এক পুলিসের পুজোর গপ্পো
ত্রয়ণ চক্রবর্তী, কলকাতা
##
একবছর আগেই ছুটির দরখাস্ত করে রেখেছিল রজত। কৃষ্ণা আর তিন্নিকে কিছুটা চমকে দেবে বলে আগে কিছু জানায় নি। ২ বছরের তিন্নি এর মধ্যেই আন্দাজ করতে পেরেছে, আর পাঁচটা বন্ধুর মতো তার বাবাকে সে পুজোর সময় পাশে পাবে না। নতুন জামার গন্ধ মেখে দূর্গা ঠাকুর, অসুর কাকু, গণেশ দাদা, কার্তিক, লক্ষ্মী দিদি, সরস্বতী দেখা হলেও পাপা পাশে থাকবে না।
হয়তো সেইসময় কোনও মন্ডপের বাইরে যান নিয়ন্ত্রনে সর্তক নজর রাখতে হচ্ছে রজতকে।
রজত চৌধুরি পুলিস কর্মী। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেছে তার কর্ম জীবনের। চাকরি পাওয়ার একবছরের মাথায় কৃষ্ণার সঙ্গে বিয়ে তার। কলেজ জীবনের প্রেম টিকিয়ে তাকে শুভ পরিণতি দিতে পেরেছিল ওরা। দুজনেই দুজনের প্রথম প্রেম ছিল। বিয়ের দুবছরের মাথায় তিন্নি আসে। ছোট পরিবার, খুশি সচ্ছল। কিন্তু সুখী নয়। কারণ কর্মসুত্রে রজতের সঙ্গে পরিবারের দূরত্ব। ছোট্ট তিন্নিকে নিয়ে কৃষ্ণা থাকে কলকাতার টালিগঞ্জে রজতদের পৈতিক বাড়িতে। রজতের এখন পোস্টিং জেলার দিকে। পুজোর দিন কয়েক আগে বাড়ি এসেছিল ও। সত্যি বলতে মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারেনি রজত।
বাড়ি ঢুকতেই তিন্নি জিগেস করেছিল, পাপা, পাপা এবারও তো তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে না, তাই না? উত্তরের আশা না করেই গুড়গুড় করে খেলনা গাড়ি নিয়ে দাদু, ঠামের ঘরে দৌড়ে দিল।
এবারও পুজোর মধ্যে রাতে একবার করে বাড়িতে ফোন করা ছাড়া,আর সেভাবে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি। নবমীর সকালে চাপ খানিকটা কম, ফোন করে সকালেই সুখবরটা দিল এস আই রজত চ্যাটার্জি, একাদশী থেকে লম্বা ছুটি মঞ্জুর হয়েছে।
তুমি ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নাও, দ্বাদশীর সকালেই বেড়াতে যাবো। রজতের এই কথায় কৃষ্ণা আনন্দিত তা বলতে হয় না। বহুদিন বাদে থানায় বসে মনে ভালো হয়ে যায় রজতের। থানার ছাদে উঠে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরিয়ে লম্বা টান দেয়। তারপর ধোঁয়াটা আকাশের দিকে মুখ তুলে ছাড়ে, বহুদিন বাদে ও আকাশ দেখল। শরতের আকাশ এমনিতেই কুমারী মেয়েদের মতো একা থাকলে খুব ছটফটে, পাশে কেউ এলেই দায়িত্ববান। কৃষ্ণার সঙ্গে বিয়ের আগে ভিক্টোরিয়ায় ঘুরতে গিয়ে শেষ এইভাবে আকাশ দেখেছিল রজত। ও তারিয়ে তারিয়ে তাকিয়ে দেখে, সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে ওদের ঘুরতে যাওয়ার প্লেনটা যেন দেখতে পায় রজত। হঠাৎই বেজে ওঠে ফোন, ধরতেই বড়বাবু জানায় কালকের বিসর্জনকে নিয়ে শালাগুলো ঝামেলা তৈরি শুরু করেছে। যা খবর দুপুর থেকে থানা এরিয়ায় টেনশনটা আরও বাড়বে। ধড়ফড় করে বাস্তবে ফিরল রজত। সিড়ি দিয়ে নামতেই বুঝলো দুইদল গুন্ডার পেশীর লড়াইটা এবার মাত্রা ছাড়িয়েছে। থানার সামনেও বোমাবাজি হয়েছে দুবার। ঘটনার মোড় অন্যদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আন্দাজ করে, ওয়ারলেসে বড় কর্তাদের প্রয়োজনীয় বার্তা পাঠিয়ে থানা থেকে বেরালো রজত। সোর্স মারফত খবর পেয়েছে কাছেই একটা গলিতে মজুত করা হচ্ছে অস্ত্র। গলি তিনদিক থেকে ঘিরে ভিতরে ঢুকলো রজত, ঢাকের বাদ্যি দুর থেকে ভেসে আসছে। নীল শরতের পেজা মেঘ রজতকে জানান দিচ্ছে এই অ্যাসাইমেন্টের পর লম্বা ছুটি তাঁর। অকুতোভয় বলে ফোর্সে তার একটা সুনাম আছে। ধীর পায়ে খোলা বন্দুক নিয়ে গলিটার বাঁ-দিকে ঘুরতেই, কান ফাটানো একটা আওয়াজ, সারাদিক ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেল। বাইরে থাকা পুলিস কর্মীরা আরো ফোর্স নিয়ে ততক্ষনে দৌড়ে এসেছে।
রক্তাক্ত রজতের ফোনটা বেজে চলেছে, এক সহকর্মী ফোনটা ধরতেই ওদিক থেকে কৃষ্ণা কিছু না শুনেই বললো, তিন্নি তোমায় কি বলছে শোনো। ওদিক থেকে তিন্নি আধো গলায় বলেই চলছে, ‘পাপা, আই লাভ ইউ। পাপা আমরা অনেক ঘুরবো। তুমি আমায় প্রজাপতি ধরে দেবে, পাপা তুমি এবার আমাদের সঙ্গে,….
রজতের দেহটা একবার শেষ ঝাকুনি দিয়ে নীরব হয়ে গেল দূগ্গা পুজোয়।