গোবরে পদ্ম
তনুপ্রিয়া চক্রবর্তী, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##
বিগত কয়েক মাস ধরে চলা চাতক তুল্য প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো ১০ই আগস্ট। চিরকালের প্রিয় বান্ধবীর পরিবারবর্গ ও আমার পরিবার মিলিয়ে মোট ৮ জন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বেরিয়ে পড়লাম জি-প্লট অর্থাৎ গোবর্ধনপুরের উদ্দেশ্যে। গোবরডাঙা থেকে গোবর্ধনপুরে পৌঁছনোর যাত্রাপথ বেশ যান-বৈচিত্র্যে ভরপুর আর হবে নাই বা কেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বীপ এটি। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ৭.১৪ এর লক্ষীকান্তপুর লোকাল ধরে শুরু হল আমাদের যাত্রা। পৌনে দুই ঘন্টার ট্রেন জার্নির পর লক্ষীকান্তপুর থেকে আমরা একটা নতুন (অন্তত আমার কাছে নতুন) যানবাহনে চড়ে বসলাম যার নাম জিও গাড়ি। সেই গাড়ি জিওর স্পিডকে অনুকরণে কিঞ্চিৎ সফল হয়েছে বটে তবে তা উন্নত যন্ত্রপাতির কারণে নয় বরং ক্ষয়ে যাওয়া ফাঁপা দেহের কারণে। যাই হোক, লাগেজ সহ আট জন মানুষে বোঝাই হয়ে ছুটে চলল জিও গাড়ি। ব্রেকফাস্ট সারা, গল্প গুজব আর দুই পাশের জানলা দিয়ে উঁকি মারা সবুজ বন্ধুদের শোভা দেখতে দেখতে কেটে গেল ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের পথ, আমরা এসে পৌঁছলাম রাম-গঙ্গা ঘাটে।
আধ ঘন্টা অপেক্ষার পর একটি ভটভটি নৌকায় চেপে আমরা রওনা দিলাম চাঁদমারি ঘাটের উদ্দেশ্যে। সবুজাভ জলের শান্ত দুলুনি, দুই পাশের ম্যানগ্ৰোভ অরন্য আর নীল আকাশের সাদা মেঘরাশি একটু একটু করে তৃষ্ণাবারি সঞ্চার করছিল আমাদের ভ্রমন পিপাসু হৃদয়ে। সওয়া এক ঘন্টা পরে আমরা পৌঁছলাম চাঁদমারি ঘাটে, সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মোটর ভ্যান। ভ্যানে চাপতেই শুরু হল মজার পালা; এর আগে যতবারই মোটর ভ্যানে চেপেছি বিশেষ ভালো লাগেনি, কিন্তু এই ভ্যান আমার এতদিনের দেখা মোটর ভ্যানের চেয়ে আকারে বড় আর মাথায় ছাউনি দেওয়া। লাগেজ পত্র মঝখানে রেখেও আট জন মানুষ চারপাশ দিয়ে বেশ স্বস্তিতে বসে গেলাম। মসৃণ পিচের রাস্তা দিয়ে চললাম আমরা দুই পাশে গাছে ঘেরা ঘন ছায়াপথ দিয়ে। চারিদিকে অজস্র জলাভূমি, মাছের ভেড়ি, চিংড়ি মাছের চাষ দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম আমরা।
১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট বাদে আমরা হাজির হলাম আগে থেকে বুক করা হোম স্টেতে। পেটে তখন চলছে ক্ষিদের হামলা; কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লাম খাওয়ার টেবিলে। বেশি না, ডাল, আলু ভাজা,পুঁইশাক চচ্চড়ি, চিংড়ির তরকারি আর নদীর ট্যাঙরা মাছের কালিয়া দিয়ে দুপুরের পেটপুজো সম্পন্ন হল। তারপর সমুদ্রে নামার পরিবর্তে আমাদের কুটিরের পাশেই টলটলে পুকুরে আমরা নেমে পড়লাম কোমরে গামছা বেঁধে। খানিক দাপাদাপি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রের সন্ধানে। সে এক কান্ড বটে, দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি,গর্জন শুনতে পাচ্ছি অথচ কোনো পথ দিয়েই কাছে আর পৌঁছে উঠতে পারছি না; মনটাই দমে গেল, শেষে কি পুকুরে দুটো ডুব দিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে হবে! স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেই বলে, “ইদিকেও সমুদ্র সেদিকেও সমুদ্র।” সবদিকে গেলেই সমুদ্র কিন্তু আমরা খুঁজে ফিরছি খ্যাপার মত। অবশেষে পেলাম দুটি ছোট্ট বন্ধু – অর্চিতা আর প্রীতিকা। ওরা আমাদের নির্দিষ্ট পথে পৌঁছে দিল সমুদ্রের পাড়ে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম এই নির্জন সমুদ্র, তার বালুতট ও চারপাশের অপরূপ শোভা দেখে। সূর্যি মামা বিদায়ের আগে শেষ সম্ভাষণটুকু রেখে গেলেন আকাশ আর সমুদ্রের কাছে।
সন্ধের পর কুটিরে ফিরে পেঁয়াজি-মুড়ি সহযোগে চলল আড্ডা আর রাতে মুরগির ঝোল দিয়ে নৈশভোজ সারা হল। যাদের তত্ত্বাবধানে আমরা ছিলাম তারা এতটাই ঘরোয়া রান্না করছিলেন যে “তেল কম দেবেন, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দেবেন না” এসব আমাদের বলতেই লাগল না। পরেরদিন ভোর থেকেই আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিলাম সমুদ্র ও তার সৌন্দর্য উপভোগে। গোবর্ধনপুরের সমুদ্রে বালি ও কাদার প্রকোপ বেশ কম, তাই সমুদ্র-স্নান বেশ উপভোগ্য হল।
দুপুরে নানা রকম সুস্বাদু খাবারের সাথে দেশি কাঁকড়ার তরকারি খেয়ে একেবারে আপ্লুত হয়ে গেলাম। সন্ধ্যায় সমুদ্র-শোভা পান করে ঘরে ফেরার পথে অন্য এক চমক তৈরি ছিল আমাদের জন্যে; আমার শিল্পী বান্ধবী ও তার শিল্পী পরিবারবর্গের সুবাদে আমরা এমন এক মানুষের সন্ধান পেলাম যিনি মৎস্যজীবী থেকে প্রত্মতত্ত্ববিদে পরিনত হয়েছেন এবং তৈরী করেছেন এক সংগ্ৰহশালা যা পাল্টে দিয়েছে সুন্দরবন সম্পর্কে আমাদের জানা সমস্ত চিরাচরিত ধারণা। খবর পাওয়া মাত্রই আমরা ছুটলাম তাঁর বাড়ি। গিয়ে যা দেখলাম তাতে তো চক্ষু ছানা বড়া আর যা শুনলাম তাতে ঐ বিশ্বজিৎ সাউ নামক ভদ্রলোকের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।
গত ৩২ বছর ধরে ক্লাস ফোর পাশ এই মানুষটি সুন্দরবন অঞ্চল থেকে মাছ ধরা ও মাটি কাটার সুবাদে পেয়েছেন নানা ঐতিহাসিক জিনিসপত্র ও নগর সভ্যতার নিদর্শন। শুধু সেখানেই থেমে না থেকে তিনি প্রতিটি জিনিসের ইতিহাস জেনেছেন, বুঝেছেন ও পর্যালোচনা করেছেন। ২০১৫ সালে ‘টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া’ সহ ‘বিজনেস টাইমস্’ এবং ‘আর্থ জার্নাল’ এ বিভিন্ন আর্টিকেল বেরিয়েছে তাঁকে ও তাঁর সংগ্ৰহকে নিয়ে। প্রতিদিনই ইতিহাসের অধ্যাপক, পি.এইচ.ডির ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সমৃদ্ধ করছেন নিজেদের পড়াশোনা আর তার সাথেই চলছে জ্ঞানের আদানপ্রদান। বিশ্বজিৎ বাবুও স্বীকার করলেন যে তিনিও সমৃদ্ধ হচ্ছেন এর ফলে; কিন্তু সেই সমৃদ্ধি শুধুই জ্ঞানের, অর্থের নয়।
পর্যাপ্ত স্থান, আলমারি কিছুই নেই ওনার কাছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি নতুন আলমারি দিয়েছে বটে কিন্তু তা ওনার সংগ্ৰহের পরিমাণ অনুযায়ী কিছুই নয়। ওনার স্ত্রীর গলা থেকে ঝরে পড়ল সংসার চালানোর যন্ত্রনার কথা। তবুও দমে নেই সেই ঐতিহাসিক, বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন সংগ্ৰহশালা আর নিজের হাতে লিখছেন সুন্দরবনের ইতিহাস। ওনার মূল প্রামাণ্য বিষয় হল, সুন্দরবন নেহাতই নদীর পলি-বালি দ্বারা গড়ে ওঠা ব-দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত কোনো জায়গা নয়, সুন্দরবনের পলি-বালির নীচে চাপা পড়ে আছে হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক কোনো সভ্যতা যা এক সময় ছিল উর্বর ও উন্নত আর এর সপক্ষে যথার্থ প্রমাণ ও তিনি যোগাড় করেছেন। আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সেমিনারে বক্তব্য রাখার ডাক পান উনি কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবে স্থায়ী ভাবে কোনো উচ্চপদে থাকার অধিকার ওনার নেই। আজও ওনার পেশা মাটি কাটা ও মাছ ধরা। ফিরে আসার তাড়া থাকায় ওনার সাথে দুই ঘন্টার আলাপেই আমাদের ক্ষান্ত হতে হল,আরও অনেক কিছু ওনার কাছ থেকে না জেনেই চলে আসার অতৃপ্তি নিয়ে আমরা ফিরলাম।
১২ই আগস্ট দুপুরে টাটকা ইলিশ মাছের ঝাল খেয়ে দেড়টার খেয়া ধরে শুরু করলাম আমরা ফিরতি যাত্রা। নদী, মাঠ, জলা ভূমির মধ্যে জেগে থাকা নরম কাদা-লেপা বাড়ি গুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম ওরা কেন পায়নি নীল-সাদা সরকারি পাকা বাড়ি? পরক্ষণেই ভাবলাম আরও অনেক কিছুই পায়না বলেই হয়তো ওদের রান্না তরকারি, ওদের ফোটানো দুধসর চালে অত্ত স্বাদ। ওরা তো গরিব নয়! তাই তো সমুদ্রের গ্ৰাসে ঘর খোয়ানো ফুচকা-দিদার মুখে নেই কোনো অভিযোগ, নেই কোনো হতাশা; বাড়ির উঠোনের শাক-পাতা, ঢ্যাঁড়শ, সবজি আর পুকুরের মাছের অনিশ্চিত লভ্যতা দিয়েই ভাত খাচ্ছে চেটেপুটে, তাই তো উদয় থেকে অস্ত মাঠে-উঠোনে-বাড়ির চালে কাজ করা পুরুষ ও মহিলা সকলের মুখে দিনের শেষে লেগে রয়েছে অমলিন হাসি। গরিব তো আসলে আমরা যারা অনেক অনেক পাই আর তাই মাঝে-মধ্যেই ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে ছুটে যাই ওদের কাছে; একটু দম নেবো বলে, মনের মলিনতা মুছব বলে।