লাখ টাকা রোজগার
রাজর্ষি বর্ধন, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
হরিসাধনবাবুর মাঝে-মাঝেই মনে হয়, মানুষ হয়ে জন্মানোটাই তাঁর মহাপাপ হয়েছে!
নিজের জন্মের ওপর কারোর নিয়ন্ত্রন থাকেনা, যতটা থাকে নিজের জীবনযাপনের ওপর। হরিসাধনবাবু দ্বিতীয় ব্যপারেও ডাহা ফেল! সংসারের জোয়াল একবার কাঁধে নিলে একেবারে বলদ হয়ে যেতে হয়! আর বলদ তো গাভীর মতো ফলবতী হয়না , গায়ে-গতরে খাটতে পারলেই আদর! যেমন নিজের স্ত্রী আর দুই-ছেলেমেয়ের জন্য প্রাণপাত করে যান সামান্য মাইনে পাওয়া সরকারি অফিসের পিওন হরিসাধনবাবু! পিওনের স্ত্রী-ছেলেমেয়ের সব শখ-আহ্লাদ মেটে না , কিন্তু তাঁরই সহকর্মী দুই জুনিয়ার পিওন সেসব খুব আশ্চর্যভাবে পারে ! সেটা তাঁর বাড়ির লোকের কাছে অজানা নয়। এ নিয়ে নিত্যদিন তাঁকে কথাও শুনতে হয় –তিনি কত বড় অপদার্থ !
হরিসাধনবাবু জানেন , ছা-পোষা চাকরি করতে গেলে নিজেকে গণ্ডার হতে হয়। তিনি নিজের ডিফেন্সে কিছু বলেননা। হয়ত তিনি অপদার্থই – কারণ তিনি নির্লজ্জের মতো ঘুষ নিতে পারেন না, পারেন না ওপরওয়ালার সঙ্গে বেইমানি করতে!
স্ত্রী মুখ-ঝামটা দিয়ে বলেন, “ওসব নিজের অপদার্থতা ঢেকে রাখার বাহানা! মুরোদ নেই তাই পারোনা !”
হরিসাধনবাবু ভাবলেন, তাই হয়ত হবে ! নিজেকেও তিনি অপদার্থ ভাবতে শিখে গেছেন, তাতে যদি বাড়ির লোক খুশি থাকে! তিনি তো পরিবারের খুশিই চেয়ে এসছেন!
দিনের শেষে নিজেকে নিঙড়ে দিয়ে বাড়ি ফেরেন, আরও বুড়োটে মেরে যান, ভেতরে-ভেতরে একটু-একটু করে ক্ষয়ে যান – সবই করেন বাড়ির লোকের কাছে “অপদার্থ” খেতাবটি পাওয়ার জন্য বুঝি!
সেদিন অফিসে বড়বাবু তাঁকে কথা শুনিয়েছিলেন , তিনি নাকি স্লো হয়ে যাচ্ছেন ! মনে মনে অবসন্ন ছিলেন তিনি , মাথাটাও ভার ছিল । বাড়ি ফিরে ক্লান্ত গলায় একগ্লাস জল চাইলেন !
ভিতরঘর থেকে বউ এসে বলল, “ রান্নাঘরের ছাদটা বর্ষার আগে সারানো দরকার, নইলে ঘর জলে ভাসবে!”
থার্ড ইয়ারে পড়া মেয়ে এসে বলে, কলেজ থেকে এক্সকারসানের জন্য সিমলা নিয়ে যাচ্ছে, তাঁর জন্য পাঁচহাজার টাকা লাগবে!
ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষে পড়া ছেলে বলে, “ বাবা আমার সেমিস্টার ফি এখনও দেওয়া হয়নি!”
হরিসাধনবাবুর মাথা ব্যাথাটা বেড়ে গেলো। তিনি জল চেয়েছিলেন, বদলে তিনটে প্রশ্ন ধেয়ে এলো। তিনি তবু শান্ত গলায় বললেন, এখন এতোটা খরচ ওঠানো সম্ভব নয়, পুজোর বোনাসটা পেলে হয়ত –
কথা শেষ হওয়ার আগেই স্ত্রী বলে উঠলেন – জানতাম, এমন জবাবই আসবে! প্রয়োজন না মেটাতে পারলে কেন বিয়ে করেছিলে? ছেলে-মেয়ের বাপ হয়েছিলে কেন?
যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল হরিসাধনবাবুর, তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, এমাসে যদি কিছুটা ব্যবস্থা করতে পারি –
“ হ্যাঁ ! কতো লাখ-টাকা আনবে তা তো জানা আছে! এ ক’বছরে তো কতো টাকাই দেখলাম !” বউয়ের কথাগুলোতে যথেষ্ট শ্লেষ ছিল! তিনি এতোটা সামলাতে পারলেন না , মাথার ভেতরে বিস্ফোরণ হচ্ছিল। উত্তেজিত হয়ে বললেন – এই চললাম, তোমার ‘লাখটাকা’ জোগাড় না করে ফিরব না! বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আরও দিগভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ক্লান্ত-অবসন্ন ভাবটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তিনি সেই দিকেই পা-বাড়ালেন যেদিকে কোনদিনও যাননি। স্টেশনের ওপাশে কালু শেখের আড়তে হরেকরকমের মদ পাওয়া যায়। তিনি একটা চোলাই নিলেন!
পরদিন রেললাইনের ধারে হরিসাধনবাবুর লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেলো! চোখ উলটে গেছিল, বুকে-জামায় বমি শুকিয়ে ছিল! জামাটা সামনের দিকে ছেঁড়া ছিল। সবাই মনে করল, মদ খেয়ে শরীরের অস্বস্তিতে তিনি জামা খোলারও সময় পাননি!
রেললাইনে হরিসাধনবাবু বাদেও আরও তিন-চারটে মৃতদেহ ছিল, প্রত্যেকে কাল কালু শেখের কাছ থেকে চোলাই খেয়েছিল! কালু ফেরার। পুলিশ তাকে খুঁজছে। পরীক্ষায় জানা গেলো মদের বিষক্রিয়ায় সবার মৃত্যু হয়েছে।
সরকার থেকে প্রত্যেক মৃতের পরিবারকে দু’লাখ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হল !