মা

বটু কৃষ্ণ হালদার, কলকাতা

 

“মা” ছোট্ট একটা শ্রুতি মধুর পবিত্র শব্দ এই পৃথিবীতে। এক বিশাল পরিধির সমষ্টি সমস্ত সন্তানদের কাছে। তাই তো কবির লেখনী তে উঠে এসেছে “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে”। মা এক কথায় এক বিশাল জগত, তার মহিমা তুলনাহীন। বটের ছায়ার মত শান্তিদায়িনী। এক বিশাল সমুদ্রের গভীরতা যেমন মাপা যায় না, এক অসীম নীল অনন্ত সীমার যেমন কোন মাপ হয় না ঠিক তেমনই তার মহিমা। এই জগত সংসারে মা হোল  অপার তুলনা হীন মহিমা ও নিখুঁত ভালোবাসার জায়গা। মা মানে মায়াবী ও স্নেহময়ীর অবস্থান। পৃথিবীতে প্রায় সব ভাষাতেই মায়ের বন্দনা রচনা করা হয়েছে।

মা নিয়ে অনেক গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, এমনকি সাহিত্যিক দের সাহিত্য চার্চ হয়েছে বারংবার। মায়ের অপার করুণা কে বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থে।  ভগবতী  দেবী ছিলেন শিক্ষা র পরম গুরু বিদ্যাসাগর মহাশয় এর মা, যার ডাকে সাড়া দিয়ে উত্তাল দামোদর নদী পার হয়ে ছিলেন।  যশোদা, কুন্তি, গান্ধারি, সীতা, পার্বতী,  জগত জননী সারদা মা,  শচী  মাতা এমনি বহু মায়ের কাহিনী আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে পেয়েছি।

প্রতিটি  নারীর স্বপ্ন থাকে সিঁথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে  লাল চেলি পরে নব বধূ রূপে স্বামীর ঘরে আসবে। অবশেষে সে গর্ভধারিনী হবে নিয়ম অনুসারে। দশ মাস দশ দিন নিজ গর্ভে সন্তানকে সুস্থ ভাবে লালন পালন করে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন এই ভুবনে। প্রকৃতির নিয়মে এক মা এই অসাধ্য সাধন করেন শত কষ্টের মধ্যে দিয়ে। সমাজে পূর্ন নারী হিসাবে স্বীকৃতি পায় তখনই। সেই শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরে তার স্তন পান করান। ধীরে ধীরে সে বেড়ে উঠতে থাকে। মায়ের হাজারো কষ্ট ও দূর হয়ে যায় সন্তানের মধুময় হাসি ভরা চাঁদ বদন খানি দেখে।

প্রকৃত ভাবে একজন নারী বা মহিলা সন্তান জন্ম দেয়ার অধিকারিণী। গর্ভধারনের ন্যায় জটিল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ধর্মিয় অবস্থান থেকে এই সংজ্ঞাটি বিশ্বজন গৃহীত হয়েছে। একজন নারী পারে পিতৃ হীন সন্তানদের সুস্থ ভাবে লালন পালন করতে। পিতৃ পরিচয় হীন সন্তানদের বড় করতে এক মা হাজারো লাঞ্চনা,গঞ্জনা, সহ্য করে ও সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার একান্ত প্রয়াস করে যান আপোষ হীন ভাবে,নি স্বার্থে। মুখের অন্ন নিজে না খেয়ে সন্তান দের পেট ভরে খেতে দেন। অন্যান্য সজীব কুলের ক্ষেত্রে ও একই নিয়ম দেখতে পাওয়া যায়। মা তো মা হয় সে যে কোন ক্ষেত্রে।

এমনি একটি সন্তান কে এই ভুবনের আলো দেখাতে গিয়ে নিজের জীবন কে বলিদান দিতে পিছপা হননা। এক মা পারেন গোবি সাহারর বুকে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে। এক মা হতে  পারেন দিক দিশা হীন, অসহায় পরিবারের আলোর দিশারি। এক শিশু সন্তান তার মায়ের স্তন কামড়ে দেয় দুধ খাবার সময়, এমনকি আঘাত ও করে সে সময় শারীরিক আঘাত পেলেও মানসিক ভাবে আত্ম তৃপ্তি অনুভব করে এই ভেবে তার সন্তান খেলা করছে তার সঙ্গে। চোখের আড়াল হলে সারা পাড়া খুঁজে বেড়ায় তাকে একটু চোখের সামনে দেখে তৃপ্তি পাবেন। অপেক্ষা করে মা প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তে সন্তানের জন্য।

একটি মা তার সংসার জীবনে কত না কষ্ট করে। পরিবার কে ভালো রাখার জন্য দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ন। সংসার খরচ চালানোর জন্য কিছু টাকা দিয়ে নিশ্চিত খরচ  এর জ্বলা থেকে

মুক্তি পেয়ে যাই। কিন্তু মা সারা মাস কাউকে কোনো কষ্টের কথা না জানিয়ে দিব্য সংসার টা সুস্থ ভাবে চালিয়ে নিয়ে যায়। দিনের সূর্যাস্ত থেকে মধ্য  রাত পর্যন্ত মায়ের কোন ছুটি নেই। সন্তানের যতো চাওয়া পাওয়া র জুলুম বা আব্দার সব মা কে ঘিরে। সবার মুখে অন্ন তুলে দিয়ে নিজে জল, ফ্যান বা অনাহারে দিন রাত কাটিয়ে দেয় তার খেয়াল কেউ রাখে না। খাবার খেতে খেতে ঘুমন্ত সন্তান  যদি জেগে যায় খাবার ফেলে বুকের স্তন দিয়ে তাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সন্তান যদি পায়খানা বা প্রস্বাব করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পরিষ্কার করে দেয়। তবে মায়ের  অবদানকে অস্বীকার করে এমন পাষণ্ডও নেহাত কম নয় এই সমাজে। আমরা খবর রাখি না তার চাপা কষ্টের কথা। অকাতরে সবাই নিজের হিসেবে টা বুঝে নিয়ে ক্ষান্ত হয়ে যাই। সারা দিন পরিশ্রমের পর মধ্য রাতে যখন নামে স্বস্তির অবকাশ ঠিক তখনই পরিবার কর্তার (পিতা) হিসেবে বুঝে নেবার পালা। শারিরীক অবস্থার খবর রাখেনি সারাদিন তবু ও রাতে বুঝে নেয় নিজের শারীরিক হিসেবে। ধর্ষণ হল সামাজিক চরিত্র কিন্তু প্রতি নিয়ত চেনা বিছানায় চেনা মুখ দ্বারা ধর্ষিত হোন প্রতি নিয়ত। এমন ও জীবনের অতি মনোরম সুখকর  ফুল সজ্জা রাতে ও ধর্ষিত হোন নববধূ। খুব কাছের মানুষ গুলো সময় সময়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। সারাদিনের ক্লান্তির পর করো বুকে মাথা রেখে ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা গুলো শোনানোর  মত প্রিয়জন আজ বড্ড অভাব। তেমনই নিজের সন্তান কে ঘুম শান্তির ঘুমপাড়াতে গিয়ে মা জেগে থাকে সারা রাত। আমরা অনেক তীর্থ ক্ষেত্রে গিয়ে বহুল অর্থ ব্যয় করে পূর্ণ লাভের চেষ্টা করি অথচ বৃদ্ধ মা কে ডাক্তার দেখানোর জন্যে পয়সার বড়ো অভাব বোধ করি। সেই মা কে বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রম কিংবা রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে কুন্ঠা বোধ করি না।

মা জগত এর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। একরাশ হতাশাময় অন্ধকার একমাত্র আলোর দিশারী তিনি। একটি শিশুর  সুস্থ, সাবলীল, নিয়ম, নিষ্ঠার মধ্যে তার জীবন বৈচিত্র্য হওয়া উচিত তাই সুন্দর জগত হলেন মা। মা ‘কে ঘিরে শিশুর দুষ্টুমি আব্দার এর জগত শুরু হয়। তিনি কখনও বিরক্ত হোন না। এককথায় এক বিরক্তি হীন জগত এর নাম শুধুমাত্র মা। তাইতো আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন “যার মা আছেন সে কখনো গরিব নয়”।  জর্জ ওয়াশিংটন এর মতে “আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হলেন আমার মা, মায়ের কাছে আমি চীর ঋণী।

মা হলেন সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, দিনের সূর্যাস্ত হতে মধ্য গগণের ডুবে যাওয়া অর্ধ চাঁদ। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আজ হাজারো মায়ের আত্ম হুতির করুন স্বর ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে। যারা শিশু কন্যা বা ভ্রুন তারাই একদিন হবে মা। ধর্ষিত হচ্ছেন শিশু কন্যা। মাতৃ গর্ভতে হত্যা করা হচ্ছে ভ্রুণ।  পণ প্রথায় হাজারো জননী আজ আত্ম হনন এর পথ বেছে নিয়েছে। বৃদ্ধ জন্ম দায়ী মায়ের চোখের জল শুকিয়ে যায় বৃদ্ধাশ্রমের কোনো এক ফাঁকা বারান্দায়, নয় তো হারিয়ে যায় অন্ধ গলির বাঁকে, মৃত্যু হয় অবহেলায়। সন্তান জন্ম দেবার সময় অনেক মানুষের সমাগম কিন্তু সেই মায়ের মৃত্যু তে অন্তিম ক্রিয়াকর্ম করতে থাকে না আপন জন সত্যি চরম বেদনা দায়ক , মর্মস্পর্শী বাস্তব চিত্র।

নিজ সন্তান দ্বারা আজ বৃদ্ধ মাতা পিতা প্রহৃত হচ্ছেন প্রতি পদে পদে, সন্তান নিতে তেমন নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে বাবা মায়েরা। মায়ের যে আঙুল ধরে শিশু জগত চিনতে শেখে শিশুর সেই হাত আজ হিংস্র পশুর থাবায় পরিণত হয়েছে। সন্তান দের পেট ভরাতে গিয়ে অনাহারে মরে মা। ওরে পাশণ্ড, ওরে পিশাচ এর দল বন্ধ কর মাতা পিতা কে নিয়ে হিংস্র মরণের খেলা। যেদিন মায়েরা মুখ ফিরিয়ে নেবে সমাজ থেকে, সন্তান জন্ম দেবার অঙ্গীকার থেকে মুক্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে বন্ধ্যাত্ব এর উপায় অবলম্বন করবে, সেই দিন এই পৃথিবীতে থমকে যাবে জন্ম মৃত্যুর ইতিহাস। শুরু হবে এক নতুন সভ্যতার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 2 =