বন্দি
ধ্রুপদ ঘোষ, গরিফা, উঃ ২৪ পরগণা ##
আজকাল আর বাপের বাড়িও যায় না তনিষ্ঠা। বাড়ি – অফিস, অভিরুপকে সামলে আর সময়ই পায় না। যদিও ঈশাণকে হোস্টেলে পাঠানোর পর থেকে মন আর ভালো নেই তনিষ্ঠার। যখন ঈশাণ ছিল তখন তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়েই ছিল তার দৈনন্দিন ব্যস্ততা। ছেলের প্রথম হামাগুড়ি কিংবা আধো আধো সুরে নানান প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, প্রথম ড্রয়িং কিংবা হোম ওয়ার্ক, স্কুল কিংবা জিমন্যাস্টিক্স ক্লাস সব সবই ছিল তার ব্যস্তময় জগৎ। ঈশাণও ছিল তার মায়ের নেওটা। অফিস টুকুনি বাদ দিলে – তনিষ্ঠার বাকী সময়টা তো ঈশাণের জন্যই। কিন্তু অভিরুপের সময় কোথায়? সিনেমা জগতের স্টার, ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা – ছেলে বউ এর জন্য সময় কোথায়? তনিষ্ঠার অনুনয়ে হয়ত ছেলের জন্য সময় বার করতে পারলেও নিজের জন্য আর কোন অনুনয় করে না সে। অভিমান আর করে না সে। হয়ত ভুলে গেছে। অফিস আর ঈশাণ – এ দুইকে নিয়ে নিজের জগৎ নিজের মত করে গড়ে নিয়েছে – স্ব ইচ্ছায়।
সাড়ে সাত মাসের প্রেম আর ১১ বছরের বিবাহিত জীবন। প্রেমিক আর স্বামী – দুই অভিরুপের বিস্তর ফারাক, তনিষ্ঠা জানত সবই। খুঁতখুঁতে মানুষরা কেবল অন্যের থেকে খানিকটা বেছে বেছে নেয়। সম্পূর্ণ তনিষ্ঠাকে অভিরূপ কখনও যে দেখতে পাবে না, তা সে ভালো করেই জানত, কিন্তু তবু কেন সে অভিরুপকে ভালোবাসল – কে জানে! হয়ত মানুষটার যত্নের প্রয়োজন ছিল। অভিরুপের মুখের উপর কোন কথাই সে বলে নি কখনও। সে সোফা সেটের রং হোক বা ফিক্স ডিপোসিটের আমাউন্ট। তাই তো সাউথ সিটির ঝাঁ চকচকে থ্রি বি এইচ কে আজ তার ঠিকানা আর সেই ঠিকানায় সে কি বন্দী!
ঈশাণের সেদিন সর্দি জ্বর হয়েছিল। অফিস থেকে ছুটি নিতে পারে নি। প্রজেক্ট মিটিং ছিল সেদিন। সে দিন না মা আসতে পারে নি আর সে ছুটি ম্যানেজ করতে পারে নি – কোন ভাবেই ম্যানেজ করতে পারে নি। মালতীর মাকে বলেছিল একটু বেশি সময় থাকতে। মিটিং সেরে হন্তদন্ত হয়ে ক্যাব নিয়ে বাড়ি। লিফটে দরজায় অফিরুপ আর কোলে ঈশাণ। হ্যাঁচকা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল তনিষ্ঠাকে। প্রথম ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেল এক বাবা। ছেলেটা জ্বরে মা মা করে কাঁদছিল আর হাউ হাউ করে কাঁদছিল মা ফ্লাটের দরজায় মালতীর মাকে জড়িয়ে। সাতদিন আর অফিস যায় নি, রেজিগনেশন ও লিখে ফেলেছিল, অভিরূপ এসে বলল..
– কাল সকালে আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি, ঈশাণের জামাকাপড় গুছিয়ে রেখো। he has been admitted to Darjeeling Convent.
পা জড়িয়ে কেঁদেছিল কিন্তু অভিরূপ টলেনি। সারারাত ঈশাণকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল তনিষ্ঠা। হোস্টেল গেটে ঈশাণের ছোট্ট হাত দুটো জড়িয়ে তনিষ্ঠা যখন কাঁদছিল, ঈশাণ বলেছিল – I love you Mom আর অভিরূপ বলেছিল – try to be a better mother।
আজ প্রায় পাঁচ মাস ২৩ দিন ঈশাণ হোস্টেলে। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ টায় পেরেন্টস কল টাইম, তনিষ্ঠাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। এখন শুধু অফিস আর বাড়ি আর টলিউডের বিখ্যাত স্টারের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা। দাম্পত্য আজ যেন ছদ্মবেশ। তবুও তনিষ্ঠা প্রতিদিন সকালে অভিরূপের জিমের ব্যাগ গুছিয়ে দেয়, প্রোটিন শেক তৈরি করে, ডায়েট চার্ট ফলো করে ব্রেক ফাস্ট বানায়, রাতে ডিনার টেবিলে অপেক্ষা করতে করতে ঢুলে পড়ে ঘুমে। তবুও।
আজ বিপদ অন্যখানে, অফিস কলিগরা মিলে মুকুটমনিপুর যাবে ঠিক করে। যাওয়ার দিনও ঠিক কিন্তু তনিষ্ঠার মাথায় ছিল না যে অভিরূপ জানিয়েছিল – পরের মাসে পিতা’র প্রিমিয়ার, তোমায় যেতে হবে, সঞ্জীব তোমার মেক ওভার করে দেবে। ডেটটা বলে নি আর। পি এ-র কাছ থেকে শুনেছিল ২২ তারিখ, পরের মাসে আর অফিস টুরটাও ঐ সময়ে। গতকাল রাতে অনেকবার চেষ্টা করেছে তনিষ্ঠা অভিরূপের সাথে কথা বলতে, বার বার উত্তর পেয়েছে – ব্যস্ত আছি। সকালেও একবার পাশে গিয়ে বসেছিল কিন্তু তখন অভিরূপ ঘুমে, ডাকতে সাহস পায় নি।
অফিস কলিগদের না করে দিল তনিষ্ঠা অবশেষে। প্ল্যানটা ভেস্তে গেল ওদের। খুব খারাপ লাগছে যে ওর জন্যই সবটা। কিন্তু সে কি করে বোঝাবে সকলকে সে কতটা বন্দি – কতটা। অভিরুপ ছাড়া সে যে কিছুই নয়। কি করে বোঝাবে আর কেই বা বুঝবে।
অফিস থেকে ক্যাব নিয়ে তনিষ্ঠা বেড়িয়ে পড়ল কল্যাণীর দিকে। আজ সে যাবেই। ওয়াটস্আপ খুলে অভিরুপের ডিপিটা দেখল, সুন্দর ঝকঝকে ছবি, নীচে লেখা – Can’t talk, Whatsapp only. তনিষ্ঠা লিখল – আজ মায়ের কাছে যাচ্ছি
উত্তর এল একটি পিং শব্দের সাথে – কেন?
মোবাইলটা পাশে রেখে ক্যাবের জানলার কাঁচ নামাল তনিষ্ঠা। বলল – ভাইয়া জারা এসি বন্ধ কর দিজিয়েগা। এক রাশ ঠান্ডা বাতাস এসে চুলের বাঁধন আলগা করে দিল তনিষ্ঠার। চোখ বুজে এগিয়ে গেল জানলার দিকে, বাইরে তখন রাস্তার পাশের পথচারী, মোটেল, গ্যারেজ, সবুজ ঝোপঝাড়, ধান ক্ষেত, বড় ছোট গাছ সব ছুটছে – সব ছুটছে প্রচণ্ড গতিতে পিছনের দিকে, ছুটছে প্রচণ্ড গতিতে।