যৌতুক
বিশ্বজিৎ রায় ##
বিয়ের পরের দিন। দুপুরবেলা। শাশুড়িমা নানারকম খাবার সাজিয়ে নতুন জামাইকে আদর করে বললেন ” নাও বাবা, এবার শুরু করো। আহা ! মা আমার পুণ্যবতী। তাই এমন শিবের মত বর পেয়েছে।সোনার টুকরো জামাই আমার। জামাই তো নয়, সন্তান, সন্তান পেয়েছি আমি। নাও নাও বাবা , লজ্জা কি ! মায়ের কাছে আবার লজ্জা কি !”
এদিকে, শশুরমশাই ভবতোষবাবু কি একটি জরুরী কাজে স্ত্রী ননীবালার সাথে কথা বলবার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তিনি স্ত্রীকে বললেন-
” কই শুনছো, একবার এদিকে এসো দেখি।”
ননীবালা শুনলেন কিন্তু কোনরকম গুরুত্বই দিলেন না। জামাই নিয়ে ব্যস্ত। গ্রীষ্মের দুপুর, লোড শেডিং। জামাই ঘেমে অস্থির। জামাইকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন।
ভবতোষবাবু আবার ডাকলেন। দ্বিতীয়বার ডাকবার পর ননীবালা বললেন-
” এই যাই , একটু অপেক্ষা করো। দেখছো না জামাই ঘেমে অস্থির। খাবার মুখে তুলছে না।” উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। “ তোমার শরীর ঠিক আছে তো বাবা ? “- জামাইকে শাশুড়িমা জিজ্ঞাসা করলেন।
এতক্ষণ লাজুক জামাই মাথা নিচু করে ছিল। এবার জামাই মাথা নেড়ে জানান দিলো যে তাঁর শরীর ঠিকই আছে। খাবারেও হাত দিলেো , কিন্তু মুখে আর তুলছে না। মাথা নিচু করে শুধু খাবার নাড়তে লাগলো। হাবভাবে মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা বলতে চাইছে। সামনে শশুর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত আর্মি। চেহারা ? ও থাক, বুঝতেই পারছেন আর্মির লোক । ইতিপূর্বে বিয়ের দেয়া নেয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একপ্রস্থ হয়েছে। ভবতোষবাবুর এ ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কখনও কখনও মানসিক শান্তির চাইতে ঘরোয়া শান্তিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হয়, নইলে এক শ্রেণীর উপর অত্যাচার হচ্ছে বলে ভারতীয় পেনাল কোর্ডের গুতুনিতে হাজতবাসের সম্ভাবনাও থাকে। অতএব বুদ্ধিমান শান্তিপ্রিয় গৃহকর্তারা (?) ” যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম” নয়, বরং “যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব”কেই সুখী সংসারের জন্য আদর্শ বীজমন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন । পত্নীর ইচ্ছাই পতির ইচ্ছা, নইলে অশান্তি বাড়ে। একেতে অসহ্য গরম, তার উপর সামনেই যমদূতের ন্যায় শশুড়মশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন– মানে জামাইয়ের বুক ফাটছে কিন্তু মুখ ফুটছে না। শাশুড়িমা পরিস্থিতিটা বুঝতে পারলেন। তিনি জামাইকে বললেন-
” কিছু বলবে বাবা ? তোমার শশুরমশাই দেখতে রাগি মনে হলেও উনি মাটির মানুষ । তুমি নিশ্চিন্তে বলো , কি বলতে চাও, কোনো ভয় নেই ।”
ভবতোষবাবু বিরক্ত হয়ে পড়লেন। কয়েকদিন ধরে গাধার খাটুনি চলছে। গতকাল সারারাত জেগে কাটিয়েছেন। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন, দুপুরে তাদের ও বরপক্ষের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা, মেয়ের বিদায়ের আয়োজন করা, এবং সর্বোপরি সন্ধ্যার পর থেকেই পাওনাদারদের পেমেন্টের তাগাদা শুরু হবে। তিনি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জামাইকে বললেন-
” বলো বাবা বলো । কিছু লাগবে ? “
“কিছু লাগবে ?”-এই বিশেষ কথাটাতেই জামাই যেন মনে বল পেল। জামাই আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললো-
” মা, বিয়ের যৌতুক হিসাবে অনেককিছুই দিয়েছেন, টিভিও রয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস বাদ পড়ে গেছে ।”
ভবতোষবাবু ভয় পেয়ে গেলেন। আবার কি দাবী করে বসে কে জানে ! ননীবালা ভবতোষবাবুর মুখের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন এবং ঢোক গিলে জামাইকে জিজ্ঞাসা করলেন-
” কি চাই বলো ? “
ঘরে সব নিঃস্তব্ধ। কি চায় ! কি চায় ! টেনশনে ভবতোষবাবুর মাথা ভনভন করে ঘুরছে, দম বন্ধ হবার জোগাড় ।
আবদার করে জামাই বললো-
” মা, টিভিতো দিয়েছেন, কিন্তু এ্যান্টিনা কোথায় ? আমার একটি এ্যান্টিনা চাই, নইলে আপনার মেয়ে টিভি দেখবে কি করে ?”
দেখো কান্ড ! জামাইয়ের আবদার শুনে ভবতোষবাবু তিক্তবিরক্ত হয়ে পড়লেন । রাগে কান মাথা দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। একেতে বিয়ের ঝামেলায় শরীর , পকেট সব সর্বশান্ত হবার জোগাড়, আর ব্যাটা সামান্য এক এ্যান্টিনার জন্য এত নাটক। নগদ অর্থ, ঘর সাজাবার জন্য সব কিছুই দেওয়া হয়েছে । সামান্য একটি এ্যান্টিনা – তাও বলে কিনতে পারবে না ! ওটাও শশুরের ঘাড় মটকাবে। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটি ১০০ টাকা নোট বের করে জোড় গলায় ডাকতে লাগলেন-
” ওরে, কে কোথায় আছিস ? শিগগিরি এদিকে একবার আয় দেখি।”
ডাক শুনে বছর ৩০এর একটি লোক ছুটে এলো। তিনি লোকটির হাতে টাকাটি দিয়ে বললেন-
” এখনিই যা, যেখান থেকে পারিস একটি শক্ত বাঁশ কিনে নিয়ে আয়। “
ঘর ভর্তি সব লোক অবাক ! ভবতোষবাবু আর্মির লোক। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ হচ্ছে। সুতরাং অনর্থক ভাবাই স্বাভাবিক। বাঁশের কথা শুনে জামাই বাবাজীর অবস্থা যে কি হয়েছিল তা জামাই বাবাজীই জানে । ননীবালার গলা গেল শুকিয়ে । শেষে জামাই পেটাবে না কী ! তিনি ভয়ে ভয়ে ভবতোষবাবুকে বললেন-
” বাঁশ ! বাঁশ কি হবে ?”
ভবতোষবাবু কিছুটা শ্লেষের সুরেই বললেন-
” সবই তো দিয়েছি, এ্যান্টিনা যদি দিতেই হয়, তবে ওটিই বা বাদ দেবো কেন ? বলি এ বয়সে এ্যান্টিনা ধরে তো আর জামাইয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না, তাই বাঁশও দিলাম। বাঁশ সব কাজেই লাগবে- আমি মরলেও লাগবে, আবার বাবাজীর এ্যান্টিনার কাজেও লাগবে। দেখো, বাবাজী যাবার সময় বাঁশটি যেন ভুলে না যায়।”