অনাদরের আদর

 তনুপ্রিয়া চক্রবর্তী, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##

তুতানের চোখে মামাবাড়িটা এখন বড়ো অদ্ভুত ঠেকছে। গতকাল এসে থেকেই দেখছে নীলু মামু বেশিরভাগ সময়েই ব‍্যস্ত আর যখনই দেখা হচ্ছে বিষন্নতার গর্তে ডোবা চোখ দুটি দিয়ে শুধুই তাকিয়ে থাকছে তুতানের দিকে, কিছু বলছে না। সারা বাড়ি জুড়ে শুকনো রজনীগন্ধার ঘ্রাণে মাথা ভারি হয়ে আসে ওর। দিদানের ফাঁকা খাটের ওপর এখন একটা ফ্রেম বাঁধানো ফটো; সামনে এক গ্লাস জল ও ডিশের ওপর কিছু মিষ্টি রাখা। দিদান গত দুই বছর ধরে মিষ্টি একদমই পছন্দ করত না তাহলে তাঁঁর ফটোর সামনে এমন মিষ্টি কেন সাজিয়ে দিয়েছে? উত্তর খুঁজে পেল না বারো বছরের তুতান। এমন আরও অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পায়নি সে; এই যেমন নীলু মামুর অনেক আপত্তি সত্ত্বেও দিদান প্রতি মাসে দুটো দিনের জন্য কেন যে তাদের বাড়ি থাকতে যেত তুতান বুঝতে পারে না। নীলু মামুর আপত্তির কারণ যে তারই বাবা-মায়ের নির্মম আচরণ একথা মনে পড়তেই কান গরম হয়ে ওঠে ওর, চোখের মধ্যে জমে ওঠে জলীয় উত্তাপ। ছোট থেকেই তুতান দেখে আসছে নীলু মামুর ধ‍্যান-জ্ঞান দাদুন আর দিদানকে সুখে রাখা। ছোট একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়িয়ে আর কিছু টিউশনি করেই তিন জনের খাওয়া-পরা,রোগ-ব‍্যাধির খরচ চালিয়ে আসছে। তার  মধ্যেও নিয়ম করে তুতানের পছন্দের গল্পের বই গুলো কিনে এনে প্রতিবছর জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেয় নীলু মামু। দাদুন চলে যাওয়ার পর টিউশনি পড়ানোও কমিয়ে দিতে হল, দিদান সারাদিন বাড়িতে একা থাকতে পারত না বলে। সকলের সুখের যোগফলেই যেন নীলু মামুর সুখ; আলাদা করে নিজের সুখ নিয়ে ভাবতে তুতান কখনও তাকে দেখেনি। সুতরাং তাদের বাড়িতে দুটো দিনের জন্য থাকতে এসে দিদানের অযত্ন হলে নীলু মামুর যে বুকে শেল বিঁধবে এ আর বড়ো কথা কী! প্রতি মাসেই দিদানকে পৌঁছে দিয়ে মামু বারান্দা থেকেই ফিরে যায়; তুতান বাড়ি থাকলে শুধু তার সাথেই কথা বলে।

দিদান আসলে সহজ-সরল ভুলো মনের মানুষ; মায়ের সাজানো ঘর-বাড়িতে মেপে চলা ফেরা করার বা মেপে কথা বলার কায়দাটা সে কিছুতেই রপ্ত করতে পারেনি। উঠোন থেকে হেঁটে এসে সেই চটি পরেই হয়তো ঢুকে গেল মায়ের মোজায়েক করা ঘরে। কখনো আবার তেল চুপচুপে মাথাটা দামি রং করা চকচকে দেওয়ালে ঠেকিয়ে বসে পড়ল; কখনও বা অযাচিত কৌতুহলে প্রশ্ন করে ফেলল জামাইয়ের অফিসের পদোন্নতি নিয়ে। প্রতি মাসে মাত্র দুটো দিন এগুলো নিয়ে মাকে বড়ো বিব্রত দেখত তুতান। এদিকে তুতান যে সারা মাস অপেক্ষা করে থাকে দুটো দিন দিদানের কাছে গল্প শুনতে শুনতে ভাত খাবে বলে, তা দেখেও রাগে জ্বলে উঠত তুতানের মা। একদিন এইসব নিয়ে প্রতিবাদ করায় তুতানের মা ঝাঁঝিয়ে বলেছিলেন “তোমার তো এখনো সব কিছু বোঝার বয়স হয়নি, তাই বেশি পাকামো করতে এসো না! এত যে দিদানের ওপর দরদ দেখাচ্ছ জানো তো দিদান মারা গেলে ঐ একতলা বাড়ি খানা তোমার ঐ নীলু মামাই পাবে, আমি পাব কাঁচকলা।” এর সাথে যোগ দিয়ে বাবাও বললেন, “তাছাড়া এখন যদি পঞ্চব‍্যঞ্জন সাজিয়ে যত্ম-আত্তি করি তাহলে তোমার ভাই ঠিক ওনাকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়বে।” সেদিন থেকেই বাবা-মায়ের প্রবৃত্তি ভালোই বুঝে গিয়েছিল তুতান। কাঁচকলা পাওয়ার আগে মা দাদুনের কাছ থেকে কত কী পেয়েছিল বিয়ের সময় আর বিয়ের পরেও সে গল্প মায়ের কাছেই শুনেছে তুতান;  মা খুব গর্ব করেই সকলকে বলে যে তার বিয়েতে অনেক জাঁকজমক হয়েছিল। বড়ো মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের খুশি করতে আর জামাইয়ের নিখুঁত আদর-যত্ম করতে গিয়েই নীলু মামার জন্য কিছু রাখতে পারেনি দাদুন,এ কথা দিদানের মুখে শুনেছে তুতান। অন‍্য কারোর কাছে নয়, দিদান এসব মনের কথা শুধু ঠাকুরকেই বলত। গতবার গরমের ছুটিতে দাদু-বাড়ি গিয়ে মা যখন বাড়ি ভাগ নিয়ে বিশ্রী অশান্তি করল তখনই তুতান শুনেছিল দিদান কেঁদে কেঁদে ঠাকুর ঘরে বসে এইসব কথা বলছে ঠাকুরের সাথে।

সে বার যখন মায়ের টাইফয়েড হল তখন দিদান কে দুই মাসের জন্য নিজের কাছে পেয়েছিল তুতান। সে তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। মায়ের সেবা করার পাশাপাশি তুতানের সম্পূর্ণ দেখভাল দিদানই করত। তখন দুই বেলাই দিদানের হাত থেকে গোল্লা পাকানো ভাতের গ্ৰাস মুখে নিয়ে যে তৃপ্তি পেত তা আর কোনোদিন কোনো খাবারেই পায়নি। দিদান খুব ভালো গান গাইত বলে তুতানের বায়না ছিল রোজ রাতে দিদানের গান শুনে তবেই সে ঘুমাবে। মা সেরে ওঠার পর দিদানের চলে যাওয়ার আগের দিন দিদান কে একটা ছোট্ট সোনার লকেট দিয়ে বলল,”নাও এটা রেখে দাও। অনেক করেছ আমার জন্য, আমি খালি হাতে কারোর থেকে কিছু নিই না;পরে তো আর বলতে পারবে না যে মেয়ে তোমাকে শুধু শুধু খাটিয়ে নিল!” মা দেখতে পায়নি, কিন্তু তুতান দেখেছিল লকেটটা হাতে নিয়ে ছলছলে চোখে চুপ করে বসে ছিল দিদান। তুতান খুব ভয় পেয়েছিল, দিদান যদি রাগ করে আর না আসে! জড়িয়ে ধরে দিদানকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তুমি আসবে তো আবার?”  দিদান তার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলেছিল, “আমাকে যে আসতেই হবে দাদুভাই, না হলে যে তোর মুখটা দেখতে পাব না।” তুতানের লুচি খুব প্রিয় কিন্তু মা লুচি বেলতে পারে না।  দিদান লুচি বেলায় পারদর্শী; তাই দিদান আসলেই লুচি কপালে জুটত তুতানের। তুতান বাদাম খেতে ভালোবাসে বলে দিদান পয়সা জমিয়ে তার জন্য নিজের হাতে বাদামের খাজা বানিয়ে আনতো। কিন্তু তুতান যখন দেখল দিদানের আঙুলগুলো একদিকে বেঁকে যাচ্ছে তখন সে বারন করে দিয়েছিল দিদান কে খাজা বানাতে। আস্তে আস্তে ভাঙছিল দিদানের শরীর। পাঁচ মাস আগে তুতানের জন্মদিনে শেষবার দিদান এসেছিল তাদের বাড়ি, তুতানের অনেক আবদারে গেয়েছিল, “কবে দেখা দিবি/কোলে তুলে নিবি/সকল বাসনা পুরাবে/কোথা ভবতারা….” 

নাহ্ নীলু মামু দায়িত্ব কারোর ঘাড়েই চাপায়নি। গত চারমাস ধরে অক্লান্ত সেবা করে গেছে শয্যাশায়ী দিদানের। বারবার শুধু ফোন করেছে তুতান নীলু মামু কে,দিদান একটুও সেরে উঠছে কিনা,একটু উঠে বসতে পারছে কিনা জানার জন্য।  মা করোনার প্রকোপ আর লক ডাউনের কারণ দেখিয়ে একবারও গেল না দিদানের কাছে। তুতান কতবার মা কে বলেছে, “বাবার তো অনেক টাকা, চলো না একদিন একটা ট‍্যাক্সি ভাড়া করে দিদানকে দেখে আসি।” কেউ শোনেনি তার কথা। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল আজ থেকে ঠিক বারো দিন আগে। সকালবেলা নীলু মামু যখন দিদানের শেষ অবস্থার সংবাদ দিল তখন তুতানের প্রভাবশালী বাবা এক ঘন্টার মধ্যে ট‍্যাক্সি জোগাড় করতে পেরে অহংকারে বুক ফুলিয়ে গাড়িতে বসলেন। তুতানের মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “ভাগ‍্যিস পেলে ট‍্যাক্সিটা, না হলে আর লোকের কাছে মুখ দেখানো যেত না; তাছাড়া মায়ের মুখে গঙ্গার জলটুকু তো দিতে পারব।” সকলের সেদিন খুব তাড়া দিদানের কাছে যাওয়ার কিন্তু তুতানের যেন পা আর চলছিল না। গাড়িতে উঠতে দেরি করার জন্য মায়ের কাছে বকুনিও শুনল। দিদান শেষ পর্যন্ত মায়ের আশা পূর্ণ করেছিল। তারা পৌঁছনোর একটু পরেই অচেতন দিদান হিক্কা তুলল একবার; মা আর নীলু মামা মুখে গঙ্গার জল দিতেই বুকের ওঠা-নামা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। হতভম্ব তুতানের মনে হল “ঐ রকম জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে থাকা দিদান আদৌ কি বুঝতে পারল যে তারা এসেছে? দিদান কি সত্যিই বুঝল যে কারা তার মুখে গঙ্গার জল দিল?” আজ তেরোদশা, মৎসমুখ করবে নীলু মামু জ্ঞাতিদের নিয়ে। দিদান বিছানা নেওয়ার পর থেকে নীলু মামুই রান্না করত। আজ সকাল থেকেই তুতান দেখছে তার মা দিদানের রান্নঘর জুড়ে মহা উৎসাহে রান্না করতে বসে গেছে আর নীলু মামাকে বলেও দিয়েছে আজ সে নিজে হাতে মায়ের প্রেতাত্মাকে রান্না করে খাওয়াতে চায়। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তুতান দেখতে থাকে মা কত যত্মে মাটির থালায় দিদানের জন্য ভাত-তরকারি গুছিয়ে দিচ্ছে। সবশেষে একটা বড়ো মাছের দাগা দিদানের থালায় রাখতেই তুতানের মনে পড়ল একটা দুপুরের কথা। তাদের বাড়িতে দিদানকে মা সবসময় মাছের পেটি খেতে দিত আর দিদান ব‍্যাজার মুখে খেত। সেদিন দুপুরে দিদান বলেছিল মাকে, “মাছ তো আমার ভালোই লাগে না, তবু দিস যদি পেটি দিস না, ঐ তলতলে চামড়ার ডেলা আমার ভালো লাগে না। “তুতানের মা উত্তর দিয়েছিল,” কে খাবে বলোতো মা পেটিটা?  তোমার জামাইয়ের হাই প্রেশার, আমারও তাই, তুতান আবার পেটি ভালো খায় না। “দিদান আর কিছু বলেনি, কিন্তু সেদিন থেকে তুতান চুপিচুপি মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে তার পাতের দাগার সাথে দিদানের পাতের পেটিটা পাল্টে নিত। সে আর দিদান আগেই খেতে বসত আর মার তখন মনোযোগ সিরিয়ালে, তাই ধরা পড়েনি কোনোদিন। দিদান আপত্তি করলে বলত, “মা ছাই জানে, আমার পেটি খেতে মোটেও খারাপ লাগে না।” মাসে মাত্র দুটো দিন দিদানের জন্য এটুকু করতে পারবে না সে! 

মায়ের ডাকে চমক ভাঙলো তুতানের। খাবার গুছিয়ে মা ডাকছে তার সাথে পুকুর পাড়ে যাওয়ার জন্য, ওখানেই খাবারগুলো রেখে আসা হবে।  মায়ের হাতে খাবারের থালা আর জ্বলন্ত ধূপকাঠি। কর্কশ রৌদ্রের মধ্যে তুতান মায়ের মাথায় ছাতা ধরে হাঁটতে থাকে।  হঠাৎ তার মা বলে উঠলো, “ভাবতেই পারছি না সত্যি! এই লক্ ডাউনের মধ্যে কী সব হয়ে গেল বল্ তুতান?”  গলার মধ্যে এঁটে আসা জমাট কষ্টটা গিলে নিয়ে তুতান বলল, “হুম্, সব বদলে গেল।”

6 thoughts on “অনাদরের আদর

  • July 1, 2020 at 4:20 am
    Permalink

    খুব বাস্তবোচিত গল্প। এমনটাই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ভাল লাগল পড়ে।

    Reply
    • July 1, 2020 at 5:37 am
      Permalink

      ধন্যবাদ

      Reply
    • July 3, 2020 at 4:16 pm
      Permalink

      ভালো লাগলো গল্পটা।শেষটাতে একটু চমক থাকলে,একান্ত আমার মতে,আরো সুন্দর লাগতো।

      Reply
      • July 3, 2020 at 5:28 pm
        Permalink

        ধন্যবাদ

        Reply
  • July 2, 2020 at 7:09 pm
    Permalink

    খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটি।
    এটি পড়তে পড়তে আমাদের সমাজের একটি খুব কুৎসিত অথচ বাস্তব চিত্র ফুটে উঠলো।

    Reply
    • July 3, 2020 at 1:00 pm
      Permalink

      ধন্যবাদ সায়নী

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 − 6 =