সেতুবন্ধন

  সুমিত ভট্টাচার্য্য 

 

যেভাবে মাঠ গ্রাম মহানগর পেরোয় সেভাবেই সময় পেরোয় আমাদের ভালো থাকা, কম ভালো থাকা, এসবই অবশ্য সেই সময়ের পথ পার হওয়া। এ পথের সাথী হয়ে বেঁচে থাকা। মৃত্যু, শোক, আক্ষেপ সব সঁপে যায় সময়ের কোলে। কেউ ভাবে ভালবাসবে, কারও প্রেম পুরনো রঙে, ফড়িঙের উড়ে যাওয়ায় কেউ খুঁজে পায় শিশুবেলা। সেই মাঠ, ঘাস,কথকতারা, ইস্কুল ফেরত ঘেমো জামায় মেঠো স্বাদ নিয়ে গোঁত্তা খাওয়া ঘুড়ি,ব্যাট,ক্যাম্বিস বল মনের ছবিতে ভেসে ওঠে বর্ষায় কাগজের নৌকার মতো।স্বপ্নের জলরঙে ভালবাসার বিকেল, এক্কাদোক্কা এক উজান হয়ে থাকা শিশুকাল। ঠাকুমার ঝুলি, উপেন্দ্রকিশোর থেকে নানা রূপকথা আর তার চরিত্রেরা চোখে এক পলক ছোঁয়া দিয়ে যাওয়া অকৃত্রিম সেই অনুভূতি আরও আরও গভীরে নিয়ে স্বপ্নের জাহাজে ভাসিয়ে দিত।

ঘুমের রেশ একটু একটু করে কাটে। স্বপ্নের ভাব বদলায়। চোখ মেলতে থাকা চোখেরা নতুন পৃথিবী চিনতে শেখে। অধ্যায় বদলের মুহুর্তে পরিবেশও জানান দেয় সেও এক চরিত্র এই জীবনের ছোটগল্পে। পরিবেশ এক সামান্য শব্দ আবার সময়ের পথ চলায় এর ভূমিকাও অনন্য। নদীর পাড়ে বসে মাঝিমাল্লার দাঁড় বাওয়া, জেলেদের মাছধরা, একডুবে স্নান এসব দেখার বেলায় উদাস হয়না অথচ বড় হতে থাকা মন একটু নরম হয় তার বাইরের ব্যবহারে। শিশু নয় কৈশোরে পা দেওয়া সময় নিজেকে খানিক বড় ভাবার চেষ্টায় অস্থিরতা। নৌকো ধরা বা মাঝিদের ভেসে যাওয়া যেন কৈশোর চোখের রোমাঞ্চ! মাঠ ময়দানের সঙ্গে নিবিড় টান নইলে যেন নদীরপাড়ে বসেই কেটে যেত সারাবেলা।  সময় আসে কথা ঝরে নতুন কথা, শব্দ তেরি হয় কৈশোর থেকে বেলা বয়ে যৌবন জোয়ারভাটায়। একটু একরোখা, উদ্দাম, বাধ না মানার মন। তবে আবেগ মথিত আঘাতও আসে অহরহ। সেও সামলে চলে নতুন কে পাবে বলে। কল্লোল জাগিয়ে তোলা এক নতুন।আবদ্ধ জলের কারাগার ভেঙে নতুন দিক উদ্ভাসের শপথ। তবু অভিজ্ঞতার অভাব আঘাত কে গুরুগর করে তোলে। ছিঁড়ে যাওয়া তার জুড়ে ফের গীটার বেজে উঠলেও প্রেম ফিরে আসেনা। সময়টা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ঘরানা, নতুন স্বপ্ন, নতুন স্বর বদল।

জগৎ আরেকটু মায়াবী করে তোলে বাড়িয়ে দেওয়া নতুন হাতেরা। অন্যমাত্রার এক জগতের স্বপ্ন দিয়ে ঘোর লাগিয়ে দেয়।  খানিক সময় লাগলেও ঘোর কাটে, ছড়ে ঠিকই তবে ক্ষতে প্রলেপও পড়ে সময়ের নিয়মেই। একটু একটু করে একান্নবর্তী থেকে একক পরিবার কেন্দ্রিক সমাজ হওয়ায় আনন্দের ভাগীদার কমে যায়। আর একথা কেনা জানে আনন্দ ভাগেই আনন্দলাভ। সেই ছোট্ট থেকে আজকের মুহুর্ত বড় বেশী আলাদা ঠেকে। সমাজ, দিনকাল বুঝতে শেখা, ঠেকতে ঠেকতে বড় হয়ে ওঠা। ক্রমশ চোখে পড়ে পৃথিবীর জীর্ণ দশা। সূর্যোদয়ের চেয়ে সূর্যাস্ত চোখে পড়ে বেশী। বহুতল যেখানে প্রাণখুলে আকাশ দেখা দেয়না, ঘুড়ি ওড়া বিকেল বা কুড়িয়ে পাওয়া কাটা ঘুড়ি এক অবাস্তব কল্পনার মতো মনে হয়। ঘর যত বড় হয় বেড়ে যায় দূরত্বও। বিত্তশালী আবাসনের উঁচুতলা ঘর থেকে মানুষ দেখা গেলেও ছোঁয়া বেই মাটির নিজস্বতা। আর পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশার প্রবণতা পরিবার সূত্রেই পায়, অথচ বেড়ে ওথে আত্মকেন্দ্রিক যাপনের মধ্য দিয়ে। চার দেওয়ালের আপন কাহিনী নিয়ে কেটে যায়। যন্ত্রের মতো এক কাঠামোর দিকে এগোতে থাকে সময়। আসলে এসবই বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগের আত্মকথা। পাখি দেখা, সকালের প্রথম আলো, ঋতু বদল এসবই যেন হারিয়ে যাওয়া কথোপকথন। বয়স যত এগোয় যৌবন ছাড়িয়ে কথারা পেরোয় তাদের পথ, সেখান থেকেই যখন কুড়িয়ে পাওয়া লাল সুতো নীল সুতো, কাটা ঘুড়ি, ভাঙা লাটাই তখন মন পিছু ফেরে একবার। এমনটাতো কথা ছিল না। সেই মাঝিদের গলা ছেড়ে গান, ঠাকুরদার পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে শিশুদিনের মস্করা। কি বিস্তর ফারাক থেকে বেড়ে ওঠা আর চেতনের। আজকের অত্যাধুনিকতার যুগে দাঁড়িয়ে সময় কে মাৎ দেওয়ার চেষ্টায় জীবনকে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিযোগিতার নিরিখে, গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

ইদ, শারদ উৎসব, বড়দিনের মাধুর্যকে আর সেই মেলোডি দিয়ে মাপা যায়না। এখনের বসতি অন্য মুখ, অথচ এই উৎসবের মুহুর্তই আসল মিলন পর্ব। ঘরানা যিত বদলেছে ভালবাসার আদলও বদলেছে তার সঙ্গে।দেখনদারী,পেশকারী ভাবনার দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এর ফল হিসেবে কাঠেরপুতুল মাফিক সময় ও তার ব্যবহারিক জীবনরীতির দেখাই মিলবে। বসন্তকে বলা হয় প্রেমের ঋতু, অর্থাৎ কিনা প্রেম ও প্রেমের সংস্পর্শে এক প্রবাহ তৈরি হয়। যদিও প্রেম অনন্ত বিশ্বজনীন তবু এই ঋতুর এক আলাদা মাত্রা থাকেই। তবে বসন্তের গন্ধে রঙ না মিশলে বসন্তের বিকাশ হয়না। ঠিক এখানেই এসে থমকে যায় কথা। সত্যিই আজকের অত্যাধুকিকতার ব্যস্ত যুগে আবিরখেলা নেই, দোল নিয়ে সেই মাতামাতি নেই, বা অন্য ঋতুর ঘুড়িখেলায় রাত জেগে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার হিড়িক নেই যেন বড্ড সেকেলে হয়ে পড়েছে এসব। চোখের সামনে নাহোক খুব কম হলেও দু একটা ব্যতিক্রম চোখে পড়েই যায়। সেই কিতকিত সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে রঙিন আবীর কেনার ছটফটানি। মুছে কিছুই যায়নি কেবল সময়ের চাপে ধুলো পড়েছে খানিক। আবার জগিয়ে তুলতে রোদের প্রয়োজন আর সেই পথিক হল সম্পর্ক আর তার মূল্যবোধ। আলো চিনতে ও তার প্রকৃত বিকাশের জন্যে চাই শিক্ষার প্রতিফলন।

পরিবেশে দরকার সেই শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ। একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। একাকীত্বের মধ্য দিয়ে নয়,একাত্ম হয়ে থাকার জন্যে গান। এ এক ফিরে আসার গান। সেই গান হোক শিশুবেলা জাগিয়ে রাখার, ভালবাসার সঙ্গে নতুন আশার গান। মানবশৃঙ্খলের স্বাদ যদি বহুতলে পৌঁছোয়ে তবে সেদিন দেরী নেই ঐ বহুতল থেকে মাটির কথোপকথনে মিশবে মিলনলিপি। পাশাপাশি বসে থাকা  শিশুমনে ‘আমি-তুই’ নয় আমরা জেগে উঠবে। কিন্তু এই জেগে ওঠা বা অন্যদিনের আলোর জন্য প্রয়োজন অপেক্ষার।যেমন গন্তব্যের জন্যে অপেক্ষায় থাকা যায়  তেমনই নতুন আলো পেতেও অপেক্ষা করা যায়, যেন এই অপেক্ষাই এক অন্য প্রাপ্তি। সভ্যতার এই বহুতলীয় প্রতিযোগিতার বাইরেই আছে নতুনের চমক, শুধু চোখে পড়া দরকার।

শিশুবেলা হোক বা বড়বেলার অফিসপাড়া, ফুটপাথের খাবার, আড্ডা, কেবিন, তর্ক, বিতর্ক প্রেম সাহিত্য সবেই নিজস্বতাই স্বীকৃতি দিয়েছে।যেখানে ইঁদুরদৌর থাকেনি ভালবাসা জিতে নিতে শিখে গেছে সেখানেই। নতুন রঙ ভালবাসায় ভরে ওঠে আগামীর প্রতীক। অথচ মেকি আচার সর্বস্বতা জীবনধারণের মৌলিক সুগন্ধিকে সমূলে উৎখাতের চেষ্টায় মেতে। এগোনোর মতো করে সঠিক এগোতে পারলে মেঘ কেটে যায় নিজস্ব নিয়মেই। তাতে সভ্যতার যান্ত্রিকতায় খানিক লাগামও পড়ানো সম্ভব হয়। ভালো থাকার ইচ্ছেই নতুন সময় বয়ে নিয়ে আসে, শিশুকাল, কৈশোর যাপন, যৌবন উদ্দীপনা সরে গেলেও মনে শৈশব, কৈশোর, যৌবন জেগে থাকে বারোমাস। যান্ত্রিকতার ঊর্ধ্বে উঠে তাকে চিনতে পারা চাই,সফল নয় সার্থকতা ধরা দেবে প্রথম প্রেমের মতো।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − eleven =