অঞ্জনা ( ২য় পর্ব )
অচেনা অথচ গুরুত্বপূর্ণ, পুরাণে রয়েছে এমন অসংখ্য নারী চরিত্র। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখা থাকছে অবেক্ষণ–এ। বড়দিন সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে হনুমানের মা অঞ্জনার কাহিনী। এবারে দ্বিতীয় পর্ব, লিখছেন ময়ুমী সেনগুপ্ত।
পুঞ্জীকস্থলার লক্ষ্য কিন্তু পবনদেবের সঙ্গে জলকেলি নয় , বরং নিজের সিক্ত সৌন্দর্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ওই যুবকদের প্রলুব্ধ করতেই উৎসুক বেশি সে। ওদিকে ওই নির্বোধ যুবকবৃন্দ। তারা খুব ভালো ভাবেই জানে এই অপ্সরাকে তারা কোনোদিন পাবে না। তাই শুধু এই নারীর সৌন্দর্য চক্ষু দিয়ে লেহন করেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে।
আর পুঞ্জীকস্থলা , সে তো রীতিমতো ওই নির্বোধ যুবকদের প্রলুব্ধি বাড়িয়ে তুলছে। নিজেকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করে সে বারংবার এগিয়ে দিচ্ছে যুবকদের কাছেই। আর এই অপ্সরাকে পাবে না জেনেও যুবকদল ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু আর নয়। এবার তাঁকেই এগিয়ে যেতে হবে। নাহলে পবনদেবের হাতে ওই মরণশীল মানুষদের মৃত্যু অনিবার্য।
পবনদেব বুঝতেও পারছেন না পুঞ্জীকস্থলার চাতুরী। যে সে সকলকেই ব্যবহার করে চলেছে। আর প্রেমের সাতপরতা কাপড়ে বাঁধা পবনদেবের চোখে বাগদত্তার অপমান বড় হয়ে উঠবে। ওই যুবকদের একটি দোষ , যে ওরা পতঙ্গের মতো ওই রমণীর জ্বলন্ত রূপের প্রতি ধাবিত হচ্ছে।
কে না জানে সৃষ্টির আদিকাল থেকে নারীকে কেন্দ্র করে ঘটে গিয়েছে রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতা। প্রমাদ গুণলেন বৃহস্পতি। এখুনি এই নিন্দনীয় কার্যের সমাপ্তি ঘটাতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে পিতা হিসেবে তাঁকে কঠোর হতে হবে। প্রথমবার আর সর্বোপরি শেষবার। কারণ শুধু মুখের শাসনে মনে হয় না তাঁর এই দুর্বিনীত কন্যাকে বাগ মানানো যাবে।
দু চোখ জলে ভরে আসে বৃহস্পতির। এ কি সেই কন্যা তাঁর , যে আধো আধো বুলিতে মাতিয়ে রাখতো দেবগুরুকে। এ কি সেই মেয়ে , যাঁর জন্য কোনোদিন বৃহস্পতিকে স্বামী বলে স্বীকার না করা তারা স্বীকার করে নিয়েছে , এ তাঁদের দুজনের সন্তান। গর্ভজ না হলেও সন্তান সন্তান-ই হয়। যে মেয়েটার দু চোখের তারায় সেদিন পর্যন্ত খেলা করতো সারল্যের আলো, আজ সেখানে শুধুই ইন্দ্রিয়ের দাসত্বের অভিমান , নিজের সৌন্দর্যের গর্ব।
যুবকদের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই পুঞ্জীকস্থলার মুখে ফুটে উঠলো এক রহস্যময় হাসি। এক আঁজলা জল ছুড়ে দিলো তাদের দিকেই লক্ষ্য করেই।
অপ্সরার এই জল ছুঁড়ে দেয়া প্রত্যক্ষ ইন্ধন যোগালো সেই যুবকদের। উৎসাহিত হয়ে তারা ভাবলো অপ্সরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাদেরকে জলকেলি করবার। কিন্তু এগোতে গিয়েও থেমে গেলো যুবকদের পা। চোখ পড়লো অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা দেবগুরু বৃহস্পতির উপর। দেবগুরুর চোখ দিয়ে যেন অগ্নি বর্ষিত হচ্ছে। সভয়ে থেমে গেলো তারা। ওদিকে অপ্সরা দ্বিগুণ উৎসাহে জলকেলি করতে শুরু করলো। একমাত্র লক্ষ্য ওই যুবকদের উত্তেজিত করা। রূপ যৌবনের মত্ততায় শিষ্টাচারের স্বাভাবিক সীমাটুকুও সে লঙ্ঘন করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু তা নিয়ে পুঞ্জীকস্থলার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ থাকা তো দূর , বরং সে আরো উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল।
হঠাৎ পুঞ্জীকস্থলার কানে এলো বহু পরিচিত কণ্ঠস্বর , স্তব্ধ হও দুর্বিনীতা যুবতী। নারীর ভূষণ লজ্জা। যা স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে তো ফেলেছ বহু পূর্বেই , এখন মানুষকে রূপ যৌবনের ছলাকলায় বিভ্রান্ত করার মতো নীচ কাজেও লিপ্ত হয়েছো। একজন পুরুষের বাহুলগ্না , অথচ মনে মনে কামনা করছো বহু পুরুষকে। এ কেমন ধারা প্রেম তোমার। প্রেম শব্দের অপমান করেছো নির্বিকারচিত্তে। এমন শিক্ষাই কি তুমি আমার কাছে পেয়েছো ?
বারবার তোমার মা তোমায় সাবধান করেছেন। কিন্তু তাঁর কথা মান্য করবার পরিবর্তে তাঁকে তাঁর অতীতের কথা তুলে অপমান করেছো , যন্ত্রণা দিয়েছো। সে মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু আমার কাছে তোমার বিপক্ষে একটি কথাও বলেনি। কারণ সেই নির্বোধ মাতা তারা আজ বিশ্বাস করে , যে তাঁর সন্তান ঠিক একদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবে।
পুঞ্জীকস্থলার কানে যেন কেউ জ্বলন্ত সীসে ঢুকিয়ে দিলো। এ কোন কণ্ঠস্বরে কথা বলছেন তাঁর সঙ্গে পিতা বৃহস্পতি। এ কি সেই ব্যক্তি যাঁর স্নেহভরা কণ্ঠস্বর অহরহ তার কানে মধুসিঞ্চন করতো। সর্বসমক্ষে তো দূর একান্তেও পিতা তার সঙ্গে কখনো এরকম ভাবে কথা বলেন নি। আজ জীবনে প্রথম বার কন্যা নয় , যুবতী সম্বোধন ! সত্য কথা বলতে পিতার উপস্থিতি এ যাবৎ তার চোখেই পড়েনি। পড়লে হয়তো সে নিজেকে সংযত করতে পারতো।
কন্যাকে নিরুত্তর দেখে বৃহস্পতির রাগ আরো বেড়ে গেলো। বলে চললেন তিনি। আসলে ভুলটা আমারি। বোঝা উচিত ছিল এক গাছের ছাল কখনো অন্য গাছে লাগে না।তা তার পিছনে যতই মেহনত করা হোক না কেন। একদিন না একদিন তা খুলে ঠিক পড়েই যাবে। তেমনি অপরের সন্তানকে যতই আদর ভালোবাসা স্নেহ মমতা দিয়ে মানুষ করা হোক না কেন , তাতে কোনো লাভ হয় না। সে কোনোদিনই নিজের সন্তান হয়ে উঠতে পারে না , তুমিই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর তাছাড়া আমার মনে রাখা উচিত ছিল , রক্ত কখনো বেইমানি করে না। রক্তের রং জলের চেয়েও ঘন। কাজেই তোমার ধমনীতে বয়ে চলা অপ্সরার শোণিত যে একদিন না একদিন স্বধর্মে প্রকাশিত হবে , এ তো আমার আর তারার আগেই বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু বাৎসল্যপ্রেমে অন্ধ থাকায় দুজনের কেউই তা বুঝতে পারিনি।
এতোক্ষণ নীরব থেকে সব কথা শুনছিলো পুঞ্জীকস্থলা। কিন্তু বৃহস্পতির তার রক্ত নিয়ে কটাক্ষ করায় ক্রোধে জ্বলে উঠলো অপ্সরা। ভুলে গেলো এক লহমায় , যে সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্মদাতা না হলেও পালকপিতা , যিনি নিজের কথা না ভেবে তাকে আদর যত্নে একটু একটু করে এতো বড়টি করেছেন। ভুলে গেলো এক মুহূর্তে যে এগুলো তাঁর রাগের কথা , অভিমানের বাক্য। একবার তার একথাও মনে হলো যে , আসলে এ সব হলো পালিকামাতা তারার চক্রান্ত। তাঁকে অতীত নিয়ে খোঁটা দেয়ায় , তিনি আমাকে দেবগুরুর চোখে হেয় করতেই এখানে পাঠিয়েছেন বৃহস্পতিকে। না হলে এ স্থানের কথা তো তাঁর জানা সম্ভব নয়। পুঞ্জীকস্থলার একবারের জন্য মনে হলো না যে , তারার পক্ষে এই জলকেলির কথা জানা তো দূর , অনুমান করাও অসম্ভব।
(চলবে )