তাল কুড়োনো ভূত
গোপাল মিস্ত্রি ##
কার যেন ফিসফিস কথা শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল ইন্দ্রর। বিছানায় শুয়েই বোঝার চেষ্টা করল কে কথা বলল, কোথা থেকে বলল। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না। দরজা বন্ধ করেই ঘুমিয়েছিল সে। আর দোতলায় পূব ধারের এই ঘরটায় তো সে একাই ঘুমোয়। অতএব ঘরের মধ্যে কেউ হবে না। নির্ঘাৎ বাইরে কেউ কথা বলছে।
প্রচণ্ড গুমোট। এবার শ্রাবণের শেষে ভালো বৃষ্টি হয়নি, তাই ভাদ্রের শুরুতে গরমটা যেন বেশিই। ঘামে ইন্দ্রর বালিশ বিছানা ভিজে গেছে। উঠে অন্ধকারেই মশারির বাইরে বেরিয়ে এল সে। এই ফিসফিস কথাটার রহস্য ভেদ করতে হবে। পরানপুরে বিজলিবাতি নেই। দোতলার টানা বারান্দায় একটা লণ্ঠন ঝোলানো আছে। তার আলো এ ঘরে আসে না। কত রাত জানা নেই, তবে ইন্দ্র বুঝতে পারল সকাল হতে এখনও ঢের দেরি। পূবের খোলা জানলা দিয়ে উঁকি দিল। বাইরে বালি বালি জ্যোৎস্না। মাঝরাতেই মনে হয় চাঁদ উঠেছে।
এপাশে নীচেই মাটির রাস্তা। হঠাৎ নজরে পড়ল, বাড়ির কোণের দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন কথা বলছে। কার সাথে কথা বলছে লোকটা? আর তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কী কথা বলছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। লোকটা ওখানে করছেই বা কী? ‘কে ওখানে’ বলে ডাকতে গিয়েও ডাকল না ইন্দ্র। চোরই হবে মনে হয়। তার চেয়ে বরং বাইরে বেরিয়ে দেখা যাক। ওকে ধরতে হবে। এই ভেবে সে সন্তর্পণে ঘরের দরজা খুলে আরও দু’টো ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল। ওপর নীচ সব ঘরেই দরজা বন্ধ, সবাই ঘুমোচ্ছে।
পুরনো আমলের গজাল পেটানো পুরু কাঠের সদর দরজা খুলতে গেলেই ক্যাঁচ করে জোরে শব্দ হয়। এখন শব্দ হলে বাইরের লোকটা বুঝে যাবে। আবার বাড়িরও কেউ জেগে যেতে পারে। তাই আস্তে করে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল ইন্দ্র। তবু শব্দ হল। লোকটা মনে হয় টের পাবে না। কারণ লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে এই সদর দরজাটা বেশ খানিকটা দূরে। এপাশটা বাড়ি আর গাছের ছায়ায় অন্ধকার। সে বাইরে বেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে দেখল কেউ নেই। এই তো এখানেই ছিল। তাহলে কি দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পালিয়েছে? কোন দিকে গেল? বালি বালি জ্যোৎস্নায় চারদিক একটু পরিষ্কার হলেও তাকে দেখা যাচ্ছে না।
ইন্দ্র, মানে ইন্দ্রনীল এ বাড়ির ছোট ছেলে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। খেলাধূলায় চৌকস। ভয়ডর বলে কিছু নেই। অন্ধকারেও দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারে। গোটা গ্রাম তার নখদর্পণে। তারজন্য বাড়িতে বকাও খায়। কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। ঠিক করল লোক দু’টোকে খুঁজতে হবে। ওরা ঠিক চুরি করার মতলব নিয়ে বেরিয়েছে। তাই নিঃশব্দে বাড়ির কোণে রাস্তায় এল যেখানটায় দাঁড়িয়ে লোক দুটো কথা বলছিল। রাস্তাটা ডানদিকে ইন্দ্রদের বাড়ি, পুকুর পেরিয়ে গ্রামের শেষ অবধি ধানখেতে গিয়ে মিশেছে। চাষিরা মাঠ থেকে গোরুর গাড়িতে ধান তুলে এ পথে আসে। আর বাঁদিকে কয়েক পা গিয়ে এ গ্রামের মূল রাস্তায় মিশেছে। যে রাস্তাটা গ্রামের মাঝখান চিরে পূব পশ্চিমে গেছে। ইন্দ্র একটুখানি ডানদিকে এগিয়ে নিজেদের পুকুরের পাড় পর্যন্ত গিয়ে দেখল সেখানে নেই।
এবার ফিরে মূল রাস্তা ধরে খানিকটা বাঁদিকে এগলো। ঘোষেদের বড় গোয়াল ঘরের পিছনে বিরাট বাঁশবন। প্রচুর গাছপালা বলে ঘন অন্ধকার। গোয়ালের কাছে এসে আবার সেইরকম কথা শুনতে পেল ইন্দ্র। এবার যেন একটু জোরে জোরে। নিঃশব্দে এগিয়ে এবার দেখতে পেল। গোয়ালের কোণে দাঁড়িয়ে। কিন্তু একটা লোক। তার পিঠে একটা বস্তা। অন্যজন মনে হয় গোয়ালের আড়ালে। দৃশ্যমান লোকটা কথা বলছে। এবার স্পষ্ট কথাটা শুনতে পেল ইন্দ্র। লোকটা বলল, হাবুলদা, আগে ঘোষেদের এই বাগানটা ঘুরে নিই। এখেনে আট দশটা তালগাছ আছে। মনে হয়, অনেক তাল পাব। তুমি কী বল? লোকটা একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। হাবুলদা কী বলল শোনা গেল না। লোকটা আবার বলল, তাই? আচ্ছা চলো।
লোকটা এবার অদৃশ্য হাবুলদার সঙ্গে বাঁশবনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ইন্দ্র ঠিক বুঝতে পারছে না এই লোকটা কে? আর যার সঙ্গে কথা বলছে সেই হাবুলদাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? লোকটা কথা বলতে বলতেই বাঁশবনের ভেতর ঢুকে গেল। ইন্দ্র জানে ভেতরে কোনও রাস্তা নেই। আঁশ, ঝামটি আর কাঁটা গাছের ঝোপে ভর্তি। আর ওদিকে চাষের জমি। ওদের এদিক দিয়েই ফিরতে হবে। ইন্দ্র ঘোষেদের বাড়ি লাগোয়া বিশাল অশ্বত্থগাছে ঢাকা পোড়ো মন্দিরটার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সে এমনভাবে দাঁড়াল যে কেউই ওকে দেখতে পাবে না। কিন্তু লোক দু’টো বেরলোই সে দেখতে পাবে।
ইন্দ্র ভাবছে, এই লোকটা কে? আর হাবুলদাই বা কে? গ্রামেরই কেউ কি? তাহলে চিনতে পারছে না কেন? গ্রামের তো বেশিরভাগ লোককেই সে চেনে। কিন্তু এই লোকটাকে চিনতে পারছে না। যদিও মুখ দেখতে পায়নি। কিন্তু চেনা মানুষ হলে তো পিছন থেকেও বোঝা যায়।
বেশ খানিকক্ষণ পরেই আবার কথা বলতে বলতে ওরা বেরিয়ে এল। একি! এতো একজনই। তার পিঠের বস্তাটা একটু ভারী দেখাচ্ছে। মনে হয় গোটাকতক তাল পেয়েছে। কিন্তু হাবুলদা নামের লোকটা কোথায়? লোকটা তো ফিসফিস করে কথা বলেই যাচ্ছে। তাহলে কি ভূতের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা? একটা যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ইন্দ্রর গোটা শরীরে। নাকি হাওয়াটা ঠান্ডা কে জানে। ইন্দ্র শুনেছে ভূতেরা চললে নাকি ঠান্ডা বাতাস বয়। তবে ভয় পাওয়ার ছেলে নয় সে।
লোকটা তার অদৃশ্য সঙ্গীর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে ইন্দ্রর সামনে দিয়ে সোজা পূব দিকে হাঁটা দিল। ইন্দ্রর চমক ভাঙল। সে ভাবল, যাকগে ও তাল কুড়োতে বেরিয়েছে। এই সময় রাতে ধূপধাপ করে তাল পড়ে। ফেটেও যায়। যাদের গাছ তারা সকালে কুড়িয়ে নেয়। কিন্তু রাতে যে কেউ তাল কুড়োতে বেরোয় এতদিন বুঝতে পারেনি ইন্দ্র। ওরা তো চুরি করছে না, পড়ে থাকা তাল কুড়োচ্ছে। থাক, আর গিয়ে কাজ নেই।
ভাবল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল লোকের বাড়ির গাছের তাল ও কুড়োবে কেন? ওই লোকটা নির্ঘাৎ অন্য কোনও গ্রাম থেকে এসেছে। অন্য মতলবও থাকতে পারে। তাল কুড়োনোর নামে চুরিটুরি করতে পারে। আর কার সঙ্গেই বা লোকটা কথা বলছে দেখতে হবে। কে এই হাবুলদা? সে যদি ভূত হয় তাহলে মানুষের সঙ্গে সে কথা বলছে কীভাবে? আর যদি মানুষ হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে না কেন?
ইন্দ্রকে কি নিশিতে পেল? না, সে তো সচেতন। ঠিক করল শেষ অবধি দেখতে হবে। তাই বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে পিছু নিল, যাতে লোকটা বুঝতে না পারে। এখন আর লোকটার কথাগুলো স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে ফিসফিসানিটা বোঝা যাচ্ছে। হাঁটছে আর কথা বলছে। তার পিঠে বস্তায় তাল। ইন্দ্রর হঠাৎ মনে পড়ল বেতালের কথা। সে গল্পের বইয়ে পড়েছে, রাজা বিক্রমাদিত্যের কাঁধে চড়ে বেতাল কথা বলতে বলতে যেত। রাজা চুপ থাকত। এও কি তাই? তবে এখানে লোকটা কথা বলছে। তার পিছনে যে ইন্দ্র যাচ্ছে তা যেন টেরই পাচ্ছে না। নাকি টের পেয়েও অদৃশ্য হাবলুদার কথায় অবজ্ঞা করছে? হাবুলদা তাকে পিছনে তাকাতে বারণ করেছে? কথাটা মনে হতেই জেদ বেড়ে গেল ইন্দ্রর।
ইন্দ্রদের বাড়ি ছাড়িয়ে সোজা পূব দিকে হাঁটছে ওরা। ইন্দ্রও হাঁটছে। সামনেই একটা বড় পুকুর। তার পাড়েও দু’চারটে তাল গাছ আছে। সেখানেও প্রত্যেকটা গাছের তলায় ও খুঁজতে গেল। ইন্দ্র দাঁড়িয়ে রইল রাস্তাতেই। তাল পেল কিনা বুঝতে পারল না।
এবার অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে ঝোপজঙ্গল আর কয়েকটা তালগাছ। একপাশে বিশাল একটা কেয়া ঝোপ। ফুল ফুটেছে, দারুণ তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। গন্ধটা খুব ভালো লাগে ইন্দ্রর। সে শুনেছে কেয়া ঝোপে সাপ থাকে। অথচ সেখানেও নিঃসংকোচে ঢুকে গেল লোকটা। ঝোপজঙ্গল ঠেলে ঠেলে গাছের গোড়ায় তাল কুড়োতে লাগল। দূরে দাঁড়িয়ে আবছা চাঁদের আলোয় দেখছে ইন্দ্র। মনে হয় একটা দু’টো তাল পেল। তা বস্তায় ভরল।
এবার ফেরার পালা। ডাইনে বাঁক নিল লোকটা। বাঁহাতে ধানখেত। ডানহাতে ডাঙা। ডাঙায় বেশ কয়েকটা তালগাছ আছে। ঘন কাঁটা ঝোপজঙ্গল। লোকটার কাছে এসব যেন কিছুই নয়। সব মুখস্থ। ইন্দ্ররও সব জানা। তবু এই ঝোপের ভিতর দিয়ে হাঁটতে একটু ভয় ভয় করল তার। ভয়টা সাপখোপের। এতক্ষণ তো গ্রামের পরিষ্কার মেঠো রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে। কিন্তু এখন জঙ্গল দিয়ে হাঁটতে হবে। তবে ওই লোকটা যখন যেতে পারছে তখন সেও পারবে। ইন্দ্র তো ভীতু নয়।
লোকটা কথা বলতে বলতেই সবকটা তাল গাছের তলা খুঁজল। কিছু পেল না মনে হয়। তারপর সেই খানখেতে যাওয়ার রাস্তায় উঠে আবার ইন্দ্রদের বাড়ির দিকেই বাঁক নিল। ইন্দ্রও তাই করল। কিন্তু একি! লোকটা যে তাদেরই পুকুরের পাড়ে এসে থামল। ইন্দ্রদের বাড়ির পাঁচিলের বাইরে তাদের বড় পুকুরটা। খিড়কির দরজার বাইরে ঘাটে নামার জন্য সিঁড়িও আছে। ওরা পুকুরে স্নান করে। পুকুরের একধারে ওদের বাড়ির পাঁচিল হলেও বাকি তিনধার খোলা। একপাশে এই রাস্তা আর সামনের দিকে ওদেরই খামার। পুকুরের পাড়ে জঙ্গল আর অনেকগুলো তালগাছ। সবকটা গাছেই প্রচুর তাল হয়। এই সময় পাকা তাল পড়ে পুকুরের জলে ভাসে। ওরা সকালে সেই সব তাল তুলে আনে। মা, ঠাকুমা তাল দিয়ে কতকিছু তৈরি করে। তালের বড়া, লুচি, পিঠে, এমনকী রুটিও খুব পছন্দ ইন্দ্রর। বাড়তি তাল আদিবাসী পাড়ার লোকেদের বিলিয়ে দেয়। লোকটা তাহলে এবার ওদের গাছের পড়ে থাকা তাল কুড়িয়ে নেবে। কিছু না বলে নেওয়া তো চুরিই। এবার তো কিছু একটা করতেই হবে। ইন্দ্র মনে মনে বলল, এতক্ষণ অন্যদের গাছের তাল কুড়িয়েছ কিছু বলিনি, এবার তো আমাদের বাড়ির তাল চুরি করতে দেব না। তবে তার আগে দেখা যাক লোকটা কী করে।
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ইন্দ্র। লোকটা তার সঙ্গীকে বলল, হাবুলদা, তুমি জলে নামবে না আমি নামব?
হাবুলদা কী বলল শুনতে পেল না ইন্দ্র। লোকটা আবার বলল, ‘ঠিক আছে আমিই নামছি। রায়দের পুকুরে অনেক তাল পড়ে আছে গো। কালকে বেশ কিছু রোজগার হবে।’ বলেই লোকটা পিঠের বস্তাটাকে পুকুরের পাড়ে নামাল। এবার ইন্দ্র চেঁচিয়ে উঠল, এই তুমি আমাদের পুকুরে নামছ কেন? এখান থেকে তাল চুরি করবে না।
সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঝপাং করে শব্দ হল। পরপর দু’বার। ইন্দ্র একছুটে একেবারে পাড়ে এসে চাঁদের আবছা আলোয় খুঁজতে লাগল লোকটাকে। কিন্তু দেখতে পেল না। বোঝা যাচ্ছে পুকুরের জলে ঢেউ খেলছে। জলের ওপর ভেসে আছে বেশ কয়েকটা তাল। কিন্তু লোকটা কোথায় গেল?
লোকটা নিশ্চয় পাড়ের জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়েছে। ইন্দ্র বলল, ‘এই লুকিয়ে থেকো না, উঠে এসো বলছি।’ কিন্তু এবারেও কোনাও সাড়া পেল না। পুকুরের কোণের দিকে আবার ঝপাং করে শব্দ হল। ইন্দ্র পাড় ধরে সেদিকে এগিয়ে এল। কিন্তু লোকটাকে দেখতে পেল না।
এবার ইন্দ্র পাড় ঘুরে ঘাটে এসে চিৎকার করে ডাকল, বড়দা, মেজদা, সেজদা তোমরা উঠে এসো। পুকুরে তাল চুরি করতে নেমেছে।
ইন্দ্র বেশ কয়েকবার চিৎকার করে ডাকার পর বুঝতে পারল বাড়িতে সবাই জেগে উঠেছে। হ্যারিকেনের আলো জ্বলে উঠেছে। বাবা, মা, কাকা, কাকিমা, ঠাকুমা, দাদু সহ বাড়ির সবার কথা শোনা যাচ্ছে। যেন ডাকাত পড়ার কোলাহল। একটু পরে খিড়কির দরজা খুলে দাদারা বেরিয়ে এল। বড়দা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? এতরাতে তুই এখানে কী করছিস?
ইন্দ্র বলল, দেখো না একটা লোক তাল চুরি করতে আমাদের পুকুরে নেমেছে।
বড়দা আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায়? তুই দেখলি কী করে?
ইন্দ্র বলল, আমি দেখেছি। অনেকক্ষণ ধরে গোটা গ্রামে ও তাল কুড়িয়ে এসে আমাদের পুকুরে নেমেছে। কিন্তু এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। মেজদা টর্চটা জ্বালো না।
মেজদা তিন ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে গোটা পুকুরের ওপর দিয়ে ঘোরাল। প্রায় শান্ত, স্থির জল আর গোটাকতক ভেসে থাকা তাল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না।
বড়দা জিজ্ঞেস করল, তুই কখন বেরিয়েছিলি?
ইন্দ্র, বলল, অনেকক্ষণ। আমি ভেবেছিলাম চোর। তাই ওর পিছু নিয়েছিলাম হাতেনাতে ধরব বলে। কিন্তু পরে বুঝলাম ও তাল কুড়োতে বেরিয়েছে। শেষকালে আমাদের পুকুরে…
এবার বড়দা বলল, যাকগে। তুই ঘরে চল।
ইন্দ্র বলল, তাল চোরটাকে খুঁজব না?
বড়দা ধমক দিল, চোর থাকলে তো খুঁজব। সেকি বসে থাকবে?
ইন্দ্র বলল, ও জলেই কোথাও লুকিয়ে আছে। ওই ওপারে ওর তালের বস্তাটা পড়ে আছে।
মেজদা বলল, কোথায়? বলে ইন্দ্রর নির্দিষ্ট করা জায়গায় টর্চ ফেলল। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না।
ইন্দ্র বলল, ওখানেই তো বস্তাটা নামিয়ে ও জলে নামল।
বড়দা বলল, বলছি তো কেউ নেই, পালিয়েছে।
সবাই মিলে জোর করে ইন্দ্রকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এল। মাঝরাতে ঘর থেকে এভাবে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়ির সবাই মিলে খুব বকাবকি করল। মা কান্নাকাটি জুড়ে দিল, একটা বিপদ আপদ হতে পারতো। ভগবান রক্ষে করেছে।
কীসের বিপদ? ইন্দ্রর খটকা যাচ্ছে না। বলল, লোকটা তাহলে কোথায় গেল?
বাবা, বড়দা বলল, এখন ঘুমোগে যা, সকালে শুনবি।
ইন্দ্র জেদ ধরল, না এখনই শুনব। আমার অতো ভয় নেই।
বাড়ির ছোটছেলের সাহসের কথা সবার জানা। মা তবু আপত্তি করল, রাতবিরেতে তেনাদের নাম নিতে নেই। বড়দা বলল, তুই যাকে দেখেছিস সে ভোম্বল। তোর জন্মের আগের কথা। তালের সময় রোজ রাতেই তাল কুড়োতে বেরতো। সেই তাল পরের দিন বাজারে বিক্রি করত। আমাদের পুকুরেও নামত। আমরা তা জানতাম না। কিন্তু একদিন সকালে উঠে আমরা দেখি ভোম্বলের দেহ জলে ভাসছে। পাড়ে বস্তায় তাল ভরা। ওর মা বলেছিল, রোজ রাতে দু’বার করে তাল কুড়োত ভোম্বল। তুই সেই ভোম্বলের ভূত দেখেছিস। এই সময় অনেকেই নাকি ওকে দেখতে পায়।
-আর হাবুলদা?
-সে তো ওরই জ্যেঠতুতো দাদা, তার আগের বছরই শিমূল গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল। আগে ওরা এক সাথেই তাল কুড়োত।
-ও মাগো।’ বলেই ভুতুম আর বৃষ্টি আমাকে আর মিষ্টিদিকে জড়িয়ে ধরল। ভালোদাদু জিজ্ঞেস করল, ভয় পেলি নাকি তোরা?
সত্যি বলতে কী, ভয়ে আমারও গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। মিষ্টিদির তাই। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল ভালোদাদু? তোমার ভয় করল না?
ভালোদাদু বলল, আমার অত ভয় নেই। পর দিন থেকে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি সেই ভূতটাকে খুঁজতে বেরতাম। কিন্তু আর কোনওদিন দেখতে পাইনি।
খুব কম ভূতের গল্প পড়েই বেশ ফুরফুরে একটা মজা পাওয়া যায়। এটা তেমন।