অসহায় প্রকৃতি– অসহায় প্রাণ
অর্ণব ঘোষ, বারাসত
বেশ কিছু দিন আগে চেরাপুঞ্জি গিয়ে ছিলাম। নেড়া পাহাড়গুলো দেখে মনে হল অনেক দিন এখানে বৃষ্টি হয় নি। পাহাড়ের মাথার ঘাসগুলো সব শুকিয়ে খড়। সেভেন সিস্টার ফলস এর কেবল এক জনেরই দেখা মিলল। গিয়েছিলাম মায়াপুর, দেখলাম গঙ্গার পাড়ের উঁচু উঁচু ঢিপি আর ঝোপঝাঁড় কেটে যেখানে সেখানে রাস্তা বানানো হচ্ছে। গজিয়েছে নানান সাইজের হোটেল আর রেস্তোরাঁ। মাছরাঙা দ্বীপ নামে যে পিকনিক স্পট ছিল সেটা এখন ইট ভাটা শুনি। বড়ন্তিতে পলাশ গাছ কেটে হোটেল বানানোর উৎসাহ দেখে বুঝলাম এখানকার মানুষ জানেই না লোকেরা এখানে পলাশ ফুল দেখতেই আসে। আসলে বড় থেকে ছোট সব শহরের সবুজ বনানীর টুটি চেপে শ্বাস রোধ করা হয়েছে অনেক আগেই। আর্বানাইজেশন নামক রাক্ষস তারপর দ্রুত গ্রামের দিকে ধেয়ে এসে তাকেও আধ মরা করে দিয়েছে। এখন পালা ভারজিন প্রকৃতির। নদী নালা, পাহাড় জঙ্গল কারোর এর হাত থেকে নিস্তার নেই। জন বিস্ফোরণ আর বেকারত্ব সেই দানবকে দিন দিন আরও ভয়ংকর করে তুলছে।
মানুষের লোভও কম যায় না। দ্রুত বড় লোক হওয়ার বাসনায় দশ পুরুষের ভিটে সহ পুকুর বাগান তুলে দিচ্ছে প্রমোটারদের হাতে। প্রকৃতি পাঠ, জীব বৈচিত্র এসব গাল ভরা নাম শুধু প্লাস্টিক ল্যামিনেটেড বই এর পাতায়। লুপ্তপ্রায় প্রাণী এখন শপিং মলের শোকেসে সাজানো থাকে সফট টয় নামে। আমরা এগিয়ে চলেছি। দেশ এগিয়ে চলেছে। পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে বিষ বাষ্প আর বিশ্ব। তাই প্রকৃতি দিনে দিনে দূরে সরে যাচ্ছে।একদিন দরজা খুললে যে গাছপালা আর পশুপাখি দেখা যেত তা দেখতে আজ হাজার হাজার টাকা খরচ করে যেতে হচ্ছে জঙ্গল সাফারিতে। সাবাই ঘাস আর বাঁশ কেটে কাগজ বানিয়ে তাতে লেখা চলছে নেচার স্টাডির প্রজেক্ট ওয়ার্ক। আমরা কবে বুঝবো যে ওই বাঁশ আর সাবাই ঘাসের জঙ্গলেই হতে পারে নেচার স্টাডির শ্রেষ্ঠ ক্লাস রুম। মেরুদেশের বরফ গলবে ওজন স্তর ফুটো হবে আর সেই ছবি ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড এ ভাইরাল হবে। বাতানুকূল যন্ত্রের মত কিছু আবিষ্কার হয়তো উষ্ণতা বৃদ্ধি জনিত সমস্যার সামান্য চটজলদি সমাধান দেবে কিন্তু তা কত দিন? দিন দিন এসির কুলিং ক্যাপাসিটি কমছে তা তো আমরা স্বচক্ষে দেখছি। কত সেমিনার কত ‘ঘন্টা খানেকের’ পর্যালোচনা আপনার মাথার উপর দিয়ে যাবে…..অথচ কোনো সরকার হুইপ দিয়ে বলবেন না যে বৃক্ষ নিধন নর হত্যার মত দন্ডনীয় । কেউ প্রমোটারদের কলার চেপে ধরে বলবে না…..ফিতে মেপে ইটের স্তুপ বিক্রির সময় ….স্তুপের আশেপাশে অন্তত দুশো বর্গ ফুট বাগানও বানাতে হবে।
প্রকৃতির কবরের উপর নগর সভ্যতা নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে ….সে নাক উঁচু থেকে উচ্চতর হবে কিন্তু ওই নাসারন্ধ্রে কোথা থেকে শ্বাস বায়ু আসবে তা কল্পনাতীত। গভীর সংকটের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এ মানব সভ্যতা। সমস্ত জঞ্জাল আর দূষণ ঠেলে এই পৃথিবী কে শিশুর বাস যোগ্য করে তোলার যে অঙ্গীকার করেছিলেন কবি একদিন, তা আজ লোভের করাতের সামনে দাঁড়িয়ে ভীষন অসহায় । সময় এসেছে নতুন এক শ্রেণী সংগ্রামের যেখানে আদর্শ, ভালবাসা আর জ্ঞানকে সম্বল করে লোভের বিরুদ্ধে তৈরি হতে হবে। তারপর চৈতন্য দেবের মত উদ্বাহু হয়ে দিকে দিকে বেরিয়ে পড়া বন সৃজন আর সবুজ রক্ষার কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে। হরিনাম কিংবা আবির নয় সবুজ প্রকৃতি আর সবুজ মনের নবজাগরণই হবে সে আন্দোলনের বীজ মন্ত্র।