সম্পাদকীয় (দোলযাত্রা সংখ্যা, ২০১৯)
ভাইসাব ইয়ে ব্যাগ কেয়া আপ লোগোকা হ্যায়? আচমকা মিহি কণ্ঠস্বরে আনমনা দৃষ্টিতে তাকালাম ঘুরে। একটি বছর কুড়ির ছেলে দাঁড়িয়ে সামনে। দোহারা চেহারা, হাতে একটি লেডিস ওয়ালেট। সেটি দেখিয়েই সে বলল ব্যাগটি আমাদের কিনা। প্রথম দিকে ঠাওর করতে পারিনি ব্যাপারটা, একটু আগেই জমাটি আড্ডা হচ্ছিল। আমার সফরসঙ্গী পরিতোষদা, কল্যাণীদি, মণিদীপাদি, ছন্দাদি, শুক্লাদি, সন্দীপদা, অরুনবাবু সকলে মিলে নরম রোদে বসে গুলতানি করছিলাম। জায়গাটি বেশ, সিটং। নামটির মতই জায়গাটিও বেশ মিষ্টি। পাহাড়ের মাঝে শান্ত সবুজ একটা গ্রাম। নানা রঙের ফুলে চারিদিকে রঙিন রঙিন। ইতিউতি কমলা লেবুর গাছ। শীতটাও হাড় কাঁপানো নয়, বরং বেশ আরামদায়ক। তাই সক্কাল সক্কাল প্রায় সকলেই একটু আধটু ঘুরে ফিরে এসে আমাদের হোম স্টের সামনে বসে একটু হাসি মস্করা করছিলাম। একটু আগেই অন্যরা ভিতরে চা খেতে গিয়েছেন। আমি একা বসে মেঘ পাহাড়ের খেলা দেখছিলাম। এরই মাঝে ওই খোকার আগমন। কিছু একটা আঁচ করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। বোঝা গেল সে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশেই পড়ে থাকা একটা মানি ব্যাগ পেয়েছে; তার ধারণা ওটা আমাদের কারোরই হবে। আমারও তাই মনে হল। একটু হাঁক ডাক করতেই বেরিয়ে এলেন প্রায় সকলেই, তাদের মধ্যে থেকেই সলজ্জ ভঙ্গিমায় মাথা বাড়ালেন শুক্লাদি। বোঝা গেল ওটি তারই ব্যাগ। রাস্তার ধারে ছবি তোলার সময় রেখেছিলেন, পরে নিতে ভুলে গিয়েছেন। ছেলেটি নির্দ্বিধায় ব্যাগটি আমাদের হাতে দিয়ে নির্লিপ্ত মুখে চলে গেল। ধন্যবাদ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, অনাবিল এক হাসিতে সেটা যেন উড়িয়ে দিল সে। একে অপরের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ আমরা। শুক্লাদিও থ। ব্যাগে মোবাইল, টাকা সবই অবিকৃত। যদিও দেখার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না।
সেই দিনই আমাদের সিটং ছেড়ে কলকাতায় ফেরার দিন। নিউ মাল থেকে ট্রেনে উঠব আমরা। সেই অনুযায়ী দুপুরে খাবার খেয়ে রওনা হওয়ার কথা। এমন সময় ঘন মেঘে ছেয়ে গেল চারদিক। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। দুটি গাড়ির মধ্যে একটির কাছেই ত্রিপল রয়েছে। তাই একটি গাড়ির মাথাতেই সব ব্যাগগুলিকে দেওয়া হল, যাতে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানো যায়। সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ ট্রেন। হিসেব টিসেব করে দেড়টা নাগাদ রওনা দিলাম আমরা। যাওয়ার সময় হোম স্টে কর্মী সরিতার খাদা পরিয়ে আনুষ্ঠানিক বিদায়ে আপ্লুত প্রায় সকলেই। সফর শেষে ফেরা, বাইরের মেঘ তখন যেন আমাদের মনেও জমেছে একটু একটু করে। ঘন্টা তিনেকের পথ। পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে নেমে যাচ্ছে গাড়ি। হাতে সময় আছে, একটু হেলতে দুলতে, মাঝে মাঝে নেমে ছবি তুলতে তুলতে চলেছি আমরা। কেটে গেছে ঘন্টা দুয়েক। আমাদের গাড়ি পাহাড় ছেড়ে নেমে এসেছে সমতলে। পাশ দিয়ে বহতা তিস্তার শোভা দেখতে দেখতেই সন্ধ্যার ফোন। সন্ধ্যা আমাদের সিটং এর হোম স্টের মালকিন। খুব হাসিখুশি, সাহায্য প্রবণ মহিলা। আমরা ফিরে আসার সময় স্বামী স্ত্রী দুজনেই ছিল না, ছেলে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে কালিম্পং গিয়েছিল। সেজন্য তারা খুবই অনুতপ্ত, দুঃখিত; বার বার জানিয়েছে সেটা। ফোন পেয়ে ভাবলাম যে আবার বুঝি সেই দুঃখ প্রকাশের শেষটুকু শোনাবে। ফোন ধরতেই উদ্বিগ্ন গলা, “স্যার আপলোগ কাহা তক পৌঁছে হো?” কেন, এই তো সেবকের কাছাকাছি। “হামারা রুম মে তিন লাগেজ রহে গয়া, ও আপ লোগোকা হি হোগা।” অ্যাঃ বলে কি? আমি তো শুনে কয়েক মুহুর্ত চুপ। প্রথমেই চালককে বললাম গাড়ি দাঁড় করাতে। আমাদেরটি দাঁড়াতে কিছুক্ষণ পর আরেকটি গাড়িও পিছনে এসে দাঁড়াল। ব্যাপার শুনে তো সকলেরই মুখ চুন। প্রথমেই খোঁজ কার ব্যাগ হতে পারে? সব ব্যাগ একটি গাড়ির উপরে ত্রিপলে জড়ানো, দেখারও উপায় নেই। ঘরের নম্বর শুনে এবং ব্যাগের বিবরণ শুনে মোটামুটি ছন্দাদি নিশ্চিৎ হলেন ওটি তার বা তাদের। ওই ঘরে ছিলেন শুক্লাদি এবং ছন্দাদি, তারা আগেই নেমে যাওয়ায় ব্যাগগুলি শেষ পর্যন্ত নেমেছে কিনা তা আর দেখার সুযোগ পাননি। যেহেতু ত্রিপলে জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে তাই শেষ বেলা কটা ব্যাগ উঠেছে সেটা আমরাও কেউ গুনে উঠতে পারিনি। তাই বলে এমন ভুল? কি আর করা! আমাদের তো মাথায় হাত, বাজে তখন প্রায় সাড়ে তিনটে। গন্তব্য নিউ মাল এখান থেকে প্রায় এক ঘন্টার দূরত্ব। কি করা, উপায়ন্তর না দেখে ফের সন্ধ্যাকেই ফোন লাগালাম। ওখান থেকে কি কোনও গাড়ি যোগাড় করে মাল পাঠানো সম্ভব। বলল, চেষ্টা করছি স্যার। ছোট্ট গ্রাম, বাড়িতে বাড়িতে তো আর গাড়ি নেই। অপেক্ষা করছি, সন্ধ্যার ফোনের। অন্যরা উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, হতোদ্যম। মিনিট পনেরো পরে সন্ধ্যার ফোন, পাওয়া গিয়েছে গাড়ি, সে মাল নিয়ে রওনা দিচ্ছে। শুনে স্বস্তির হাওয়া বইল সকলের গা বেয়ে। কিন্তু সেটা হলেও তো দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না। ওই গাড়ি ছেড়েছে পৌনে চারটে নাগাদ। আমাদের এই অবধি আসতে প্রায় দু ঘন্টা সময় লেগেছে। ও যদি তাড়াতাড়িও আসে ঘন্টা দেড়েকের আগে সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ব্যাগ নিয়ে আসতে আসতে সোয়া পাঁচটা বাজবেই। আমাদের এখান থেকে বেরলে কম পক্ষে একঘন্টা লাগবে স্টেশনে পৌছতে। সেক্ষেত্রে আমরা পৌঁছব ছটা পনেরো কুড়ি নাগাদ, আমাদের ট্রেনের সঠিক সময় ছটা বাইশ। একটু এদিক ওদিক হলেই কলকাতা ফেরা অনিশ্চিত। ব্যাগের টেনশন দূর হল, কিন্তু জুড়ে বসল ট্রেনের টেনশন। যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে তিস্তা। ব্যারেজের আগে, তাই ঘন সবুজ জলে ভরা যৌবন। অন্য সময় এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য মন আকুলি বিকুলি করে। কিন্তু এখন পাশে দাঁড়িয়েও তিস্তাকে মোটেই সুন্দরী মনে হচ্ছিল না। এর মধ্যে শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি, জুটল বেশ কয়েকটা বাঁদর। শান্তিতে দাঁড়াব তারও উপায় নেই। অগত্যা গাড়ির ভিতরে ঢুকেই বসে আছি বেজার বদনে। আমার থেকেও বেজার মুখ ছন্দাদির, মুখে হাসি আনার কথা বললেও সেটা মোটেই কার্যকরী হচ্ছে না। আমরাও ব্যাপারটা বুঝে বাইরে বাঁদরদের বাঁদরামি দেখেই কিঞ্চিৎ সময় পার করছি। এক একটা সেকেন্ড যেন এক একটা বছর। সময় কাটছে না মোটে। এমন সময় এসএমএস-এর ঘন্টি। সাধারণত কোম্পানির এসএমএসই-ই হয়, অন্য সময় দেখিই না। এখন সময় কাটাতে ওটাই দেখার বিষয় মনে হল। এসএমএস খুলতেই মুখটা ভরে গেল হাসিতে, অজান্তেই বেরিয়ে এল উল্লাস। অন্যরা কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে। এই পরিস্থিতিতে আমি এত উল্লসিত হতে পারি কোন দৈব ওষুধে সেটাই জানার বিষয়। এসএমএস রেলের, বলা আছে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস তার নির্ধারিত সময় থেকে দু ঘন্টা দেরিতে চলছে। সত্যি বলছি ট্রেন লেটের খবর শুনে মনে হল প্রেমিকার গম্ভীর বাপ বিয়েতে রাজি হয়েছে। এতটা ভাল আর কখনও লাগেনি। অন্যরাও তখন স্বস্তি মেশানো ভাল লাগায় সম্পৃক্ত। হনুমানেরা একটু দূরে, বৃষ্টিও যেন পড়ছে না। এবার যেন তিস্তাকে একটু একটু করে ভাল লাগতে শুরু করল। ক্যামেরাটা নিয়ে চলে এলাম গাড়ির বাইরে, ছবি তুললাম পটাপট। প্রায় দেড় ঘন্টার আগেই চলে এল সন্ধ্যার পাঠানো গাড়ি। তাকে কিছু টাকা দিলেন ছন্দাদি। মাল পত্র তুলে নিয়ে রওনা হলাম নিউ মালের দিকে।
দুটি ক্ষেত্রেই ওরা আমাদের সাহায্য করেছে, বা বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে বলা যায়। কিন্তু বিনিময়ে কিছুরই আশা না করে। ব্যাগ যে কুড়িয়ে পেয়েছিল সে তো ধন্যবাদটুকুও না নিয়েই চলে গিয়েছিল। পরে ব্যাগ নিয়ে যে চালক এল সে কিন্তু নির্দিষ্ট অর্থ নিয়েই চলে গেল। বাড়তি কিছুই দাবি করেনি সে। দুটি ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি এমন ছিল যে দাবি করলে তা দিতে বাধ্য হতাম আমরা। কিন্তু সে সুযোগ নেয়নি বা নিতে চায়নি তারা। ফিরে আসতে আসতে তাই মনে হচ্ছিল পাহাড়ের নিচে, গায়ে থাকে বলে পাহাড়ের মতই পাহাড়ের মানুষগুলির মনটাও এত বড় হয় বুঝি! কিন্তু আমরাও তো আকাশের নিচে থাকি, কই আমাদের তো…
একটা ভাললাগার গল্প শেয়ার করলাম। ভাল থাকবেন সকলে। অবেক্ষণ পড়তে এবং পড়ে কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।
পলাশ মুখোপাধ্যায়
প্রধান সম্পাদক
অবেক্ষণ