টর্চার করে যাচ্ছে।’
‘ সে সব তো ঠিক আছে অন্বেষা, কিন্তু সব থেকে আগে প্রতীক নেলসনের আঘাতের কারণ জানতে হবে। টর্চার ছাড়া অন্য কারণও তো হতে পারে ?’
‘ অন্য কারণ ?’  অবাক হলো অন্বেষা -’  কী অন্য কারণ হতে পারে ?’
‘ সেটা এখানে বসে বলা সম্ভব নয়। তুমি যদি প্রতীকের জন্য কিছু করতে চাও তাহলে সব থেকে আগে তার শরীরে আঘাতের কারণ জানার চেষ্টা করো। তুমি যেটা বলছো সেটা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।’
গম্ভীর মুখ করে বসে রইল অন্বেষা। যেন কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। কোনো এক অজানা কারণে তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে মৃদু হাসছে মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করলো -’  অন্বেষা, তুমি কি এই ব্যাপারে তদন্ত করতে চাও নাকি ?’
মৃত্যুঞ্জয়ের এহেন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল অন্বেষা। কী বলবে ভেবে পেলো না। আবার কিছু চিন্তা করে বলল -’  ভালো বলেছো তুমি এটা মৃত্যুঞ্জয়দা। এ বিষয় যদি আমি তদন্ত করি তাহলে মন্দ হয়ে না।’
‘ একেবারে মিসেস মার্পল কিম্বা ন্যান্সি ড্রিউ।’
দুটো বিখ্যাত ডিটেকটিভের সাথে নিজের তুলনা শুনে ঈষৎ লজ্জা পেলো অন্বেষা।
‘ ধ্যাৎ, কী যাতা বলো না তুমি।’
‘ লেগে পড়ো। কিন্তু সাবধান, তদন্তের পথে কিন্তু কাঁটার অভাব নেই।’

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। মৃত্যুঞ্জয় নিজের ঘরে পায়চারি করছে এবং দ্রুত সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে। মনটা চঞ্চল তার। এমন ভাবে অন্বেষাকে তদন্তের জন্য উস্কে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। সে জানে যে কোনো রহস্যের তদন্ত করতে গেলে বহু প্রকারের বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়ে। অন্বেষার অল্প বয়স,  রক্ত গরম,  সে হয়তো বিপত্তির কথা চিন্তাই করবে না। না, খুব ভুল করে ফেলল মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ সে স্কুটির আওয়াজ শুনতে পেলো। এ আওয়াজ সে চেনে। অন্বেষার স্কুটি। এতো রাতে অন্বেষা যাচ্ছে কোথায় ? ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলো মৃত্যুঞ্জয়। দেখলো, অন্বেষা নিজের স্কুটিতে বসে কোথাও বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেলো সে। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে চিন্তার ছায়া স্পষ্ট। সে দ্রুত কদমে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সান্যাল বাবুর ঘরের বন্ধ দরজায় টোকা দিলো। সান্যাল বাবু দরজা খুলতে তাঁকে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো -’  এতো রাতে অন্বেষা কোথায় গেলো ?’
ঈষৎ ঘাবড়ে গেলেন সান্যাল বাবু। বললেন -’  ওর এক বান্ধবীর নাকি খুব শরীর খারাপ। সেখানেই গেলো।’
অন্বেষা সত্যি বলেছে তো? নাকি, বান্ধবীর শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তদন্ত করতে?

পর্ব – ২
……………………..

সান্যাল বাবু ঘাবড়ে গেলেন।
‘কেন, কিছু হয়েছে?’
নিজের মনের সন্দেহটা সান্যাল বাবুর সম্মুখে প্রকাশ করতে পারলো না মৃত্যুঞ্জয়।
‘ না, কিছু নয়। এতো রাতে বেরলো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি। রাতে কি ফিরবে অন্বেষা ?’  মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ না বাবা। রাতে আর ফিরবে না। যার বাড়ি গেছে, তার বাড়িতেই রয়ে যাবে।’
‘ ঠিক আছে। আপনি শুয়ে পড়ুন।’
মৃত্যুঞ্জয় নিজের ঘরে ফিরে এলো। মনের সন্দেহটা ক্রমে প্রবল হয়ে যাচ্ছে তার। অন্বেষাকে  এক বার ফোন করা কি উচিত? ফোন করলেও অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে সেই কথাই বলবে যে সে নিজের বাবাকে বলেছে। যে বান্ধবীর বাড়ি যাওয়ার কথা অন্বেষা নিজের পিতাকে বলেছে, তার ঠিকানা পেতে পারতো মৃত্যুঞ্জয়। তার বাড়ি গিয়ে জানতে পারতো অন্বেষার এতো রাতে বাড়ি থেকে বেরোবার উদ্দেশ্য কী। কিন্তু সান্যাল বাবুর কাছ থেকে ঠিকানা চাওয়া উচিত মনে করলো না মৃত্যুঞ্জয়। ভদ্রলোক চিন্তায় পড়ে যাবেন। প্রতীক নেলসনের ঠিকানাও জিজ্ঞেস করা হয়নি। নয়তো মৃত্যুঞ্জয় সোজা সেখানেই চলে যেতো। কী করবে কিছু ভেবে না পেয়ে মৃত্যুঞ্জয় নিজের মোবাইল উঠিয়ে কল করলো অন্বেষাকে। বেশ কিছু বার রিং হলো, কিন্তু অন্বেষা ফোন তুললো না। মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তা বৃদ্ধির জন্য অন্বেষার ফোন রিসিভ না করাটা যথেষ্ট ছিলো। না, আজ রাতে আর ঘুম হবে না মৃত্যুঞ্জয়ের। জানালা খুলে অন্ধকার রাত্রে আকাশের চাঁদ ও তারা দেখেই তার সম্পূর্ণ রাত কাটবে। আজকের রাত যেন একটু বেশি লম্বা। মাঝে – মাঝে নিজের মোবাইলে সময় দেখে নিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়। সময় যেন এগোতেই চায় না। গভীর রাত যখন নিজের পা বাড়িয়ে ভোরের পানে অগ্রসর হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের। সে দেখলো অন্বেষার ফোন।
‘ হ্যালো!’
‘ তুমি জেগে আছো?  আসলে দেখলাম তোমার ফোন এসেছিল। তখন বিজি ছিলাম তাই রিসিভ করতে পারিনি। এখন ফ্রি হয়েছি, তাই ভাবলাম তোমায় কলব্যাক করে দেখি।’  কথা গুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অন্বেষা।
‘ তুমি আছো কোথায় এখন?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে। তার শরীর খারাপ ছিলো তাই এসেছি।’
মৃত্যুঞ্জয় ঠিকই ভেবেছিলো, অন্বেষা যে কথা নিজের বাবাকে বলেছে সে কথাই মৃত্যুঞ্জয়কে বলল।
‘ ঠিক তাই তো? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার?’
মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে আচমকা এহেন প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলো অন্বেষা। খানিক চুপ থাকলো সে। তাকে চুপ থাকতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  তার মানে আমার ধারনাটা ঠিক। গতকাল দুপুরে আমাদের কথোপকথন আর রাতে তোমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াতেই আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আর ইউ অল রাইট নাও?’
‘ হ্যাঁ মৃত্যুঞ্জয়দা। আমি ঠিক আছি। এখন বান্ধবীর বাড়িতেই আছি। সেও ছিলো আমার সাথে। সকালে ফিরছি। ফিরে সব বলছি তোমায়।’  চাপা গলায় বলল অন্বেষা।

সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ অন্বেষা এলো মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। একটা চেয়ারে বসতেই মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল -’  ভুলটা আমারই হয়েছিল। তোমাকে এমন ভাবে তদন্তের বিষয় বলাটা ঠিক হয়নি।’
‘ এতে ভুলের কী আছে মৃত্যুঞ্জয়দা ? সত্যি বলতে এই বিষয়টার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আগে থেকেই ছিলো। নয়তো আমি স্টিগমাটার বিষয় জানার জন্য খ্রিস্টান ধর্মের বইগুলো কিনতাম কেন? আর একটা কথা তো বলতেই হয় মৃত্যুঞ্জয়দা, তোমার অবজার্ভেশন পাওয়ারটা দুর্দান্ত। রাতে আমাকে বাইরে বেরোতে দেখে এটা আন্দাজ করে নেওয়া যে আমি প্রতীক নেলসনের আঘাতের বিষয় ইনভেস্টিগেশন করতে যাচ্ছি, জাস্ট ওসাম। তোমার রিসার্চ স্কলার না হয়ে ডিটেকটিভ হওয়া উচিত ছিলো।’
নিজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে না মৃত্যুঞ্জয়ের। কিন্তু অন্বেষার সাহসের তারিফ নিজের মনে না করে সে থাকতে পারলো না। সত্যি, মেয়েটার সাহস আছে।
অন্বেষার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। তাকে জিজ্ঞেস করলো -’  কিছু জানতে পারলে?’
অন্বেষা উৎসাহ নিয়ে বলতে আরম্ভ করলো -’  তোমাকে শুরু থেকে বলি। আমাদের অফিসেই একটা মেয়ে আছে, নাম, রাধিকা মেহেতা। সে আবার কোনো অজ্ঞাত কারণে প্রতীককে নিজের মন দিয়ে বসেছে। প্রতীকের শরীরে এমন আঘাতের কারণে সেও চিন্তায় থাকে। অফিসে প্রতীক কারুর সাথে যদি দু – চারটে কথা বলে তো সে একমাত্র রাধিকা। কিন্তু সে রাধিকাকে ও নিজের আঘাতের কারণ জানায়নি। গত কাল তোমার সাথে কথা হওয়ার পর রাধিকার সাথে এই বিষয় ডিটেল্সে কথা হলো আমার। নিজের শরীরে আঘাতের কারণ প্রতীক এমনিতে বলবে না সেটা বুঝতে আর বাকি ছিলো না। তাই আমরা প্ল্যান করলাম যে রাতের নিরিবিলিতে প্রতীকের বাড়ির আশেপাশে থেকে তার শরীরে আঘাতের কারণ জানবো। কাজে রিস্ক ছিলো আর সাথে ছিলো এক অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার। তাই আর দু’বার ভাবলাম না। বেরিয়ে পড়লাম রাতে স্কুটি নিয়ে।’
‘ প্রতীকের বাড়ি কোথায় ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ এখান থেকে একটু দূর। জায়গাটার নাম, কংকড়বাগ কলোনী। কলোনীর এক গলিতে শেষ বাড়ি। এক তলা ছোট বাড়ি। প্রতীক ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা থাকে না। বাড়ি ঘেরা পাঁচিলটা প্রায় চার ফুটের। আমরা নিঃশব্দে আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। বাড়ির সামনে একটা বাইক দাঁড়িয়ে আছে সেটা আগেই লক্ষ্য করেছিলাম। বাড়ির ভেতর থেকে আবছা – আবছা গলার আওয়াজ ভেসে আসছিল। এক নয়, দুজনের। সিওর হয়ে গেলাম যে বাড়ির ভেতর প্রতীক ছাড়া আরও এক জন কেউ আছে। তারা কী বলছিল সেটা ঠিক শুনতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে কেউ বেরলো। অন্ধকারে তাকে চিনতে পারলাম না। বাইকে বসে আমাদের ঠিক উল্টো দিকে চলে গেলো।’
‘ বাইকের নম্বরটা নোট করেছো?’
দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কাটলো অন্বেষা।
‘ ইশ…. নোট করা হয়নি।’
‘ ঠিক আছে। তার পর?’
‘ পুরো বাড়িতে একটি ঘরে লাইট জ্বলছিলো। জানালা বন্ধ ছিলো। জানালার ঠিক ওপরে একটা ভেন্টিলেটর আছে। সেই ভেন্টিলেটরের কারণেই বোঝা যাচ্ছিলো যে ঘরে লাইট জ্বলছে। খানিক পর ঘর থেকে হঠাৎ গানের শব্দ পেলাম। মিউসিক সিস্টেম চালানো হলো। কিন্তু সেই গানের আওয়াজের মধ্যেও কারুর গলার শব্দ আমি পাচ্ছিলাম। সেটা এক জনের কি দু’  জনের বলা শক্ত। মশার কামড়ে বেশ অনেকক্ষণ আমাদের সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। তার পর গানের আওয়াজের মধ্যেই কানে এলো বাসনের আওয়াজ। কিছু বাসন যেন মাটিতে পড়লো। তার কিছুক্ষণ পরেই চিৎকার। এক প্রকারের চাপা আর্তনাদ। ঠিক মনে হলো যেন কেউ তাকে জখম করছে। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সেই শব্দ আমরা শুনতে পেলাম। রাধিকা আর সহ্য করতে পারছিলো না। ছুটে সে বাড়ির ভেতর যেতে চাইলো। আমি বাধা দিলাম। চাপা আর্তনাদের শব্দ বন্ধ হওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক পর ঘরের লাইট নিভে গেলো। তার পর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমরা আরও প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করলাম। যদি আরও কিছু জানতে পারি, এই আশায়। কিন্তু কিছুই হলো না আর। অগত্যা ফিরে এলাম আমরা। আমার সন্দেহ যেই লোকটা বেরিয়ে গেলো সে সব জানে, এবং তার বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বাড়িতে প্রতীক ছাড়া আরও এক জন ছিলো। নয়তো প্রতীক কথা বলতো কার সাথে ? গানের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, মৃত্যুঞ্জয়দা।’

মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ ঘাড় হেঁট করে অন্বেষার কথা শুনছিলো। এবার চেয়ার থেকে উঠে খোলা জানালার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল -’  গানটা বাজানো হয়েছিল আঘাত আর চাপা যন্ত্রণার শব্দকে দাবিয়ে রাখার জন্য। ঘরের ভেতর কী হচ্ছে সেটা যেন আশেপাশের লোকেরা যেন বুঝতে না পারে। প্রতীকের বাড়ি কোথায়?’
একটু চিন্তা করে অন্বেষা বলল -’  যত দূর মনে হয়ে সমস্তিপুরে। এখান থেকে বাসে করে গেলে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা।’
‘ তোমার আজ অফিসে গিয়ে দুটো কাজ আছে। প্রথম, প্রতীকের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করো, আর দ্বিতীয়, ওর বাড়িতে কে  -কে  আছে তার খোঁজ নাও।’
‘ ঠিক আছে। আরও কিছু?’
‘ রাধিকাকে মানা করে দিও গত রাতের কথা ভুলেও যেন প্রতীককে না বলে। আপাতত এই কাজগুলো তুমি করো, তার পর দেখছি আমি কী করতে পারি।’
কথা শেষ করে প্রায় অর্ধেক সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। জানালাটা বাড়ির পেছন দিকে। সেখানে গাছগাছালি ছাড়া এখন কিছুই নেই।
‘ তুমি কি সাহায্য করবে মৃত্যুঞ্জয়দা ?’  প্রায় লাফিয়ে উঠলো অন্বেষা।
‘ হুম, করবো।’  গম্ভীর গলায় বলল মৃত্যুঞ্জয়।

বিকেল প্রায় চারটে বাজে। কংকড়বাগ কলোনীর সেই গলিটার সামনে একটা পানের দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়। দোকানে মৃত্যুঞ্জয় ভিন্ন আর অন্য কোনো গ্রাহক নেই। এই ফাঁকে দোকানিকে  মৃত্যুঞ্জয় হিন্দী তে জিজ্ঞেস করলো -’  তিওয়ারী সাহেবের বাড়িতে কে  থাকে ?’
দুপুর একটা থেকে বিকেল চারটে। তিন ঘন্টা হয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের এখানে আসা। সে জেনেছে, যে বাড়ি তে প্রতীক নেলসন ভাড়া থাকে সেই বাড়ির মালিকের নাম, অনিরুদ্ধ তিওয়ারী। ভদ্রলোক সপরিবার উত্তরপ্রদেশের কানপুরে থাকেন। সেখানেই নাকি চাকরী করেন তিনি। পাটনার এই বাড়িটা তিওয়ারীজী’র বাবা বানিয়েছিলেন। বাড়িটা দীর্ঘদিন খালি পড়ে ছিলো। প্রায় দু’বছর। দু’বছর পর এক ছেলে এখানে এসে থাকতে শুরু করে। তার থাকতে আসার পর থেকেই শুরু হয়ে বিচিত্র কিছু ঘটনা। প্রত্যেক রাতে কেমন যেন অদ্ভুত শব্দ সেই বাড়ি থেকে বেরোয়। ছেলেটার সর্বাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। আশেপাশের লোকেরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। ভেবেছিল পুলিশে খবর দেবে, কিন্তু গাফিলতির দরুণ সেটা করা হয়নি।
পানের দোকানিটা বলল -’  বাবু, আমি দোকান বন্ধ করি রোজ রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার ভেতর। ছেলেটা অফিস থেকে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ফেরে। ঠিক তার কিছুক্ষণ পর একটা আরও ছেলে আসে।’
‘ বাইকে করে ?’  মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ হ্যাঁ বাবু, বাইকে। সেও হয়তো এক সাথেই থাকে।’
‘ তার বিষয় কিছু বলতে পারবে তুমি ?’
খানিক চিন্তা করে দোকানি বলল -’  বাড়ি ঢুকবার আগে আমার দোকান থেকে রোজ এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে যায়। তার চেহারা আমি দেখেছি। বয়স তিরিশের কাছাকাছি, রোগা চেহারা, মুখটা লম্বা, চাপচাপ দাড়ি আছে, আর হ্যাঁ, গলার আওয়াজটাকে মন যেন খ্যাসখ্যাসে।’
‘ বাইকের নম্বরটা কোনো দিন লক্ষ্য করেছো ?’
‘ না বাবু।’
মৃত্যুঞ্জয় দোকানির হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলল – সে যখন রোজ আসে, আজকেও আসবে। তার বাইকের নম্বর নোট করে নেবে।’
‘ জী বাবু। বহুত আচ্ছা।’  দোকানি খুশি – খুশি সেটাকা নিয়ে নিলো।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো মৃত্যুঞ্জয়। সূর্যের তাপ যখন কমে আসছে, তখন সে পা বাড়ালো প্রতীক নেলসনের বাসস্থানের দিকে। চার ফুটের পাঁচিল, ছ’  ফুটের মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য সেটা টপকে ভেতরে ঢুকতে বিশেষে অসুবিধে হবে না।

পর্ব – ৩
……………………..

বাড়িটা ছোট, আশেপাশে বলতে গেলে জংগল। কোনো সময় হয়তো বাগান ছিলো, কিন্তু এখন সেটা জংগলে পরিণত হয়েছে। সদর দরজায় তালার দরুণ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ সম্ভব নয়। বাইরে থেকেই মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো যে বাড়ি তে খুব বেশি হলে দুটো ঘর। একটা ঘর বাড়ির পেছন দিকে। বেরোবার জন্য একটা দরজাও আছে। সন্তর্পণে বাড়িটার চারিপাশে ঘুরে – ঘুরে দেখছে মৃত্যুঞ্জয়। বাড়িটা বেশ পুরনো, তায় আবার যত্নহীন। বেশ কিছু কাঠের জানালা অল্প – অল্প ভাঙ্গা। জানালা গুলো বেশ উঁচু তে, তাই ছিদ্র দিয়ে কিছু দেখা সম্ভব হলো না মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য। এবার মাটির দিকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গেছে সূর্যাস্ত। পাঁচিল টপকে প্রবেশ করার প্রায় চল্লিশ মিনিটের বেশি হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ের। দিনের আলো থাকতেই নিজের কাজ শেষ করতে হবে তাকে। মাটির দিকে তাকাতেই খানিক পর কিছু রক্ত মাখা ব্যান্ডেজ ও তুলো পেলো সে। স্টিচের কিছু সুতো তার হাতে এলো। প্রায় অর্ধেকটা পুড়ে যাওয়া বইয়ের একটা পৃষ্টা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। তৎক্ষনাৎ সেটা তুলে নিলো। আধ পড়া কাগজটা ভালো করে দেখলো। সাথে – সাথে মাটি তে ছড়ানো প্রায় একই প্রকারের বেশ কিছু কাগজের টুকরো তার চোখে পড়লো। কোনোটা প্রায় নব্বই শতাংশ পুড়ে যাওয়া তো কোনোটা পঞ্চাশ শতাংশ। একে – একে সব গুলোকে  উঠিয়ে নিরীক্ষণ করলো মৃত্যুঞ্জয়। সব গুলো পৃষ্টাই মেডিকালের বইয়ের। সব গুলোকে  এক সাথে দলাপাকিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটে পুড়লো সে। আরও কিছু পাওয়ার আশায় ঘাড় হেঁট করে মাটির দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় এগোতে থাকে। মাটি তে ওটা কী পরে আছে ? উবু হয়ে বসে সে জিনিসটা তুললো মৃত্যুঞ্জয়। একটা ছবিকে  যেন দু টুকরো করা হয়েছে, তারই একটা অংশ এখন মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। এক পুরুষের ছবি। ব্যাক ব্রাশ করা চুল, চোখে চশমা, ফ্রেঞ্চকাটদাড়ি, পরনে সুট -টাই। ছবিটা সাদা – কালো, বলাই বাহুল্য যে বেশ পুরনো ছবি। সেই ছবিটাও নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করলো মৃত্যুঞ্জয়। চারিপাশে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। হাতঘড়ি তে সময় দেখলো সে, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। আর বেশি সময় নেই হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতীক নেলসন চলে আসবে। ঘাসের ওপর আরও কী – কী আছে অন্ধকারের দরুণ দেখা সম্ভব নয়। পাঁচিল টপকে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নেমে ঠিক সে সময় লোহার ফটক খোলার শব্দ পেলো সে। তৎক্ষনাৎ বাড়ির পেছন দিকের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো মৃত্যুঞ্জয়। আলোআঁধরির মধ্যে দেখতে পেলোকে উ ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মাঝারি উচ্চতা, বাঁ হাতের চেটো তে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা, পিঠে একটা ব্যাগ। সদর দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো মৃত্যুঞ্জয়ের। খানিক পরেই বাড়ির পেছন দিকের ঘরের বাতি জ্বলে গেলো। মৃত্যুঞ্জয়ের বুঝতে দেরি হলো না যে, এই ছেলেটাই প্রতীক নেলসন। না, আর এখানে থাকা ঠিক না। অতি সন্তর্পণে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়।
পানের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট ধারালো সে। আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকলেকে মন হয়ে ? খুব সম্ভব দ্বিতীয় ছেলেটাও খানিক পরেই চলে আসবে। দোকানি বার – বার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। দোকানে গ্রাহকের প্রাচুর্যের কারণে কিছু বলতে পারছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল যে মৃত্যুঞ্জয় দ্বিতীয় ছেলেটার অপেক্ষাই করছে। অল্প একটু সুযোগ পেয়েই দোকানি মৃত্যুঞ্জয়কে  বলল -’  আমি আপনাকে জানিয়ে দিতাম বাবু। আপনার সময় নষ্ট করার দরকার ছিলো না।’
মৃত্যুঞ্জয় একটা আরও সিগারেট ধরিয়ে বলল -’  এতক্ষণ যখন থেকেই গেলাম, তখন কাজটা শেষ করে যাওয়াই ভালো।’
দোকানির মুখটা শুকিয়ে গেলো। সে হয়তো ভাবলো মৃত্যুঞ্জয় নিজেই কাজটা সম্পন্ন করে তার থেকে সেই একশোটাকাটা ফেরত চেয়ে নেবে।
সিগারেটে দুটোটান দিতেই পেছন থেকে এক বাইকের আওয়াজ পেলো মৃত্যুঞ্জয়। বাইকটা দাঁড়ালো দোকানের সামনে এসে। দোকানের পাশের দিকে আড়াল করে মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়েছিল। বাইকে যে বসে ছিলো সে যখন নিজের হেলমেটটা খুলল, তখন তাকে পরিস্কার দেখতে পেলো সে। দোকানি ঠিকই বর্ণনা করেছিলো। এতক্ষণে বাইকের নম্বরটা মৃত্যুঞ্জয় নিজের মোবাইলে নোট করে নিয়েছে। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে যখন বাইকে বসে থাকা ছেলেটা পার্স বার করেটাকা দিতে যাবে, ঠিক তখনই মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলো পার্সে এক জনের ভিজিটিং কার্ড। কার্ডে লেখা ছিলো -’  পঙ্কজ চৌধরী, এডুকেশন ফর অল ইনস্টিটিউট, ১৬/বি, বোরিং রোড, পাটনা – ৮০০০০১।’
বলাই বাহুল্য মৃত্যুঞ্জয় পুরো ঠিকানাটা নিজের মোবাইলে টুকে নিলো।
সে ছেলেটা সিগারেটের মূল্য দিয়ে বাইক স্টার্ট করে চলে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে। তার চলে যাওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় দোকানিকে  আবার একশোটাকা দিয়ে বলল -’  আমি যে তার বাইকের নম্বর নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সে খবর যেন ঘুনাক্ষরেও তার কানে না যায়।’
দাঁত বার করে দোকানিটাকা নিয়ে বলল -’  কিসি কো নাহি বোলেংগে বাবু। কিসি কো নাহি।’

মৃত্যুঞ্জয় বাড়ি ফিরলো তখন রাত সাড়ে আটটা। ঘরে ঢুকেই ফোন করলো সুপ্রতীক অধিকারীকে । বলল -’  তোর পৈতৃক বাড়ি এটা। তুই বহু বছর থেকেচিস এখানে। তাই না ?’
‘ হ্যাঁ।’  সুপ্রতীক জবাব দিলো।
‘ পাটনাতে কোনো পুলিশ অফিসারের সাথে তোর পরিচয় আছে ?’
‘ হঠাৎ তোর পাটনাতে পুলিশের কী দরকার পড়লো ?’
‘ দরকার আছে বস, দরকার আছে। আর টি ও থেকে একটা বাইক নম্বরের ডিটেলস নিতে হবে। বাইকটা কার এবং তার বাড়ির ঠিকানা। পারবি ?’
‘ কোনো গন্ডোগোল বেঁধেছে কি ?’
‘ না। চিন্তা করিস না। গন্ডোগোল বাঁধলেও মৃত্যুঞ্জয় আছে এখানে।’
‘ জানি তুই গন্ডোগোল বাঁধতে দিবি না। দে, নম্বরটা দে। কালকের মধ্যে ডিটেলস পেয়ে যাবি।’
‘ গুড।’
মৃত্যুঞ্জয়ের নম্বর দিয়ে ফোন রাখতেই ঘরে ঢুকলো অন্বেষা।
‘ কোথায় ছিলে তুমি মৃত্যুঞ্জয়দা ? প্রায় দু’  ঘন্টা ধরে তোমার অপেক্ষা করছি।’  কথাটা বলে একটা চেয়ারে বসলো অন্বেষা।
‘ কাজে গিয়েছিলাম। অত্যন্ত দরকারী কাজে।’  একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল। চলে গেলো খোলা জানালার কাছে।
‘ গতকাল রাতে প্রতীকের হাতে চোট লেগেছে।’  অন্বেষা বলল।
‘ জানি। হাতের পাতায়। মোটা করে ব্যান্ডেজ বেঁধে আছে সেখানে।’  সিগারেটে একটা লম্বাটান দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
অবাক কন্ঠে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো -’  তুমি কী করে বুঝলে ? দেখেছো নাকি তাকে ?’
‘ হুম। তার বাড়ির কাছেই ছিলাম। তোমাকে যা খোঁজ নিতে বলেছিলাম নিয়েছ ?’
‘ নিয়েছি।’  অন্বেষা বলল -’  প্রতীক নেলসনের বাড়ি সমস্তিপুরে সেটা তোমাকে আগেই বলেছি। বাড়ি তে থাকেন তার বাবা জোসেফ নেলসন। মা নেই, হয়তো মারা গেছেন। এক সরকারী স্কুলের টিচার ছিলেন তার বাবা। রিটায়ার করে এখন বাড়ি তেই থাকেন। এই নাও বাড়ির ঠিকানা।’  একটা কাগজ অন্বেষা এগিয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
কাগজটা হাতে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  জোসেফ নেলসন কোন স্কুলে কাজ করতেন সেটা নিশ্চই জানতে পারোনি ?’
মাথা নেড়ে না বলল অন্বেষা।
এক সাথে সিগারেটের তিন – চারটে লম্বাটান দিয়ে সেটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। এগিয়ে এলো অন্বেষার পাশে রাখা কাঠের টেবিলের দিকে। প্যান্টের পকেট থেকে কাগজের টুকরো গুলো এবং আধ ছেঁড়া ছবিটা বার করে টেবিলে রেখে বলল -’  এ গুলো পেলাম প্রতীকের বাসস্থানের জংগল থেকে।’
ঘাড় হেঁট করে সে গুলোর দিকে তাকালো অন্বেষা। আধ পড়া কাগজ গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল -’  এ গুলো তো মেডিকলের বই মনে হয়ে।’
পরক্ষণেই তার নজর গেলো ছেঁড়া ছবিটার দিকে।
‘ এই ছবিটা কি প্রতীকের বাবার ?’  মৃত্যুঞ্জয়কে  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ জানি না। নো আইডিয়া। হয়তো প্রতীকের বাবার, হয়তো তার সাথে যে থাকে তার বাবার। ছবিটা দেখে মনে হয়ে ভদ্রলোকের বিয়ের সময়ের ছবি। ছবির নিচেটা ভালো করে দেখো অন্বেষা। তারিখ লেখা ছিলো। ছবিটা ছেঁড়ার ফলে তারিক বাদ পড়ে গেছে। কিন্তু সাল এখনও স্পষ্ট, ১৯৮৬।’
‘ ফ্রেঞ্চকাটদাড়ি দেখে তো খ্রিস্টান বলেই মনে হয়ে। কিন্তু প্রতীকের সাথে মুখের আদলের কোনো মিল দেখছি না।’  ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো অন্বেষা।
‘ সব সময় এটা সম্ভব না যে ছেলের মুখের আদল বাবার সাথে মিলেই যাবে। প্রতীককে  হয়তো নিজের মায়ের মতো দেখতে। কিম্বা কারুর মতো না।’
কথা শেষ করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ বেশ কিছু প্রশ্ন মনে খটকা দিচ্ছে অন্বেষা। প্রথমত, মেডিকলের বই সেখানে কী করছে ? বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছেকে ন ? নিজের শরীরের চোটের চিকিৎসা কি প্রতীক নিজেই করে ? তাহলে যখন তার মাথা ফাটে তখন স্টিচ করেকে  ? গত রাতেই বা পরিপাটি করে তার হাতে ব্যান্ডেজকে  বেঁধে দিলো ? তোমাদের অফিসে ছেলেদের সংখ্যা নিশ্চই কম নয়। তাহলে রাধিকা প্রতীককে ইকে ন ভালোবাসলো ? দ্বিতীয় ছেলেটাই বাকে  ? অবশ্য সেই ছেলেটার বিষয় আগামী কাল ইনফরমেশন পেয়ে যাবো।
অনেক প্রশ্ন অন্বেষা, অনেক প্রশ্ন।’
হঠাৎ অন্বেষার দিকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো -’  তোমাদের অফিসের লাঞ্চটাইম কখন হয়ে ?’
‘ দুটো।’  জবাব দিলো অন্বেষা।
‘ ঠিক আছে। কাল লাঞ্চটাইমে তোমাদের অফিস যাবো। প্রতীকের সাথে কথা হলে ভালো, নাতো রাধিকার সাথে কথা বলবো। রাধিকাকে  একবার ঝাঁকিয়ে দেখা যাক, যদি কিছু বেরিয়ে আসে।’

পর্ব – ৪
……………………..

অন্বেষার অফিস এক্সিবিশন রোডে। এক বহুতল অট্টালিকার ছ’  তলায় তাদের অফিস। দুপুর দুটোর আগেই মৃত্যুঞ্জয় সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ঠিক দুটোয় অন্বেষার ফোন এলো মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে।
‘ অফিসে চলে এসো মৃত্যুঞ্জয়দা। ক্যান্টিন আছে। এখানেই খেয়ে নেবো।’
ক্যান্টিনে অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়ের আলাপ করালো রাধিকার সাথে। অন্বেষার বয়সী রাধিকা। উচ্চতা অন্বেষার থেকে অল্প কম হলেও মুখশ্রী খুব সুন্দর। গায়ের রং বেশ ফরসা। খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় রাধিকাকে  বলল -’  দেখুন, আমি আপনাকে আগেই বলে দিতে চাই যে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞেস করবো। আমার যত দূর মনে হয়ে, যে ব্যাপারে তদন্ত করতে আপনি এবং অন্বেষা এগিয়েছেন সেটা খুবই গুরুতর এবং জটিল। একটা মানুষের শরীর চোটের কারণে যদি দিনে – দিনে ক্ষত – বিক্ষত হয়ে যায়, তাহলে সেটার শেষ পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। যদি সত্যি প্রতীক কোনো বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাহলে সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করা আমাদের কর্তব্য। আর সেই কারণেই আপনাকে যে প্রশ্ন গুলো করবো তাতে কিছু ব্যক্তিগন প্রশ্নও হতে পারে। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না।’
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। রাধিকা যে একটু ঘাবড়ে গেলো সেটা বলাই বাহুল্য। ভয়ার্ত দৃষ্টি তে তাকালো অন্বেষার দিকে। অন্বেষা বলল -’  নির্দ্বিধায় উত্তর দে রাধিকা। প্রতীককে  তুইও বাঁচাতে চাস আর আমরাও।’
সামনে রাখা জলের গেলাস থেকে দু’  ঢোঁক জল পান করে মৃত্যুঞ্জয়কে  রাধিকা বলল -’  বলুন।’
‘ কত দিনের পরিচয় আপনার প্রতীকের সাথে ?’
‘ প্রায় চার মাস। ছ’  মাস আগে সে অফিসে জয়েন করেছে। তখন বেশি কথা হতো না তার সাথে। তার পর আসতে – আসতে বন্ধুত্ব হয়ে।’  রাধিকা বলল।
‘ যত দূর জানি প্রতীক মিশুকে নয়। আপনার সাথে তার ঘনিষ্টতার বিশেষ কারণ ?’
‘ আমাদের এক – অপরের সঙ্গ ভালো লাগে।’
‘ তাহলে তো অনেক কথাই সে আপনাকে বলেছে নিশ্চই। যেমন নিজের শরীরে চোটের কার্নের বিষয় আপনাকে বলে থাকতে পারে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় মাথা গরম হলো রাধিকার। বিরক্তির স্বরে বলল -’  যদি কারণটা আমি জানতাম তাহলে রাতে এতো রিস্ক নিয়ে তার বাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকতাম না।’
‘ তাও ঠিক। আচ্ছা, এতো ছেলে আপনাদের অফিসে আছে, আপনার প্রতীককে ইকে ন পছন্দ হলো ? মানে …. প্রতীক তো সাধারণ ছেলেদের মতো না।’
মৃত্যুঞ্জয় যে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি রাধিকা। অবাক দৃষ্টি তে তাকালো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। বিস্ময়েরদারুণ কন্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল তার। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল -’  ভালোবাসার পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না। যেখানে যুক্তি থাকে সেখানে ভালোবাসা থাকে না।’
‘ ভেরি গুড। আচ্ছা, আপনাদের দুর্বল মুহূর্তেও কিছু উল্লেখ করেনি প্রতীক ?’
এবার আর থাকতে পারলো না রাধিকা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। প্রায় চিৎকার করে বলল -’  কী ভেবেছেন আপনি নিজেকে ? একটা মেয়ের অপমান করতে আপনার লজ্জা করে না ? আমি আপনাকে চিনি না, জানি না, এ সব বাজে প্রশ্নের উত্তর দেবোকে ন আপনাকে ?’
‘ রিল্যাক্স ম্যাডাম, রিল্যাক্স। প্লিজ বসুন। এটা আপনিও জানেন যে এ প্রশ্ন গুলো অত্যন্ত দরকারী। আপনি জানেন যে আমরাকে উ প্রতীকের খারাপ চাই না। তাই প্লিজ, মাথা গরম করবেন না।’  শান্ত কন্ঠে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
অন্বেষা বোঝালো রাধিকাকে  -’  শান্ত হো রাধিকা। এ সব জানা খুব দরকার ছিলো মৃত্যুঞ্জয়দা’র জন্য। যখন সে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তখন তাকে কোপোরেট করা কি আমাদের উচিত নয় ?’
চেয়ারে বসলো রাধিকা। অর্ডার দেওয়া খাবার চলে এসেছে। তিন জনেই খেতে শুরু করলো। খাবার মাঝেই মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো -’  প্রতীকের বাড়ি তে যে ছেলেটা আসা – যাওয়া করে তাকে কোনো দিন ভালো করে দেখেছেন ?’
‘ না।’  সংক্ষিপ্তে উত্তর দেয় রাধিকা।
‘ আপনি কোনো দিন জিজ্ঞেস করেননি তার বিষয় ?’
‘ করেছিলাম। প্রতীক বলেছিলো যে তার পুরনো বন্ধু।’
‘ আপনার বাড়ি কোথায় ?’
‘ পাটলিপুত্র কলোনী তে।’
আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন করলো না মৃত্যুঞ্জয়। লাঞ্চ শেষ হলো তাদের। হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় দেখলো যে ক্যান্টিনের গেটে এসে হাজির হলো প্রতীক নেলসন। রাধিকার দিকে তাকিয়ে বলল -’  ভাবেছিলাম তোমার তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু দেখলাম পুরো লাঞ্চ আওয়ারটাই নিয়ে নিলে।’

গত সন্ধ্যের আলো আঁধারির মধ্যে প্রতীক নেলসনকে  ভালো করে দেখতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। আজ ভালো করে দেখার সুয়োগ পেলো তাকে। ঝাঁকড়া – ঝাঁকড়া মাথার চুল, ক্লিন শেভ, কপালে ও দুটো গালে অসংখ্য কাটা ও স্টিচেরদাগ, বাঁ হাতের পাতায় এখনও পরিপাটি করে বাঁধা ব্যান্ডেজ। চেহারায় বিশেষত্ব বলতে এর থেকে বেশি উল্লেখ্যযোগ্য কিছু নেই।
‘ নো ডিয়ার, আসলে অন্বেষার একদাদা এসেছে। তাই দেরি হয়ে গেলো আর কি।’  রাধিকা এগিয়ে গেলো প্রতীকের দিকে। দুজনে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

লিফ্ট দিয়ে নীচে নামবার সময় মৃত্যুঞ্জয় অন্বেষাকে  বলল -’  তোমাকে এক দিনের ছুটি নিতে হবে অন্বেষা।’
‘কে ন বলো তো ?’
‘ প্রতীকের অতীতের বিষয় জানা দরকার। সেটা জানতে পারবে যেখানে সে নিজের ছোট বেলা কাটিয়েছে সেখানে। মানে, সমস্তিপুরে। তোমাকে সমস্তিপুর যেতে হবে। প্রতীকের বাবার সাথে দেখা করতে হবে। তদন্ত যদি চালিয়ে যেতে চাও, তাহলে ছুটি নাও অফিস থেকে।’
ঈষৎ পান্ডুবর্ণ হয়ে গেলো অন্বেষার মুখ। নিচু গলায় বলল -’  সে না হয়ে ছুটি নিলাম। কিন্তু …. কিন্তু আমাকে কি সমস্তিপুর একলা যেতে হবে ?’
লিফ্ট থেকে বাইরে এলো তারা।
‘ এক জনকে  সাথে লাগবে। তাই না ?’  মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘ শুধু তোমাকে। তুমি যখন এগিয়ে এসেছো, তখন থাকতে তো হবেই আমার সাথে।’  প্রতিউত্তর দিলো অন্বেষা।
‘ হ্যাঁ ভালো কথা। সেই ছেলেটার নাম আর ঠিকানা জানা হয়ে গেছে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় চমকে উঠলো অন্বেষা।
‘ তাই নাকি ?দারুণ তো। কী নাম তার, কী করে সে ?’
‘ কী করে সেটা তো এখনও জানা যায়নি, তার নাম হলো বিকাশ পান্ডে। তুমি অফিসে যাও অন্বেষা। তোমার লাঞ্চটাইম শেষ।’

বিকেল পাঁচটা বাজে যখন মৃত্যুঞ্জয় বোরিং রোডে’  এডুকেশন ফর অল ইনস্টিটিউটে’  পৌঁছালো। চার তলা এক বাড়ির সম্পূর্ণ দু’  তলাটা ইনস্টিটিউট। নীচে সারিসারি সাইকেল রাখা। বেশ কিছু অল্প বয়সী ছেলে – মেয়েরা দু’  তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। নিজের – নিজের সাইকেলের দিকে এগোলো প্রত্যেকে। একটা ছেলেকে  মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো -’  পঙ্কজ চৌধরীকে  কোথায় পাবো ?’
‘ স্যার ক্লাসেই আছেন। জাস্ট একটা ব্যাচ শেষ হলো। এখনই শুরু হবে একটা।’  জবাব দিয়ে ছেলেটা নিজের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

দু’  তলায় উঠল মৃত্যুঞ্জয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বাঁ দিকে একটা বড় হল ঘর, বেশ বড়। টেবিল চেয়ার পাতা ঘরময়। সামনের দেয়ালে ব্ল্যাক বোর্ড। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো ছাত্ররা নিজের – নিজের স্থান গ্রহণ করছে। ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে পাতা চেয়ারে হাতে এক মোটা বই নিয়ে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তিনি হয়তো পঙ্কজ চৌধরী। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ ঊর্ধে, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, অর্ধেক থেকে বেশি সাদা। মাঝারি উচ্চতা, রোগা ছিপছিপে চেহারা এবং গায়ের রংটা একটু কালোর দিকে। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেলো তার দিকে। নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলো -’  আপনি কি পঙ্কজ চৌধরী ?’
ভদ্রলোক খানিক হাঁ করে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
‘ হ্যাঁ, আমি।’  চাপা কন্ঠে বললেন তিনি।
‘ আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য ক্ষমা চাইছি, অত্যন্ত প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে একটু বাইরে আসবেন ? দরকারী কথা আছে।’
ছাত্রদের অপেক্ষা করতে বলে পঙ্কজ চৌধরী বেরিয়ে এলেন মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। সিঁড়ির মুখের কাছে দাঁড়িয়ে কথা হলো তাদের।
মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  জানি আপনার সময় অনেক মূল্যবান, তাই বেশি সময় নেবো না আমি। আমি শুধু এক জনের বিষয় জানতে আপনার কাছে এসেছি।’
‘ কার বিষয় ?’  পঙ্কজ জিজ্ঞেস করলেন।
‘ আপনি বিকাশ পান্ডেকে  চেনেন ?’
‘ বি….কা…শ পান্ডে !’  মনে করার চেষ্টা করলেন পঙ্কজ চৌধরী।
‘ হ্যাঁ, বিকাশ পান্ডে। বাড়িদানাপুর, সগুনা মোড়। প্লিজ মনে করুন।’
‘ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আসলে বিকাশ পান্ডে নামের এক আরও ছাত্র ছিলো আমার। তাই গুলিয়ে ফেলছিলাম আর কি।’
‘ কী জানেন তার বিষয় ?’
‘ বিকাশ ওয়াস এ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আপনি তো বুঝতেই পারছেন যে আমি সাইন্স পড়াই।কে মেস্ট্রি তে খুব ভালো ছিলো সে। খুব ভালো বলতে এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রিলিয়ান্ট। অনার্সে 80%এর ওপর নম্বর পেয়েছিল। তাতেও সে খুশি হয়েনি। আমাকে বলেছিল সে নাকি আরও বেশি আশা করেছিল।’  উৎসাহিত হয়ে বললেন পঙ্কজ চৌধরী।
‘ সে এখন কী করছে ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ জানি না। দু হাজার বারোর ব্যাচ ছিলো। তার পর দু – এক বার দেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে আর দেখা নেই।’
‘ আচ্ছা, তাদের বাড়ি তেকে কে  আছে জানেন কী ?’
‘ না। তা জানি না।’
‘ বাড়ির আর্থিক অবস্থার বিষয় কোনো ধারনা ?’
খানিক ভেবে পঙ্কজ চৌধরী বললেন -’  আমার অনুমান আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। ইনস্টিটিউটের ফি জমা করতে প্রায় দেরি করতো। ভালো ছাত্র ছিলো, তাই আমি কন্সিডার করতাম।’
‘ তার বাবা কী করেন জানেন কী ?’
‘ না মশাই। বলতে পারবো না।’
‘ একটা শেষ প্রশ্ন। প্রতীক নেলসনের নাম শুনেছেন কী ?’
ভদ্রলোক আবার চিন্তা করলেন।
‘ না। শুনিনি।’
এক দীর্ঘস্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি আমার অনেক হেল্প করলেন।’
পঙ্কজ চৌধরী আমতা – আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন -’  বিকাশ কোনো প্রবলেমে নেই তো ?’
‘ এখন প্রর্যন্ত না। ধন্যবাদ, আসি।’  মৃত্যুঞ্জয় চলে গেলো সেখান থেকে।

পর্ব – ৫
…………………….

কেয়ারটেকার রাতের খাবার দিয়ে যাওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে ঢুকলো। তখন প্রায় রাত দশটা বাজে। টেবিলের ওপর ঢাকা খাবারের থালা দেখে অন্বেষা বলল -’  এখনও খাওনি ?’
মৃত্যুঞ্জয় চেয়ারে বসে একাগ্রচিত্তে সিগারেটেটান দিয়ে যাচ্ছিলো।কে য়ারটেকার কখন রাত্রি আহার দিয়ে গেছে আর কখন অন্বেষা ঘরে প্রবেশ করেছে, তার হুঁশ নেই।কে য়ারটেকারটাও কথা বলে কম। মৃত্যুঞ্জয়কে  চিন্তামগ্ন দেখে চুপিসারে খাবার রেখে চলে গেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের সংবিৎ ফিরলো অন্বেষার কথায়। মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের চেয়ারে অন্বেষা উপবেশন করলো।
‘ কিছু চিন্তা করছো নাকি ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ চিন্তার বিষয় হলে চিন্তা তো করতেই হয়ে। কোনো জিনিসের তদন্ত করতে গেলে নিজের চিন্তাধারাকে  বহু দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়ে। এমন অনেক সম্ভাবনার বিষয় ভাবতে হয়ে যেটা আদতে সম্ভাবনা হতেই পারে না।’
‘ মানে ?’
চেয়ার থেকে উঠে ঘরে পায়চারি শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়। বলল -’  অনেক সম্ভাবনা। সত্যি বলতে আজ রাধিকার সাথে কথা বলার পর অনেক বিচিত্র – বিচিত্র সম্ভাবনার উৎপত্তি মনের মধ্যে হলো।’
‘ রাধিকার সাথে কথা হওয়ার পর ?’  চমকে উঠল অন্বেষা।
‘ হুম, রাধিকা। রাধিকার প্রতীকের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তে খটকা লাগছে আমার। হয়তো আমার খটকাটা নিছকই ভুল হতে পারে। পরশু রাতে তোমরা দেখতে পেয়েছিলে যে প্রতীকের বাসস্থান থেকে এক অন্য, তোমাদের অপরিচিত ছেলে বেরোয় এবং বাইকে করে চলে যায়। তার মানে এটাই হলো যে সে ছেলেটার বিষয় তোমরা আগে জানতে না। আজ রাধিকা আমায় বলল যে সে নাকি ওই অপরিচিত ছেলেটার বিষয় প্রতীককে  জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু কখন ? কখন জিজ্ঞেস করেছিল সে ? মেনে নিলাম গতকাল জিজ্ঞেস করেছিল। তাহলে কি প্রতীকের সন্দেহ হবে না ? রাধিকা সেই ছেলেটার বিষয় কী করে জানলো, প্রতীক তাকে সেটা জিজ্ঞেস করবেই। তখন রাধিকা বলতে বাধ্য হবে তোমাদের রাতের অ্যাডভেঞ্চারের বিষয়। আসল খটকা তো আমার এখানেই লাগছে অন্বেষা। তাহলে কি রাধিকা বিকাশ পান্ডের বিষয় আগে থেকেই জানে ? আর যদি জেনে থাকে তাহলে তোমার থেকে লুকিয়ে রাখলোকে ন ?’
অন্বেষা অবাক দৃষ্টে তাকিয়েছিলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
‘ মাই গড ! এ বিষয় তো আমি ভেবেই দেখিনি।’  বলল অন্বেষা।
‘ ভেবে দেখতে হয়ে অন্বেষা, ভেবে দেখতে হয়ে। যখন তদন্ত করতে নেমেছো, তখন প্রতিটি জিনিসকে  খুঁটিয়ে দেখতে হবে। কখন কোন জিনিস থেকে কী দরকারী তথ্য বেরিয়ে আসবে, বলা কঠিন।’
পুনরায় চেয়ারে বসলো মৃত্যুঞ্জয়।
খানিক চুপ থাকার পর মৃত্যুঞ্জয় আবার বলল -’  বিকাশ পান্ডের বিষয় বেশ কিছু ইনফরমেশন পাওয়া গেলো। কিন্তু যা ইনফরমেশন পাওয়া গেছে সেটা যথেষ্ট নয়। আমাদের জানতে হবে বিকাশ পান্ডের সাথে প্রতীক নেলসনের লিংক।’
‘ সেটা কী ভাবে জানতে পারবো ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
প্রায় বিড়বিড় করে মৃত্যুঞ্জয় নিজের মনেই বলল -’  পান্ডে জী’র বাড়ি তে যেতে হবে এক বার। দেখা যাককে মেস্ট্রি তে এক্সট্রা অর্ডেনরি স্টুডেন্ট এখন কী করছে।’
দুজনেই খানিক চুপ থাকলো। কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছে অন্বেষা, কিন্তু বলতে পারছে না। খানিক পর মুখটা পান্ডুবর্ণ করে বলল -’  একটা খারাপ খবর আছে, মৃত্যুঞ্জয়দা।’
‘ কী ?’
‘ আগামী কাল আমি অফিস থেকে ছুটি পাইনি। ছুটি পেলে সমস্তিপুর যাওয়া যেতে পারতো।’
একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  ঠিক আছে, তাহলে কাল আমি বিকাশ পান্ডের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। একটা কথা মনে রেখো অন্বেষা, এবার থেকে আমরা যা – যা করবো সেটার বিষয় যেন রাধিকা না জানতে পারে।’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো অন্বেষা। যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। বলল -’  তুমি নিশ্চিন্তি থাকতে পারো মৃত্যুঞ্জয়দা। রাধিকা এবার থেকে কিছুই জানতে পারবে না।’
‘ আর হ্যাঁ, সগুনা মোড়,দানাপুর কী করে যাবো, সেটা বলেদাও।’

সগুনা মোড় থেকে ডান দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা তাকে বড় গলি বললে ভালো হয়ে। রাস্তার দু’  ধারে কোনো সময়ে খোলা মাঠ ছিলো, এখন সেখানে বড় – বড় বাড়ির প্রাচুর্য। বড় – বড় বাড়ি পেরিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে বিকাশ পান্ডের বাড়ি খুঁজে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। ছোট এক তলা বাড়ি। গেটের পাশে লেখা আছে – বিনয় পান্ডে। মৃত্যুঞ্জয় জানে বিনয় পান্ডে বিকাশের বাবার নাম। লোহার ফটকে টোকা মারলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ কৌন হ্যায় ?’  ভেতর থেকে এক ভারী পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।
‘ বিকাশ সে মিলনা থা।’  মৃত্যুঞ্জয় বলল।
লোহার ফটক খুলে গেলো। হাত কাটা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। হিন্দী তেই বললেন -’  বিকাশ তো অফিসে। বেলা বারোটা বাজে। এই সময় কি সে বাড়ি তে থাকে ?’
‘ ফেরে কোটায় ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ রাত দশটা কিম্বা এগারোটার মধ্যে ফিরে আসে।’ ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
‘ আপনি কি তার বাবা ?’
ভ্রুকুটি করে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক।
‘ তুমিকে  হে ? এর আগে তো কোনো দিন দেখিনি তোমায়।’  সন্দেহের স্বরে বললেন পান্ডে জী।
‘ আপনি আমাকে চিনবেন না। এটা জানুন যে আমি একটাকে সের ইনভেস্টিগেশনে এখানে এসেছি।
‘ ইনভেস্টিগেশন !’  ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন।
‘ আজ্ঞে হ্যাঁ। বিকাশ কোন অফিসে কাজ করে ?’
পান্ডে জী বিকাশের অফিসের নাম ও ঠিকানা দিলেন। মৃত্যুঞ্জয় আবার জিজ্ঞেস করলো -’  কোটায় ছুটি হয়ে তার ?’
‘ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা।’
‘ সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সে কোথায় থাকে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেননি ?’
আমতা – আমতা করে বিনয় পান্ডে বললেন -’  নিজের…. নিজের বন্ধুদের বাড়ি।’
‘ আপনি কি জানেন আপনার ছেলে বিকাশ পান্ডে রোজ সন্ধ্যে তে কংকড়বাগ কলোনী যায় ?’
মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লেন বিনয় পান্ডে।
‘ কংকড়বাগ কলোনী ! সেখানে তো শুনেছি কোনো ভাড়াটে থাকে।’
এবার ভ্রুকুটি করে মৃত্যুঞ্জয় তাকালো।
‘ ভাড়াটে থাকে মানে ? সেখানে আপনার কোনো বাড়ি আছে নাকি ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আমার বাড়ি না। আমার এক ভাইয়ের বাড়ি। অনিরুদ্ধ তিওয়ারী তার নাম। কানপুরে থাকে সে। বাড়িটা খালি পড়েছিল তাই শুনেছি ভাড়া দিয়েছে কাউকে।’
‘ ভাড়াটেকে  আপনি চেনেন ?’
‘ চিনবো কী করে ? তাকে তো চোখেও দেখিনি।’
‘ আপনার ছেলে তাকে চেনে সেটা আপনি জানেন নিশ্চই ?’
‘ জানি না। তবে আমার ছেলে যদি তাকে চেনে তাতে কোনো অসুবিধে তো নেই।’
‘ অসুবিধে আছে কি না সেটা পরে জানা যাবে পান্ডে জী। তবে একটা কথা আপনাকে বলে রাখি, সেই বাড়ি তে ভাড়াটে যে সে কিন্তু সন্দিগ্ধ। শুনেছি আপনার ছেলে নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো।’
নিজের ছেলের প্রশংসা শুনে মুচকি হাসলেন বিনয় পান্ডে। বললেন -’  তা তো ছিলো। আই আই টি থেকে পড়ার ইচ্ছে ছিলো। আমি পুরো ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু কী যে হলো তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিকাশ বলল যে সে পাটনা তেই থাকতে চায়। এখানেই কোনো এক কোম্পানী তে কাজ করবে সে। জেদ ধরে রইল। আমি বেশি কিছু বললাম না তাকে। এখন আফসোস হয়ে। যদি আই আই টি থেকে পড়তো, তাহলে অনেক বেশিটাকা রোজগার করতে পারতো।’
কথার শেষে ভদ্রলোকের মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠল।
‘ তার আই আই টি থেকে না পড়ার পেছনে কারণ জিজ্ঞেস করলেন না ?’
‘ করেছিলাম। কিন্তু জবাব দেয়নি সে।’

বেশিক্ষণ আর থাকলো না মৃত্যুঞ্জয় সেখানে। এবার তার গন্তব্য বিকাশের অফিস। বিকাশের অফিস ফ্রেজার রোডে। সগুনা মোড় থেকে বেশ অনেকটাই দূর। পথে অত্যাধিক ভিড়ের দরুণ সগুনা মোড় থেকে ফ্রেজার রোড পৌঁছাতে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রায় দু’  ঘন্টা সময় লাগলো। পাটনা স্টেশন থেকে নাক বরাবর সোজা রাস্তা বেরিয়ে গেছে ফ্রেজার রোড। গান্ধী ময়দান পর্যন্ত চলে যাওয়া এই পথে আকাশবাণী সহিত প্রচুর বড় – বড় সরকারী আর বেসরকারী কার্যালয় আছে। সাথে আছে বেশ কিছু শপিং মল। আকাশবাণী থেকে একটু এগিয়েই এক বহুতল অট্টালিকার সামনে অটো থেকে নামলো মৃত্যুঞ্জয়। অট্টালিকার ভেতরে ঢুকবার সময় মৃত্যুঞ্জয় দেখলো তার পাশ দিয়ে এক জন বাইকে করে বেরিয়ে গেলো। হেলমেটে ঢাকা চেহারার জন্য মৃত্যুঞ্জয় চিনতে পেলো না তাকে। কিছু একটা সন্দেহ হতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাইকের দিকে তাকালো সে। নম্বর প্লেটের দিকে নজর গেলো। নম্বরটা চেনে। জ্যামের কারণে বিকাশ পান্ডের বাইক অত্যন্ত ধীর গতি তে পাটনা স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। একটা অটো থামিয়ে সেটা তে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। অটোটা বাইক থেকে প্রায় কুড়ি হাত পেছনে। মন্দ গতি তে অটো বাইকের পিছু নিচ্ছে। আফসোস হলো মৃত্যুঞ্জয়ের। এই মুহূর্তে যদি তার কাছেও বাইক থাকতো তাহলে বিকাশ পান্ডেকে  নাগালে পেতে বেশি বেগ পেতে হতো না তাকে। মাঝে – মাঝে বাইক আর অটোর দূরত্ব বাড়ছে। চারিপাশে বাইক, গাড়ি, অটোর ভিড়ের দরুণ চোখের আড়ালে হয়ে যাচ্ছে বিকাশ পান্ডে। অটো তে বসে ছটফট করছে মৃত্যুঞ্জয়। শেষ রক্ষা কি হবে ? মৃত্যুঞ্জয় কি জানতে পারবে এই অসময় বিকাশ পান্ডে নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে কোন গন্তব্যের পানে রওনা দিয়েছে ? মৃত্যুঞ্জয় জানে পাটনা স্টেশন থেকে এক্সিবিশন রোডের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। সে ফোন করলো অন্বেষাকে ।
‘ তুমি কি কিছুক্ষণের মধ্যে পাটনা জংক্শন পৌঁছাতে পারবে ? আসলে তোমার স্কুটি তার খুব প্রয়োজন আমার।’  অন্বেষাকে  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ ঠিক আছে, আমি আসছি। তুমি এখন কোথায় ?’
‘ ফ্রেজার রোডে। খুব ভিড়। অটো তে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশন পৌঁছাবো। তুমি দেখে নাও এক্সিবিশন রোডে জ্যাম আছে কি না।’

না, এক্সিবিশন রোডে জ্যাম ছিলো না। মৃত্যুঞ্জয়ের স্টেশন পৌঁছবার আগেই অন্বেষা সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলো। অন্বেষার স্টেশন পৌঁছবার ঠিক মিনিট দুয়েক পর মৃত্যুঞ্জয়ের অটো থামলো স্টেশনের সামনে। অটো থেকে নামতেই অন্বেষাকে  দেখতে পেলো সে। অন্বেষা নিজে একটা হেলমেট পরেছিলো এবং মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য নিজের কলিগের একটা হেলমেট জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল। চটজলদি অটোর ভাড়া মিটিয়ে অন্বেষার কাছে এসে তার হাতে থাকা হেলমেটটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে নিজে পরলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ ব্যাপারটা কী মৃত্যুঞ্জয়দা। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’  বলল অন্বেষা।
‘ কোনো দিন এতো ভিড়, এতো জ্যামকে  আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসিনি যত আজ ভালোবাসলাম। আজ যদি রাস্তায় এতো ভিড় না হতো তাহলে হয়তো বিকাশ আমার নাগালের বাইরে চলে যেতো।’
স্কুটি স্টার্ট করলো মৃত্যুঞ্জয়, অন্বেষা পেছনে বসলো।
যে দিকে বিকাশ বাইক নিয়ে গিয়েছিল সে দিকে একটু এগোতেই সেই বাইককে  দেখতে পেলো তারা। স্টেশনের পাশ দিয়ে একটা ফ্লাইওভারে উঠে পড়েছে দুজনের দু’  চাকা। খানিক পর বিকাশ নিজের বাহনকে  ডান দিকে ঘুরিয়ে রাজেন্দ্র নগর স্টেশনের পথ ধরলো। তুলনামূলক এদিকে ভিড় কম। বিকাশের বাইক থেকে মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষার স্কুটির দূরত্ব এখন মাত্র দশ হাত। ইচ্ছাকৃতই স্কুটির গতি অল্প কম করলো মৃত্যুঞ্জয়। সে চায় না বিকাশের কোনো রকমের সন্দেহ হোক। হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা দেখলো রাজেন্দ্র নগর স্টেশনের কিছু আগে বিকাশ নিজের বাইক দাঁড় করলো। এক জন অপেক্ষা করছিলো তার। বাইক দাঁড় করাতেই সে বসে গেলো বাইকের পেছনে। মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা দুজনেই চিনতে পারলো তাকে।

পর্ব – ৬
…………………….

‘ ওঃ মাই গড। এটা আমি কী দেখছি মৃত্যুঞ্জয়দা ?’  বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ খুব সম্ভব আরও অনেক কিছুই দেখতে আর জানতে পাবে।’  চাপা গলায় মৃত্যুঞ্জয় বলল।
‘ সেই কারণেই হয়তো রাধিকা আজ অফিসে আসেনি। কিন্তু এখনও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’  অন্বেষা কথা শেষ করলো।
সামনের বাইক পুনরায় স্টার্ট হলো। রাধিকাকে  পেছনে বসিয়ে এগিয়ে গেলো বিকাশ পান্ডে। মৃত্যুঞ্জয় তৎক্ষনাৎ তাদের পিছু নিলো না। খানিক দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশ্চর্য হলো অন্বেষা। বলল -’  কী হলো ? ফলো করবে না ?’
‘ করবো। একটু দূরত্ব রাখতেই হবে। আমাদের দেখে নিলে অসুবিধে আছে।’
বিকাশ ও রাধিকার এগিয়ে যাওয়ার প্রায় কুড়ি সেকেন্ড পর মৃত্যুঞ্জয় স্কুটি স্টার্ট করলো।

রাজেন্দ্র নগরে বেশ বড় এক জলের ট্যাঙ্কি আছে। সেই ট্যাঙ্কিকে  ঘিরে ছোট – বড় বেশ কিছু বাড়ির ভীড়। ট্যাঙ্কির গা ঘেঁসে এক সরু গলি চলে গেছে। সেই গলির শুরু তেই এক দু’  তলা বাড়ি সামনে নিজের বাইক দাঁড় করালো বিকাশ পান্ডে। নিচের তলা বন্ধ। ফটক খুলতেই পাশ দিয়ে চলে গেছে দু’  তলায় যাওয়ার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে দুজনেই উঠে গেলো দু’  তলায়। জলের ট্যাঙ্কির কাছে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটা দেখছিল মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা। অন্বেষা বলল -’  মেন গেটে তো তালা লাগিয়ে দিলো। এবার আমরা ভেতরে ঢুকবো কী করে ?’
‘ রাধিকাকে  কল করে মোবাইলটা আমাকেদাও।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মতো কাজ করলো অন্বেষা। যে মুহূর্তে রাধিকার মোবাইলে রিং হলো, ফোনটা মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো সে।
‘ হ্যাঁ বল অন্বেষা।’  ওপার থেকে রাধিকার গলা ভেসে এলো।
‘ অন্বেষা নয়, মৃত্যুঞ্জয়। রাধিকা, কোনো জিনিসই বেশি দিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক না এক দিন সত্য ঠিক সামনে চলে আসে। খুব প্রয়োজন না হলে আমি দরজা ভাঙ্গি না। তাই বলছি, আপনারা নিচে নামবেন, না আমার ওপরে উঠে দরজা ভাঙ্গবো ?’
মৃত্যুঞ্জয়ের এহেন কথায় থতমত খেয়ে গেলো রাধিকা। কী বলবে কিছু বুঝতে না পেয়ে ফোনকে টে দিলো সে। কিছুক্ষণ পর দু’  তলার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রাধিকা। সামনের বারান্দায় এসে রাস্তার দিকে তাকালো। তার ঠিক সামনে প্রায় পনেরো হাতের তফাতে জলের ট্যাঙ্কি। মৃত্যুঞ্জয়কে  খোঁজার জন্য এদিক – সেদিক তাকাচ্ছিল সে। হঠাৎ জলের ট্যাঙ্কির দিকে নজর গেলো তার। দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষাকে । ম্লান দৃষ্টি তে খানিক চেয়ে রইল সে দিকে, তার পর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষাও বাড়ির দিকে এগোলো। ফটক খুলে তাদের ভেতরে ঢুকবার পথ করে দিলো রাধিকা। তার পান্ডুবর্ণ মুখের পানে খানিক এক দৃষ্টে চেয়ে অন্বেষা বলল -’  তুই যে এতো বড় কথা আমার থেকে লুকিয়ে রাখবি এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’
প্রত্যুত্তর দিলো না রাধিকা। তিন জনে দু’  তলায় উঠল। ঘরে একটা চেয়ারে ঘাড় হেঁট করে বসে বিকাশ। একটা খাট পাতা, অন্বেষা ও রাধিকা বসলো তাতে। মৃত্যুঞ্জয় বসলো না।
‘ বিকাশ বাবুর সাথে কথা পরে হবে। আগে রাধিকার সাথে কিছু কথা সেরে নেওয়া যাক আগে।’  রাধিকার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো -’  আপনার বিকাশ পান্ডের সাথে সম্পর্কটা কী ?’
রাধিকা মাটির পানে চেয়ে বসে আসে। মুখে কথা নেই তার। রাধিকার বদলে বিকাশ বলল মৃত্যুঞ্জয়কে  -’  আমি বলছি আপনাকে। সব কথা খুলে বলছি আপনাকে।’
‘ খুব ভালো। কিছু লুকাবেন না দয়া করে।’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ না। লুকাবো না।’  বিকাশ বলতে শুরু করলো -’  রাধিকার সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। স্কুল লাইফ থেকে। রাধিকা যে প্রতীক নেলসনের সাথে প্রেমের খেলা খেলছে সেটা আমারই প্ল্যান। প্রতীকের বিচিত্র কান্ডকারখানার বিষয় জানা দরকার।’
‘ প্রতীকের সাথে তো আপনার রোজ দেখা হয়ে, জিজ্ঞেস করেননি ?’
‘ দেখা তো রোজ হয়ে। জিজ্ঞেসও করেছি। কিন্তু জবাব দেয়নি সে। যে বাড়ি তে প্রতীক ভাড়া থাকে সেটা আমার কাকার বাড়ি। আমি প্রতীককে  এটাও বলেছি যে কারণ না বললে তার এই ভয়ানক সব কার্যকলাপের খবর আমি কাকাকে  বলে দেবো।’
‘ তার পর ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ আমার হাতে – পায় পড়লো সে। কাকাকে  বলতে মানা করলো।’
‘ সে মানা করলো আর আপনি মেনে নিলেন ?’  মৃত্যুঞ্জয় বলল।
পুনরায় ঘাড় হেঁট করলো বিকাশ।
‘ বলুন বিকাশ বাবু, বলুন। আসল কথাটা কী সেটা বলুন। আপনাদের মধ্যে কোনো কি কোনো এগ্রিমেন্ট হয়েছিল ? যেমন প্রতীক নেলসন সন্দেহজনক লোক, তেমন আপনিও কিছু কম না।’
মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় চমকে উঠল বিকাশ পান্ডে।
‘ আ….আমি সন্দেহজনক ?’  আমতা – আমতা করে বলল সে।
‘ হ্যাঁ, আপনিও।কে মেস্ট্রি তে আপনি এক্সট্রা অর্ডিনারি স্টুডেন্ট। আই আই টি থেকে পড়ার ইচ্ছেও ছিলো আপনার। দেশের যে কোনো ভালো আই আই টি কলেজে আপনার অ্যাডমিশন হয়ে যেতো। হঠাৎ আপার ইচ্ছে তে পরিবর্তন ঘটল। আপনি পাটনা তেই রয়ে গেলেন। সাফল্যকে  নিজের হাতে ঠেলে দিলেন আপনি। কারণটা জানতে পারি কি ?’
মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে খানিক অবাক দৃষ্টি তে তাকাবার পর বিকাশ বলল -’  পাটনা থেকে চলে গেলে আমার গবেষনার কাজ পুরো হতো না।কে মেস্ট্রি তে আমি ভালো ছিলাম। একটাকে মিকলের বিষয় গবেষনা করার পোকা আমার মাথায় বহু দিন আগেই ঢোকে। ক্ষমা করবেন, সেই গবেষনার বিষয় আপনাদের আমি বলতে পারবো না। ওটা কনফিডেন্সিয়াল। এ টুকু কথা দিতে পারি যে আমার গবেষনা পুরো হলে ভবিষ্যতে দেশের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং ভালোই হবে। শুরু তে নিজের কিছু জমানোটাকা দিকে গবেষনা শুরু করলাম। কাকার বাড়িটা খালি ছিলো তখন। বাড়ি তে দুটো ঘর। আমার গবেষনার জন্য একটা ঘর যথেষ্ট ছিলো। অর্থের অভাবে মাঝে বহু দিন আমি নিজের রিসার্চ বন্ধ রাখি। একটা চাকরী শুরু করি। স্যালারিরটাকা দিয়ে আবার শুরু করি নিজের রিসার্চ। তার পর সেই বাড়ি তে প্রতীক নেলসন আসে। কাকা আমাকে ফোন করে বলে দিয়েছিল যে তাকে একটা ঘর খুলে দিতে। আমি তাই করলাম। নিজের অফিস শেষ করে আমি রোজ সেই বাড়ি তে যাই। রিসার্চের কাজ চালিয়ে যাই। এখন আরটাকার অভাব হয়ে না।’
‘ বুঝলাম। ব্ল্যাকমেল। নিজের কাকাকে  প্রতীকের বিষয় না বলার কারণে প্রতীক থেকেটাকা নেওয়া আর নিজের গোপন রিসার্চকে  এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই তো ?’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
খানিক চুপ থেকে বিকাশ পুনরায় বলতে শুরু করলো -’  কিন্তু সেটা করেও আমি শান্তি পাইনি। প্রতীকের শরীরে এমন সব চোট কী করে লাগে সেটার জানার প্রবল ইচ্ছে মনের ভেতর রয়ে গেলো। তার পর এক দিন রাধিকা আমায় বলে যে তার অফিসে নাকি এক অদ্ভুত ছেলে জয়েন করেছে। রাধিকার মুখে তার নাম শুনলাম। তার পরেই আমার মাথায় এই প্ল্যানটা আসে। রাধিকা যদি প্রতীককে  কোনো ক্রমে নিজের প্রেমের জালে ফাঁসাতে পারে, তাহলে প্রতীকের চোটের কারণ জানা যেতে পারে।’
ইতিমধ্যে মৃত্যুঞ্জয় ঘরময় পায়চারি আরম্ভ করেছে। পুংখানুপুঙ্খ ভাবে পুরো ঘরটাকে দেখছে সে। হঠাৎ রাধিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো -’  তো রাধিকা, কিছু জানতে পারলে ?’
‘ না। এখন অবধি কিছুই বলেনি সে। ওর পেট থেকে কথা বার করবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আফসোস, সফল হয়েনি এখনও।’  বিষন্নতা মেশানো সুরে রাধিকা বলল।
‘ আমরা এতো জন মিলেও যদি প্রতীকের শরীরে লাগা আঘাতের কারণ খুঁজে না বার করতে পারি, তাহলে তো সেটা আমাদের ফল্ট, মৃত্যুঞ্জয়দা।’  হতাশার স্বরে কথাটা বলল অন্বেষা।
মৃত্যুঞ্জয় যেন তার কথা শুনলোই না। সে বিকাশকে  জিজ্ঞেস করলো -’  তুমি ছাড়া সে বাড়ি তে আরকে  -কে  যায় ?’
‘ বলতে পারবো না। আমি প্রায় সন্ধ্যে সাতটায় ঢুকি আর রাত এগারোটায় বেরোই। এর মধ্যে তোকে উ আসে না। তার পরে যদিকে উ আসে, সেটা আমার জানা নেই। সারা সকাল আমি সেই বাড়ি তে যাই না।কে  আসছে,কে  যাচ্ছে সেটা জানবো কী করে ?’
‘ এই বাড়িটা কার ?’  মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
‘ এই ঘরটা আমি ভাড়া নিয়েছি। আই আই টি তে অ্যাডমিশন না নেওয়ার পর থেকেই বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়ে। মাসে কিছু দিন বাড়ি তে থাকি, ভালো না লাগলে এখানে চলে আসি।’  বিকাশ বলল।
‘ তুমি বললে যে তোমার কাকার বাড়ি তে দুটো ঘর। একটা ঘরে তুমি রিসার্চ করো আর একটা ঘরে প্রতীক থাকে।’
‘ হ্যাঁ।’
‘ প্রতীকের ঘরে কোনো দিন ঢুকেছো ?’
‘ না। সে নিজের ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না।’
‘ হবে না। এমন করে হবে না। রহস্য ভেদ করতে গেলে তার ঘরে ঢুকতেই হবে।’
‘ কিন্তু কী করে ? চাবিও তো নেই আমার কাছে।’  বিকাশ বলল।
খানিক শূন্যের দিকে তাকিয়ে আবার রাধিকার দিকে ফিরলো মৃত্যুঞ্জয়। তাকালো ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি তে। রাধিকা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে অবাক নেত্রে চেয়ে রইল। তার ইঙ্গিত বুঝতে পেলো না সে। এবার মৃত্যুঞ্জয়কে  নিজের মুখেই কথাটা বলতে হলো। রাধিকার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল -’  আর কোনো উপায় নেই রাধিকা। আমাদের প্রতীকের ঘরে ঢুকতেই হবে। আর সেটা করার জন্য তালা ভাঙ্গা অনিবার্য। প্রতীক নেলসনের সামনে সেটা করা অসম্ভব। পরশু রবিবার। সারা দিন তুমি প্রতীক নেলসনকে  ব্যস্ত রাখবে। যেখানে খুশি ঘুরতে যাও তাকে নিয়ে। এই ফাঁকে আমরা দরজার তালা ভেঙ্গে তার ঘরে প্রবেশ করবো।’
‘ কিন্তু যখন সে ফিরে এসে দেখবে যে তার ঘরের তালা ভাঙ্গা, তখন তো সন্দেহ হবে তার।’  বলল বিকাশ।
‘ হবে বৈকি। সন্দেহ না হওয়ার কোন কারণ নেই। সেটারও একটা উপায় ভেবেছি।’
‘ কী উপায় মৃত্যুঞ্জয়দা ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ প্রতীক নেলসনের ঘরের তালা ভাঙ্গার সাথে – সাথে বিকাশের ঘরের তালাও ভাঙ্গা হবে। বিকাশ নিজের ঘরের কিছু জিনিস সরিয়ে রাখবে। বিকাশ সেই ঘরে রিসার্চ করে। দরকার পড়লে দু – একটা টেস্ট টিউবও ভেঙ্গে দিতে পারে। পুরো ব্যাপারটাকে এমন করে সাজাতে হবে যাতে মনে হয়ে সেই বাড়ি তে অন্য কারুর প্রবেশ ঘটেছিল। বিকাশ, তোমার গবেষনার বিষয় কি প্রতীক জানে ?’
‘ কিছু – কিছু জানে। প্রতীক এটা জানে যে আমি কিছু একটা নিয়ে রিসার্চ করছি। এ বিষয় কোনো ইন্টারেস্ট দেখায়নি সে।’  বিকাশ জবাব দিলো।
‘ ভেরি গুড। তাহলে তো আরও সহজ হয়ে গেলো। প্রতীককে  এটা বোঝাতে হবে সেই বাড়ি তে এমন এক জনের প্রবেশ ঘটেছিলো যে বিকাশের গোপন গবেষনার বিষয় জানতে পেরেছিল। খালি বাড়ি পেয়ে ঘরে ঢোকে। সে জানতো না বিকাশের ঘর কোনটা। তাই দুটো ঘরের তালাই সে ভেঙ্গে দেয়। সে হয়তো বিকাশের অজ্ঞাত প্রতিপক্ষ।’
‘ এক্সিলেন্ট !’  উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে অন্বেষা।
মৃত্যুঞ্জয় আবার বিকাশকে  বলে -’  আমি আর অন্বেষা সেই বাড়ির আশেপাশেই থাকবো। রাধিকা প্রতীককে  ফোন করে সকাল সাড়ে ন’টায় দেখা করার কথা বলবে পাটনা জংক্শনের সামনে। প্রতীকের বেরোতে – বেরোতে হয়তো দশটা বাজবে। সময় আগে – পিছেও হতে পারে। তাও আমার বিশ্বাস খুব একটা দেরি সে করবে না। প্রতীকের সাথে রাধিকার দেখা হয়ে গেলে রাধিকা অন্বেষাকে  ওয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ করবে। সেটাই হবে আমাদের গ্রীন সিগনাল। বিকাশ ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের অ্যাটেন্ড করবে। সাথে নিয়ে আসবে এক বড় হাতুড়ি। আমরা তিন জানে বেলা বাড়া পর্যন্ত বিকাশের ঘরে অপেক্ষা করবো। দুপুরের দিকে যখন রাস্তায় লোক চলাচল কম হবে তখন ভাঙ্গা হবে প্রতীকের ঘরের তালা। আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে অন্বেষা রাধিকার ওয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করবে। ততক্ষণ রাধিকারদায়িত্ব প্রতীক নেলসনকে  ব্যস্ত রাখার। কি রাধিকা, পারবে তো ?’
কোনো এক অজানা ভয়ে রাধিকার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় শুধু ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলো যে সে একমত।

পর্ব – ৭
…………………….

স্কুটিটা এসে দাঁড়ালো পানের দোকানের ঠিক দশ হাত পেছনে। তখন ঘড়ি তে সকাল ন’টা বেজে দশ মিনিট। রোদের তেজ ধীরে – ধীরে কড়া হবে। যতক্ষণ না প্রতীক নেলসন বাড়ি থেকে বেরোয় আর বিকাশ আসে, ততক্ষণ এক এমন জায়গায় দাঁড়াতে হবে যেখানে রোদের তাপও পৌঁছবে না আর প্রতীকের চোখের আড়ালেও থাকা যাবে। কিন্তু এমন জায়গা এখানে কোথায় ? গলির মুখের ঠিক উল্টো দিকে একটা সাইবার ক্যাফে। এই মাত্র সেটার শার্টার খুললো। মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা এক অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। মৃত্যুঞ্জয়ের চোখের ইশারা অন্বেষা বুঝতে পেলো। দুজনে এগিয়ে গেলো সে দিকে।
‘ বসা যেতে পারে কি ?’  দোকানিকে  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসুন না।’  দাঁত বার করে হেসে দোকানি বলল। সকালে দোকান খুলতেই যে গ্রাহক চলে আসবে, ভাবতে পারেনি সে। গ্রাহক দেখে নিজের খুশিকে  সামলে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।
একটা কম্প্যুটারের সামনে অন্বেষা বসলো। কিছু একটা করতে হবে তাই খুলে নিলো নিজের ফেসবুক প্রোফাইল।
‘ তুমি বসবে না।’  অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়কে ।
‘ না, আমার বসলে চলবে না।’
সাইবার ক্যাফের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সে।
সকাল ন’টা চল্লিশ। অন্বেষার মোবাইল বেজে উঠল।
‘ হ্যাঁ বল….কোটায় ?….ঠিক আছে..তুই কি পৌঁছে গেছিস ?..ঠিক আছে, রাখলাম।’
‘ রাধিকার ফোন নিশ্চই ?’  অন্বেষার ফোন রাখার পর তাকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ হ্যাঁ। রাধিকা পাটনা জংক্শন পৌঁছবে। শি ইজ অন দি ওয়ে। প্রতীক তাকে বলেছে যে ঠিক দশটায় সে বাড়ি থেকে বেরোবে।’  অন্বেষা বলল।
দশটা বেজে দশ মিনিটে নিজের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে গলির মুখে এলো প্রতীক নেলসন। নিজের বাঁ দিকে মুড়ে পানের দোকানের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলো সে। নতুন কোনো ক্ষতচিহ্ন তার শরীরে মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলো না।
‘ এখনও বিকাশ এলো না ?’  কম্প্যুটার বন্ধ করে মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ যতক্ষণ না প্রতীক এই কলোনী ছাড়ছে, বিকাশ ঢুকবে না। তাকে যদি প্রতীক এক বার ভুল করেও দেখে নেয় তাহলে আমাদের পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাবে। বিকাশ এখন কংকড়বাগ কলোনীর ঠিক বাইরে এক পিৎজা হাটে আমাদের জন্য পিৎজা কিনছে। সে নজর রেখেছে রাস্তার দিকে। যে মুহূর্তে কলোনী থেকে বেরিয়ে প্রতীক অটো ধরবে, সে দোকান থেকে বেরিয়ে চলে আসবে এ দিকে।’
সাইবার ক্যাফের ছেলেটাকে টাকা দিয়ে দুজনে বেরিয়ে এলো। পানের দোকানের দিকে এক বার তাকালো মৃত্যুঞ্জয়। গ্রাহক খুব একটা নেই। দুটো বয়স্ক লোক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জমিয়ে গল্প করছেন।
‘ অন্বেষা, তুমি স্কুটি নিয়ে সোজা প্রতীক নেলসনের বাড়ির সামনে দাঁড়াও। আমি বরং একটা পান খেয়ে আসি।’
‘ পান !’  চমকে উঠল অন্বেষা।
‘ হুম, পান। তুমি এগিয়ে যাও।’
অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে স্কুটি নিয়ে এগিয়ে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় গিয়ে দাঁড়ালো পনের দোকানের সামনে। দোকানি এক বার দেখেই চিনতে পেলো তাকে। এক গাল হেসে বলল -’  আপ ! আইয়ে – আইয়ে।’
এক প্যাকেট সিগারেট কিনে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল -’  দরকারী কথা আছে তোমার সাথে।’
‘ বলিয়ে না বাবু।কে য়া বাত হ্যায় ?’
মৃত্যুঞ্জয় ইশারা করে তাকে দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে বলল। ঠিক সেই সময় বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল। বিকাশের কল।
কল রিসিভ করতেই ওপার থেকে বিকাশ বলল -’  প্রতীক অটো তে বসে পড়েছে। আমার পিৎজাকে না হয়ে গেছে। আমি আসছি।’
‘ ঠিক আছে।’  ফোনকে টে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
দোকানিকে  জিজ্ঞেস করলো -’  কিছুক্ষণ আগে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক ছেলে তোমার দোকানের সামনে দিয়ে চলে গেলো। তাকে চেনো নিশ্চই ?’
‘ হাঁ বাবু। এটাই তো থাকে ওই বাড়ি তে।’  দোকানি বলল।
নিজের পার্স থেকে দুশোটাকার একটা নোট বার করে দোকানির হাতে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  যে ছেলেটা রোজ বিকেলে তোমার থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কিনে সেই বাড়ি তে যায়, তার সাথে আমি আজ যাবো সেই বাড়ি তে। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে। এই কথাটা যেনকে উ জানতে না পারে।’
দোকানি স্বছন্দেটাকাটা নিয়ে নিলো। বলল -’  বাবু, এর আগেও আপনি আমার ওপর দয়া দেখিয়েছেন। আমি আপনার কথা না তো কাউকে বলেছি, আর না কাউকে বলবো।’
‘ ভেরি গুড।’  দোকানির পিঠে এক চোপড় মেরে বলল মৃত্যুঞ্জয়।

নিজের স্কুটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির সামনে মৃত্যুঞ্জয় অপেক্ষা করছে অন্বেষা। মৃত্যুঞ্জয়কে  আসতে দেখেই বলল -’  তোমার যে পানের নেশা আছে সেটা আমি জানতাম না তো ?’
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল -’  পানের নেশা নয় সোনা আমার, কাজের নেশা। আসলে ওই দোকানিকে  হাতের মুঠোয় আনা দরকার ছিলো।’
‘ কী করে আনলে তাকে নিজের হাতের মুঠোয় ?’
‘ ভেরি সিম্পল,টাকা দিয়ে। যে দিন প্রথম আমি এখানে আসি সে দিনও তাকেটাকা দিয়েছিলাম নিজের মুখ বন্ধ রাখার জন্য। আজকেও তাই করলাম। আমরা যে এখানে এসেছিলাম সে খবর প্রতীক নেলসন পর্যন্ত যাবে না। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, বিকাশের কল এসেছিল। প্রতীক অটো তে চড়ে গেছে। বিকাশের পিৎজাকে না হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে।
বিকাশের পৌঁছাতে আরও দশ মিনিট সময় লাগলো। এসেই অন্বেষাকে  সে জিজ্ঞেস করলো -’  রাধিকার কোনো ম্যাসেজ এসেছে ?’
‘ প্রতীকের রওনা হওয়ার পর কোনো ম্যাসেজ আসেনি।’  জবাব দিলো অন্বেষা।
বাইকের ডিকি থেকে বেশ বড় রকম একটা হাতুড়ি বার করে সেটাকে  মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিকাশ বলল -’  এতে কাজ হবে তো ?’
‘ আলবৎ হবে। আচ্ছা বিকাশ, তুমি প্রতীক নেলসনের হাতে কোনো দিন মেডিকলের বই দেখেছো ?’
‘ মেডিকলের বই ? কই, নাতো।কে ন বলো তো ?’
‘ বাড়ির আশেপাশে প্রচুর বইয়ের প্রায় অর্ধেক পুড়ে যাওয়া পৃষ্টা পাওয়া গেছে। সেই পৃষ্টা গুলো মেডিকাল বইয়ের।’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
খানিক চিন্তা করে বিকাশ বলল -’  না, মেডিকলের বই দেখিনি। হয়তো তার ঘর থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতীকের মেডিকলের সাথে কী সম্পর্ক হতে পারে ?’
‘ সেটাই তো প্রশ্ন বিকাশ, সেটাই তো প্রশ্ন। সব প্রশ্নের না হোক, কিছু প্রশ্নের উত্তর যে আজ পাওয়া যাবেই সেটা আমার বিশ্বাস।’
নিজের মোবাইল ঘাঁটছিলো অন্বেষা। হঠাৎ সে বলল -’  রাধিকার ওয়াটসঅ্যাপ করেছে। প্রতীকের সাথে তার দেখা হয়েছে। তারা গান্ধী ময়দানে কোনো এক রেস্তোরাঁ তে জলখাবার খেয়ে সিনেমা দেখতে যাবে।’
‘ গুড। ভেতরে যাওয়া যাক।’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।

ফটক খুলে ভেতরে ঢুকতেই চারিপাশে চার ফুটের পাঁচিল ও আগাছা। মাঝখানে এক তলা ছোট বাড়ি। ছ’  ধাপ সিঁড়ি উঠে সদর দরজা। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার প্রায় বাড়ি তে প্রবেশ করলো তারা। বাড়ির সব জানালা বন্ধ, একটা বাতিও জ্বলছে না। স্বিচ বোর্ড কোথায় সেটা খুব ভালো করেই জানে বিকাশ পান্ডে। দু – তিনটে স্বিচ পরপর টিপতেই বেশ কিছু আলো জ্বলে গেলো। তারা দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট ডাইনিং হলে। আদ্যিকালের দুটো কাঠের আলমারি ছাড়া বেশ কিছু আবর্জনা ছড়ানো চারিদিকে। ডাইনিং হলের ডান দিকে রান্না ঘর। বলাই বাহুল্য সেটাও বন্ধ। পাশাপাশি দুটো ঘর।দান দিকের ঘরটা বিকাশের এবং বাঁ দিকেরটা প্রতীকের। নিজের ঘরের তালা খুললো বিকাশ। তিন জনেই ভেতরে ঢুকলো। বিকাশ এগোলো ঘরের জানালা খুলতে, কিন্তু তাকে মানা করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ জানালা খুলতে হবে না। লাইট জ্বালিয়েদাও। বইয়েরকে উ যেন দেখতে না পায়ে যে এ বাড়ি তেকে উ আছে।’
অগত্যা লাইট জ্বালাতে হলো বিকাশকে । ছোট ঘর। জানালার দিকে একটা চৌকি পাতা। দুটো কাঠের টেবিল, একটা চেয়ার। টেবিলে নানা ধরনের টেস্ট টিউব। এক দিকের দেয়ালে বড় এক তাক বানানো আছে। সেই তাক জুড়েও বিভিন্ন ধরন ও আকৃতির শিশি – বোতল ও টেস্ট টিউব। কোনো টেস্ট টিউবে নীল রঙ্গের জল তো কোনো টেস্ট টিউবে লাল অথবা হলুদ জল। সে গুলো যে বিভিন্ন ধরনেরকে মিকাল সেটা বুঝতে সময় নিলো না মৃত্যুঞ্জয়। ছাদে ঝুলছে আদ্যিকালের এক সিলিং ফ্যান। স্বিচ দিতেই বিকট এক শব্দ করে সেটা ঘুরতে আরম্ভ করলো। চেয়ারে বসলো অন্বেষা। টেস্ট টিউব গুলোকে  ভালো করে নিরীক্ষণ করতে শুরু করলো সে। খানিক নিরীক্ষণ করার পর যখন কিছুই বুঝলো না তখন সেখান থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বিকাশে হাতে একটা প্যাকেট। সেটা খুলে ভেতর থেকে তিনটে পিৎজা বার করে সে বলল -’  মধ্যপ্রদেশে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। সেটাকে  শান্ত করা দরকার।’
প্রাতঃরাশ শেষ হওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় বিকাশকে  জিজ্ঞেস করলো -’  তুমি তো অনেক দিন ধরেই প্রতীককে  চেনো। কোনো দিন কিছু বলেছে নিজের অতীতের বিষয় তোমাকে ? কোনো দিন জিজ্ঞেস করেছো তুমি ?’
‘ জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু কোনো দিনই বিশেষ কিছু বলেনি সে। যত বার জিজ্ঞেস করেছি, ততবার কথা এড়িয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, রাধিকাকে  বলেছে। সে কোন স্কুল, কলেজে পড়েছে সে সব। এর থেকে বেশি কিছু হাজার চেষ্টা করেও রাধিকা তার মুখ থেকে বার করতে পারেনি।’
‘ অদ্ভুত রহস্যময় ছেলে মাইরি। অনেক ছেলের সাথেই আমার পরিচয় আছে, কিন্তু এমন বিচিত্র, এমন কমপ্লিকেটেড ছেলে কোনো দিন দেখিনি।’  বলল অন্বেষা।
‘ হুম। তাই তো এইকে সের প্রতি রুচি দেখলাম আমি।’  মৃত্যুঞ্জয় বলল।
এদিক – ওদিকের কথায় এগিয়ে চললো সময়। এক সময় ঘড়ি দুপুর একটা বাজার ইঙ্গিত দিলো। বাইরে রোদের তাপ বেশ ভালোই বেড়েছে। লোকের চলাচল যে কমেছে সেটা বলাই বাহুল্য। হাতুড়ি দিয়ে প্রতীকের তালা তে দু – তিনটে জোরে ঘা দিলো মৃত্যুঞ্জয়। চকিতে তালার আকৃতি তে পরিবর্তন ঘটলো। ফটকের ও সদর দরজার তালারও একই অবস্থা হলো। তদন্তের খাতিরে নিজের বেশ কিছু টেস্ট টিউবকে  জলাঞ্জলি দিতে হলো বিকাশকে । এটা করতে যে বুক ফেটে গেলো সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো।
‘ টেস্ট টিউব গুলোরদাম অনেক। আবার কিনতে হবে।’  বিষন্নতা ভরা কন্ঠে বলল বিকাশ পান্ডে।
অতঃপর তারা এগোলো প্রতীক নেলসনের ঘরের দিকে। হাতুড়ি মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। তালায় চারবার সজোরে প্রহার করতে হলো তাকে। তালা ভেঙ্গে হাতে চলে এলো তার। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে ঘরটাকে  আলোকিত করলো বিকাশ। দুটো ঘরের আকার ও আকৃতি একই। আসবাবপত্র বলতে একটা চৌকি, একটা ছোট্ট স্টিলের আলমারি, একটা কাঠের টেবিল ও চেয়ার এবং কিছু বাসনপত্র। ঘরে যেকে উ থাকে সেটা ঘরের অবস্থা দেখে বলা সম্ভব নয়। অপরিচ্ছন্নতায় পরিপূর্ণ ঘর।
বাসনপত্রের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  বাসন আছে অথচ গ্যাস দেখছি না। প্রতীক কি বাইরে থেকে খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে আসে নাকি ?’
‘ হ্যাঁ।’  জবাব দিলো বিকাশ।
চৌকি তে পাহাড় করে রাখা জামাকাপড়। সে গুলোকে  একে – একে উঠিয়ে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষা ও বিকাশও ঘরের প্রতিটি কণা পুংখানুপুঙ্খ ভাবে দেখতে শুরু করলো। চৌকি তে রাখা বেশ কিছু বেল্টের ওপর নজর গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের। ভালো করে সে গুলোকে  দেখে যথাস্থানে রেখে দিলো সে। হঠাৎ তার নজর গেলো দেয়ালের দিকে। সাদা দেয়াল, তাতে অল্প – অল্প রক্তেরদাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে দিকে খানিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেবিলের দিকে এগোলো মৃত্যুঞ্জয়। মোটা – মোটা বেশ কিছু বই এবং এক ব্লুটুথ মিউসিক সিস্টম সেখানে। কোনোটা ছেঁড়া, কোনোটা অর্ধেক পুড়ে যাওয়া। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো সব বই গুলো মেডিকলের। বই গুলোর শেষাংশ গুলোই ভালো করে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ মৃত্যুঞ্জয়দা, এদিকে এসো।’
হঠাৎ অন্বেষার কন্ঠস্বর শুনতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। চৌকির পেছন দিকে এক কোণায় উবু হয়ে বসে আছে অন্বেষা। তার নজর চৌকির নিচের দিকে। অন্বেষার ডাকে মৃত্যুঞ্জয় আর বিকাশ ছুটে গেলো সে দিকে।
‘ কী হলো ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
অন্বেষা ইশারা করলো চৌকির তলার দিকে।
পুরো ঘরের তুলনায় চৌকির তালাটা বেশ পরিস্কার। বেশ বড় আকারের চৌকো কাঠের বাক্স রাখা সেখানে। সেটাকে  টেনে বার করলো মৃত্যুঞ্জয়। বাক্সটাকে  কাঠের সুটকেস বললে ভুল বলা হয়ে না। প্রায় পাঁচ ফুট বাই চার ফুটের। বাক্সটা ছিলো এক তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। ধুলোর লেশমাত্র নেই বাক্সর গায়ে। পুরো ঘরে এই একটি মাত্র জিনিস যেন যত্ন সহকারে রাখা।
‘ কী হতে পারে এটা ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ যতদূর মনে হয়ে ফাস্ট এড বক্স। তা ছাড়া অন্য কিছু হবে বলে তো মনে হয়ে না।’
কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় খুলল সেটাকে । চাবি দিয়ে লক করার জায়গা আছে বটে, কিন্তু লক করা ছিলো না সেটা। বক্সের ভেতরে আছে গোল করে পেঁচানো দুটো বেল্ট, বেশ কিছু ব্লেড, ছুরি, ব্যান্ডেজ, স্টিচ করার সুতো, অপারেশনে ব্যবহার করার কিছু কাঁচি। সাথে আছে চারটে কাগজের ছোট – ছোট টুকরো। বাক্সটা বিকাশের হাতে দিয়ে কাগজের টুকরো গুলো বার করলো মৃত্যুঞ্জয়। প্রথম টুকরো তে লেখা আছে – এস 1, দেয়াল। দ্বিতীয় টুকরো তে লেখা আছে – এস 2, বেল্ট। তৃতীয় তে – এস 3, ব্লেড ছুরি। এবং চতুর্থ কাগজের টুকরো তে লেখা আছে – এস 4।
‘ এটা কী হেঁয়ালি মৃত্যুঞ্জয়দা ?’  বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
অন্বেষার প্রশ্ন যেন মৃত্যুঞ্জয়ের কানেই গেলো না। ভ্রুকুটি করে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল কাগজের সেই রহস্যময় টুকরো গুলোর দিকে।
‘ এস 4এর পাশে কিছু লেখা নেইকে ন ?’  প্রশ্নটা করলো বিকাশ পান্ডে।
মৃত্যুঞ্জয় এবারও চুপ। ঘরে খানিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে থাকলো। কাগজের ওপর থেকে নজর সরিয়ে খানিক শূন্যের দিকে চেয়ে রইল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ অন্বেষা, বিকাশ, দেখো ভালো করে। আরও যদি কিছু পাও।’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
চৌকি তে জামাকাপড়ের স্তুপের মধ্যে ছিলো একটা ব্যাগ। ব্যাগেও কাপড়ের পাহাড়। না, আর বিশেষ কিছুই পেলো না তারা।
‘ ঠিক আছে। বিকাশ, এবার তুমি ফোন করো প্রতীককে । তুমি জানো তোমায় কী বলতে হবে।’
মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মতো বিকাশ ফোন করলো প্রতীককে । কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর প্রতীক ফোন তুলতেই কান্না মেশানো স্বরে বিকাশ বলল -’  প্রতীক, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি এখনই বাড়ি এসেছি। সব তোলপাড় হয়ে গেছে। জানি না চোর এসেছিল কিনা। তালা ভেঙ্গে দিয়েছে সব। তোর ঘরের, আমার ঘরের। আমার বেশ কিছুদামী টেস্ট টিউব ভেঙ্গে দিয়েছে। তুই যেখানেই আছিস, চলে আয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
বিকাশের ফোন রাখার পর অন্বেষা তাকে বলল -’  বেশ ভালোই অভিনয় করতে পারো তুমি।’

বিকাশ রয়ে গেলো সেখানে। মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষা যখন বেরলো তখন বিকেল চারটে। প্রতীকের সেখানে পৌঁছবার আগেই এক রেস্তোরাঁ থেকে কিছু খাবার প্যাক করে দিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। খিদে তাদেরও পেয়েছিল। কংকড়বাগ থেকে বেরিয়ে পাটনা জংক্শনের কাছে নিউ মার্কেটের একটা রেস্তোরাঁ তে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষা। খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে  বলল -’  আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই কাগজের টুকরো গুলো কি কোনো সংকেত ? যদি সংকেতই হয়ে, তাহলে কিসের সংকেত সে গুলো ? এস 1, এস 2 এ গুলো তো ট্রেনের কামরায় লেখা থাকতে দেখেছি। রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে।’
‘ তা দেখেছো হবে। কিন্তু এটার ট্রেনের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম কাগজে কী লেখা ছিলো ?’
‘ এস 1 আর দেয়াল।’  বলল অন্বেষা।
‘ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখেছো ভালো করে ?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
খানিক চিন্তা করে অন্বেষা বলল -’  কিছু বিশেষ তো পাইনি।’
‘ তার মানে তুমি লক্ষ করোনি। দেয়ালের গায়ে ছিলো রক্তেরদাগ। রক্তেরদাগ আমি পেলাম কাঠের বাক্স তে রাখা বেল্টেও, সাথে ব্লেড আর ছুরি তে তো ছিলোই। এবার ভালো করে চিন্তা করে দেখো। প্রথম কাগজ …. দেয়ালে রক্তেরদাগ, দ্বিতীয় কাগজ …. বেল্টে রক্তেরদাগ, তৃতীয় কাগজ …. ব্লেড ও ছুরি তে রক্তেরদাগ। কিছু বুঝতে পেলে ?’

পর্ব – ৮
…………………….

প্রচুর মাথা ঘামিয়েও কিছু বুঝতে পারছে না অন্বেষা। চারটে চিরকুট, তাতে কিছু সাংকেতিক শব্দ, রক্তেরদাগ। না, পারছে না সে। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তার। মাথা ধরে চুপ করে বসে রইল অন্বেষা। খাবার চলে এসেছে। খাবার সময় হঠাৎ অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো -’  চার নম্বর চিরকুটটা খালিকে ন ? তাতে দেয়াল, ব্লেড কিছুই তো লেখা নেই।’
‘ গুড কোয়েশ্চন ? তোমার কী মনে হয়ে, কী লেখা যেতে পারে তাতে ?’  বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ আমি কী করে বুঝবো ?’
‘ ভেবে দেখো। সমীকরণ গুলোকে  এক – এক করে মিলিয়ে দেখো।’
‘ তুমি তো এমন করে বলছো যে রহস্যের সমাধান তুমি করে ফেলেছো।’
খাবার থেকে চোখ সরিয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  পুরো সমাধান এখনও হয়েনি। তবে কিছুটা তো অবশ্যই করে ফেলেছি।’
‘ সমাধান করে ফেলেছো ? কী বুঝলে ?’  উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ বলবো।’
বাড়ি যাওয়ার পথে আর কোনো কথা হলো না তাদের মধ্যে। বাড়ি যখন পৌঁছালো তারা তখন ঘড়ি তে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। মৃত্যুঞ্জয় সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। দরজা বন্ধ করে দিলো ভেতর থেকে। অন্বেষা নিজের ঘরে বসে নিরন্তর ভাবতে থাকে কাগজের সেই টুকরো গুলো এবং তাতে লেখা সাংকেতিক শব্দ গুলোর বিষয়। সে যা – যা দেখেছে, মৃত্যুঞ্জয় তাই দেখেছে। তাহলে মৃত্যুঞ্জয় কী এমন আবিষ্কার করে ফেললো যেটা সে পারলো না। মৃত্যুঞ্জয় এইকে সে যদি অন্বেষাকে  সাহায্য না করতো তাহলে কি অন্বেষা কোনো কূলকিনারা বার করতে পারতো এই রহস্যের ? কথাটা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেললো অন্বেষা। মৃত্যুঞ্জয়দা’ র অবজারভেশন ক্ষমতার সামনে মাথানত করতেই হয়ে। কিন্তু তার অবজারভেশন কী বলে সেটা জানার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল অন্বেষার। এখন কি মৃত্যুঞ্জয়দা’ র ঘরে ঢোকা ঠিক হবে ? সারা রাস্তা কোনো কথা বলেনি সে। বাড়ি তে এসেও সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। নিশ্চই এই রহস্য নিয়ে চিন্তার গভীর সাগরে ডুবে আছে সে। তাকে কি এই সময় বিরক্ত করা ঠিক হবে ? কিন্তু নিজের মনের ছটফটানিকে  যে কিছুতেই কম করতে পারছে না সে। জীবনে প্রথম বার অন্বেষা কোনো রহস্যের সম্মুখীন হয়েছে। এর শেষ না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। না, আর বসে থাকতে পারলো না সে নিজের ঘরে। বেরিয়ে পড়লো নিজের ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলো।
‘কে  ?’  ভেতর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যরিটোন আওয়াজ ভেসে এলো।
‘ আমি অন্বেষা।’
দরজা খুললো মৃত্যুঞ্জয়। একটা চেয়ারে বসে অন্বেষা বলল -’  অনেক ভাববার চেষ্টা করলাম মৃত্যুঞ্জয়দা। কিন্তু কিছুই মাথায় এলো না। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র রহস্য। যেমন বিচিত্র সে, তেমন বিচিত্র তার চালচলন। কখনও হাত কাটা, কখনও মাথা ফাটা। জানো, এক দিন রাধিকা কী বলছিলো আমায় ?’
মৃত্যুঞ্জয় খাটে বসে ঘাড় হেঁট করে নিজের মোবাইলের দিকে কি সব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ঘাড় হেঁট করেই জিজ্ঞেস করলো -’  কী বলছিলো রাধিকা ?’
‘ বলছিলো যে সে এক দিন নাকি সোনপুর গিয়েছিলো। সেখানে তার মামার বাড়ি। ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। গান্ধী সেতুর ওপর সন্ধ্যের আলো তে হঠাৎ সে প্রতীককে  দেখতে পায়ে। গঙ্গার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো সে। কৌতূহল হয়েছিল রাধিকার। সাথে তার মা – বাবা ছিলো তাই গাড়ি থামিয়ে প্রতীকের সাথে দেখা করতে পারেনি। প্রতীককে  পরে সে জিজ্ঞেস করেছিলো বটে, কিন্তু চিরকালের মতো জবাব দেয়নি প্রতীক।’
এবার মৃত্যুঞ্জয় তাকালো অন্বেষার দিকে।
‘ কী বললে ? গান্ধী সেতু তে ?’
‘ হ্যাঁ।’  অন্বেষা বলল -’  গঙ্গার ওপর একটা ব্রিজ আছে। মহাত্মা গান্ধী সেতু নাম। প্রায় ছ’  কিলোমিটার লম্বা।’
‘ আহাঃ .. সে সব জানি। সেখানে প্রতীক দাঁড়িয়েছিলো ?’
‘ হ্যাঁ।’
অন্বেষা দেখলো মৃত্যুঞ্জয়ের মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। নিশ্চই কিছু একটা ক্লু সে পেয়েছে। কৌতূহলী দৃষ্টি তে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চেয়ে রইল অন্বেষা।
মৃত্যুঞ্জয় উৎসাহের সাথে বলল -’  বুঝে গেছি। চার নম্বর চিরকুটে কী লেখা হতে পারে, সেটা বুঝে গেছি।’
‘ কী ?’  অন্বেষার কৌতূহল ক্রমে বাড়ছে।
নিজের মোবাইলটা খাটে রেখে ঘরময় পায়চারি শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়।
বলল -’  প্রথম চিরকুটে দেয়াল, দ্বিতীয় চিরকুটে বেল্ট, তৃতীয় চিরকুটে ব্লেড, ছুরি আর চতুর্থ চিরকুটে ….’
মৃত্যুঞ্জয় তাকালো অন্বেষার দিকে। অন্বেষা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়ের পানে। অন্বেষার চোখে চোখ রেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  চতুর্থ চিরকুটে জল।’
‘ জল !’  চমকে উঠল অন্বেষা -’  কিন্তু তুমি কী করে শিওর ?’
মৃত্যুঞ্জয় লঘু কদমে অন্বেষার দিকে এগোলো। জ্বলজ্বল করছে তার দুটো চোখ। অন্বেষা যে চেয়ারে বসে, সে চেয়ারের দুটো হাতলে নিজের দুটো হাত রেখে, অন্বেষার দিকে ঝুঁকে এবং নিজের মুখ তার মুখের অত্যন্ত কাছে নিয়ে গিয়ে বলল -’  তুমি হয়তো এটা যেনে অবাক হবে যে প্রতীক নেলসনের শরীরের আঘাতের একমাত্র কারণ প্রতীক নেলসন নিজে।’
‘ মানে ?’  অন্বেষার আশ্চর্য এবার নিজের সীমা লংঘন করলো।
মৃত্যুঞ্জয় পুনরায় শুরু করলো ঘরময় পায়চারি করা।
‘ এটাকে এক ধরনের মানসিক ব্যাধি বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।’  মৃত্যুঞ্জয় বলতে আরম্ভ করলো -’  নিজের ক্ষতি করা, নিজেকে আঘাত দেওয়া এক ধরনের মানসিক রোগ। মেডিকাল সাইন্সে এই রোগের দুটো নাম। প্রথম হলো – সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার, আর দ্বিতীয় নাম হলো – বি পি ডি মানে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার। এই রোগে মানুষে নিজেকে ক্ষতি করে। হয়তো সে এতে আনন্দ পায়ে, হয়তো নিজের শরীরের ব্যথাকে  উপভোগ করে।’
‘ তার মানে তুমি বলতে চাও যে প্রতীক সেই মানসিক রোগে আক্রান্ত ?’  জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ ইয়েস মাই ডিয়ার। প্রতীক বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। সব থেকে বড় কথা হলো সে জানে যে সে এই বীভৎস রোগের শিকার।’
‘ কী করে বুঝলে তুমি যে সে জানে ?’
‘ তার ঘরে মেডিকালের বই দেখে। জানি না কী কারণে সেই বই গুলোকে  সে পুড়িয়ে ফেলেছে। যে বই গুলো প্রতীকের ঘর থেকে আমি পাই, সে গুলো সাধারণত সাইক্রিয়াটিস্টরা পড়ে।’
‘ আর ওই চিরকুট গুলোর মানে ?’  প্রশ্নের পাহাড় জমে আছে অন্বেষার মনে।
‘ ভালো করে ভেবে দেখো অন্বেষা। মানে তুমিও বুঝতে পারবে। প্রথম চিরকুট – এস 1, দেয়াল …. দেয়ালে রক্তেরদাগ। এখানে’  এস’  এর মনে কী ?’  এস’  মানে স্টেপ। পুরো মানে হলো স্টেপ 1, দেয়াল। শরীরে আঘাতের আরম্ভ হয়ে দেয়াল থেকে। দেয়ালে মাথা ঠুকে নিজের কপাল ফাটানো। এস 2, মানে স্টেপ 2 হলো বেল্ট। আমার বিশ্বাস তার শরীরে বিশেষ করে পিঠে বেল্টের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাবে। এস 3, মানে স্টেপ 3 হলো ব্লেড আর ছুরি। হাত কাটা, গাল কাটা এই সব।’
‘ তাহলে স্টেপ 4 রিক্তকে ন ?’
ঈষৎ গম্ভীর হয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  স্টেপ 4 হলো চরম আঘাত। সেই চরম আঘাতটা কী সেটা এখনও হয়তো প্রতীক ঠিক করতে পারেনি। অন্বেষা, নেশা এক অদ্ভুত ফিলিংস। আমরা নেশা করি, সিগারেট, মদ ইত্যাদি। এটাকে তুমি সাধারণ ভাবে চিন্তা করে দেখো। আমরা যখন মদ খেতে শিখি, তখন একটা বা দুটো পেগে আমাদের নেশা হয়ে যেতো। কিন্তু সেই পর্যায় নেশা করতে গেলে আমাদের এখন পাঁচ – ছ কিম্বা সাত – আট পেগও লেগে যায়ে। সিগারেট আমি এক সময় দিনে দুটো কিম্বা তিনটে খেতাম, এখন এক প্যাকেটের বেশি খাই। তার মানে ব্যাপারটা হলো নেশার পরিমান দিনে – দিনে বেড়ে যায়ে। নিজেকে আঘাত করাটা প্রতীকের এক ধরনের নেশা। প্রথমে দেয়ালে মাথা ঠুকে চোট লাগাতো। আসতে – আসতে তাতে তৃপ্তি কমে গেলো। তার পর শুরু হলো বেল্ট দিয়ে নিজের শরীরে প্রহার। কিছু দিন পর এতেও তার মন ভরলো না। নেক্সট হলো ব্লেড, ছুরি ইত্যাদি, ইত্যাদি।’
ভয়ার্ত কন্ঠে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো -’  তাহলে শেষ তৃপ্তি সে কিসে পাবে ?’
‘ ওই যে বললাম, জল। খুব সম্ভব জলের মাধ্যমে প্রতীক যে আঘাতটা পাবে, সেটা হবে তার শেষ এবং চরম তৃপ্তি।’
‘ কিন্তু….কিন্তু প্রতীকের এই অদ্ভুত রোগটা হলোকে ন ?’
‘ সেটা জানার জন্য প্রতীকের অতীতের বিষয় জানা দরকার। তবে বেশ কিছু কারণ হতে পারে সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডারের। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, অতীতে অত্যাধিক টর্চার হওয়া, সম্পর্কেরটানাপোড়ন, এই ধরেনের বেশ কিছু কারণ হতে পারে। এখন প্রতীকের এই রোগ হওয়ার মুখ্য কারণ কী, সেটা এখানে বসে বলা সম্ভব নয়। সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার দু’  রকমের হয়ে। একটা নন্ সুসাইডল সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার এবং সুসাইডল সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার। নন্ সুসাইডল সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার যখন নিজের সীমা লঙ্ঘন করে তখন সেটা সুসাইডলে পরিণত হয়ে। যেমন তোমাকে নেশা বৃদ্ধির উদাহরন দিলাম, ঠিক তেমনই। আশা করি প্রতীকের এখনও এই রোগটা সুসাইডল পর্যন্ত যায়নি।’
কথাটা শেষ করতেই বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল। বিকাশ ফোন করেছে।
‘ হ্যাঁ বলো বিকাশ।’
‘ মৃত্যুঞ্জয়দা, প্রতীক এসেছিলো। সব দেখলো, শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। নো রিয়াকশন। আমি তাকে বললাম যে পুলিশকে  খবর দিতে যাচ্ছি, কিন্তু মানা করলো আমায়। নিজের ঘরে গিয়ে এদিক – ওদিক দেখলো, কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো তার পর বেরিয়ে গেলো।’
‘ কোথায় ?’  উৎকন্ঠায় জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ জানি না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু জবাব দিলো না। এটাই তো ওর প্রবলেম, কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না।’
‘ সাথে কিছু নিয়ে বেরিয়েছে কি ?’
‘ না, কিছুই না। খালি হাতে বেরলো। তবে বেরোবার সময় তার মুখটাকে মন অদ্ভুত ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে, এতো দিন ধরে দেখছি তাকে, কিন্তু এমন মুখ কোনো দিন দেখিনি। ভয় পেলাম, তাই ফোন করলাম তোমায়।’
‘ বিকাশ, আমাদের বাঁচাতে হবে তাকে।’  কথাটা প্রায় চিৎকার করে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ কিন্তুকে মন করে ?’  জিজ্ঞেস করলো বিকাশ।
‘ রাধিকা কোথায় ?’
‘ সে তো নিজের বাড়ি চলে গেছে।’
‘ তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে বলো। তুমি তার কোনো নিয়ারেস্ট পয়েন্টে দেখা করো তার সাথে। তারপর তোমরা গান্ধী সেতুর দিকে রওনাদাও।’
‘ গান্ধী সেতুর দিকে !’  আশ্চর্য হলো বিকাশ।
‘ হ্যাঁ। বেশি প্রশ্ন নয়। তাড়াতাড়ি করো। আমার মনে হয়ে সময় খুব কম আমাদের হাতে।’
কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় ফোন রেখে অন্বেষাকে  বলল -’  অন্বেষা, নিজের স্কুটি বার করো। রাইট নাউ।’
‘ কী হলো ?’  অন্বেষার মুখও ফ্যাকাসে।
‘ বললাম না সময় নেই। হরিআপ।’

সূর্যাস্ত হওয়ার অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। পাটনার রাস্তাঘাট এখন স্ট্রিট লাইটে ঝলমল করছে। অফিস ফেরার সময়, তাই রাস্তায় ভিড় বেশি। স্কুটির চালক সিটে বসে আছে মৃত্যুঞ্জয় এবং তার পেছনে অন্বেষা। গান্ধী সেতুর যাওয়ার রাস্তা অন্বেষা বলে দিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়কে । কখনও স্কুটি আশি কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার গতি নিয়ে তীর বেগে ছুটে যাচ্ছে, তো কখনও কুড়ি কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় নেমে আসছে তার গতি। হঠাৎ পেছন থেকে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো -’  তুমি কি শিওর যে প্রতীক সেখানেই গেছে ?’
‘ একটা অনুমান মাত্র। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। প্রতীক নেলসন হয়তো এটা আন্দাজ করতে পেরেছে যে চোর বিকাশের নয় তার ঘরেই ঢুকেছিলো। আর যে ঢুকেছিলো সে যে আদৌ চোর নয়, সেটাও হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে সে। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে যে তার ক্ষতর সন্ধান করতেইকে উ এই কান্ড করেছে। প্রতীকের সব থেকে আগে সন্দেহ যাওয়া উচিত বিকাশের ওপরে। এবার তাকে বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যেটা সে চায় না। যারা মধ্যপান করে তারা মাঝে – মাঝে নিজের দুঃখ, কষ্ট ভুলবার জন্য অত্যাধিক মদ্যপানের শরণাপন্ন হয়ে। চরম পর্যায় নেশা, চরম পর্যায় তৃপ্তি। যতদূর মনে হয়ে এখানেও চরম পর্যায় তৃপ্তির সময় চলে এসেছে।’
বিকাশের ফোন এলো মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে। মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল অন্বেষার হাতে। অন্বেষা কল রিসিভ করলো। ওপার থেকে বিকাশ বলল -’  আমরা মিঠাপুর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেছি।’
‘ এগিয়ে বাঁ দিকেটার্ন নাও। আমরা সেখানেই আছি।’  অন্বেষা বলল।
স্কুটি দাঁড় করালো মৃত্যুঞ্জয়। বাইপাস রোড এটা। পাশেই বাস স্ট্যান্ড। প্রচুর বাসের যাওয়া – আসা এই রাস্তায়। গান্ধী সেতু পাটনা থেকে শুরু করে হাজীপুর পর্যন্ত চলে গেছে। গঙ্গা নদীর ওপর প্রায় ছ’  কিলোমিটার লম্বা এই ব্রিজ সাউথ ও নর্থ বিহারকে  এক করার মুখ্য পথ। মহাত্মা গান্ধী সেতুর থেকে আর বেশি দূর নেই তারা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিকাশ ও রাধিকা সেখানে যথাস্থানে পৌঁছালো। সবাই মিলে এক সাথে এগোলো এবার।
‘ কী ব্যাপার মৃত্যুঞ্জয়দা ? হঠাৎ আমাদের এখানে ডাকলে ?’  মৃত্যুঞ্জয়কে  জিজ্ঞেস করলো বিকাশ।
‘ প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারবে তাই ডাকলাম।’ মৃত্যুঞ্জয় জবাব দিলো।
‘ সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু এখানেইকে ন ?’
‘ যদি আমার অনুমান ঠিক থাকে তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবে।’

বেশিক্ষণ লাগলো না তাদের মহাত্মা গান্ধী সেতু পৌঁছাতে। তীর বেগে সেতুর ওপরে উঠল তাদের দু’  চাকা। খানিক এগোতেই তারা দেখতে পেলো ব্রিজের রেলিংএর ধারে মাথানত করেকে উ দাঁড়িয়ে আছে। পরনের জামাকাপড়ে তাকে চিন্তে পেলো প্রত্যেকে। সে আসতে – আসতে রেলিংএর গায়ে পা দিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে।
‘ প্রতীক….প্রতীক ….!’  চিৎকার করলো বিকাশ। কিন্তু গাড়ির আওয়াজে দেবে গেলো বিকাশের চিৎকার। স্কুটির গতি অনেক কমিয়ে দিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়।
‘ না, চিৎকার করে লাভ নেই।’  বিকাশকে  কথাটা বলেই স্কুটির গতি আরও অল্প করলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষাকে  বলল -’  অন্বেষা, আমি স্কুটি থামতেই নেমে যাবো। স্কুটি তুমি হ্যান্ডেল করবে।’
‘ ঠিক আছে।’  অন্বেষা একমত।
যেমন কথা তেমন কাজ। স্কুটি থেকে নেমে হেলমেট খুলে অন্বেষার হাতে দিয়েই মৃত্যুঞ্জয় দৌড় দিলো প্রতীকের দিকে। ততক্ষণে প্রতীক রেলিংএর প্রায় অনেকটাই চড়ে গেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের পেছন – পেছন অন্বেষা, বিকাশ ও রাধিকাও সে দিকে দৌড় দিলো। জলে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ তাদের কানে এলো। গাড়ির ও হর্নের শব্দের দরুণ খুব ক্ষীণ আওয়াজ এলো তাদের কানে। জলে ঝাঁপ দেওয়ার শুরু তে একটা শব্দ, কিছু সেকেন্ড পরেই তাদের কানে আরও এক শব্দ এলো।
‘ মৃত্যুঞ্জয়দা !’  গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়লো অন্বেষা।

পর্ব – ৯ ( শেষ পর্ব ) 
………………………………

প্রতীকের জলে ঝাঁপ দেওয়ার কিছু সেকেন্ড পরেই ঝাঁপ দিলো মৃত্যুঞ্জয়। দৃশ্যটা এখনও চোখের সামনে ভাসছে অন্বেষার। মৃত্যুঞ্জয়ের নাম ধরে চিৎকার করে দিতে দ্রুত বেগে ছুটে গেলো সে। গঙ্গা নদী থেকে প্রায় চল্লিশ ফিটের উচ্চতা ব্রিজের। নিচে ঝাঁপ দিলে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই অল্প। মৃত্যুঞ্জয়কে  ঝাঁপ দিতে দেখে চোখে প্রায় অন্ধকার দেখছিলো অন্বেষা। ব্রিজের ওপর থেকে অন্বেষা দেখতে পেলো, জলে পাগলের মতো হাত – পা ছুঁড়ছে মৃত্যুঞ্জয়। বিকাশ বুঝতে পারলো সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। কিছু একটা শেষ চেষ্টা তাকে করতেই হবে। অন্বেষার অবস্থা যে ভালো নয় সেটা বুঝতে পেরেছিলো বিকাশ। রাধিকাকে  সে বলল -’  তোমাকেই সামলাতে হবে একে। আর এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলে কিছু হবে না। স্কুটি আর বাইক এখানেই থাক। যা হবে দেখা যাবে। আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। তাড়াতাড়ি করো, হাতে সময় খুব কম।’
ব্রিজের মুখেই সিঁড়ি। সেটা দিয়ে নিচে নেমে এলো তারা। উর্ধশ্বাসে ছুটে চলল গঙ্গার ঘাটের দিকে। ঘাটটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। যখন তারা ঘাটে পৌঁছালো দেখতে পেলো তিনটে লোক মিলে এক অচেতন ব্যক্তিকে  ধরে বেঁধে ঘাটে নিয়ে আসছে। অচেতন ব্যক্তির সংখ্যা এক, বুকটা কেঁপে উঠল অন্বেষার।কে  সেই অচেতন লোকটা ? প্রতীক, নাকি মৃত্যুঞ্জয় ? যারা তাকে ধরে বেঁধে তুলে নিয়ে আসছে, তারা নিশ্চই মাঝি। হৃদস্পন্দন ক্রমে বাড়ছিল অন্বেষার। অচেতন অবস্থার লোকটা বেঁচে আছে তো ? ঘাটের পাশে এক গাছের নিচে তাকে শুইয়ে দেওয়া হলো। বিকাশ ও রাধিকা লঘু কদমে সে দিকে এগিয়ে গেলো। এগোতে পারেনি অন্বেষা। আতঙ্কে তার পা যেন পাথরের ন্যায় এক জায়গায় স্থির হয়ে গিয়েছিলো। মাঝিরা নিজেদের মধ্যে কি সব কথা বলছিলো। অন্বেষার সাথে তাদের দূরত্ব খুব একটা বেশি ছিলো না, তাও অন্বেষার মনে হলো যেন তাদের কথা বহু দূর থেকে কানে ভেসে আসছে। হঠাৎ বিকাশের গলা শুতে পেলো সে।
‘অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে।’
মাঝিদের মধ্যে এক জন বলল -’  আপনাদের লোক ? নিয়ে যান বাবু। আর পারি না আমরা। রোজ – রোজকে উ নাকে উ জলে ঝাঁপ দেবে আর আমরা বাঁচাতে দৌড়াব। কী করবো ? চুপচাপ বসে থাকতেও পারি না। মনুষত্ব বলে একটা জিনিস আছে তো।’
কথাটাটা বলে সে উল্টো দিকে চলে গেলো। অন্বেষা দেখলো, আরেকটা মাঝি তার সঙ্গ নিয়ে এগিয়ে গেলো তার সাথে। রাতের অন্ধকারের কারণে কারুর চেহারাই স্পষ্ট দেখতে পেলো না অন্বেষা। কিন্তু, মাঝি তো তিন জন ছিলো। ফিরে গেলো দু’  জন। আরেক জন কোথায় ? অন্বেষা দেখলো, রাধিকা এগিয়ে আসছে তার দিকে। তার কাছে এসে রাধিকা বলল -’  বিকাশ অ্যাম্বুলেন্সকে  ফোন করেছে।’
‘ ক….ক….কে এটা ?’  কোনো ক্রমে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
‘ প্রতীক। মাথা নাকি ফেটে গেছে। অনেক রক্ত বেরিয়েছে। আমি কাছে গিয়ে দেখিনি, বিকাশ বলল।’
রাধিকার জবাবে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল অন্বেষার। প্রতীককে  পাওয়া গেলো, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় কোথায় ? মৃত্যুঞ্জয়কে  কি পাওয়া গেলো না। গলা শুকিয়ে গেলো অন্বেষার। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিলো তার। হঠাৎ নিজের পেছন থেকে সেই চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সে।
‘ চেষ্টাটা অবশেষে সফল হলো। কি বলো, অন্বেষা।’
পেছনে ফিরতেই আতঙ্ক আর খুশি মিশে একাকার হয়ে গেলো অন্বেষার হৃদয়ে। অনেক চেষ্টা করেও নিজের চোখের জল সে আটকে রাখতে পারলো না। ছুটে গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। অন্বেষার এহেন অবস্থা দেখে মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল -’  তোমার কী মনে হলো, আমি গেলাম ? না অন্বেষা, মৃত্যুঞ্জয় এতো সহজে যাবে না।’

দুপুর বেলা। এক বেসরকারী হাসপাতালের আই সি ইউকে বিনের সামনে বসে আছে অন্বেষা, রাধিকা, বিকাশ ও মৃত্যুঞ্জয়। খানিক আগেই ডক্টর এসে বলে গেছেন যে প্রতীক ইজ কমপ্লিটলি আউট অফ ডেঞ্জার। কিন্তু এখনও জ্ঞান ফেরেনি তার। মাথার পেছনে লেগেছিলো অল্প আঘাত। সেই থেকে নিজের জ্ঞান হারিয়েছে সে। ব্রেন স্ক্যান করা হয়েছে। রিপোর্ট নর্মাল। ডক্টরের বিশ্বাস কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের জ্ঞান ফিরে পাবে প্রতীক নেলসন। তা ছাড়া কপালে মোট দশটা স্টিচ লেগেছে তার। ভেঙ্গেছে ডান পাটাও। মৃত্যুঞ্জয়ের যে আঘাত লাগেনি তা নয়। কপালে অল্প আঘাতের সাথে – সাথে বাঁ হাত ভেঙ্গেছে তার।
‘ এতো উঁচু থেকে ঝাঁপ দেওয়ার পর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা যে খুব কমে যায় সেটা আর বলে দিতে হয়ে না। আমার মনে হয়েছিল যে প্রতীক হয়তো সাঁতার জানে না। সাঁতার জানলে সে জলে ঝাঁপ দিতো না। মৃত্যুকে  সামনে দেখে অজান্তেই তার হাত – পা চলতে শুরু করতো। শেষ তৃপ্তি সে আর পেতো না। প্রতীককে  বাঁচাবার আমার কাছে একটাই উপায় ছিলো। প্রতীকের সাথে – সাথে জলে ঝাঁপ দেওয়া। আমি তাই করলাম। আমি যদি অল্প দেরি করতাম, তাহলে প্রতীককে  জীবিত অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসা হয়তো সম্ভব হতো না।’  হাসপাতালে বসে কথাটা বলল মৃত্যুঞ্জয়।
‘ এমন করো না মৃত্যুঞ্জয়দা। তোমাকে ওই ভাবে ঝাঁপ দিতে দেখে আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল, সেটা শুধু আমি জানি।’  বলল অন্বেষা।
‘ এতো ভয় পেলে চলে না, সোনা আমার। তদন্ত করতে গেলে অনেক বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়ে। তার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার।’
হাসপাতালে পুলিশ এসেছিলো। মৃত্যুঞ্জয় কথা বলল তাদের সাথে। মৃত্যুঞ্জয় জানে পুলিশের সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয়ে। পুলিশকে  ম্যানেজ করতে খুব ভালো পারে সে। মৃত্যুঞ্জয়ের ফিরে আসার পর আই সি ইউ’ র সামনে রাখা এক বেঞ্চির দিকে এগিয়া গেলো অন্বেষা। এক বৃদ্ধপ্রায় লোক মাথা হেঁট করে সেখানে বসে আছে। তার কাঁধে হাত রেখে অন্বেষা বলল -’  আপনি উঠুন, মিস্টার নেলসন। চলুন আমার বাড়ি। স্নান করে কিছু খেয়ে বরং রেস্ট নিন আপনি। আপনার শরীরটাও তো ভালো দেখছি না।’
…………………………………………………………..
প্রতীক নেলসনের অতীত 
…………………………………………..

সন্ধ্যে বেলায় বাড়ির ছাদে বসে আছে তারা। মৃত্যুঞ্জয়, অন্বেষা এবং প্রতীক নেলসনের বাবা জোসেফ নেলসন। রাধিকা নিজের বাড়ি তে। প্রতীকের সাথে হাসপাতালে আছে বিকাশ পান্ডে। কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতাল থেকে খবর এসেছে যে প্রতীকের জ্ঞান ফিরেছে। বিকাশকে  চিনতে পেরেছে সে। এখন অনেকটাই সুস্থ প্রতীক।
বাড়ির ছাদে তিনটে চেয়ারে বসে আছে তিন জানে। সামনে একটা ছোট্ট গোল সেন্টার টেবিল। চায়ের সরঞ্জাম তাকে। মৃত্যুঞ্জয় এবং প্রতীক নেলসনের হাতে চা দিয়ে নিজের চায়ের কাপটা উঠিয়ে নিলো অন্বেষা। মিস্টার জোসেফ নেলসনের বয়স ষাটের ওপরে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ছোট – ছোট চোখ গুলো যেন ভেতরে ঢুকে গেছে। এক মুখ খোঁচা – খোঁচাদাড়ি – গোঁফ। মৃত্যুঞ্জয় এবং অন্বেষা সেই আধ ছেঁড়া ছবিটার সাথে সামনে বসা ভদ্রলোকের মুখশ্রী মেলাবার চেষ্টা করছে। অল্পবিস্তর মিল যে আছে সেটা বলাই বাহুল্য। চায়ে দু’  চুমুক দিয়ে মিস্টার নেলসন বলতে শুরু করলেন -’  প্রতীকের এই অবস্থার পেছেনেদায় একমাত্র আমি। আসলে প্রতীক আমার নিজের ছেলে না, সৎ ছেলে আমার। প্রতীকের মা, মানে কান্তা মিশ্রা আমাদের স্কুলেই কাজ করতো। বিধবা। আমি তখন যাকে বলা হয়ে ইয়াং। কান্তা দেখতে সুন্দরী ছিলো। যা হয়ে আরকি। প্রেমে পড়লাম তার। জানতাম আমি খ্রিস্টান সে হিন্দু। বাড়ি তে ঝামেলা হবেই। সে সব ঝামেলাকে  হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা ছিলো আমার মধ্যে। আসল ঝামেলার সৃষ্টি করলো কান্তা নিজে। আমাকে এক দিন সে বলল যে তার নাকি দু’  বছরের একটা ছেলে আছে। আমি সেটা জানতাম। কোনো আপত্তি ছিলো না আমার। কিন্তু কান্তা একটা শর্ত রাখলো। আমি যেন বিয়ের পর তার থেকে কোনো বাচ্চার আশা না রাখি। তার ভয় ছিলো যে আমার নিজের সন্তান হয়ে গেলে তার ছেলেকে  আমি ভালোবাসবো না। হাজার হোক, নিজের রক্ত তো নিজের রক্তই হয়ে। তখন আমি কান্তাকে  পাওয়ার জন্য মরিয়া। তার সব শর্ত মেনে নিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পর তাকে মানিয়ে নেবো। কিন্তু আমার ভাবনাকে  ভুল প্রমাণিত করলো কান্তা। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক পাও এদিক থেকে ওদিক হলো না সে। কতো দিন, আর কতো দিন সহ্য করতাম আমি ? তখন রাগ হতো, নিজের ওপর, নিজের ভাগ্যের ওপর।কে ন,কে ন এতো মেয়ে থাকতে আমি কান্তাকে ই বিয়ে করলাম। আসতে – আসতে কান্তার ছেলে প্রতীক আমার ঘৃণার পত্র হয়ে গেলো। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে মা – বেটাকে  মারধর করতাম। বিয়ের চার বছর পর কান্তা চলে গেলো আমাকে আর নিজের ছেলেকে  ফেলে রেখে। তখন ভেবেছিলাম প্রতীককে  কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসবো। কিন্তু সমাজের ভয় সেটা করনি। আমি আবার বিয়ে করলাম। প্রতীক প্রথমে সৎ বাপ পেয়েছিল, এবার সৎ মা পেলো। অত্যাচারের সীমা থাকলো না তার ওপর। মাঝে – মাঝে মায়া যে হতো না আমার তা নয়। প্রতীকের যখন আট বছর বয়স তখন তাকে আমি বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে আসি। প্রতীকের খরচ আর সংসারের খরচ। চাপ বাড়তে থাকে আমার ওপর। স্ত্রীর সাথে রোজ অশান্তি। আমার নিজের ছেলে পিটারও বড় হচ্ছিলো। তার পেছনে খরচ করা বেশি বাঞ্ছনীয় মনে করলাম আমি।’
খানিক থামলেন মিস্টার নেলসন। চায় আরও দু’  চুমুক দিয়ে বললেন -’  ছোট থেকেই প্রতীকের মধ্যে একটা অদ্ভুত গুণ দেখেছিলাম। আমার কাছে বেধড়ক মার খাওয়ার পর নিজের ঘায়ে সে নিজেই মলম লাগতো। কারুর সাহায্য নিতো না সে। মার খাওয়া নিজের নিয়তি ভেবে নিয়েছিল সে। প্রতীক জানতো তার মায়ের মারা যাওয়ার পর আরকে উ নেই যে তার শরীরের ঘায়ে মলম লাগবে। হঠাৎ একদিন প্রতীকের বোর্ডিং স্কুল থেকে ফোন আসে। সে নাকি নিজের শরীরে নিজেই আঘাত দেয়। আমি ছুটে গেলাম সেখানে। ডক্টর দেখানো হলো। বেশ কিছু মাস তার চিকিৎসা চলল। প্রতীককে  বেশ কিছু মাস নিজের সাথে রাখলাম। নিজের স্ত্রীকে  আমি বলে দিয়েছিলাম যে সে যদি প্রতীককে  ভুলেও কিছু বলে তাহলে আমার থেকে খারাপকে উ হবে না। আমার স্ত্রী রাগ করে বাড়ি ছেড়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে গেলো, নিজের ছেলেকে  নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয় বাবু, সত্যি বলতে প্রতীক আমারকে উ না। কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই তার সাথে। মানছি যে আমি তাকে মারধর করেছি, টর্চার করেছি তাকে। কিন্তু আগলে রাখারও তো চেষ্টা করেছি। আমার বদলে অন্যকে উ হলে করতো কি ? মনে তো হয়ে না করতো। প্রতীক সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো। বেশ ভালোই ছিলো সে। যতোটা সম্ভব তাকে ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনি সেটাকে  আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করাও বলতে পারেন। কিছু যায় আসে না আমার। হ্যাঁ, আমি ছোট্ট, নির্বোধ শিশুর ওপরে নিজের দুঃখে, আক্রোশে অত্যাচার করেছি। সেটারই প্রায়শ্চিত্ত করছিলাম আমি। প্রতীক মেডিকাল পড়তে চেয়েছিলো। পরীক্ষা তে বসলো। পাস হয়ে গেলো। পি এম সি এইচ, মানে পাটনা মেডিকাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে তার অ্যাডমিশন হলো। ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনা তে ভালো ছিলো। কলেজেও খুব নাম করলো। সেখানকার প্রফেসররা তার এক্সট্রা অর্ডেনরি ট্যালেন্ট দেখে আশ্চর্য হতো। আসলে ছোট বেলা থেকে নিজের চিকিৎসা নিজেই করতে শিখেছিলো সে, সেটাই মেডিকাল কলেজে কাজে এলো। কিন্তু….কিন্তু আমি আর পারলাম না, মৃত্যুঞ্জয় বাবু। আমি আর পারলাম না খরচা চালাতে। আমার নিজের ছেলের পেছনে দিনে – দিনে খরচ বাড়ছিলো। প্রতীকের মেডিকাল পড়ার জন্য আমি ব্যাংক থেকে লোন নিনি। পাছে যদি লোনেরটাকা দিতে না পারি। প্রতীককে  দু’  বছর মেডিকাল পড়াতে পেরেছিলাম। এই দু’  বছরে খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিলো সে। তার পর থেকে আবার তার মধ্যে পরিবর্তন দেখলাম। বেশ কিছু দিন সে বাড়ি তে থাকলো। সারা দিন গুম হয়ে থাকতো। কারুর সাথে কথা বলতো না। সত্যি বলতে আমাকে ঘৃণা করতো সে। হঠাৎ এক দিন আমায় বলল যে সে পাটনা তে থেকে চাকরী করতে চায়। পাটনাতেই বাড়ি ভাড়া করে থাকবে। আমি আর বাধা দিলাম না তাকে। প্রতীক চলে গেলো পাটনা। প্রায় দু’  বছর হলো সে পাটনাতেই আছে। শুরু – শুরু তে তার সাথে যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু আসতে – আসতে সেটাও শেষ হয়ে গেলো। ফোন করলে ফোন তুলতো না সে। কালেভদ্রে যদি কোনো দিন ফোন তুলতো তো এক মিনিটের বেশি কথা বলতো না। শুনেছিলাম যে সে জব চেঞ্জ করেছে’  বাড়ি চেঞ্জ করেছে। তার নতুন অফিস আর বাড়ির ঠিকানা আমি জানতাম না। এক দিন তাকে ফোন করলাম, লাগলো না। বেশ কিছু দিন তাকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। বুঝে গেলাম যে সে হয়তো নিজের ফোন নম্বর চেঞ্জ করেছে। আমাকে দিতে চায় না নিজের নতুন নম্বর। রাগ হলো তার ওপর। এতো করার পরেও এই ব্যবহার ? পরের সন্তান পরেরই হয়ে। তাকে নিজের নাম দিয়েছি, আমার কেউ ছিলো না সে, তাও সারা জীবন আগলে রেখেছি। না, এই দুর্ব্যবহার আমার সহ্য হলো না। রাগে দুঃখে আমিও তার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করলাম। সে কোথায় আছে, কী করছে, জানবার কোনো চেষ্টাই করলাম না আমি। পাটনা তে আমার অনেক পরিচিতি আছে। ইচ্ছে হলেই তার খোঁজ খবর নিতে পারতাম। কিন্তু নিলাম না। প্রায় আট মাস ধরে তার কোনো খবর নেই আমার কাছে। হঠাৎ আজ সকালে আপনি আমার বাড়ি তে এসে বললেন যে প্রতীকের এই অবস্থা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মৃত্যুঞ্জয় বাবু, অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিলেন।’
শেষ কথাটা বৃদ্ধ দু’  হাত জোর করে মৃত্যুঞ্জয়কে  বললেন। তাঁর দু’  চোখ বেয়ে বেরিয়ে এসেছিলো অশ্রুধারা।
প্রতীকের অতীতের বর্ণনা করে মিস্টার নেলসন নিচে চলে গেলেন। মৃত্যুঞ্জয় একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্বেষাকে  বলল -’  শেষ আট মাস ধরে প্রতীক মিস্টার নেলসনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। খুব সম্ভব তখন থেকেই এই রোগটা আবার তাকে আক্রমণ করেছিলো।’
খানিক চুপ থাকার পর অন্বেষা বলল -’  এই কাপ গুলো নিচে রেখে আসি মৃত্যুঞ্জয়দা। তুমি এখানেই থেকো, যেও না কোথাও।’
অন্বেষা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে নিচে চলে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় ছাদময় পায়চারি শুরু করলো। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। আশেপাশের বাড়ি গুলো তে বাতি জ্বলে গেছে সেটা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। ছাদের দরজার ঠিক ওপরে একটা বাতি ছিলো, সেটা জ্বালিয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষা হাসিমুখে ছাদে ফিরে এলো। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো তার হাতে একটা লিপস্টিক।
‘ হঠাৎ লিপস্টিককে ন ?’  জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
‘ কী করবো ? অনেক খুঁজেও মার্কার পেলাম না যে। তাই অগত্যা এটাই আনতে হলো।’
‘ কী করবে এখন লিপস্টিক দিয়ে ?’
‘ বলছি। নিজের বাঁ হাতটাদাও।’
মৃত্যুঞ্জয়ের বাঁ হাতটা নিজের বাঁ হাতের ওপর রাখলো অন্বেষা। সাদা প্লাস্টার মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। নিজের লাল লিপস্টিক দিয়ে সাদা প্লাস্টারের ওপর অন্বেষা লিখলো -’  গেট ওয়েল সুন, মৃত্যুঞ্জয়দা।’
মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল -’  মৃত্যুঞ্জয়দা, ইউ আর জিনিয়াস।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three + 14 =