সম্পাদকীয় (এপ্রিল সংখ্যা)
অদ্ভুত আঁধার এক… তার মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। এক অচেনা অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ছি সকলে। এ বড় কঠিন দিন। যখন বার বার বলা হচ্ছে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স বজায় রাখার জন্য। আসলে আমরা তো সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স বহুকাল আগে থেকেই মেনে চলি। পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত এখন কমে গিয়েছে, কমে গিয়েছে নির্ভেজাল আড্ডার সেই আসরগুলি। পাড়ায় পাড়ায় হারিয়ে গিয়েছে রকে বসে ঘণ্টার পর ঘন্টা ধরে আড্ডার সেই চেনাছবি। এখন পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলার সেই চেনা ছবিও চোখে পড়ে কই? বিয়ে বাড়ি বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে দিন চারেক আগে থেকে নানান মানুষের ভিড় আর তো চোখে পড়ে না। এখন অনুষ্ঠান মানে তিন ঘন্টার ছোট্ট ইভেন্ট, গুটি কয়েক লোক। রেশনের মত লাইন দিয়ে খাওয়া। সোশ্যালি অনেকটা ডিস্ট্যান্সে চলে এসেছি আমরা। এখন একটা ভাইরাস আমাদের সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সের জন্য বাধ্য করেছে। কিন্তু করোনা জানে না আমাদের মধ্যে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স বেড়ে গিয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই।
আমাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আছে। যা ধীরে ধীরে ডিস্ট্যান্স বাড়িয়েছে স্বজনের থেকে। তাই এখন মা বাবা ছেলেমেয়েকে অথবা স্বামী স্ত্রীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বা পায়েসের বাটির ছবি পাঠায় ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে। বন্ধুদের মধ্যে আড্ডা বসে মোবাইল থেকে মোবাইলে। একসঙ্গে হৈচৈ করে খেতে যাওয়ার দিনও প্রায় শেষ। ঘরে বসেই চলে আসছে জিভে জল আনা খাবার, মনপসন্দ রেস্তোরা থেকে। আসলে সামাজিক দূরত্ব আমরা আগেই বাড়িয়েছি। বার বার তাই সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সের কথা বলে আমাদের অন্ধকার দিকটিকে প্রকাশ না করলেই কি নয়। আসলে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলবার কথা বলতে গিয়ে আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ঘোষণা করছি সকাল বিকেল। সামাজিক ভাবে আমরা তো কবেই দূরে চলে গিয়েছি একে অপরের থেকে। বারো বছর ধরে আমার ফ্ল্যাটের দুপাশে, অর্থাৎ দুটি দেওয়ালের ওপাশে যে প্রতিবেশীরা থাকেন তাদের মুখ চিনি মাত্র। না আজও তাদের ফ্ল্যাটে আমরা যাইনি, বলা ভাল তারা যেতে বলেননি বা ঢুকতে দেননি। ভাবুন তো পাশের দেওয়াল! এর পরেও কি বলতে হবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। অথচ আমাদের ছেলেবেলায় পাড়ায় পাড়ায় প্রতিবেশীদের বাড়িতে আমাদের সকলের ছিল অবাধ বিচরণ। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কি জানতাম না, সোশ্যাল ডিসট্যান্স কথাটাও শুনিনি। তাই আমাদের আনসোশ্যাল সেই জীবন ছিল এক অনাবিল, অকৃত্রিম আনন্দে ভরপুর। সেই দিন আর ফিরে আসবে না। গ্রামে গঞ্জেও ঢুকে পড়েছে মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া দুইই। যারা সমস্বরে চিৎকার করে বলছে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স বজায় রাখুন। অন্য বহু রোগের মতই করোনা আজ এসেছে কাল চলে যাবে নিশ্চয়, কিন্তু একটু বুকে হাত রেখে ভাবুন তো অন্যকে সন্দেহ করবার, প্রতিবেশীকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার, আত্মীয়দের বিপদে (এমনকি মৃত্যু হলেও) পাশে না দাঁড়াবার যে বীজ সে পুঁতে দিয়ে যাচ্ছে তা চারাগাছ থেকে মহীরুহ হতে খুব বেশি সময় নেবে কি? বিশেষ করে আগে থেকেই যখন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং এর উর্বর মাটি, জল, আলো এখানে বিদ্যমান।
এই প্রবল দুঃসময়েও ভাল থাকার চেষ্টা করবেন সকলে। অবেক্ষণ রইল সময় কাটাতে আপনার পাশে। কথা হবে ফের পরের সংখ্যায়।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ
সুন্দর সম্পাদকীয়।তৃপ্ত হলাম।
সম্পাদক মহাশয়ের জন্য নতুন বছরের হার্দিক শুভেচ্ছা।
লেখাটি বাস্তবিকই অনবদ্য
সত্যিই বড় সুন্দর করে বাস্তব কথা বলেছেন। বাস্তবিকই এর আঁচ পড়তে শুরু করেছে।
এত বড় বাস্তব কথা বোধহয় বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছু বলা যেত না। বাস্তবিক, আমাদের জীবনে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে, বর্তমানে করোনার প্রকোপে সেটা নিয়ে হৈ চৈ করে বলা হচ্ছে মাত্র। এর বেশী কিছু নয়।