কারেন্ট
বন্দনা বিশ্বাস ##
লকডাউন চলছে গত দুমাস।নারিনের এমনিতেই মন ভালো ছিল না।তার ওপর প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আমপান বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেল নারিনের অন্তর আর বহির জগৎ। জীবনকে মনে হলো বন্যার জলের স্রোতে ভেসে চলা খড়। ডুবতে ডুবতে ভাসে আবার জেগে ওঠে পুনরায় ডোবার অপেক্ষায়..
ইতু আর সৌমীতৃষ্ণা ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে দামালপনা করে চলে। ওরা নারিনের বান্ধবী, অন্তরঙ্গ কিনা নারিন বুঝতে পারে না কিন্ত বন্ধু সেটুকু বুঝতে পারে। ইতু আর সৌমীকে ভালো লাগার কারন ~ জীবন কী এবং কেন ~ তা নিয়ে ভুল হোক- ঠিক হোক ওরা অন্তত কিছুটাও প্রশ্নকাতর।ওদের প্রতি নারিনের আগ্রহের মূল কারণ এই অবুঝ জীবনজিজ্ঞাসা।
আমপান হওয়া ইস্তক আজ দশদিন হলো কারেন্ট নেই। পিলার, ট্রান্সফর্মার গাছের শেকড়ের মতো উপরে রয়েছে। প্রশাসন যথাসাধ্য করছে। শহর কলকাতা কমপ্লিট করে গ্রামে পৌঁছাতে টাইম লাগবে তো। গ্রামের লোকেরা কোনও কালেই একনম্বর নাগরিকের মর্যাদা পায়নি। তারা দ্বিতীয় শ্রেনীর ছিল-আছে।
নারিন গ্রামেরই মেয়ে। কিন্ত আস্ত পৃথিবীটা তার বুকের ভেতরে। মহাবিশ্বের দোলায় দুলে ওঠে তার শরীর- মন- আত্মা। সে এক অব্যক্ত কান্না, অব্যক্ত আনন্দ, অবর্ণনীয় ভালো লাগা। ভালোবাসার এ এক অনিবার্য ইফেক্ট। যেমন কারণ থাকলে ফলাফল থাকবেই, তেমন..
দশদিন হলো কারেন্ট নেই। নারিন তাই নিজের দিনলিপি বদলে নিয়েছে এই কটা দিনের। সূর্যিমামা হামা দেওয়ার আগেই তার সকালের সব কাজ কমপ্লিট। সক্কাল সক্কাল বই নিয়ে বসে। দিনের আলো যেন তার বেহিসেবের ফাঁক গলে একটুও বেরিয়ে না যায়। খুব সতর্ক। ফোন অকেজো হয়ে রয়েছে সেই গেল বিষ্যুদবার থেকে। তার প্রাণশক্তি, অচিনপাখি সেই বই। বই-ই তার শক্তি।
এদিকে লকডাউনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে করোনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কৃষকের দীর্ঘশ্বাস, বনস্পতির ওপড়ানো শেকড়, ঘরের উড়ে যাওয়া চাল, রেশনের দোকানে সকালে এসে বিকেল পযর্ন্ত লাইনে হাপিত্যেস বসে থাকা, মাথাপিছু বরাদ্দ চালের জন্য কাঙালীপনা, পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষুধার্ত ক্রোধ, রেললাইনে টুকরো হয়ে পড়ে থাকা রুটির সঙ্গে টুকরো টুকরো পড়ে থাকা দেহখন্ড ~~করোনার ওসব পাত্তা দিতে বয়ে গেছে।
ছোটবেলায় ঝি ঝি পোকার ডাককে নারিনের রোমান্টিক মনে হতো। ঠাকুমার চুলে বিলি কাটা, পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া, গল্পচ্ছলে তার নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে পোক্ত না করতে পারার খেদ- নাতনি নারিনকে আদর করতে করতে বলে তিনি হাল্কা হতেন। ঠাকুমার আদর নারিনের বেশ লাগত। একথা ভেবে মজা পেত ~ যা হতে পারেনি আর যা হতে পেরেছে ~ এই দুটো ইচ্ছেই আসলে আমার ঠাকুমার আশ্রয়প্রার্থী। যাকে নারিন সেই মুহূর্তে জড়িয়ে শুয়ে আছে সে তার বাবার মা,ঠাকুর্দার স্ত্রী আবার তারই ঠাকুমা ~ এতোকিছু একটা মানুষ কী করে হতে পারে ভেবে নারিন তাজ্জব হয়ে যেত, ভাবলেশহীন ভাবে বিস্মিত এবং অবাক হতো এবং শৈশবের নিয়ম মেনে যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ত।
আমপান-উওর বিদ্যুৎ- বিহীন সান্ধ্যকালীন ঝি ঝি পোকার ডাক নারিনের অস্বস্তি বাড়িয়েই চলে। না আছেন সেই প্রাণপ্রিয় ঠাকুমা। না আছে শৈশবের স্বস্তি। বিদ্যুৎবিহীন, অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত মোটে কাটতেই চায় না। মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে যায়। মন শুধু সাক্ষী থাকে একের পর এক জেগে ওঠা চিন্তার। চিন্তাগুলো স্হায়ী হয় না। অনুভবহীনও থাকে না, বিরামও নেয় না তাদের আসা- যাওয়ার।
কখনো চাঁদের পাহাড়ের শঙ্করের সঙ্গে নারিন আফ্রিকায় চলে যায় তো পরক্ষনেই জাঙ্গিয়া পরা শৈশবের খেলার মাঠ। খেলা না থামিয়েই পুরুলিয়ার ঝালদায় সেই টুসু পরব দেখতে যাওয়ার পথে দূ্র্ঘটনায় রাস্তা-জুড়ে রক্তাক্ত,ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে নারিন আর তার বি. এড কোং..।যখন হাত – পা ভেঙে রক্তাক্ত কাতরাচ্ছে নারিন আর তার সহপাঠীরা। আচমকা বরাভয় হাস্যমুখ মা-সারদা নারিনের মাথা টিপে দিচ্ছে, বলছে – “তুই বড্ড চঞ্চলা” মাথায় বোলানো মায়ের হাত ধরে নারিন বলে – “তুমি বলছ?বুকের ভেতর দুমড়ে- মুচড়ে,উথালপাথাল, তান্ডব করে চলে যায় ঝাঁক ঝাঁক চিন্তারা।বাইরে তার একফোঁটা বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাও?”
কোন ফাঁকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নারিন। শৈশবহীন, বিদুৎবিহীন সারদীয় শান্ত সকালে ঘুম ভাঙল নারিনের। ইতু আর সৌমীকে ফোন করতে যাবে, অমনি ক্যাবলার মতো একচোট খিলখিল হেসে উঠল আপনমনে ~ফোনে তো চার্জ নেই। সেই কবে থেকেই অকেজো।