রাইটার্সের ভুত

প্রণব কুমার চক্রবর্তী, বারাসত

হঠাৎ লাল বাজার কন্ট্রোল রুম থেকে ভবানী ভবনে সিআইডির ওসি ভৌতিক স্কোয়াডের কাছে ফোন এলো। ওসি ভৌতিক স্কোয়াডকে ইমিডিয়েটলি রাইটার্সের সিক্যুরিটি ইনচার্জের সাথে দলবল সঙ্গে নিয়ে দেখা করার জন্য৷ওখানে নাকি সম্প্রতি অশরীরী আত্মার ঘোরাফেরা শুরু হয়েছে৷ উচ্চপদস্থ আধিকারিক থেকে নিম্নপদের কর্মচারি সবাই ভয়ে কাজ করতে চাইছে না৷ কে একজন মহিলা কর্মচারি নাকি ওই খবর শোনার পরে সেই যে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এখনো জ্ঞান ফেরে নি৷ সমানে ভুল বকে চলেছে !

লালবাজার থেকে ভবানী ভবনের সাহায্য চাইছে ,  দারুন ব্যাপার৷

সাংঘাতিক ব্যাপার !  রাইটার্সে ভুত !

যথারীতি ডাক পড়লো গোঁফেশ্বর দারোগার৷ সম্প্রতি ভদ্রলোক রাজ্যের বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন ধরনের ভৌতিক কান্ডের কিনারা করে যথেষ্ট নাম করেছেন৷ ফলতা থানার আকুঞ্জি ভুতের অত্যাচার !  কালিবাজার থানার ফ্লাইং ভূতের তান্ডব !  মগরাহাটের আলো ভুত !

এ্যাকচুয়ালি  , গোঁফেশ্বর দারোগাকে রাজ্য সরকার সম্প্রতি পদোন্নতি করিয়ে ভবানী ভবনে সিআইডির ভৌতিক স্কোয়াডে নিয়ে এসেছে৷ তার ঘাড়েই রাইটার্সের এই  ভূতের ব্যাপারটা দেখবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে৷ এখন ওকে আর গোঁফেশ্বর দারোগা বলা যাবে না৷ যেহেতু উনি প্রমোশন পেয়ে ইনেসপেক্টার পদে উন্নীত হয়েছেন , তাই ওকে বলা উচিৎ শ্রীমান গোঁফেশ্বর রায়৷ সেই শ্রীমান গোঁফেশ্বর রায় চেম্বার থেকে বেরুবার সময় দেয়ালে টাঙানো একটা ঢাউস মার্কা কালি ঠাকুরের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত বার পঞ্চাশেক প্রণাম ঠুঁকে বললেন– মা ? আমাকে এই যাত্রায় রক্ষা কোরো৷ অনেকটা সেই ঠাকুর রামকৃঞ্চের মত কাতর কন্ঠে বলে উঠলেন –  মা ? তুই দেবী দত্তকে উতড়ে দিয়েছিস! রুনু গুহ নিয়োগীকে পরীক্ষায় পাশ করিয় দিয়েছিস! আমাকেও করাস কিন্তু৷ না হলে আমার শব সাধনাই নষ্ট হয়ে যাবে৷ নাম , যশ এবং প্রতিপত্তি – কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না৷

শব সাধনা!

গোঁফেশ্বর দারোগার কথাগুলো কান যেতেই সহকারী বিরিঞ্চী হোমগার্ড চোখ দুটো ছানাবড়ার মত গোল করে বলে উঠলো  – তার মানে আপনি স্যার তান্ত্রিক ! তন্ত্রসাধনা করেন ?

সেটা আবার কখন বললাম ?  গোঁফেশ্বর দারোগা রীতি মতো ক্রুদ্ধ হয়ে বলে ওঠেন –তুমি দেখছি বিরিঞ্চী কানে কম শোনো! এ রকম হলে তো তোমাকে এই ভৌতিক স্কোয়াডে রাখা যাবে না৷ এই স্কোয়াডে যারা কাজ করে তাদের চক্ষু , কর্ণ , নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক শরীরের এই পঞ্চইন্দ্রিয় সম্পূর্ণভাবে এ্যাকটিভ থাকা দরকার৷ তোমার তো কথা শুনে মনে হচ্ছে…..

কেন স্যার?  বিরিঞ্চী হোমগার্ড এক রকম আর্তস্বরে বলে ওঠে–স্যার ? আপনিই তো বললেন যে আপনার শবসাধনা মাটি হয়ে যাবে !

আরে বোকা  !  গোঁফেশ্বর দারোগা নিজের গোঁফের দুই প্রান্তে মোচড় দিতে দিতে বলেন– সব সাধনা মানে এনটায়ার সাধনা, বুঝতে পেরেছো ?

ইয়েস স্যার৷ বিরিঞ্চী হোমগার্ড গোঁফেশ্বর দারোগাকে একটা কড়া স্যালুট লাগিয়ে বলে–স্যার ? আমাদের গ্রামে গঞ্জে আমরা দেখেছি ভুত ছাড়াতে তান্ত্রিক কিংবা কাপালিকদের ডেকে আনে৷ আমি তেমনটাই ভেবেছিলাম৷ লালবাজারের এই ভৌতিক স্কোয়াডে সাহেবরা যাদের বদলি করে নিয়ে এসেছেন সবাই নির্ঘাৎ তান্ত্রিক কিংবা কাপালিক  !

যাকগে স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে৷ চলেন৷ বেশ দেরি হয়ে গেছে৷

বিরিঞ্চী ফাইলপত্র সব বগলে নিয়ে ঘর থেকে বেরুতেই গোঁফেশ্বর দারোগা ওকে ডেকে থামিয় বলেন– যাও তো৷ আমার টেবিলের ড্রয়ার থেকে লাল কাপড়ের টুকরোটা নিয়ে এস৷ ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলে !  না হলে হয় তো ভূতের তদন্ত করতে গিয়ে আমিই ভূতের খপ্পরে পড়তাম ! ওই লাল কাপড়ের টুকরোটা আমাকে কামরূপের কামাখ্যা মন্দিরের এক সাধু দিয়েছিলেন৷ বলেছিলে – যখনই কোনও ভৌতিক কিংবা অপদেবতার ব্যাপারে তদন্তে যাবি সঙ্গে নিয়ে যাস৷ রাইটার্সের এই তদন্তে ওই লাল কাপড়ের টুকরোটা খুবই জরুরী৷ যাহ্৷ নিয়ে আয়৷ ওটা জামার বুক পকেটে রাখতে হবে৷

বেরতে দেরি হওয়ায় রাইটার্সে পৌঁছই গোঁফেশ্বর দারোগাকে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হল৷ প্রথমত কর্মচারিদের,  আর দ্বিতীয়তঃ রাইটার্সের সিক্যুরিটি ইনচার্জের কাছে৷

গোঁফেশ্বর দারোগা সবাইকে শান্ত ভাবে বুঝিয়ে বললেন – দেখুন৷ এটা দারুন সিরিয়াস কেস৷ ভৌতিক ব্যাপার৷ তদন্তে নামার আগে রাইটার্সের পুরানো ইতিহাসটা একটু স্টাডি করে নিতে হবে আদারওয়াইজ আমাকে অন্ধকারেই থাকতে হবে৷ বলতে পারবেন এই বিল্ডিংটা কবে তৈরি হয়েছিলো ?  কেন তৈরি হয়েছিলো ?  সেখানে কোনও মার্ডার বা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল কিনা?  ভুত তো আর কিছুই নয় , স্রেফ অতৃপ্ত আত্মা !  সেই রকম কোনও পূর্ব ইতিহাস রাইটার্সের আছে কিনা ?

একজন অল্প বয়স্ক আধিকারিক জানালেন  –  সে কি আজকের কথা ! ১৭৭৬ সালে কোম্পানীর শাসনের সময় এটা তৈরি করার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিলো৷ খুব সম্ভবত তৈরি করে ওদের জুনিয়ার অফিসারদের থাকার জন্য চালু করা হয়েছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে৷ কথিত আছে বর্তমানে বিল্ডিংটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে , সেখানে এক সময় একটা গির্জা এবং কিছু বিক্ষিপ্ত জন বসতির অস্তিত্ব ছিল৷সেগুলো সব ধ্বংস করেই গড়ে তোলা হয়েছিল এই বিল্ডিংটা৷ এমন কথাও শোনা যায় যে , এখানে যে সব গোরাসাহেবদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল – তারা নাকি গভীর রাত্রে বিভিন্ন ধরনের সব আওয়াজ  –  কখনও অট্টহাসি ,  আবার কখনও নাকি সুরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতো !  যে কারনে ওই সব গোরা অফিসারদের কেউই এই বিল্ডিংয়ে রাত্রিবাস করত না৷ পরবর্তীকালে এটাকে অফিসে পরিনত করা হয়েছিল৷

গোঁফেশ্বর দারোগা সব শোনার পরে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলে ওঠেন  –  দ্যাটস কান্ট বি ! একশ বছরের পুরানো আত্মা সব থেকে উচ্চস্তরে পৌঁছে যায়৷ মুক্তি হয়ে যায়৷ ওরা আমাদের এই স্তরে নেমে আসে না৷ আপনারা যে সব আত্মার কথা বললেন , সে গুলো তো দুশো বছরেরও বেশি পুরানো৷ সো দে কান্ট বি৷ অন্য কোনও একশো বছরের মধ্যের আত্মার কিছু ব্যাপার আছে৷

একশো বছরের মধ্যে থাকা আত্মা!

কে কে হতে পারে ! কর্মচারিদের মধ্যে গুনগুন ফিসফাস আলোচনা শুরু হয়ে গেল৷

তা হলে কি সেই  ……

ভিড়ের মধ্য থেকে কে এক জন বলে উঠলো – বিনয় , বাদল কিংবা সিম্পসন সাহেবের আত্মা নয় তো !  একটু ভেবে চিন্তে হিসেব করে বলল  – ইয়েস৷ আই এ্যম রাইট৷ দুহাজার আঠারো মাইনাস ঊনিশো তিরিশ, মানে হল অষ্টাশি বছর৷ কি বলেন ওদের আত্মা হতেই পারে !

দিনেশকে এদের থেকে বাদ দিচ্ছেন কেন ? বিরিঞ্চী হোমগার্ড চোখ বুঁজে নিজের হাতদুটো কপালে ঠেঁকিয়ে বলে ওঠে –  বাপের বেটা ছিল বটে !  পটাসিয়াম সাইনায়েডের মত বিষ খেয়েও হজম করে ফেলেছিলেন! ভাবতে পারছেন স্যার?

ঠিকই তো বলেছে ! গোঁফেশ্বর দারোগা তার রাণাপ্রতাপের মতো মোটা কালো পাকানো গোঁফের দুই প্রান্তে বার কয়েক মোচড় লাগিয়ে বলে ওঠেন   – একটা এত বড় ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের ঘটনা আমি কি ভাবে ভুলে গেলাম ! দিস ইজ ভেরি ব্যাড যাক গে ,  চলুন তো আমাকে ওই সিম্পসন সাহেব যে ঘরটায় বসতেন  – সেটা দেখাবেন৷ বিনয়,  বাদল আর দিনেশ গুপ্তরা যেখানে তাঁদের খেলা শেষ করে গিয়েছিলেন , আই ডু ওয়ান্ট টু স্টার্ট সেখান থেকেই৷ নির্ঘাৎ ওদের মনের ভেতরের অনেক কথা আমাদের এখনও অজানা থেকে গেছে৷ সিম্পসন সাহেব ছাড়া ওইদিন ওদের আর কাকে কাকে হত্যা করার কথা ছিল ? কেন চার্লস টেগার্টকে আগে আক্রমন না করে সিম্পসনকে করতে গিয়েছিল ?  কত দিন আগে থেকে এই ব্যাপারে ছকটা কাটা হয়েছিল?…জানিস বিরিঞ্চী , ওই সব বিপ্লবী দেশ প্রেমীকরা ইদানিং কেন আবার এই মর্তলোকে আসা শুরু করেছেন বিশেষ করে এই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে?

কি করে বলব স্যার৷

কেন বলতে পারবি না ?  গোঁফেশ্বর দারোগা নিজের মুখটা ভেটকিয়ে বলেন – সারা দেশ জুড়ে যা শুরু হয়েছে ! অনাচার–ব্যাভিচার , মারা-মারি ,  খুনো-খুনি ,  চুরি-বাটপারি ,  দুর্নীতি!  ওরা কি এই সব দেখার জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন ? মনে হয় আজকের লোকজনকে সেই কথাই জানাবার জন্য আবার মর্তলোকে আসা শুরু করেছেন? একবার যখন ক্ল্যু পেয়েছি , আমি আজকেই প্ল্যানচেটে বসে সব জেনে নেব ৷ ডোন্ট ওরি৷….

কথা শেষ করে গোঁফেশ্বর দারোগা হুড়মুড় করে রাইটার্সের ডিজি পুলিশের চেম্বারের দরজা ঠেলে ঢুকতে যেতেই কলকাতা পুলিশের কমিশনার এবং ডিসি হেড-কোয়ার্টার এসে পেছন থেকে থামিয়ে রীতিমত ধমক দিয়ে বলে উঠলেন – ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন ? ঘটনা ঘটেছে অর্থ দপ্তরের ঘরে৷ সারা ঘর এবং সিঁড়িতে রক্তের ফোঁটা পড়ে থাকতে দেখেই তো সবাই হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে !  শুক্রবারে বাংলা বন্ধের দিন সবাই অফিস করে যে যার মত বাড়ি চলে গিয়েছিল৷ পরের দুদিন ছিল – ছুটি৷ সব বন্ধ ছিল৷ অথচ রক্তের দাগ ! সেটাই তদন্ত করে দেখা দরকার৷ আর আপনি সেটা না করে গিয়ে ঠেলে উঠছেন প্রোটেকটেড জোনের ডিজি পুলিশের ঘরে ! ইডিয়েট !  আপনাকে কে এখানে আসতে বলেছে ?  কেসটা দেখার কথা হোমিসাইড স্কোয়াডের , সেখানে আপনি ভৌতিক স্কোয়াডের লোক কি তদন্ত করবেন ? যান৷ ভাগুন৷ গিয়ে ওসি হোমিসাইডকে আসতে বলুন৷

গোঁফেশ্বর দারোগা অগত্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিরিঞ্চী হোমগার্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন – চল৷ দেখলি তো কেউ আসল তদন্তটা করতেই দেবে না৷

এটা কোনও তদন্তের ব্যাপার?  বিরিঞ্চী হোমগার্ড যেতে যেতে বলে –খোঁজ নিয়ে দেখুন স্যার৷ কি খোঁজ নিয়ে দেখবো ?  গোঁফেশ্বর দারোগা জিজ্ঞেস করে৷

ওই যে সিঁড়ি থেকে অফিসের ঘর পর্যন্ত যে রক্তের দাগ দেখা গেছে , সেটা কেন হয়েছে জানেন ?

কেন ? গোঁফেশ্বর দারোগা বিস্ময় মিশ্রিত দৃষ্টিতে বিরিঞ্চী হোমগার্ডের দিকে তাকিয়ে বলেন – তোর এই ব্যাপারে তদন্ত করা হয়ে গেছে?

এই কেসের তদন্ত করাটা কি খুব কঠিন স্যার ? আসলে বৃহস্পতিবার মানে বাংলাবন্ধের আগের দিন রাইটার্সে সমস্ত কর্মচারিরাই রাত্রে থেকে গিয়েছিল৷ ওরাই সব মস্তি করে রাত্রে মুরগি নিয়ে এসে কেটে রান্না করে খেয়েছিল৷ ওই রক্ত নির্ঘাৎ সেই কাটা মুরগির৷ মানুষের মোটেই নয়৷

সে না হয় হল৷ কিন্তু, অফিসের কর্মচারিরা কেন ব্যাপারটা স্বীকার করছে না?  হুজ্জতি শুরু করেছে ?

হুজ্জতি করছে কারন – রাইটার্সের অফিস ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রান্না করাটা বেআইনি৷ যে মহিলাটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে , খোঁজ নিয়ে দেখুন সেই মেইন কালপ্রিট৷ ঝামেলাটা এড়াবার জন্য কায়দা করে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়ে আছে৷

যাকগে,  ও সব ওসি হোমিসাইড এসে বুঝবে৷ চল তো আমরা নির্দেশ মেনে কেটে পড়ি৷

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven − 3 =