অবরুদ্ধ (রম্যরচনা)
বিশ্বজিৎ রায় ##
—————————————————-
Birds have their own language . In fact, they communicate with each other through simple sounds and actions. Moreover, birds react in their own peculiar way to threat, pleasure and pain .
Noted theory of Salim Ali, one of the most notable ornithologists of India.
—————————————————-
সকাল থেকেই একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে আছি। এখন প্রায় দুপুর দুটোর মত হবে, তবুও নিস্তার পেলাম না। ইতিপূর্বে কখনও এমন সমষ্টিগত অবরোধ, প্রতিবাদ, জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয় নি। জানতে চাইছেন – কিসের অবরোধ, প্রতিবাদ বা জবাবদিহি ? তবে বিষয়টি একটু খুলেই বলি।
আমাদের বাড়িতে কয়েকটি কলা গাছ রয়েছে। তার মধ্যে একটি কলা গাছে বেশ কিছুদিন আগে এক কাদি কলা ধরেছিল। কলাগুলি কবে থেকে পাকতে শুরু করেছে – সে খবর আমি রাখি নি। কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কলাগুলি পাকবার খবরটি রেখেছিল আমাদের বাড়িতে পেয়ারা, আম বা কাঁঠাল খেতে আসা এক ঝাঁক বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দল। (তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যারা সঙ্গ দেয় তারা হলো কয়েকটি চটপটে কাঠবিড়ালী।) দৃশ্যটি মনোরম লাগে যখন দেখি প্রকৃতির এ বনভোজনে তাদের ঔদরিকতা ও আত্মতৃপ্তি । কলাগুলি পাকবার জন্য আজ সকালে সেগুলি পেড়ে ফেললাম। আর তারপরই শুরু হলো যত গোলযোগ। প্রথমে একটি শালিক পাখি এলো কলাগুলি খাবে বলে। এসেই দেখে গাছে কলা নেই। মাথায় হাত! বেচারা সকাল সকাল এমন অনভিপ্রেত ঘটনার সম্মুখীন হবে ভাবতেও পারেনি।কলার কাদি না দেখতে পেয়ে বাড়ির আশেপাশের গাছগুলিও ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো অন্য কোনো গাছে খাবার আছে কী না। অবশেষে যখন কোনো খাবারই খুঁজে পেল না, তখন মাথাটা হয়ে গেল গরম, কিচিরমিচির শব্দে নানা অভিযাগ, তীরষ্কার দিল শুরু করে আমাকে। তার কিচিরমিচির শব্দে একে একে অন্ততঃ আরো পনের কুড়িটি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি গেল জুটে, তারও সমস্বরে প্রতিবাদে হলো সামিল । আমরা না কী মনুষ্যজাতি, বুদ্ধিমান সর্বশ্রেষ্ঠ দুপায়া জীব। অথচ লক্ষ্যণীয় যে জগতে সবচেয়ে বেশী অন্যায় দাবী যারা করেন তারা হলো এই মানুষই। আমরা বিবেক সর্বস্ব হয়েও যদি শুধুমাত্র নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য নির্লজ্জ কাজ করতে পারি, তাহলে এদের দোষ দিয়েই বা কি হবে ? পাখিদের সমবেত প্রতিবাদে আমি পড়লাম মহা বিপদে। আমি বোঝাবো কিভাবে যে আমার গাছের ফল, এতে আমারও তো দাবি রয়েছে। কিন্তু কার দাবি কে বোঝে ! ইতিমধ্যে ওনারা সিংহভাগ ফল খেয়ে ফেলেছেন, তবুও আমাকে আমার অংশ দিতে রাজি নন। যদিও তাদের অন্যায় দাবি, তবুও এই সমবেত রোষ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ঠিক করলাম কিছুটা চাল ছিটিয়ে দেই তাহলেই রাগ কমবে। কিন্তু না, চালের একটি দানাও মুখে তুললো না। যেখানে চাল ছিটিয়েছিলাম তার থেকে কিছুটা দূরেই এক মুরগী তার পাঁচ ছয়টি তুলো দিয়ে তৈরি বলের মত ছানা নিয়ে আমার এই বেইজ্জত হবার দৃশ্যটি বেশ উপভোগ করছিল। হয়তো গালিগালাজও করছিল । আমি ওদের ভাষাতো বুঝি না , অঙ্গভঙ্গিও বুঝি না, তাই হলফ করে কিছু বলতে পারছি না, তবে আমার প্রতি ওদের চাহনি দেখে আমার মনে হলো যেন বলতে চাইছে –
তুমি গর্হিত কাজ করেছো। “
আমি ভাবলাম হয়তো মুরগীটি তার বাচ্চাদের নিয়ে চালগুলি খাবে। একটি মুরগীর ছানা চালের দানাগুলি দেখে লোভ না সামলাতে পেরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছিল, কিন্তু তাদের মা জানি না গলা ঝাঁকিয়ে কি যে বললো, ছানাটি আর এগোবার সাহস দেখালো না। মুরগীটি এমন তাচ্ছিল্যভাবে চালগুলি ফেলে রেখে স্বপরিবারে স্থান ত্যাগ করলো যে – আমি স্তম্ভিত। এদিকে পাখিদের প্রতিবাদ সমান তালে চলছে। কখনও গাছের ডালে, কখনও উঠোনে, কখনও কলপাড়ে বা কখনও একদম বারান্দার গ্রিলের সামনে এসে কৈফিয়ত চাইতে লাগলো – কেন আমি কলাগুলি পেড়েছি ? এ ডাল ও ডাল, কখনও কলাগাছে – ঘুরাঘুরি করছে আর খাবার না পেয়ে যারপরনাই রাগ উগরে দিতে লাগলো। তাদের দাবির যথার্থ প্রতিকার না করতে পেরে বাড়িতেই আবদ্ধ হয়ে আছি। বিজ্ঞানে পড়েছিলাম প্রতিটি ক্রিয়ারই না কি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। কলাগুলি পেয়ে ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া তো পেলাম, কিন্তু আমি চিন্তিত বিপরীত প্রতিক্রিয়া নিয়ে। পাখিগুলি বিপরীত প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমার বাড়ি বয়কট করে বসবে না তো! দেখা যাক, আগামীকাল কি হয়।