সম্পাদকীয়, সেপ্টেম্বর ২০২১
হঠাৎ করে ধৃতরাষ্ট্রের কথা খুব মনে পড়ছে জানেন, সব জেনেও, সব বুঝেও না দেখার ভান করে লোকটা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। একটু শক্ত গলায় ছেলেদের একটু বারণ করলে মহাভারতের গল্পটা হয়তো পাল্টে যেত। কিন্তু না, তা হয় নি। প্রাণহানি, অশান্তি, হিংসা, অবিশ্বাসের যে বিজ পোঁতা হয়েছিল তারই পরম্পরা বহন করে চলেছি আমরা, আজও। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিও একাধিক ধৃতরাষ্ট্রের উদাহরণ তৈরি করেছে বিশ্বের সামনে। আফগানিস্তানে তালিবান এলে কি হতে পারে তা সকলেই জানত, আফগানিস্তানে আলিবান এসে কি করছে তা সকলেই দেখছে। তা স্বত্বেও সকলেই কেমন নির্বিকার। কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে তালিবান সরকারকে বরণও করে ফেলেছে। তাদের অবশ্য আমি ধৃতরাষ্ট্র না বলে শকুনির দলেই ফেলব। কারন তারাই তো এতদিন গোপনে এর ইন্ধন যুগিয়েছিল।
আফগানিস্তানে যা ঘটছে তা যে ঠিক নয়, সেই দেশ যে এখন সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের বাসের অযোগ্য, সেটা বোঝা যায় প্রায় সব দেশই তাদের দূতাবাসের কর্মী এবং নাগরিকদের ওই দেশ থেকে ফেরানোয় সচেষ্ট হওয়ায়। অর্থাৎ সকলেই প্রকারান্তরে স্বীকার করেই নিয়েছে তালিবানদের শাসনে থাকা যায় না। তালিবান জঙ্গিরা সেখানে যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তা প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমে। তবু কেউ কিছুই বলছে না। একটা জঙ্গি গোষ্ঠী গোটা দেশের দখল নিয়ে সেখানে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করবার উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটা দেখেও নির্বিকার গোটা বিশ্ব। বড় দাদাদের কেউ কেউ তো তালিবানকে এখন জঙ্গি গোষ্ঠী বলতেও নারাজ। তাহলেই ভাবুন, ধৃতরাষ্ট্র কি একটা? শয়ে শয়ে।
একটু পিছনে যাওয়া যাক, তালিবানের জন্মের প্রেক্ষাপটে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের দখল নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভয় পেলেন পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মহম্মদ জিয়া উল হক। তাঁর আশঙ্কা, পাকিস্তানের বালোচিস্তানেও ঢুকে পড়তে পারে সোভিয়েত বাহিনী। তখন জিয়া উল হক রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট হতে হাত বাড়ালেন সৌদি আরবের দিকে। এর পর সৌদি এবং পাকিস্তান এক জোট হল সোভিয়েতের বিরুদ্ধে। তার সঙ্গে এল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। কারণ আমেরিকার চিরশত্রু সোভিয়েত, তাই শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ, সৌদি আরবের জেনারেল ইন্টালিজেন্স ডিরেক্টরেট বা জিআইডি-র যৌথভাবে দেওয়া অর্থে, আর পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টালিজেন্স এর পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণে তৈরি হল সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদিন বাহিনী বা মৌলবাদী জঙ্গি দল। সে সময়, ৯০ হাজার আফগান, পাকিস্তানের আইএসআইয়ের ট্রেনিংয়ে কিছু দিনের মধ্যে হয়ে উঠেছিল দক্ষ জঙ্গি বাহিনী। সেই দলেই ছিলেন মহম্মদ ওমর। ওমরকেই তালিবান আন্দোলনের জন্মদাতা বলা যায়। ১৯৯৪ সাল নাগাদ পাশতুন অঞ্চলে ধর্মীয় ছাত্রদের নিয়ে তৈরি ওমর গড়ে তুললেন তালিবানি আন্দোলন। তালিব শব্দটি থেকেই এসেছে তালিবান, অর্থ ধর্মীয় ছাত্র। আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণের ইসলামিক স্কুলের ছাত্রদের নিয়েই এই রাষ্ট্রবিরোধী দলটি তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরের ওমরের নেতৃত্বে তালিবানরা দক্ষিণ ও পশ্চিম আফগানিস্তান দখল করে। এর কিছুদিন পর দখল করে কাবুলও। ওমর হন দেশের সর্বেসর্বা। চূড়ান্ত নারী বিরোধী, অনুদার, অরাজক, অযোগ্য প্রশাসক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করে তারা। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ফেলা তখনকার উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সেই সময় চারটি দেশ তালিবানকে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে পাকিস্তান। বাকি তিনটি হল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, তুর্কমেনিস্তান এবং সৌদি আরব। ২০০১ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে তালিবান বিরোধী যুদ্ধ শুরু হলে ফের চিত্রটা পাল্টাতে শুরু করে আফগানিস্তানে। শুরু হয় নতুন করে সুস্থ জীবন যাপন। কিন্তু সইলো না সে সুখ। একটা প্রশ্ন কিন্তু সকলকেই নাড়া দিচ্ছে। তালিবান যোদ্ধার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজারের মতো। কোনও ইউনিফর্ম নেই, সিংহভাগ যোদ্ধার পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। কিন্তু তাদের চাপে কি করে তাসের ঘরের মত ধসে পড়ছে আফগান বাহিনীর প্রতিরোধ?
আসলে তালিবানদের কখনও আর্থিক সঙ্কট ছিল না। ২০১৬-তে ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০টি জঙ্গি সংগঠনের তালিকায় নাম ছিল তালিবানদের। পঞ্চম স্থানে ছিল জঙ্গি সংগঠনটি। সেবার তাদের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূল আয়ের উৎস হল মাদক পাচার, অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া আর্থিক অনুদান। ২০১৯-২০ সালে তালিবানের বার্ষিক আয় বেড়ে হয় প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চার বছরে জঙ্গি সংগঠনটির আয় বাড়ে প্রায় ৪০০ গুণ। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনা বা যোগানে তাদের কোনও অসুবিধাই হওয়ার কথা নয়। গত কয়েক বছরে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তালিবান। বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ থেকেও বিপুল আয় পাচ্ছে তারা। সেজন্যই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের কয়েক দিনের মধ্যে, সেখানে ঘাঁটি শক্ত করেছে জঙ্গি সংগঠনটি।
২০০১ থেকে এ পর্যন্ত, প্রায় ২০ বছরে তালিবান কিন্তু বসে ছিল না। তারা ক্রমাগত আক্রমণ, প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে। বার বার মার্কিন সেনা পর্যুদস্ত হয়েছে তাদের হাতে। আমেরিকা সেটা লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গেলেও নিজেরা বুঝতে পারছিল মূল সমস্যাটার কথা। মার্কিন প্রশাসন এটা বুঝে গিয়েছিল যে তালিবানকে হারানো সহজ কাজ নয়, কারন আফগান রাষ্ট্রটি দুর্বল এবং দুর্নীতিতে ভরা, তাই কোন সমন্বিত নীতি ছাড়া এগিয়ে যাওয়াটা মুশকিল। পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার চাইতে ভাল শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া।
ভারত কিন্তু শুরু থেকেই তালিবানদের এই কাজকর্মের সরাসরি বিরোধীতা করে এসেছে। কিন্তু এখন তারা চুপ। চুপ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিও। পাকিস্তান প্রথম থেকেই তালিবানদের সাহায্য করে এসেছে। তালিবানরাও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে, পাকিস্তান তাদের দ্বিতীয় দেশের মত। তালিবান মুক্ত আফগানিস্তান যেমন ভারতের বন্ধু ছিল, সেখানকার উন্নয়ন এবং বানিজ্যে ভারতের বিপুল বিনয়োগ ছিল। তেমনই তালিবানের পিছনে পাকিস্তানের মদত ছিল প্রত্যক্ষ। তাই ভারত এখন নীরব থেকে পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইছে। কিন্তু চিন, আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, জার্মানির মত বড় বড় শক্তিরা যখন তালিবানদের সরাসরি সমর্থন করছে তখন অন্যান্য দেশগুলি চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করছে। তারই সুযোগ নিয়ে ২০ বছর পর ফের ক্ষমতায় ফিরে নৃশংসতার নজির স্থাপন করতে চাইছে তালিবানরাও। মুখে শান্তির মুখোশ পরে তাদের পুরনো চেহারাটাকে ঢাকতে চাইলেও তা আজ বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত। কিন্তু সেটাই দেখেও দেখতে পাচ্ছে না গোটা বিশ্ব। বুঝেও কেউ বুঝছে না, কি অনাচার, অত্যাচার, নৈরাজ্য চলছে আফগানিস্তান জুড়ে। সে দেশের মানুষের কান্না, আর্তনাদ পৌঁছচ্ছে না বিশ্বের আর কারও কানে। চারপাশে এত ধৃতরাষ্ট্র থাকলে ফের মহাভারতের যুদ্ধ তো অবশ্যম্ভাবী। সঙ্গে রয়েছে শকুনিরাও।
ভাল থাকবেন সকলে। ফের কথা হবে আগামী সংখ্যায়। আমাদের আগামী সংখ্যা অবশ্য শারদ সংখ্যা তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিন।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ