আ মরি বাংলা ভাষা

 

পলাশ মুখোপাধ্যায়

##

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে’ কবির কল্পনায় জেগে ওঠে নানা সুখস্মৃতি। ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’ এখন কি সত্যিই বিপন্ন? সে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা উদাহরণ দিই। আমার কর্মস্থলে (একটি ২৪ ঘন্টার বাংলা খবরের চ্যানেলের অফিস) বাংলা ভাষাভাষী মানুষের পাশাপাশি বহু মানুষ আছেন যারা অন্য প্রদেশের, অর্থাৎ বঙ্গভাষী নন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে তারা প্রায় সকলেই সাবলীল ভাবেই বাংলা বলতে পারেন। অনেকে তো বাংলা লিখতে এবং পড়তেও পারেন। অথচ মজার বিষয় অফিসের বাঙালি কর্মীরা প্রায় সর্বক্ষণ তাদের সঙ্গে হিন্দি ভাষায় কথা বলে থাকেন। এমনকি এও লক্ষ্য করেছি অবাঙালিরা যদি বাংলাতেও উত্তর দেন তাহলেও তথাকথিত বাঙালিরা কথোপকথন হিন্দিতেই চালিয়ে যাওয়ায় বেশি উৎসাহী। এর প্রতিবাদ করে দেখেছি আমার পাশে অন্য প্রদেশের কর্মীরা দাঁড়ালেও বাঙালির সংখ্যা নেহাতই কম। বাংলায় কথা বলতে কি আমরা লজ্জাবোধ করি? না, সে প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কেউ আমায় দেননি, বরং প্রাদেশিক বলে গাল দিয়েছেন।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং পত্র-পত্রিকা মারফত জানা যায়, বাংলা ভাষা এখন তিনটি দেশের দাফতরিক ভাষা। ভারত, বাংলাদেশ(রাষ্ট্র ভাষা) এবং সিয়েরা লিওন(রাষ্ট্র ভাষা)। ভারতে স্বীকৃত যে ২৩টি দাফতরিক ভাষা(Official Language) রয়েছে বাংলা তার অন্যতম। ব্যবহারকারী জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলা ভাষার স্থান দ্বিতীয়, হিন্দির পরেই। ভারতে সংবিধান অনুযায়ী যে কোন রাজ্যই প্রয়োজনে হিন্দির পাশাপাশি নিজস্ব এক বা একাধিক দাফতরিক ভাষা গ্রহণ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা বাংলাকে সেই মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়া বাংলা অসম এবং আন্দামান-নিকোবর রাজ্যের সহ-দাফতরিক ভাষা। দেশ বিভাগের কারণে পূর্ববাংলা ছেড়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ‘পুনর্বাসিত’ হয়েছিল বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্য এলাকায়। বিপুল বাঙালি-অধ্যুষিত এই রাজ্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাকে দ্বিতীয় দাফতরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া ওড়িশা রাজ্যেও রয়েছে বহু সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষজন। যার কারণে সেখানকার সরকারি প্রচারমূলক কর্মকাণ্ডে হিন্দি ও ওড়িয়ার পাশাপাশি বাংলা ব্যাপক প্রচলিত। পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে বাস করেন প্রায় ২০ লক্ষ বাঙালি। সেই কারণে করাচি সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম স্বীকৃত দ্বিতীয় ভাষা হচ্ছে বাংলা

বাংলা তৃতীয় যে দেশের ‘রাষ্ট্রীয় ভাষা‘ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে তা হল পশ্চিম আফ্রিকান দেশ সিয়েরা লিওন। সিয়েরা লিওনের সঙ্গে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ স্থলের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কোনো যোগাযোগ নেই। রাষ্ট্রসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে দেশটিতে পাঁচ হাজারের বেশি বাংলাদেশি সৈন্য মোতায়েন ছিল। তারা সিয়েরা লিওনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে দেশটি। যদিও আফ্রিকান এই দেশটির সামান্য কিছু নাগরিক বাংলাদেশি সৈন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদে সামান্য কিছু বাংলা শব্দ ও বাক্য জানেন, তবু দাফতরিক ভাবে বাংলা ভাষা সেখানে জায়গা পেয়েছে। এর প্রতীকীমূল্যও অবশ্য কম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বীকৃত যে ১০টি ‘অভিবাসী ভাষা‘ রয়েছে, বাংলা তার পঞ্চম। উইকিপিডিয়ার হিসেবে সাত লক্ষ বাংলাভাষী অভিবাসী রয়েছেন, যাঁরা দৈনন্দিন জীবনে বাংলাব্যবহার করেন। বাংলাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলের স্কুলগুলো চাইলে এই ভাষা শিক্ষা দিতে পারে।

গোটা দেশ জুড়েই একটা অদ্ভুত ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা বা National Language। মূলত দেশের হিন্দিভাষী অঞ্চল থেকে উদ্ভূত এই রটনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেননা, ভারতীয় সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি, হিন্দি এদেশের রাষ্ট্রভাষা। সংবিধানের ৩৪৩(১) ধারায় স্পষ্টভাবে লেখা আছে, হিন্দি ভারতের অন্যতম দাফতরিক ভাষা (অফিশিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ)। একই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ইংরেজিকেও। অর্থাৎ ভারত সরকারের সরকারি কাজকর্মের ভাষা দু’টি- হিন্দি ও ইংরেজি। সংবিধান এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছে, ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির ক্ষেত্রে সরকারি ভাষা হিন্দি হতেই হবে, এমন কোনও বাধ্য বাধকতা নেই। রাজ্যগুলি ৩৪৫ ধারা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে তাদের নিজস্ব ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে। যেমন, গুজরাতে গুজরাতি, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা, ওড়িশায় ওড়িয়া, কেরলে মালয়ালম, মহারাষ্ট্রে মারাঠি ইত্যাদি। ভারতের মতো একটি বহু ভাষা-ভাষী দেশে কোনও একটি ভাষার আধিপত্য যে পরবর্তীতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে , তা সংবিধান প্রণেতারা সংবিধান রচনার সময়েই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তা স্বত্বেও কিন্তু আমাদের স্কুলের পাঠ্য বইতে এখনও হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বলে লেখা হয়, শিক্ষক শিক্ষিকারাও সেটাই মানেন এবং পড়ান এটাই বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য।

কেন্দ্রে যে কোন  সরকার এসেই হিন্দি ভাষাকে মান্যতা দিতে উঠে পড়ে লাগে। এই সরকারও ব্যতিক্রম নয়। সম্প্রতি ইংরেজির বদলে হিন্দি ভাষায় সব রকম সরকারী কাজ করতে বলা হয়েছে। যেমন, বিমান চালককে বলা হয়েছে হিন্দি ভাষায় ঘোষণা করতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে। তা হচ্ছে হোক, কোন আপত্তি নেই কিন্তু দেশের অন্যান্য ভাষাগুলির প্রতি এই দরদ বা আদর কই চোখে পড়ে না তো। হিন্দির প্রচার বা প্রসার নিয়ে এই উদ্যোগ নতুন নয়, সেই নেহরুর আমল থেকেই এই চেষ্টা চলে আসছে। প্রথম থেকেই দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সংবিধান বিরোধী এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করে আসছে। এখনও তারাই সোচ্চার। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় দক্ষিণের সব ক’টি রাজ্য একজোট। কন্নড়, তেলুগু, মালয়লম এবং তামিলভাষীরা হিন্দির এই আগ্রাসন রুখে দিতে বদ্ধপরিকর। দক্ষিণে পাশাপাশি চার রাজ্যের পৃথক চার ভাষা। তামিল, তেলুগু, মালয়ালম এবং কন্নড়। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির কোন সাদৃশ্য নেই। না বর্ণমালায় না শব্দ বন্ধে। তবু হিন্দির এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চার রাজ্য এককাট্টা। সচেতনভাবে হিন্দি ভাষাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।

দক্ষিণে গেলে দোকানের সাইন বোর্ড থেকে শুরু করে রাস্তার ধারে মাইল ফলক বা দিক নির্দেশকারী ফলকে সেখানকার ভাষাই চোখে পড়ে, কিন্তু কলকাতায় এখন বাংলা লেখা দেখা পাওয়াটাই দুস্কর। একটু ভাবুন তো আমাদের ক’জনের বাড়ির দরজায় থাকা নামের ফলক বাংলায় লেখা? পূর্ব ভারতের বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী বাঙালিদের এ নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। বাংলা টেলিভশনে সিরিয়ালগুলিতে হিন্দি সিরিয়ালের অন্ধ অনুকরণ। বাংলা চ্যানেলে নাচ বা গানের রিয়েলিটি শোগুলিতে বাঙালি ছেলেমেয়েদের মুখে হিন্দি গানের আধিক্য। শহরের দিকে একটু আর্থিক স্বচ্ছল বাঙালিদের বিয়ে কিম্বা অন্য উৎসবে বাংলার সংস্কৃতি বা আচার উধাও, তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে হিন্দি সিরিয়াল বা ছবিতে দেখা নানা আচার উপাচার। বাসর ঘরে গান বাজনা বা হাস্যরসের সেই রঙিন দিনগুলি সরিয়ে এখন জায়গা করে নিয়েছে সঙ্গীত (হিন্দি গান এবং নাচের অনুষ্ঠান)। গায়ে হলুদ কোণঠাসা, বদলে জনপ্রিয়তা বেড়েছে মেহেন্দির। এখানেই নিজেদের ভাষাএবং সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষিণীরা আমাদের ১০০ গোল দিয়ে দিয়েছে। হিন্দি বা ইংরেজি ছবির নির্মাতারা তাদের ছবি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় ডাব করে সেখানকার রাজ্যগুলিতে দেখাতে বাধ্য হন। কিন্তু বাংলায় সে চিন্তাই নেই, কারন সিংহ ভাগ বাঙালিই যে হিন্দি বলতে বা লিখতে পারলেই বর্তে যান। মাঝে শুরু হয়েছিল বাংলায় ডাব করে অন্য ভাষার ছবি বা সিরিয়াল দেখানোর প্রচেষ্টা। কিন্তু বাঙালি শিল্পীদের আপত্তিতে তা কার্যকর করা যায়নি। যুক্তি ছিল অন্য ভাষার ছবি বাংলায় ডাব করা হলে নাকি বাঙালি শিল্পীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে। এমন ক্ষতি তো দক্ষিণ ভারতে হয় না। সেখানে প্রায় সব অন্য ভাষার ছবি ডাব করে দেখানোর পরও দিব্যি সেখানকার শিল্পীরা করে খাচ্ছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে সেখানকার আঞ্চলিক ছবি পরে হিন্দিতে ডাব করে সর্ব ভারতীয় স্তরে মুক্তি পাচ্ছে।  এত কিছু করেও বাংলা ছবির হাল? সে তো সকলেই জানেন।

বাম আমলেও নেতা মন্ত্রী বা সাংসদরা যেমন মুখেই বাংলা প্রেমের কথা বলতেন, তেমনই এখনকার হালও সমান। বাংলার সাংসদরা দিল্লিতে যে কি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তা তারাই জানেন। আগে থেকেই এঁরা যেন হিন্দি ভাষার দাসত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন! যেমন জনপ্রতিনিধি, তেমনই জনগণ। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় দুঃখ করে বলেছিলেন ‘বাংলা ভাষা এক সময় আর কলকাতা কেন্দ্রিক থাকবে না, তা বাংলাদেশ কেন্দ্রিক হয়ে যাবে’। তাঁর এই উপলব্ধি আজ বাস্তবের রূঢ় মাটিতে দাঁড়িয়ে। কলকাতায় হাঁটলে মনে হবে না, বাংলা ভাষাভাষী কোন অঞ্চলে আছি। চোখে পড়ে না কোন বাংলা সাইনবোর্ড। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর পরে কলকাতায় বাংলা ভাষার অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান অনেকেই। আপনি কি নন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 − 14 =