তাহার নামটি
শারদীয়া ভট্টাচার্য, গোবরডাঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগনা
কী অদ্ভুত একটা অনুভূতি যে হচ্ছে! আনন্দ নাকি দুঃখ তাও ঠিক বোঝানো যাবে না। পামেলা চুপ করে বসে থাকলো নিজের ডেস্কে। বুঝে উঠতে পারছে না ওর কী করা উচিৎ। দশটা বছরে সব ঝড় সামলে গিয়েছিল।
কিন্তু বসের কথায় আজ আবার সব গোলমাল হয়ে গেল পামেলার। সক্কাল সক্কাল বস্, ডেকেছিলেন তার কেবিনে। এমন একটা কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। সবটা শুনে চমকে উঠলো পামেলা। বসের ডানহাত সে। বস্ মানুষটিও খুব ভাল। এমন বস্ মানুষ ভাগ্য করে পায়। কিন্তু সেই বস্ ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছেন। সেই জায়গায় আসছেন অন্যজন। এতটুকু শুনেই পামেলার মন খারাপ হয়ে গেল। নতুন যে আসবে সে কি আর এই স্যারের মত হবে? এত কো-অপারেটিভ, এত্ত…
“দীপঙ্কর রায়।” নতুন বসের নামটা স্যারই বললেন পামেলাকে। নামটা শুনেই চমকে উঠলো পামেলা। প্রথমে বস্ চলে যাচ্ছেন বলে দুঃখপ্রকাশ করে শেষে ইতস্তত করে, জিজ্ঞাসা করেই ফেলে কথাটা।
-“কোলকাতাতেই থাকেন বুঝি? যদিও এটা আমার জানার বিষয় নয়। তাও…এমনিই…”
-“…ইটস্ ওকে পামেলা। না না, উনি মুম্বই থেকে আসছেন।”
ঝটকা লাগল পামেলার।
-“তবে শুনেছি নাকি সাউথ কোলকাতারই ছেলে।” স্যারের কথায় থম মেরে যায় পামেলা। “তোমাকে ডাকলাম কারণ তুমিই তো ওনাকে হেল্প করবে। অ্যান্ড ইউ আর এফিসিয়েন্ট টু অ্যাসিস্ট হিম। এতদিন যেমন করে এসেছো। অ্যাই হ্যাভ দ্যাট ফেইথ অন ইউ। যাক তুমিই জানলে প্রথম। বাকিরাও জেনে যাবে আজই।” আরো অনেক কাজের কথাই বললেন বস। পামেলা শোনার ভান করে হাসি মুখে বসে থেকে উঠে এল।
উফ! কেন? কেন? কেন? বারবার এই প্রশ্নটাই মনে আসছে ওর। কেন আসছে দীপঙ্কর আবার ওর জীবনে। এই নামটাও সহ্য করতে পারে না আর। মধু যেমন বেশি ঝাঁঝিয়ে গেলে সহ্য হয় না, তেমনই দীপঙ্করের সাথে ওর সম্পর্কের মাধুরী ঝাঁঝিয়ে গিয়েছিল।
একবার মনে হল, এ অন্য কেউ। এ তো খুব কমন নাম। দীপঙ্কর রায় তো পৃথিবীতে একজনই নয়। কিন্তু ওই যে মুম্বই থেকে আসছে এই কোম্পানীতে জয়েন করতে। আর হোমটাউন লোকেশন তো আরও নিশ্চিত করছে এই দীপঙ্করই পামেলার দীপু। নির্ঘাৎ এ দীপুই।
অফিসের পর বাড়ি ফিরে একলা ফ্ল্যাট অন্ধকার করে বসে ছিল পামেলা। অন্ধকারের বুক চিরে বারবারই ঢুকে পড়ছিল তার ফেলে আসা প্রেমবেলা। ঢুকে পড়ছিল দীপঙ্কর। কলেজে ওদের আলাপ। পূর্বরাগ থেকে অনুরাগ সব। বীতরাগের পর এতদিন যে খিল আটকে স্মৃতিগুলোকে মনকুঠুরির বাইরে রেখেছিল, আজ তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।
সিসিডি থেকে ফেরার সময় পাশের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই ডাকল দীপু, “শোন…”
-“কী হল?”
-“আমার না তোকে একটা কথা বলার আছে।”
-“বল না”
-“রাগ করবি না তো?”
-“যাব্বাবা। করলে করব। প্রেম করতে হলে আমার রাগ তো তোমাকে সামলাতেই হবে সোনা। সে তো জেনেই গেছ এতদিনে। আরে বল বল। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটতে হাঁটতে বল। দেরি হয়ে গেছে। বাবা বকবে।”
-“আরে না না শোন না।ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস। হাঁটতে হাঁটতে বলা যাবে না।”
-“ওহ্! সিরিয়াস কথা হাঁটতে হাঁটতে বলতে নেই? জানতাম না রে। কিন্তু নির্জন রাস্তায় দাঁড়াতে বাবা বারণ করেছে। তাও আবার আশেপাশে কোনো ছেলে থাকলে তো কথাই নেই…” খিলখিল করে হেসে পামেলা বলল। “আচ্ছা বল বল।”
হ্যাঁচকা টানে কাছে ডেকে যেটা বলল দীপু সেটা পামেলাকে অবশ করে দিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার তো। হ্যাঁ, দীপু আসলে ওকে চুমু খেয়েছিল। প্রথম চুম্বন।
সারারাত সেদিন মোবাইল ফোনের দুপ্রান্তে অথচ একদম গা ঘেঁষে চুপ করে ছিল।
কলিং বেলের আওয়াজে চটকা ভাঙল পামেলার। ফ্ল্যাটের মেইনটেনেন্সের টাকা…।
রাতে শুয়েও ঘুম এল না। দশ বছর পর দেখা হবে। কীভাবে ফেস করবে ওকে।
-“আরে ধুর। এই দীপঙ্কর অন্য কেউ।” পামেলার চেতন সত্ত্বা ওকে ঝাঁকিয়ে দিল জোরসে।
-“তাইই হবে” পামেলা জোরেই বলে উঠল।
একটু পরে বোঝা গেল ঘুমোবার বদলে আবার ওর মনে জায়গা করে নিয়েছে প্রেমবেলার ছবি।
-“আমার খুব ভয় করছে দীপু। কী দরকার ছিল বল তো? কাকু কাকিমা জানলে কিন্তু…”
-“আরে কেউ জানবে না। বাড়িতেই তো নেই কেউ। আর তুই তো আগেও এসেছিস আমাদের বাড়িতে আমার কলেজমেট হিসেবে। আজ আমার হবু বউ হিসেবে এলি, আদর খাবি বলে।”
-“ইশশ তুই না…” লজ্জায় দীপুর বুকে মুখ লুকোলো ও, দীপুর খাটে শুয়ে। “আমার খুব লজ্জা কচ্ছে” আদুরে গলায় ফিসফিসিয়ে বলল পামেলা।
-“আমাকে তোর সব লজ্জা দে পম। আমি যত্ন করে তুলে রাখব। কেউ কোনোদিন আঁচড়ও কাটতে পারবে না।”
সেদিন এক স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল পামেলা।
কেন যে দীপুটা জেদ ধরল তখন। অতীত জারণ করতে করতেই আপন মনে বলে উঠল পামেলা।
আসলে প্রেমের আট বছর পর, যখন ওরা দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই ওদের বিয়ে নিয়ে সোচ্চার হলেন দু’পক্ষের অভিভাবক। কথাবার্তাও শুরু হল। আচমকা দীপু বলে বসল, পামেলাকে চাকরি ছাড়তে হবে।
মানে? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল পামেলার। এদিকে দীপ অনড়। চাকরি না ছাড়লে বিয়েতে রাজি নয় সে। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে রাজি হয়নি পামেলা। তার বাবা মাও রাজি হননি। হঠাৎ এমন আব্দারের কোনো জোরা্লো কারণও দেখায়নি দীপু।
বিয়েটা আর হয়নি। দীপু চাকরি বদলে নতুন কোম্পানিতে মুম্বই চলে গেল।
পামেলা বেশ কিছুদিন সময় নিল ঝড়ে ওলটপালট হয়ে যাওয়া জীবন সামলাতে। তারপর থেকে এই কোম্পানিতে সে এইচ.আর.। অফিসের সুবিধার্থে এবং আসলে একা থাকবে বলেই অফিসের কাছে ফ্ল্যাট নিয়েছে সে। এখন সে খুব ব্যস্ত একজন মানুষ। দীপঙ্কর আর তার মনের সচেতন স্তরে ছিল না এখন।
কিন্তু এবার সে কী করবে? দীপু কি পরিবার নিয়ে আসবে? এতদিনে নিশ্চয়ই ভরা সংসার ওর।
-“নাহ্ কালই চাকরিটা ছেড়ে দেবো” আবেগী পামেলা বলল।
-“ইশশ! চাকরি ছাড়লে খাবি কী?” বস্তুবাদী পামেলা জিভ ভেংচে ওঠে।
আবেগী বলে, “তাও ঠিক। কিন্তু এতদিন পর ওর আন্ডারে কাজ করব? ইজ্জত নেই আমার? জমানো টাকায় খাবো। তারপর ঠিক কিছু একটা পেয়ে যাবো” ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পামেলা। রেজিগনেশন লেটার লিখবে ব’লে।
-“নেকুমনি, অত ইজ্জত দেখিও না। চাকরি তোমার শ্বশুর বুঝি? চাইলে আর এসে গেল।” আবেগীকে থামায় বস্তুবাদী।
-“দেখো এত বাস্তববাদী হলে চলে না। আত্মসম্মান আমি কোনোদিনই খোওয়াইনি। আজও পারব না। নিজের ওপর ভরসা আছে আমার” আবেগী কথাগুলো বলল বটে, কিন্তু বস্তুবাদীর কথাকে খন্ডন করার জোর বুঝি কমে গেছে তার। পামেলার আবেগী মন ভাবে, ঠিকই। এভাবে চাকরি ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তাহলে কী করবে ও?
অনেক ভেবে ঠিক করল পামেলা। কাল সকাল থেকেই নানা জায়গায় সি.ভি. পাঠাতে শুরু করবে। ওর যা কেরিয়ার গ্রাফ চাকরি পেতে অসুবিধে হবে না। তারপর নতুন বসের মুখে রেজিগনেশন লেটার ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাবে দীপঙ্করের অফিস থেকে। ওরকম একটা ডমিনেটিং ঠগ প্রকৃতির মানুষের সান্নিধ্যে সে থাকবে না।
হ্যাঁ ঠগই বলা যায়। ঠকিয়েইছে তো সে পামেলাকে। পামেলার মন-তন সবটুকু উজাড় করে নিয়ে একটা লেম এক্সিউজ দিয়ে ওকে ছেড়ে গেছে সে। রাগের মাঝেই চোখের কোণদুটো ভিজে উঠলো ওর। মনে পড়ে গেল ঝগড়ার কথা।
কি সব বোকা বোকা কারণে ঝগড়া হত ওদের। তারপর দীপুই মান ভাঙাতো ওর। ক্যাডবেরি এনে সামনে ধরত। গাড়িতে সামনের সিটে বসে থাকা পম ছদ্ম রাগ ধরে রাখার চেষ্টা করলেই কাঁচ বন্ধ গাড়ির ভেতর আদরের চাদরে ওকে মুড়ে ক্যাডবেরি বারটা দিয়ে বলত, “নে, এটা খেয়ে মুটি হ আর রাগ কমা।”
“সেইদিনগুলোই ভাল ছিল রে দীপু। এখন আর রাগ হয়না কারোর ওপর। আমার শরীর জুড়ে আজও তোর আদরবিন্দুর আস্তরণ। তাতে মরচে পড়ে আমাকে সেপ্টিকে জর্জর করে তুলেছিল একসময়। তবু, অন্য কারুকে সে মরচে পড়া আস্তরণে প্রলেপ দিতে দিইনি।” পাথর হয়ে যাওয়া একা মেয়েটার ভেতর থেকে আজ কান্না উঠে এল। “কেন এলি তুই? এই শহরে আর না এলেই পারতিস।” রাগ আর ঘেন্নার আড়ালে অবদমিত কান্না যেন আজ প্লাবনের মত ছড়িয়ে পড়ছে।
সকালের এলার্ম ওকে থামালো শেষমেশ। আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলো। কী চেহারা হয়েছে! চোখের তলায় কালি, চোখমুখ বসা। এক রাতেই ভোল পালটে গেছে। বাচ্চাদের মতই রাগ হল দীপুর ওপর। সব ওর জন্য। ‘এখনো আমাকে জ্বালাবি তুই?’ নিজেই এবার হেসে ফেলল নিজের বোকামির জন্য। দুদ্দাড় করে রেডি হয়ে ছুটল অফিসে।
অফিসে ঢুকতে গিয়েই দেখে যেন একটু সাজোসাজো ভাব। কলিগ রেহান ওকে দেখেই গুড মর্নিং উইশ করে বলল, “শুনেছ পামেলা দি?”
-“কী? নেক্সট উইক থেকে নতুন বস্ তো?”
-“আরে নেক্সট উইক কী বলছ; বস্ আজই আসছেন। নাকি কোলকাতায় এসেছেন। আজ একবার আসবেন ভিজিট করতে। সাথে ম্যানেজমেন্ট টিম থাকবে।”
-“নতুন একজন জয়েন করবে বলে এত্ত কিছু?” ভ্রূ কুঁচকোয় পামেলা।
-“সেটাই তো। কেউ কেউ বলছে নাকি এই মিঃ দীপন হেব্বি হাই লেভেলের লোক।”
-“দীপন আবার কি? জয়েন করার আগেই বসের নামের অ্যাব্রিভিয়েশন করছিস?”
-“এই যে পামেলা এসে গেছো? আমি তোমার খোঁজ করছিলাম একটু আগেই।” বস্ ওদের কথার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।
-“সরি স্যার আজ একটু লেট…”
-“ইটস্ ওকে। যা বলছিলাম। শুনেছ ত রেহানের কাছে? আজই মিঃ দীপন… ওহো তোমাকে তো বলাই হয়নি মজার কথা” জোরে হেসে বস্ বলতে থাকেন, “আরে কাল রাতে মেইল এসেছে। তখন দেখি ভদ্রলোক দীপঙ্কর রায় নন। উনি আসলে দীপন কর রায়। সকালে টাইপিং-এ ‘স্পেস এরর’ হয়েছিল।” বস্ হাসতে থাকেন।
Ekdom baje golpo……
হয় তো গল্পটি আপনার তেমন ভাল লাগেনি, সেটা হতেই পারে, সকলের পছন্দ সমান নয় অবশ্যই। কিন্তু সরাসরি বাজে গল্প বলাটাও কিছুটা অসমীচীন। এই গল্পটি অনেকেই ভাল বলে জানিয়েছেন। আমাদের মনে হয় একটু ঘুরিয়ে আপনার যে ভাল লাগেনি সেটা বললে বোধ হয় ভাল হত। যিনি লিখেছেন তিনি সরাসরি আঘাত পেতেন না, বরং বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিনিষ্ঠ পরামর্শ পেলে পরবর্তীতে আরও উন্নতি করবার সু্যোগ পেতেন।
আমার তো গল্পটি বেশ লেগেছে। ছোট গল্পের ছোট্ট একটা মোচড়ও আছে শেষে। বেশ মজারও। ভাল লেখিকার কাছ থেকে এমন সুস্থ রুচির সূক্ষ্ম মোচড়ের গল্প ফের পাওয়ার আশায় রইলাম অবেক্ষণের পাতায়।
বেশ অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল গল্পটা পড়ে……পাঠকের সাথে লেখিকার একটা বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা হল যেন।