অঙ্গদান : একটি বৈপ্লবিক কালসন্ধি
অ-নিরুদ্ধ সুব্রত, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
‘বিপ্লব’ শব্দটির অর্থ ক্রমে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিবর্তনের গন্ডি ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে জগতের বিস্তৃত ক্ষেত্রে।শিল্পবিপ্লব, সবুজ বিপ্লব,শ্বেত বিপ্লব,প্রভৃতির পাশাপাশি একদিন সভ্যতার ধারায় এসেছে টেলিকম-বিপ্লব। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বৈপ্লবিক জোয়ার ব্যাপক ও বহুমুখী। আর আজকের ভারতবর্ষ এক নতুন সমাজ-মানবিক পরিবর্তনের ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। যার ভিত্তিভূমি তৈরি করছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসক, সরকারি সদিচ্ছা ও উদার জনসচেতনতা।
এই সেদিনও মৃত্যু পরবর্তী শবদেহ অক্ষত রূপে পেতে স্বজনদের ছিল দৃঢ় প্রত্যাশা। মস্তিষ্কের মৃত্যু-এই ব্যাপারটাই রোগীর নিকটজনকে বোঝানো একেবারেই সহজ ছিল না। বরং অপেক্ষার শেষ প্রহরের পরের প্রহরেও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা দেহ হাতছাড়া করতে রাজি ছিলনা প্রায় কেউই । প্রিয়জনের মৃত্যুকে মেনে নিতে কারও মন যেমন চায় না,তেমনি মৃত শরীরের প্রতি ছিল এক অমোঘ অক্ষত আকাঙ্ক্ষা। তা সে শবদেহ কবরে যাক বা শ্মশানে। আসলে বাস্তব এবং সত্যকে মেনে নিতে সময় লেগেছে। একটু একটু করে যুক্তি বোধ এবং মৃত্যুর পরবর্তী জগতে জীবনের প্রয়োজনে আসা নিয়ে বেড়েছে সচেতন প্রজ্ঞা। আজ যেন তারই এক বৈপ্লবিক যুগসন্ধিক্ষণ।
ঝাড়খণ্ডের বিকল-হৃদয় শিক্ষক দিলচাঁদ উপহার পেলেন একটি সুস্থ-হৃদয়। এবং ঐ একই যুগান্তকারী উদ্যোগে প্রতিস্থাপিত নতুন হৃদযন্ত্রে জীবন ফিরে পেতে চলেছেন রানীগঞ্জের পানের দোকানদার রাখাল। কিন্তু এ শুধু হৃদয় খুঁড়ে বেদনা নিবৃত্তিরই একমাত্র প্রয়াস নয়, ব্রেন ডেথ শরীরের সক্রিয় লিভার, কিডনি, কর্ণিয়া প্রভৃতি সুস্থ অঙ্গের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার সৎ ও জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার মানবিক উদ্যোগ। দিনে দিনে এই উদ্যোগ এবং ঔদার্য নিয়ে এগিয়ে আসা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির এক যুগান্তকারী সংকেত।
এই উপমহাদেশে প্রতি মুহূর্তে মিডিয়ায় চোখ কান যাই পাতুন অগণিত হিংসা,মৃত্যু, সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা আর রাজনীতি ও ধর্মের ষণ্ড-কান্ড বহমান। সাধারণ আর অতি সাধারণ দেশবাসীর সহজ সরল বোধের গভীরে সন্তর্পণে গড়িয়ে চলেছে অমানবিকতার কোহল-তরল।শিক্ষিত সচেতন মধ্যবিত্ত সর্বোক্ষণ ভুগছে দ্বন্দ্ব আর দ্বিধায়।
আর ঠিক সেই ধোঁয়াটে অন্ধকারের মধ্যেই যেন শোনা যাচ্ছে আপাত ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট বিবর্তিত এক বিপ্লবের ধ্বনি, আমরা করবো জয়। আমার জীবন, আমার শরীর-এ কেবল আমার জন্যই নয়, হয়তো এর বেচেঁ থাকা আর এক শরীরের আশ্রয়ে। বহু স্থাবর দানের চেয়ে বেশ কয়েক ধাপ উপরে উঠে অঙ্গদান আজ মহা মানবিক দান হিসাবে স্বীকৃত।
ভারতে দক্ষিণের চিকিৎসা নৈপুণ্যে আমাদের বিশ্বাস যে খানিকটা একপেশে তা পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকরা তাঁদের মহান সেবাকর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করছেন। কলকাতাতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আজ সফল ও নিয়ত। বিশেষ করে সরকার, প্রশাসন বিষয়ের গুরুত্বকে তৎপরতা ও মর্যাদা সহ মূল্য দিয়ে সহযোগিতার হাত করছে আপ্রাণ প্রসারিত। একটা সৎ প্রচেষ্টার প্রচার ও সচেতনতা নির্মাণের দায়িত্ব অনেকখানিই নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে বহুমাত্রিক মিডিয়া,প্রসংশা প্রাপ্য তাদেরও। আর সবচাইতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন তা হলো অঙ্গদানকারী মৃত ব্যক্তির স্বজন পরিজনদের শোকাহত পরিস্থিতির কঠিন মুহুর্তে উদার সহযোগিতার দৃঢ়তা। অর্থাৎ একটা বহুমাত্রিক সচেতন প্রবাহ আজ প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের রাজ্যেও। তবু, এখনও অঙ্গদানের প্রচার প্রসার যথেষ্ট নয় । এই ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির দায় কেবলমাত্র সরকারি উদ্যোগে সম্ভব নয়। সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণির দায়িত্ব যেমন বর্তায়, তেমনি সমাজে বিজ্ঞান চেতনার প্রসারে সব ধরনের চিকৎসকদেরও একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়। প্রয়োজনে বিদ্যালয় স্তর থেকে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সিলেবাসের মাধ্যমে অঙ্গদান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে সচেতন করে তোলা যায়। প্রয়োজনে এই বিষয়ে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল গুলোর মধ্যে একটা সহযোগিতার সমন্বয় গড়ে তোলা। যাতে প্রতিস্থাপন ও তৎসংক্রান্ত চিকিৎসার সব রকম সহযোগিতামূলক আদানপ্রদান সম্ভব হয়।
প্রাণ নেওয়া যে সভ্যতায় আকছার, প্রতিহিংসার আগুন যেখানে নিভে যায় না, কুসংস্কার যেখানে শ্মশানে কবরে নিয়ে যেতে চেয়েছে প্রিয়জনের অক্ষত মৃত শরীর—-শুধু পোড়াবার জন্য অথবা সমাধি দেবার জন্য। যেখানে মেডিকেল কলেজ গুলোতে শিক্ষা-সহায়ক ব্যবচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শবদেহ মেলে না। আজ সেই চিত্রের আসন্ন সমাপ্তি কিন্তু দেখা যাচ্ছে।স্পষ্ট হচ্ছে মৃত শরীরের সচল বা সুস্থ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বহু অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রীর শরীরে প্রতিস্থাপনের ভরসা। অসহায় অসুস্থকে জীবনে ফিরিয়ে দেবার এই যে মহান মানবিক ইচ্ছের সংকেত দিগন্তে উদ্ভাসিত আজ—-এ কে বিপ্লব ছাড়া, রেনেসাঁ ছাড়া অন্য কোনও ভাবে অভিহিত করা যায় কি?
চিকিৎসকদের উপর প্রায় প্রতিদিনই খড়্গহস্ত হতে দেখা যায় গুচ্ছ মানুষকে। কিন্তু তারাও যে জলন্ত মানবিকতার উদাহরণ তা বোঝা যায় ১৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যখন দ্রুততার সঙ্গে জীবিতের শরীরে প্রতিস্থাপিত করে দেন সদ্য মৃতের সুস্থ অঙ্গ। অথচ মৃতের আত্মীয় পরিজনদের চোখে জ্বল জ্বল থাকে হারানো স্বজনের স্মারক এক বা একাধিক অঙ্গ। অন্যের শরীরে এই যে বেঁচে থাকার অন্তিম সান্ত্বনাটুকু, তা কি এই নতুন কালের মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব হতো ? আজ কথায় কথায় আমরা বুঝে যাচ্ছি ‘গ্রীনকরিডোর’ নামক একটি মানবিক বন্দোবস্তের। উৎসাহিত হচ্ছি নিকটের জনে জনে অসুস্থকে অঙ্গ দানে উদ্বুদ্ধ করতে—- ব্যাপক অর্থে এ জাতির জাগরণ, বৃহত্তর এক মানবিক বিপ্লব। আজ ভারতবর্ষ তথা বাঙালি তার গর্বিত শরিক। সকল বিস্রস্ততার, বিপন্নতার মাঝে দিগ্বিদিক ধ্বনিত হচ্ছে আমরা করবো জয়,নিশ্চয়।
তবে, এর পরও যে কথাটি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সহ সকলের ভুলে গেলে চলবেনা যে, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পরবর্তী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও গৃহীত উপযুক্ত ব্যবস্থা সম্পর্কে উদাসীনতা অনেক ক্ষেত্রে মূল উদ্যোগকে অসফল করতেও পারে।সেক্ষেত্রে সমাজে কোনও ভুল বার্তা যেন না পৌঁছয়। কিন্তু আমাদের এই সত্য সম্পর্কেও অবগত থাকতে হবে যে, শুধুমাত্র সফলতার সংখ্যা দিয়ে এই মহান মানবিক বিপ্লবের প্রকৃত মূল্য যাচাই করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। বরং যুগান্তকারী এই অঙ্গদান প্রক্রিয়াকে সম্মানিত করতে হবে ভাবি প্রজন্মের হাত ধরে। যে কোনও বিপ্লবের সেখানেই সার্থকতা।