শীলাবতীর রূপের টানে
পলাশ মুখোপাধ্যায়
শিলাবতী রূপসী, তার আরও এক গুণ হল সে শুধু নিজেকে নয়, সাজায় তার চলার পথের আশপাশকেও। তাই তো নানা জায়গায় শীলাবতী এবং তার পারিপার্শ্বের নানা রকমের সৌন্দর্যের তুলনা মেলা ভার। গনগনির সৌন্দর্যের কথা তো প্রায় সকলেরই জানা আছে। আমার এবারের গন্তব্য শীলাবতীর সৌন্দর্যের সন্ধানে অন্য এক প্রায় নাম না জানা জায়গায়।
প্রথমেই বলে রাখি এপথ খুব সুগম নয়, বেশ একটু খটমটই বটে। তবে পথের দোহাই দিয়ে আমার মত ঘুরনচণ্ডীকে থামিয়ে রাখা মোটেই সম্ভব নয়। বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল। গন্তব্য বাঁকুড়ার সিমলাপাল। না সিমলাপাল শহরে নয়, আমি যাব সেখান থেকেও আরও ভিতরে ঘাগর বলে একটা জায়গাতে। পথ নির্দেশ লেখার শেষে ভাল করে দিয়ে দিচ্ছি। আসি বেড়ানোর কথায়। ব্যক্তিগত ভাবে আমার একটা সুবিধার জায়গা আমার পেশা। পেশাগত কারনে রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই কেউ না কেউ পরিচিত আছে। তারাই আমার ঘোরাঘুরির সঙ্গী হয়। আমারও ভাল লাগে, একদম একা ঘুরতে হয় না আবার স্থানীয় কেউ থাকলে ভাল করে ঘোরাও যায়। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। সিমলাপাল নামতেই আমার সঙ্গী হল স্থানীয় সাংবাদিক রাহুল কর্মকার। অল্প বয়সী রাহুল বেশ চটপটে ছেলে, ওর বাইকে চেপেই রওনা দিলাম শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে।
বাঁকুড়ার এই অংশটা এক সময় মাও অধ্যুসিত এলাকা ছিল। তাই দীর্ঘদিন এদিকে বাইরের মানুষের তেমন পা পড়েনি। এখনও তাই বেশ অনাঘ্রাত সুন্দরের ছোঁয়া মেলে আনাচে কানাচে। বাইকে করে আমরা রওনা দিয়েছি ঘাগরের দিকে। লোক চক্ষুর প্রায় আড়ালে থাকা শীলাবতীর সেখানে নাকি অসামান্য রূপ। সিমলাপাল থেকে কিছুটা যাওয়ার পর রাহুল জানাল এখানে নাকি একটা নির্জন সুন্দর জলাধার আছে। জায়গাটা দারুণ। একথা শোনার পর আমি কি সেখানে না গিয়ে থাকতে পারি? ব্যাস বাইকের মুখ ঘুরিয়ে আমাদের গন্তব্য হল জুনকুড়িয়া জলাধার বা জে কে ড্যাম।
পিচ রাস্তা ছেড়ে লাল মাটির পথ ধরে খানিকটা যাওয়ার পর সামনে তাকিয়েই মন ভাল হয়ে গেল। কাজল কালো জলে ভরা সুবিশাল এক জলাশয়। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। একদিকে অরন্যের গাঢ় সবুজ, অন্যদিকে নতুন ধানের উজ্জ্বল সবুজ। লাল মাটির পটভূমে সবুজের আবহে থাকা এই জুনকুড়িয়া জলাধারের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এর স্বাভাবিক নির্জনতা। সামনের একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে প্রাণভরে উপভোগ করলাম সেই সৌন্দর্য। শুনলাম স্থানীয় প্রশাসন নাকি এই জলাধারের আশপাশের সংস্কার করে এখানে পার্ক করবার কথা ভাবছে। সত্যি কথা বলছি আমার একথা শুনে কিন্তু একটুও ভাল লাগল না। কিছু কিছু জিনিস না সাজালেই বোধ হয় ভাল লাগে বেশি। এই নির্জন সুন্দর জলাধারটি দেখে মনে হল এর স্বাভাবিক সৌন্দর্যের কাছে অন্য প্রসাধন ফিকে।
রাহুলের ডাকে সম্বিৎ ফিরল। যে উদ্দেশ্যে এসেছি সেখানে যেতে হবে যে…, বেলা চড়ছে, ফের বাইকে সওয়ার হলাম। এদিকে এখন লাল মাটির পথ প্রায় নেই বললেই চলে। প্রায় সবই পিচ অথবা ঢালাই রাস্তা। নানা মোড়, নানা গ্রাম পেরিয়ে এঁকে বেঁকে বাইক এসে পৌঁছল এক জায়গায়। দেখলাম পিচ রাস্তাটা এখানেই শেষ। রাহুল বলল এসে গেছি আমাদের গন্তব্য ঘাগরা।
জায়গাটা নির্জন, ভাল লাগল, কিন্তু একটু এগোতেই বুঝলাম কেন এর সুখ্যাতি সুদূরে থাকা আমার কানেও পৌঁছেছে। সবুজের একটা গালিচা পেরতেই শীলাবতীর ধারা। আশপাশে কোথাও পাহাড় বা টিলা নেই। অথচ এই এলাকায় শিলাবতীর পাথুরে রূপ। এঁকেবেঁকে বড় বড় উপল খণ্ডের পাশ দিয়ে সশব্দে বয়ে চলেছে জলধারা। কোথাও তা ছোটখাটো ঝরণার রূপ নিয়েছে আবার কোথাও চঞ্চলা নদী। বর্ষার পরে শীলাবতীর ভরা যৌবন। তাই পাথরের গা বেয়ে সগর্বে, সহর্ষে সে এগিয়ে চলেছে তার যৌবন মেলে।
কোনদিকে যাব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ভাললাগা এতটাই মুড়ে ফেলেছিল আমাকে ক্যামেরাটা বের করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। চেতনা ফিরতেই আমিও শিলাবতীর মতই চঞ্চল, সতেজ। ছুটে একবার এদিকে, একবার ওদিকে যাচ্ছি। মুহূর্মুহ ছবি উঠছে, ক্লান্ত ক্যামেরা, কিন্তু অক্লান্ত আমি। আমার হাল দেখে হেসেই ফেলল সঙ্গী রাহুল। নদীটা এখানে বাঁক নিয়েছে। সবুজ প্রেক্ষাপটে একদিকে পাথরের গা বেয়ে খানিকটা এসে ডান দিকে আলতো বাঁক নিয়েছে যেখানে, সেখানে পাথর আর বালির সহাবস্থান। অল্প এগিয়েই আবার আছড়ে পড়েছে সামান্য নিচে থাকা পাথরের গায়ে। শৃঙ্গার সেরে সেখান থেকেই ফের নতুন রূপ নিয়ে এগিয়ে চলেছে আরও নতুনের টানে।
শীতকালে স্থানীয় মানুষজন এখানে একটু আধটু পিকনিক করতে এলেও, বাইরের মানুষেরা এর খোঁজ এখনও পাননি। তাই অবশ্য গোটা এলাকাটি এখনও বেশ পরিচ্ছন্ন এবং দূষণহীন রয়েছে। পাথরে বসে একটু জলে হাত দিলাম, মুখে চোখে জল ছিটাতেই সব ক্লান্তি দূর। আমার অবশ্য ঘাগরকে দেখেই দূর হয়ে গিয়েছিল সব ক্লান্তি। এক কথায় প্রথম দেখাতেই যেন প্রেমে পড়ে গেলাম ঘাগরের। মনে হল এ যেন আমার, শুধুই আমার। বাইরে থেকে পিকনিক করতে বা বেড়াতে আসা মানেই তো এখানে ওখানে থার্মোকলের থালা বাটি, বোতলের ছিপি – ভাঙা টুকরো। অথবা শব্দ দূষণ। কচি অশ্বত্থ পাতার মতই স্নিগ্ধ, শান্ত ঘাগরে যেন এগুলি খুবই বেমানান।
বেলা হল। এবার বিদায়ের পালা। না, ঘাগরকে ছেড়ে আসতে মোটেই মন সায় দিচ্ছিল না। অনিচ্ছুক অসহায় প্রেমিকের মতই ফের বাইকের সওয়ার হলাম। যাওয়ার আগেও আরও একবার চোখ রাখলাম ঘাগরের দিকে, শিলাবতীর পানে। আরও একটু কি চঞ্চলা হয়ে উঠল সে? বেড়ে গেল কি জল পাথরের গর্জন? আমার তো তেমনই মনে হল। গিয়ারে ফেলে কবজির মোচড় দিয়েছে রাহুল। বাইক এগোচ্ছে ধীরে ধীরে, বিষণ্ণ মনে বসে আছি আমি।
আমার বিষণ্ণ দশা দেখে রাহুলের বোধহয় একটু মায়া হল। বলল চলুন আপনার মন ভাল করে দিই। এতক্ষণে ও ছেলে বুঝে গেছে আমার আকার প্রকার। বলল খানিকটা গেলে শিলাবতীর আরও একটা রূপ দেখতে পাবেন যেটা আপনার মন ভাল করে দেবেই। চললাম সে পথে… খানিক যেতেই একটা সেতু, সেতু না বলে কজওয়ে বলাই ভাল। সেতুতে উঠতেই বিষন্ন মন এক লহমায় প্রসন্ন। চারিদিকে কাশের মেলা। আমরা কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ কাশ দেখি বা দেখেছি বটে কিন্তু এমন আদিগন্ত বিস্তৃত কাশের আকাশ দেখার সুযোগ মেলে না।
শিলাবতীর চর জুড়ে শুধুই সাদা আর সাদা। সে দৃশ্যও বলে বোঝাবার নয়। সাদা কাশ বনের মাঝবরাবর এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে নদী, জলে সেই কাশের ছায়া। যতদূর চোখ যায় শুধুই কাশের বাহার। দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যিই বুঝি কাশ মিশেছে আকাশে।
সিমলাপালে এসে খাওয়া দাওয়ার পালা চুকিয়ে এবার ফেরার পালা। কলকাতা থেকে একদিনে এসে ফেরা যায়, তবে একটু চাপ হয়ে যায়। এখানে ভাল থাকার জায়গা নেই। কাছাকাছি বলতে বিষ্ণুপুরে গিয়ে থাকা যায়। অথবা সদর শহর বাঁকুড়াতে গিয়েও রাত কাটাতে পারবেন। আসার সব চেয়ে ভাল ট্রেন রূপসী বাংলা। সাড়ে ছটা নাগাদ সাঁত্রাগাছি থেকে ছেড়ে পৌনে দশটায় নামিয়ে দেয় বিষ্ণুপুরে। আমিও ওটাতেই এসেছিলাম। রাজ্যরানিও কাছাকাছি সময়ে ছেড়ে এখানে পৌঁছয়। ফেরাও রূপসীবাংলাই ভাল। সাড়ে পাঁচটায় বিষ্ণুপুরে আসে, হাওড়ায় নামায় সোয়া নটা নাগাদ।
এবার বলি বিষ্ণুপুর থেকে কিভাবে যাবেন। সকলের তো আর পরিচিতি বা রাহুলের মত সঙ্গী থাকবে না। তাই তাদের জন্য এই পথ নির্দেশ – বিষ্ণূপুর স্টেশন থেকে যদি গাড়ি ভাড়া করে নেন তবে সব চেয়ে ভাল। মানিব্যাগটা তাড়াতাড়ি হাল্কা হলেও হাতে সময় নিয়ে ঘুরতে পারবেন। বিষ্ণুপুর থেকে তালডাংরার দিকে যেতে শিবডাঙ্গার মোড়, সেখান থেকে সোজা আট কিলোমিটার যাওয়ার পর বিবরদা পেরিয়ে একটা চৌমাথা মোড় পাবেন যেখান থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরুন। সোজা গিয়ে হাড়মাসড়া গ্রাম পাবেন, ফের আসবে একটা মোড়। আবার বাঁ দিকের রাস্তা ধরে বেশ খানিকক্ষণ যাওয়ার পর ডানদিকে পড়বে হরিয়ালগাড়া বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে সোজা এক কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখতে পাবেন খিচকা বাস স্ট্যান্ড। খিচকা স্ট্যান্ড বাঁ দিকে কদমা গ্রামের রাস্তা ধরুন। রাস্তার বাঁ দিকে একটি ক্যানেল চোখে পড়বে। প্রায় আড়াই কিলোমিটার সোজা একটা মোড় পাবেন, ফের বাঁয়ে ঘুরুন। ডানদিকের রাস্তা খিচকা গ্রামের দিকে যায়, বাঁয়ের রাস্তায় ১ কিলোমিটার যাওয়ার পর একটা পুকুর দেখতে পাবেন। বাঁদিকের রাস্তা ধরে তুলসিপুর মোড় থেকে ডানদিকে খানিকটা গেলেই ঘাঘর। পিচ রাস্তা ওখানেই শেষ। বাসেও আসা যায় বিবরদা হয়ে হরিয়ালগাড়া পর্যন্ত বাসও মিলবে।
কাশের মায়া কাটিয়ে ফের সিমলাপালে পৌঁছলাম যখন তখন বিকেল হব হব। ভাতের হোটেল ছিল বটে তবে আমার আর ভাত খেতে মন চাইল না। গরম গরম পেঁয়াজি ভাজা হচ্ছে দেখে মুড়ি পেঁয়াজিই খাওয়া হল। সঙ্গে লেডিকেনি। লেডিকেনির স্বাদটা কিন্তু এখনও মুখে লেগে আছে। চটপট উঠে পড়লাম বিষ্ণুপুরের বাসে। সাড়ে পাঁচটার আগেই নামিয়ে দিল বাস। সময় মত চলে রূপসী বাংলাও। উঠে পড়লাম চটপট, মিলে গেল বসার জায়গাও। ব্যাস হাতে চলে এল শারদ সংখ্যা। কিন্তু তাতে কি মন বসে? বার বার ফিরে আসছে অপরূপ ঘাগর এবং চঞ্চলা শিলাবতী তার রূপের ডালি নিয়ে।