আম বাগানের বছরব্যাপী পরিচর্যার মাসিক পঞ্জিকা

   অগ্নিভ  হালদার এবং প্রদীপ্ত  কুমার  মুখোপাধ্যায় ##

আম আমাদের দেশের সব ফলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং এটি আমাদের দেশের জাতীয় ফলও বটে। স্বাদে গুনে, রুপে ও রসে অতুলনীয়, তাই আমকে ফলের রাজা বলা হয়। আমাদের দেশে আম চাষ অতি প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই কম বেশী আম চাষ হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হয় যথাক্রমে উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তেলাঙ্গনা, বিহার, গুজরাট, তামিলনাড়ু  ও পশ্চিমবঙ্গে। এছাড়া, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্যেও প্রচুর আম চাষ হয়।

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ছাড়া প্রায় সব জেলাতেই কম বেশী আমের চাষ হয়। মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলা আম চাষে উল্লেখযোগ্য, মালদহতেই প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয় । এছাড়া হুগলী, উত্তর ২৪ পরগনা ও বর্ধমান জেলাতেও ভালো আম চাষ হয়।

চাষিবন্ধুরা সঠিক এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতিতে আম চাষ করলে অনেক বেশী এবং গুনগত মানের ফলন যেমন পেতে পারবেন তেমনি বাগানও পরিচ্ছন্ন এবং রোগবালাই মুক্ত থাকবে।

জানুয়ারিঃ নতুন বাগানের গাছের গোড়া পরিষ্কার করতে হবে ও জল সেচ করতে হবে। জলদি জাতের যেমন গোপাল ভোগ, বোম্বাই, সরিখাস, সফদার পসন্দ, বৈসাখী ইত্যাদিতে পোশাক পোকা ও সুলি পোকার আক্রমণ হতে পারে। প্রয়োজন হলে কারবারিল ৩০ জি বা মনোক্রোটোফস (৩৫ ইসি) ১৫ মিলি রতি ১০ লিটার জলে গুলে পুরো গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফুল ফোটার পর কোনোভাবেই স্প্রে করা উচিত নয়! শোষক পোকার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে ফল ধরার পর দ্বিতীয় বার স্প্রে করা উচিত।

ফেব্রুয়ারিঃ নতুন বাগানে জল প্রয়োজনমতো সেচ করতে। শোষক পোকা ও সুলি পোকার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে মধ্যবর্তী জাত (হিমসাগর, লেঙ্গড়া, লক্ষণ ভোগ, পিয়ারা ফুলি, রানি পসন্দ, মুলায়াম জ্যাম ইত্যাদি) স্প্রে করা উচিত (আগের মতোই)।

গুড়ো চিতা রোগ (Powdery Mildew) ও ক্ষত রোগ (Anthracnose ) আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন অনুসারে ৩০ গ্রাম জলে গুলে এমন সালফার বা ১০ গ্রাম ডিনোকেপ বা ১০ গ্রাম কারবেন্ডাজিম প্রতি ০ লিটার জলে গুলে একবার ফুল আসার আগে ও একবার ফল ধরার পর স্প্রে করতে হবে।

মার্চঃ শোষক পোকা, সুলি পোকা, গুড়ো চিতি রোগ ও ক্ষত রোগের উপস্থির উপর নির্ভর করে নাবী জাতে (ফজলি, আশ্বিনা, ভাদুরিয়া, ফুনিয়া, কিষাণভোগ, মোহোনভোগ, রাখাল ভোগ, আম্রপালি, মল্লিকা ইতাদি) স্প্রে করা উচিত (আগের মতোই)। ফল ধরার পর ১৫-২০ দিন অন্তর জল দিতে হবে। চারা গাছেও প্রয়োজন মতো জল দিতে হবে। ফল ঝরে পড়া রোধ করার জন্য এন. এ. এ-১ গ্রাম ৫০ লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।

এপ্রিল : ফল ধরার ও চারা গাছে প্রয়োজন মতো জল দিতে হবে। ঝরে পড়া ফল গুলি সংগ্রহ করে নষ্ট করে দিতে হবে। আমের মাছি ও দৈয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাগানের মাটি চষে দিতে হবে। আমের মাছি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত হেক্টর প্রতি ১০ টি হরমোন ফাঁদ লাগাতে হবে। আম্রমুকুলে গুটি সৃষ্টিকারী কারীপোকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ক্লোরোপাইরিফস ২৫মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে। মেঃ ফলের বৃদ্ধির সময় নিয়মিত ভাবে জল দিতে হবে। ঝরে পড়া ফলগুলি সংগ্রহ করে নষ্ট করে দিতে হবে। জলদি জাতগুলির ফল পাড়া শুরু করা যেতে পারে। নতুন বাগান লাগানোর জন্য জাত অনুসারে দূরত্ব বজায় রেখে গর্ত করতে হবে।

জুন : গাছ থেকে ফল পাড়তে হবে। আম পাড়ার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি লগা দিয়েআম পাড়তে হবে।বাগানে পড়ে থাকা ফলগুলি সংগ্রহ করে নষ্ট করে দিতে হবে। নতুন বাগান লাগানোর গর্তে (যেগুলি মে মাসে খুড়া হয়েছে) ২৫ কেজি করে জৈব সার দিতে হবে। ফল পাড়ার পর গাছ প্রতি ৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১.১ কেজি সুপার ফসফেট ও ৬২৫ গ্রাম পটাশ সার (১০ বছরের বেশি বয়সের গাছে) দিতে হবে। জুলাই : নাবি জাতের ফল পাড়তে হবে।

ফল পাড়ার পর গাছে সার দিতে হবে। যদি জুন মাসে না দেওয়া হয়ে থাকে। নতুন বাগানে চারা বসাতে হবে। নারসারিতে চারা তৈরির জন্য আমের আঁটি বসাতে হবে। আঁটি কলম করার জন্য এটি উত্তর সময়।

আগষ্ট : নাবি জাতের ফল পাড়তে হবে।ফল পাড়ার পর গাছে সার দিতে হবে। যদি আগে না দেওয়া হয়ে থাকে। নতুন বাগানে চারা বসাতে হবে, প্রচন্ড বর্ষার সময় চারা বসানো যাবে না। কলমের চারা তৈরির জন্য কলম বাঁধতে হবে। বয়স্ক, দুর্বল ও রোগ লাগা ডালগুলি কেটে ফেলতে হবে এবং কাটা জায়গায় ক্লাইটক্স লাগিয়ে দিতে হবে। যদি কান্ডে গুটি সৃষ্টিকারি পোকার উপদ্রব থাকে তাহলে ডাইমেতোয়েট / মেমোনোক্রোটোফস ১.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতেত হবে।

 সেপ্টেম্বর : আগের সমপরিমান সার দ্বিতীয় বার প্রয়োগ করতে হবে।বাগানে চাষ দিতে হবে।আঁটি কলমের চারা গুলি নারসারিতে বসাতে হবে।

বয়স্ক, দুর্বল ও রোগ লাগা ডালগুলি কেটে ফেলে ব্লাইটক্স লাগিয়ে দিতে হবে। কান্ডে গুটি সৃষ্টিকারি পোকার নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাইমেতোয়েট / মোনোক্রোটোফস১.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।

অক্টোবরঃ আগের সমপরিমান সার দ্বিতীয় বার প্রয়োগ করতে হবে।বয়স্ক, দুর্বল ও রোগ লাগা ডালগুলি কেটে ফেলে ব্লাইটক্স লাগিয়ে দিতে হবে। পাতা ও ডগায় গুটিগুলিকে নষ্ট করতে হবে।বাগানে জল সেচ বন্ধ করতে হবে।

নভেম্বরঃ অক্টোবর মাসে কাজ গুলি না করা হলে এমাসে করে ফেলতে হবে। বাগান পরিষ্কার করতে হবে।বাগানে জল সেচ বন্ধ রাখতে হবে।

ডিসেম্বরঃ দৈয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্লোরোপাইরিফস ৫০ মিলি. প্রতি ১০ লিটার জলে গুলে পুরো গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।দৈয়ে পোকা যাতে গাছে উঠতে না পারে সেজন্য গাছের গোড়া মাটি থেকে ১ মিটার উপরে ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পলিথিন লাগানোর আগে কান্ডকে ভালোভাবে কাদামাটি লেপে দিতে হবে। পলিথিনের নিচের অংশ গ্রীজ লাগিয়ে দিতে হবে।বাগানে জল সেচ বন্ধ করতে হবে।

লেখকদ্বয় কৃষি গবেষকবিশ্ব ভারতী,  শ্রীনিকেতন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × two =