সূর্যমুখী
পারমিতা ভট্টাচার্য, উত্তরপাড়া, হুগলি
পরপর তিনদিন মেয়েটাকে বাস থেকে নামতে দেখে ওর প্রেমেই পড়ে গেলো বুকুন।
না পড়ার কিছু নেই, কেমন মাখনরঙা শরীরে নিখুঁত ভাস্কর্যের মত রূপ, একরাশ কোঁকড়া, ঝাঁকড়া চুল ব্যাক ক্লিপ দিয়ে পেছনে আটকানো, চশমার পিছনে উজ্জ্বল ছটফটে দৃষ্টি! ঠোঁটের কোণে আবার ছোট্ট তিল!
ওফফফ, বুকুন তিন দিনেই ঘায়েল পুরো।
খোঁজ নিয়েছে, ওর এক দূরসম্পর্কের বন্ধুর মামাতো দিদি হয় নাকি! শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় মাস্টার্স করতে এসেছে। দূরসম্পর্কের বন্ধু, কারণ এতকাল বুকুন ওকে পাত্তাই দিত না। ওর সেকশনের একদম ঝরতি পড়তি ছেলে, লাস্ট বেঞ্চে বসে গুলতানি মারে। বুকুন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। নাইন থেকে টেনে উঠেছে চারটে সাবজেক্টে হাইয়েস্ট মার্ক্স পেয়ে, তাছাড়া ফুটবল খেলে, ছবি এঁকে প্রাইজ পায়, কদিন হলো লুকিয়ে কবিতাও লিখছে।গার্লস স্কুলের মেয়েরা আসা, যাওয়ার পথে মুগ্ধ চোখে তাকে দেখে–কোচিংয়ে আড়ে, আড়ে লক্ষ্য করে; সে কি জানেনা বুকুন! মন্দ লাগে না; কিন্তু, ও ওদের পাত্তাও দেয় না। এর মধ্যেই যে পড়ে ফেলেছে তলস্তয়, কাফকা; যে দাদুর থেকে বসে দাস ক্যাপিটালের পাঠ নেয় গম্ভীর মুখে, তার কি এত সহজে বিচলিত হওয়ার কথা?–কিন্তু, এবারের কেসটা আলাদা। বুকুনের সামনে সহসা এসে দাঁড়িয়েছে যেন, বনলতা সেন, আর ও। ও হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছে, এই পাখির নীড়ের মত চোখদুটি ওকেই আশ্রয় দিতে এসেছে।
আজ টিফিনে রুদ্রর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো বুকুন,
–কেমন পড়াশোনা হচ্ছে তোর?
–ওই, ইয়ে আর কি, ভালোই, কেন রে?
–কদিন ধরেই ভাবছিলাম, তুই তো বেশ বুদ্ধিমান, অথচ অংকে পিছিয়ে আছিস, যদি একটু হেল্প করা যায়..
– না, না, মাস্টার আছে তো বাড়িতে, ওই একটু গুন ভাগে ভুল হয়ে যায়, তাছাড়া..
– উঁহু। ভুল হবেই বা কেন! গলদটা কোথায় খুঁজে বের করতে হবে তো! সামনে মাধ্যমিক। দেখি কতটা কি করা যায় তোর জন্য!….চিন্তিত দেখায় বুকুনকে
বেকুব হয়ে এদিক ওদিক তাকায় রুদ্র। ফার্স্ট বয় রৌনক হঠাৎ আজ তাকে সাহায্য করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো কেন কে জানে! সে চিরকালের ফাঁকিবাজ, অঙ্ক, টংক নিয়ে মাথা ঘামানো তো দূরের কথা, কোনো আলোচনাই পছন্দ করে না। আমতা আমতা করে সে কথা তুলতেই রৌনক বলে
–তাছাড়া বাংলা, ইংরেজিটাও তোর কাঁচা, ওটাও দেখতে হবে।
–বলিস কি! তোর নিজের পড়াশোনা? মরিয়া হয়ে বলেই ফেলে রুদ্র
–দাদু বলেন, শুধু নিজের টা দেখলেই হয় না। সাধ্যমত দুর্বলের উপকার করা আমাদের কর্তব্য। গম্ভীর মুখে জানায় বুকুন।
এত দুর্বল থাকতে, তাকেই কেন পাকড়াল ফার্স্ট বয়, তা ভেবে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে রুদ্রর। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই থামলো না। কোচিং সেন্টারে রুদ্রর মা কে প্রস্তাব টা দিতেই উনি লুফে নিলেন। গদগদ হয়ে অনেক আশীর্বাদ করে পরদিনই রৌনককে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসলেন।
সকাল নটা বাজতেই, “আজ জীবন বিজ্ঞান স্যার স্পেশাল নোটস দেবেন”, এই বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বুকুন ধাঁ করে পৌঁছে যায় রুদ্র দের বাড়ি। বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের মধ্যে ধুমধুম করে কে যেন ড্রাম পিটছে। ইতি উতি তাকায়, ওপরের বারান্দা টায় নজর দেয়, নাঃ নেই। দরজা খুলে দেয় রুদ্র, বেজার মুখে। পেছনে ওর বিগলিত মা। একটানা সাড়ে পাঁচ মিনিট রুদ্রর সঙ্গে বুকুনের তুলনা করার পর তিনিই পড়ার খাতাটাতা বের করে দেন।
–আন্টি, আপনারা দুজনেই থাকেন বুঝি, এত বড় বাড়িতে? সুবোধ বালকের মত জানতে চায় বুকুন।
–হুঁ। রুদ্রর বাবা তো জাহাজে কাজ করেন।খুব কম আসতে পারেন বাড়িতে।
– সেই তো, একা থাকা বেশ অসুবিধার
–অসুবিধার আর কি, শুধু ছেলেটার চিন্তায়…দীর্ঘশ্বাস পড়ে আন্টির
–না, মানে, কোনো আত্মীয় টাত্মীয় থাকেন না ধারে কাছে?
বলে ফেলেই বুক ঢিপ ঢিপ বুকুনের।
–না, কাছে কেউ না। আমার বাপের বাড়ি সেই শিলিগুড়ি।
এই তো কথা এগোচ্ছে!
সরল মুখে প্রশ্ন করে বুকুন,
–সেখান থেকে আসার মত কেউ নেই বুঝি!
–আছে তো, আমার ভাগ্নী, সোনার টুকরো মেয়ে, এখানে যাদবপুরে এম এ পড়ছে। আমার বাড়িই থাকে।
–ও আচ্ছা। কই তিনি! নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করলেও, গলা শুকিয়ে গেছে বুকুনের
–দিশা তো রোববার থাকে না। সেই ভোর পাঁচটায় বেরোয়, আর রাতে ফেরে। কি সব পত্রিকা টত্রিকা করে..ঠিক বলতে পারবো না। তবে ওই যে বললাম, খাঁটি হীরে, আমার ছেলেটা যদি ওকে দেখেও একটু শিখতো..ফোঁস করে শ্বাস ফেলেন আন্টি।
আচমকা, নিজের কথা আসায়, তিতকুটে মুখ হয়ে যায় রুদ্রর। দিব্যি গল্প চলছিল, এর মধ্যে ও কোথা থেকে এলো? মায়ের ওপর ভীষণ চটে যায়!
কিন্তু, ওর থেকেও বেজার হয়ে গেছে বুকুন। রাগ হলো রুদ্রর ওপরেই। গাধা ছেলেটা একবার এটা বলতে পারল না? অবশ্য বুকুনের নিজেরই খবর নেওয়া উচিৎ ছিল। এখন নখ কামড়ে ছিঁড়ে আর কি লাভ!
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরে দিশা। খাওয়া দাওয়া গল্প গুজব সেরে সাড়ে ছটায় তার দোতলার ঘরে উঠে যায়। পারতপক্ষে সাড়ে এগারোটার আগে দর্শন দেয় না। এসব খবরাখবর নিয়ে, বুকুন পাঁচটার সময় রুদ্রকে পড়াতে যাওয়া ঠিক করেছে। স্কুল ফেরৎ ফুটবলটা মাটি হয়, তা হোক। কদিন রুদ্রও বিকেলে বেরোতে পারে না–ঘুড়ি ওড়ানো মাটি। শিক্ষক ও ছাত্র দুজনের অসীম মনোযোগের কারণে এই সোমবার ক্লাস টেস্টে রুদ্র অংকে ছয় পেয়েছে তিরিশে, আর বুকুন বাইশ। দুজনেই যথাক্রমে আগের টেস্টের থেকে ‘নয়’ ও ‘সাত’ কম পেয়েছে। তবু আন্টির খুব ভরসা, রৌনকের ওপর।
রৌনকেরই বা দোষ কি! পাঁচটায় পৌঁছে ভুরিভোজ সারতে হয় আগে। যত বলে, সবাই আসুক, একসাথে খাবো, রুদ্রর দয়াবতী মা শুনবেনই না।
― দিদি কখন আসবে তার জন্যে বসে থাকবে নাকি!খেয়ে নাও! আন্টির দৃঢ় মতামত।
খাওয়া হলে পর্দা টেনে দেন আন্টি, পাছে ভিতরের কথায় এদের পড়ার বিঘ্ন ঘটে!
পড়ার ঘরের ভিতর থেকে, সাড়ে পাঁচ টায় কলিং বেলের শব্দ শোনে বুকুন, পর্দার তলা দিয়ে দুটি মাখন রঙা পায়ের দ্রুত বারান্দা পেরিয়ে যাওয়া দেখে, মিষ্টি গলার এক আধ টুকরো, কিংবা জলতরঙ্গের মত হাসির উচ্ছাস ভেসে এসে ওকে যেন অবশ করে দেয়। ও এটাও বেশ বোঝে, ওকে শোনাবার জন্যেই দিশা মাঝে মাঝে দু এক কলি গেয়ে ওঠে। পড়ার ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে, দু একবার চোখাচোখিও হয়েছে তাদের। সেই দুষ্টু চাউনিতে কি একটা ইঙ্গিত, ইশারা ছিল না? দিশাও তো ওকে দেখেছে বাস স্টপে সেই তিনদিন। মনের মধ্যে একটা তোলপাড় কি হয়নি, বুকুনের যেমন হয়!
কিন্তু এসব কথা বলে কাকে! সুযোগও তো হয় না কাছাকাছি যাওয়ার। উপরন্তু এই অমনোযোগী ও মাথামোটা রুদ্রটাকে পড়াতে গিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছে।
এ সপ্তাহে ইংরেজি টেস্ট ছিল। রুদ্র তিন পেয়েছে, বুকুন সতেরো। হাইয়েস্ট সাম্য, ছাব্বিশ। কুড়ির ওপর জনা কুড়ি। বুকুনকে নিয়ে টিচার চিন্তিত, মা বাবাও। বুকুনের এই পরোপকার কারোরই পছন্দ হচ্ছে না। মা আড়ালে বাবার কাছে গজগজ করেন,
–তোমার বাবার জন্য এই সব হচ্ছে, নিজের পড়া নষ্ট করে পরোপকার, হুহ”!
বাবা, আমতা আমতা করেন,
–বাবা তো ভালো শিক্ষা দেবার জন্যেই…
–কি দরকার ছিল এই সবের, যত্তসব জ্ঞানের কথা, এসব করতে গিয়ে নিজের পড়াটা যাবে..
–ও ভাবে বলো না। বাবা চিরকাল অন্যের উপকার করতে শিখিয়েছেন, কত জনকে ফ্রি তে পড়িয়েছেন..
বলেন বটে, তবে ছেলের রেজাল্টের কথা ভেবে নিজের বাবার ওপর চটেও থাকেন।
রুদ্রর মাও একটু দোনোমনায়..। উপকারের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে না তো!
এদিন পড়াতে গিয়ে বুকুন, রুদ্রকে দুটো নিজের লেখা কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দিলো। বলা ভালো, নতুন কবিতা দুটি দিশাকে নিয়েই লেখা বা দিশার উদ্দেশ্যে লেখা। আর বুকুন ভালো করেই জানে রুদ্রর দাঁত ভেঙে যাবে ও দুটো ট্রান্সলেট করতে। তো, ও কি করবে? দিদির কাছে নিয়ে যাবে, যেমন এর মধ্যেও অনেকবার করেছে, বুকুন জানে। সে ক্ষেত্রে কি দাঁড়াবে? দিশা কবিতাগুলো পড়েই ওর মনের কথা জেনে যাবে, তারপর… রোমাঞ্চ জাগে বুকুনের!
“তোমায় নদীর মত লাগে, ভেজা শ্বাস ঘাসের ডগায়, কুঁচো চুল উড়িয়ে হাওয়ায়, শ্বেতপরী এগোও আগে”…
চোখ গোল গোল হয়ে যায় রুদ্রর, এসব আবার কি? এসব ইংরেজি করতে হবে? কেন? মাধ্যমিকে এত শক্ত আসে না তো!
বুকুন নির্মম। ইংরেজি শিখতে গেলে এগুলো করতেই হবে।
“নিজে না পারলে, দিদিকে দিয়ে করা” বুকুনের সাফ রায়।
আশার আলো দেখে রুদ্র। তাহলে দিদিভাইকেই দিয়ে দেবে কবিতা দুটো। আর হাঁফ ছাড়ে বুকুন, অভীষ্ট সিদ্ধি হতে চলেছে বুঝি এবার! উত্তেজনায় রোম খাড়া হয়ে ওঠে ওর।
রাতে স্বপ্ন দেখে বুকুন, শ্বেতপরী উড়ে আসছে ওর দিকে, ডানা থেকে ঝরছে আলো, কোঁকড়া চুলের রাশি সারা আকাশময় মেঘ হয়ে আছে। কাছে এসে জাদুকাঠির ছোঁয়া দেয় বুকুনকে, আর ও আলোয়, আলোয় ভরে ওঠে।
সকালটা এক চনমনে অনুভূতি নিয়ে এলো। গেটের বাইরে বসে থাকে যে নেড়ি কুকুরটা, তাকে দুটো বিস্কুট দিলো ও। শরৎ আসছে, সাদা ফেনার মত মেঘ ভাসছে নীল আকাশে… ঠিক যেন দিশার সাদা ফুলছাপ নীল কামিজটার মত।
কদিন ধরে লক্ষ করেছে ও, দিশা ফোন করতে করতে পড়ার ঘরের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে পর্দা সরিয়ে বইয়ের তাকে উঁকিঝুকি দেয়। একদিন তো আলমারি থেকে একটা বই নিয়েও গেল। যদিও ভান করলো বইয়ের খোঁজেই এসেছে, কিন্তু আসল কারণটা কি হতে পারে, তা কি আর বুকুন জানে না!
প্রি টেস্ট শুরু আজ থেকে। এখন সাতদিন বুকুন রুদ্র’দের বাড়ি যেতে পারবে না। নিজের পড়াশোনাও আছে। মন তাই একটু খারাপ। তবে, এটাও ভাবছে ও, এ কদিন ওকে না দেখে দিশাও নিশ্চয়ই উতলা হয়ে পড়বে। তার ওপর ওই কবিতাগুলো তো ওকেই অঞ্জলি দিয়েছে বুকুন, দিশাও এবার ওর খোঁজ নেবে নিশ্চিত! … নেবে না? তাও কখনো হয়!!!
আজ শুক্রবার। শেষ পরীক্ষা ছিল ভূগোল। পরীক্ষাগুলো ভালোই দিয়েছে মনে হয় এবার। মনটা উচাটন। দিশা কেমন আছে? ওও কি এ কদিন, বুকুনকে খুঁজেছে? আসতেও তো পারতো আন্টির সঙ্গে একদিন, রুদ্রকে নিতে আসার অছিলায়! ভাবে বুকুন। অবশ্য, কি করেই বা বলবে আন্টিকে, ওর ও তো লজ্জা করবে, না কি! নিজেকেই প্রবোধ দেয় সে, আপন মনে একটু লাজুক হাসেও।
গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে রুদ্র। হাসি হাসি মুখ, বুকুনের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলে,
–একটা কথা আছে বস!
ধড়াস করে ওঠে বুকুনের বুক,
–কি কথা?
–পরশু রোববার আমাদের বাড়িতে তোর দুপুরে নেমন্তন্ন। দিদিভাই বিশেষ করে বলে দিয়েছে, তুই যেন আসিস। ওর কজন বন্ধুবান্ধব আসবে, তোর সঙ্গে আলাপ করাতে চায়; তাছাড়া…………
‘দিদিভাই’, ‘নেমন্তন্ন’, ‘আলাপ’…….মাথাটা ঘুরে ওঠে বুকুনের। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি! দিশা ডেকেছে তাকে! “বিশেষ করে”!! বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করাবে বলে!!! এটাও স্বপ্ন নয়তো?? এতটা পাওয়ার আশা তো বুকুনের স্বপ্নেও ছিলোনা।
প্রানপন চেষ্টায় নিজেকে স্থির রেখে বুকুন বলে
–তাছাড়া?
–”তাছাড়া”টা বলা নিষেধ তোকে এখন..চোখ নাচিয়ে ব’লে, মুখে হাত চাপা দেয় রুদ্র। ফিসফিস করে বলে..
–তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে বললো।
বুকুনের পা কেঁপে যায়, চেষ্টা করেও কি আর সংযত থাকা যায়! বুঝতে পারে,ফর্সা মুখ লাল হচ্ছে, সদ্য জাগা হালকা গোঁফের রেখায় ঘাম..
চট করে ব্যাগ থেকে একটা চিপসের গোটা প্যাকেট বের করে, রুদ্রর হাতে দেয় সে।
–নে, খাস।
–হঠাৎ চিপস দিলি কেন? অবাক হয় সাদাসিধে রুদ্র। ওর মনে পড়ে যে, রৌনক কখনো কারুর সঙ্গে চিপস শেয়ার করে না।
–তুই ভালোবাসিস, তাই দিলাম, যা পালা।
নাকের ডগার ঘাম মুছতে মুছতে রাঙা বুকুন ভাবে, ভাগ্যিস রুদ্রটা মাথামোটা। কি লজ্জায় পড়তে হ’ত তা না হলে!
শনিবার কখনো কখনো এত দীর্ঘ হয়, বুকুনের আগে জানা ছিল না। পাঁচটা মিনিট যেন গোটা একটা দিনের মত লম্বা। পুজো আসছে, পাড়ার ক্লাবে ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে, ছটাই দের বাড়ির শিউলি গাছের তলাটা ফুলে ফুলে ভরে আছে, শু়ঁয়োপোকা উঠছে গাছের গা বেয়ে, পাতা খাবে বলে। আকাশে অনেক রং বাহারি ঘুড়ি, কচুরিপানা ভর্তি ডোবার পেছনে দু চার গোছা কাশফুল। বিজয়কাকু সাইকেল চালিয়ে ওদিকে গেল। ন’ দাদুর দোকানের টিনের চালে দুই শালিখ, নিশীথদা বাজার থেকে ফিরছে, ফুলকপি, টমেটো, ধনেপাতা উঁকি মারছে থলে থেকে। ভ্যান রিক্সা করে কাদের মালপত্র কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে কে জানে! সবকিছু বুকুনের আজ এত ভালো লাগছে কেন! এত নতুন মনে হচ্ছে কেন! সব আলো যেন আজ ওর চোখের সামনে, এত উজ্জ্বল দিন কখনও দেখেনি বুকুন আগে।
রোববার সকালে উঠে স্নান সেরে নিয়েছে বুকুন। পুজোর জন্য মাসিমনি একটা সবুজ চেককাটা শার্ট দিয়েছে, ওকে মানাচ্ছে বেশ। মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও সেই নতুন শার্ট পরে ফিটফাট হয়ে, মোট বারোবার চুল আঁচড়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দশ বার নিজেকে জরিপ করে, যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো সে। দুপুরের নিমন্ত্রণ ঠিক কটায় যাওয়া উচিত? সাড়ে বারোটা হলে একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে কি? একটা’য় পৌঁছলেই হবে! ওর মন হিসেব নিকেশ করে রায় দিলো।
কাঁটায় কাঁটায় একটায় রুদ্রর বাড়ি পৌঁছোয় বুকুন। হাতে একগোছা সূর্যমুখী ফুল, পাশের পাড়ার ফুলের দোকান ঘুরে এসেছে!
দাদু বলেন, সূর্যমুখী কখনো হারে না। অন্ধকারে ঘুমিয়ে গেলেও, ভোরের আলো পেলেই, নতুন করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
ওপরে দিশার ঘর থেকে হইচই ভেসে আসছে। ও ঘরে কখনো যায় নি বুকুন। রুদ্র এসে হাত ধরে ওকে নিয়ে গেলো,
– চল, চল, দিদিভাই এর বন্ধুরা সব এসেছে, ক’জন আবার বেশ ফেমাস বুঝলি, টিভি তে মুখ, ফুখ দেখায়। দিদিভাই তোর কথা বলছে, তোকে খুঁজছিল
বুকুন অনুভব করে ওর জিভ শুকিয়ে এসেছে, পা দুটো আড়ষ্ট। সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে যেন বুকের ভিতর ঢেঁকির পাড় ভাঙছে।
দরজার চৌকাঠে পা দিয়েই দিশা ও তার বন্ধুদের দেখতে পায় বুকুন। ঝকঝকে পোশাক ও সাজের চারটে মেয়ে, আর আঁতেল আঁতেল মুখের তিনটে ছেলে। প্রায় সবার হাতেই সিগারেট। হালকা মিউজিক বাজছে। কি একটা কথা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে খুব। সবার মধ্যে দিশা অনুপম। আজ পরেছে লালকালো লং স্কার্ট ও মেরুন কুর্তি। গলায় বিডস এর মালা, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। চোখ পাথর হয়ে গেছে বুকুনের। গলায় তেষ্টা টের পায়..
–দিদিভাই, এই নাও, এসে গেছে, সোল্লাসে জানায় রুদ্র।
দিশা ঘুরে তাকায়, তারপর দ্রুত এসে বুকুনের হাত ধরে ভেতরে টেনে আনে।
– ফ্রেন্ডস, মিট দিস ইয়ং বয়, রৌনক চ্যাটার্জী, প্রমিত তোকে এই ছেলেটার কথাই বলছিলাম সেদিন
চশমা চোখে, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির ছেলেটি বলে,
–ও এই সে? একেবারে বাচ্চা তো। এসো ভাইটি, বসো তো আমার পাশটাতে
–যা, বোস গিয়ে, ভয় কি রে রৌনক, সবাই আমার মত দাদা দিদি তো! মেরুন কুর্তি অনায়াসে বলে।
ঘরে আলো না অন্ধকার, টের পাচ্ছে না বুকুন। ও যেন একসমুদ্র জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ফ্রেঞ্চকাট পাশ থেকে পিঠ চাপড়ে দিলো
–খুব ভালো কবিতা লেখো এই বয়সেই, ভাগ্যিস দিশার নজরে এসেছিল। আমাদের পত্রিকায় সবসময়ই এইরকম ইয়ং ট্যালেন্টদের সঙ্গে ইনট্রোডিউস করিয়ে দিই পাঠকদের! বেশ কেত মেরে কথাগুলো বলে, একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে প্রমিত।
–তুমি কিন্তু নিয়মিত লিখবে আর লেখা পাঠাবে কেমন? জিন্স আর পিঙ্ক টপের মেয়েটি বলে!
– কি সুইট মুখটা, না? সোফায় আধশোয়া সিড়িঙ্গে মেয়েটা কমপ্লিমেন্ট দেয়
– বাজে কথা ছাড়, রৌনক পড়াশোনাতেও খুব ভালো শুনেছি, দিশার ভাইকে পড়ায় আবার; কেমন পরীক্ষা দিলে রৌনক? বেঁটে ছেলেটা বলে,
–এই বয়সে এমন রোমান্টিক কবিতা, কি রে প্রেম টেম করিস না কি তুই!…সালোয়ার কামিজ বলে
–আহাহা… এমন করছিস তোরা, যেন ইন্টারভিউ দিতে এসেছে, দেখ বেচারা কেমন ঘাবড়ে গেছে… প্রমিত বিজ্ঞের মত মন্তব্য করে।
–ঠিক আছে রৌনক, তুই যা, ভাইয়ের সঙ্গে গল্প কর। তারপর একসঙ্গে লাঞ্চ করবো কেমন?
স্থবির বুকুন লাল কালো লং স্কার্টের দিকে এগিয়ে দেয় সূর্যমুখীর গোছা… তার সবচেয়ে প্রিয় ফুল।
সাগ্রহে ফুল নেয় দিশা, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখ। হাত বাড়িয়ে গাল টিপে দেয় বুকুনের।
–লেখা চালিয়ে যা রৌনক, তুই অনেক বড় লেখক হবি, দেখিস।
– এ সংখ্যায় তোমার দুটো কবিতাই ছাপা হবে। অভিনন্দন।। কে যেন বলে
বুকুন আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না। অনেকে অনেক কথা বলছে মনে হয়, কিন্তু ওর কানদুটোতে লক্ষ ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে, সারা গায়ে কোথায় কোথায় যেন ছুঁচের মত কি একটা বিঁধে চলেছে। তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে– একটা বাতাবি লেবুর গাছ, তার ডালে একটা কাঠঠোকরা বসে গাছটাকে ঠোকরাচ্ছে, ― ঠুকরেই যাচ্ছে…
সিঁড়ি দিয়ে রুদ্রর সঙ্গে নামতে থাকে বুকুন
–বলেছিলাম না, তোর জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে, আনন্দে, উত্তেজনায় ফুটছে রুদ্র। মনে হচ্ছে যেন ওরই কবিতা প্রকাশিত হতে চলেছে। ফিসফিস করে জানায়
–ওই যে প্রমিত, ওটা দিদিভাই এর বয়ফ্রেন্ড, আমি জানি। রাত জেগে ফোনে কথা বলে, শুনেছি তো সব!
সিঁড়ির কোণে একটা মৌচাক হয়েছে, আন্টি বলছিলেন সেদিন, সাবধানে যেতে। অসাবধানতাবশত একটা কামড়ে দিলো কি চোখের পাতায়? কিংবা মাথার মাঝখানে? এত জ্বলছে কেন সব! সুমেরুর সব বরফ গলে গিয়ে প্রবল ধারায় নেমে আসছে কি জল?
বুকুনের ঝাপসা চোখের সামনে তখনই ভেসে ওঠে ওই সূর্যমুখীর গোছা… শ্বেতপরীর হাতে কেমন হেসে চলেছে… অভিমান, আশাভঙ্গ, অপমান কিছুই তো কই তাকে স্পর্শ করতে পারে না! রাতে ঘুমিয়ে পড়লেও, সূর্য উঠলেই সে জেগে উঠবে ফের…
ওদিকে রুদ্র লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে আর বলছে
― মা, বলেছিলাম না, রৌনক খবরটা পেয়ে খুব আনন্দ পাবে, এই দেখো, আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেছে…