সম্পাদকীয় ( জানুয়ারি, ২০২০)

সেদিন এক অদ্ভুত কথা শুনলাম। আমার এক বন্ধুস্থানীয় দাদার মেয়ে তার নিজের বিয়ে বাতিল করে দিয়েছে। পাত্র সরকারী চাকুরে, ফর্সা, দীর্ঘকায় সুপুরুষ, টাকা পয়সারও তেমন অভাব নেই। তাহলে কেন? জানা গেল পাত্র পুলিশ আধিকারিক, তাই মেয়েটি প্রায় ঠিক হওয়া বিয়ে নাকচ করে দিয়েছে। পরে তাকে যেন কেউ বলতে না পারে ঘুষের টাকায় সে আয়েশ করছে। শুনেই মনে হল ঠিক করেছে, বেশ করেছে। মেয়েও বিদুষী, সুন্দরী পাত্র তার আবার আসবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল শুধু ঘুষ খায় বা খেতে পারে বলেই বিয়েতে মানা, এটাও যেন ঠিক মেনে নেওয়া মুশকিল। আচ্ছা বুক ঠুকে একটু বলুন বা ভাবুন তো দেখি, ঘুষ কি শুধু পুলিশই খায়। অন্যরা ধোয়া তুলসী পাতা? ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারে সব চাইতে যাদের নাম বা বদনাম তারা হলেন রাজনৈতিক নেতা। রাজনীতিতে আসার পর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় ভিখারী থেকে রাজা হয়েছেন এমন  লক্ষ লক্ষ উদাহরণ আছে। কই রাজনৈতিক নেতার বিয়েতে অসুবিধে হয়েছে বলে তো শুনিনি, বরং আমার চেনা রাজনৈতিক নেতার শ্বশুর শাশুড়ি তাদের জামাই নেতা বলে বেশ গর্বই করেন দেখেছি। এরা তো চেনা, তাই আত্মীয় বা পরিচিতরা এদের দেখিয়ে বলতে পারেন ওদের ঘুষের টাকাতে ফুটানি। কিন্তু ঘুষ তো সরকারী বিভিন্ন দফতরের আধিকারিক এবং কর্মীরাও নিয়ম করে খান, তার বেলা?

বীরভূমে থাকাকালীন এক টেলিফোন কর্তা সরাসরি আমার কাছে ঘুষ চেয়েছিলেন। সাংবাদিক বলে সচরাচর আমার বা আমাদের কাছে ঠিক সরাসরি কেউ ঘুষ চান না। বেশ একটু অবাকই হয়েছিলাম। কিন্তু ওই আধিকারিকও নাছোড়বান্দা। তাকে ঘুষ না দিলে তিনি আমাদের অফিসে (ইটিভি অফিস) টেলিফোন সংযোগ এবং ভিস্যাট সংযোগ দেবেন না। আমাদেরও আঁতে লেগেছিল, ব্যাপারটা শেষমেশ জি এম( টেলিকম) পর্যন্ত গড়ায়। ওই আধিকারিক নিজে এসে ঘুষ ছাড়াই লাইন দেন। কিন্তু ঘুষে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি জেনেও ওই টাকাটা হাতছাড়া করতে চাননি।    

ঘুষ মানে সাধারণত প্রাপ্যের বাইরে গিয়ে অন্যায্য ভাবে টাকা নেওয়া বা বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে টাকা নেওয়া। ঘুষের একটা বিনীত সংস্করণ ভারতবর্ষে প্রচলিত আছে, সেটা হচ্ছে বখশিশ। কেউ কেউ বলতেই পারেন বখশিশ হল খুশি হয়ে দেওয়া উপহার। সেটা ঘুষ হবে কেন? আমাদের এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে বখশিশ  ঢুকে গিয়েছে, সেটা এখন আর খুশি হয়ে উপহার দেওয়ার পর্যায়ে নেই। উপহার তো ইচ্ছে মত দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই বখশিশের এখন রেট হয়ে গিয়েছে। ট্যাক্সি চালকদের কথা এক্ষেত্রে না বললেই নয়, তাদের সব সময়েই কিছু টাকা বখশিশ  চাইই চাই। খুচরো টাকা তাদের কাছে কখনও থাকে না। তাই পাঁচ টাকা বা আট টাকা আমরা পেলে তারা দেয় না, আবার তারা পেলে বাড়তি টাকা নিয়ে খুচরো দেয় না। অর্থাৎ যেন তেন প্রকারে বেশি টাকা নিতেই হবে, এটা কি ঘুষ নয়? ঐ টাক্সি চালকের ছেলে বৌ কি জানেন যে তিনিও তার ন্যয্য রোজগারের চেয়ে বেশি কামান?

সম্প্রতি বনগাঁয় পথসাথীতে খাবার খেয়ে বেশ ভাল লাগল। রান্না করেছেন স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। দেখেই মনে হল গরিব হলেও প্রত্যেকেই ভাল ঘরের বৌ। খাওয়ার পর রান্নার প্রশংসা করতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন জনা তিনেক। ভাল লেগেছে? তাহলে আমাদের কিছু বখশিশ দিয়ে যান। মনে হল ভাল বলাটা বোধহয় অপরাধ। ওই মহিলাদের ছেলেমেয়েরা কি জানে তার মায়েদের রোজগারে লোকের দয়ার দান বা প্রকারান্তরে ঘুষের টাকা মিশে আছে?

বাড়িতে টেলিফোন, ইলেকট্রিক বা কেবল্‌ লাইন সংযোগ দেওয়া হোক বা টিভি ফ্রিজ প্রভৃতি পৌঁছানো। সব ক্ষেত্রেই আপনাকে মিষ্টি খাওয়া বাবদ টাকা দিতেই হবে। এই লেখা যখন লিখছি তখন আমার বাড়িতে একটি বৈদ্যুতিন সামগ্রী দিতে এসেছে একটি ছেলে। জিনিসটি দেওয়ার পরেই তার উক্তি, আমার বখশিশটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন আমার একটু তাড়া আছে। অর্থাৎ নামে বখশিশ হলেও সেটা তার পাওনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। গ্যাস দেয় যে লোকটি তারও তো বখশিসের নির্ধারিত রেট কুড়ি টাকা। আচ্ছা এদের বাড়ির লোকেরা কি জানে তাদের বাবা বা কাকা বখশিশ নামক ঘুষ খান বা নেন নিয়মিত।

রেস্টুর‍্যান্টে খেতে গেলে খাওয়ার পর বখশিশ  দিতে হয়, এটা নাকি রীতি, হোটেলের বয় বেয়ারাদের কথায় কথায় বখশিশ দিতে হয়, বখশিশ দিতে হয় রাজধানী শতাব্দীতে খাবার খেলে সেখানকার কর্মীদেরও।  রেলে আরও মজার একটা ব্যাপার এখন ঘটে, ট্রেনে সাফাই করেন যারা তাদের জামায় বুক পকেটের জায়গায় পরিস্কার লেখা থাকে No Tips. অর্থাৎ ঘুষ দেওয়া নেওয়া করবেন না। ওই No tips লেখা জামা গায়েই তারা দিব্য টিপস বা ঘুষ বা বখশিশ নিয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা বলুন তো এরা কি কেউ নির্দিষ্ট কোনও মাইনে পায় না। হতে পারে সেটা কম, কিন্তু তাই বলেই কথায় কথায় বখশিশ নামক ঘুষ (ভিক্ষাও বলতে পারেন)নিতেই হবে! আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ নেওয়া বা ভিক্ষা নেওয়াটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। আরও ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। এরা কেউই পুলিশে চাকরি করে না, তাই এদের বিয়ের সময় হয় তো পাত্রী ঘুষ খাওয়ার ওজর তুলে বিয়ে ভেঙে দেন না। কিন্তু বাড়ির মানুষের বা কাছের মানুষের অজান্তে এরাও তো ঘুষের টাকা বা ভিক্ষার টাকা বাড়ি নিয়ে আসছেন। সেটার খবর কজন রাখে? আসলে মাছ খায় সব পাখি, দোষ শুধু মাছরাঙার।        

পলাশ মুখোপাধ্যায়

প্রধান সম্পাদক, অবেক্ষণ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 2 =