কৃষ্ণ পূজা
অনিকেত বন্দ্যোপাধ্যায় ##
শ্রীযুক্ত রমেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গোঁড়া বৈষ্ণব। তাঁর দর্জিপাড়ার বাড়ি, গোপাল ভবনে, রাধাকৃষ্ণ ও নারায়ণ শিলার নিত্যসেবা করেন একনিষ্ঠ ভাবে। বছরে দুইবার মহোৎসব, বৈষ্ণবসেবা, কীর্তন, কিছুই বাদ যায়না। তাঁর বাড়িতে, দেবতার আশীর্বাদে কোনও কিছুরই অভাব নেই তাই।
রমেন্দ্র, আর তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণি, রামানন্দ মঠের দীক্ষিত। তাঁদের গুরু, শ্রীমদ সত্যানন্দ প্রভু, সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। প্রতি মাসে, রমেন্দ্র আর লক্ষ্মীমণি, ফল, মিষ্টি, দই, চাল, ডাল নিয়ে বিশাল পরিমাণের ভোজ্য দান করে আসেন তাঁর গুরুকে। সত্যানন্দ মশাই তাই তাঁর এই অর্থবান শিষ্যের উপর খুব খুশী।
প্রত্যেক বছর, সত্যানন্দ, তাঁর মঠে জগন্নাথের রথযাত্রার উৎসব করেন। কোনও এক বিশেষ (ধনী) শিষ্যের বাড়িতে, সাতদিন ধরে জগন্নাথদেব সহ, গুরুদেব সত্যানন্দ সেবা নেন। ধনী ভক্তরা গুরুসেবা আর ইষ্টসেবা করে পুণ্যলাভ করেন।
এই বছর, রমেন্দ্রর অনুরোধে, তাঁর দর্জিপাড়ার বাড়িতে আসতে রাজি হলেন গুরুমশাই। গুরু রাজি হওয়ায় রমেন্দ্রের আনন্দ আর ধরেনা!! গুরুর আরাধ্য ইষ্টদেবতা জগন্নাথ নাকি ভীষণ জাগ্রত। তাই তাঁর মহাপুণ্যলাভ শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাঁর মোক্ষলাভ একেবারে পাকা!!
ক্রমশ, আষাঢ়ে রথযাত্রার দিন এল। “গোপাল ভবনে” সাজ সাজ রব। হই হট্টগোল, আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশীতে ছড়াছড়ি। পুণ্যার্থীর ঢল নেমেছে। ভিড় করে সবাই অধীর অপেক্ষা করছে, কখন শ্রীশ্রীজগন্নাথের রথ পৌঁছাবে। রমেন্দ্র, আজ গরদের ধুতি পরেছে। গায়ে দামি উত্তরীয়। গলায় সোনার মটরমালা হার। লক্ষ্মীমণির গায়ে ঢাকাই জামদানী। সারা গায়ে, উত্তরাধিকারে পাওয়া দামি গয়না। হাতে পীতলের বরণডালা।
ক্রমশ সন্ধ্যা হল। কাঠের বিশাল জগন্নাথের মূর্তি নিয়ে, গুরুজী পৌঁছালেন শিষ্যবাড়ি। শাঁখ, কাঁসর বাজিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল উপরে। গুরুজীর গায়ে নতুন গেরুয়া বসন। কপালে দীর্ঘ তিলক। গলায় মোটা গোলাপ ও রজনীগন্ধার মালা। যেন স্বর্গের কোনও মহর্ষি।
পরের দিন থেকে, যথারীতি নিত্যসেবা আরম্ভ হল। রমেন্দ্র এই আটদিন, মাইকের ব্যবস্থা করেছে, যাতে গোটা এলাকা থেকে মন্ত্রোচ্চারণ আর কীর্তন শোনা যায়। ফুল, মালা, মিষ্টি, দই, ছাপ্পান্ন ভোগ সহকারে জগন্নাথের উৎসব। যাগযজ্ঞ, ভাগবত পাঠ ও জ্ঞানযজ্ঞের বিশাল আয়োজন। পাড়ার সবাইকে আমন্ত্রণ করা হল, জগন্নাথের বিশেষ ভোগ খেতে।
গুরুদেবের সাথে যে চেলারা এসেছিল, তারাও যথারীতি কাজে লেগে পড়ল। পোলাও, তরকারি সহকারে ভোগ, বিভিন্ন পরিমাপে বিভিন্ন ধরনের বাক্সে বন্দী হতে লাগল। কোনটা ১০১ টাকার দক্ষিণার বদলে, কোনটা আবার ১০০১ টাকার বদলে, বিতরণ হতে লাগলো। আর যে অভাগা গরিব নাস্তিকদের, ধর্মকর্মে পুণ্যলাভের অধিকার নেই, তাঁদের সেই ১১ টাকার দক্ষিণার বদলে, জুটল একটু বাতাসা আর চরণামৃত। আর জুটল মঠকর্মীদের বক্র ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টি।
একদিন, এইরকম ভোগ বিতরনের সময়, সত্যানন্দ গুরু যখন শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করছেন, শ্রোতাদের সম্মুখে, তখন, একটা বছর ছয়-সাতেকের বাচ্চা ছেলে, ছেঁড়া নোংরা জামা পড়ে, সোজা উপস্থিত হল শ্রীজগন্নাথের সামনে। কাতর হয়ে, উপস্থিত লোকেদের বলল, তাঁকে কিছু খেতে দিতে। কিন্তু, যেই দেখল, মাইকের শব্দে ও ভক্তির প্রাবল্যে কেউই তাঁর কথা শুনছে না, তখন সে নিজেই এগিয়ে গিয়ে, একটা ভোগের বাক্স নিয়ে খেতে লাগল, প্রচণ্ড খিদেয়।
তক্ষুনি চিৎকার করে উঠল সত্যানন্দ!! এক অপবিত্র বালকের স্পর্শে, অশুচি হয়ে গেছে জগন্নাথদেবের ভোগ। গোটা স্থানটাই অশুচি হয়েছে। এক্ষুনি ওই অভদ্র নোংরা বাচ্চাটাকে তাড়াবার আদেশ দিলেন। ফলে, এক গ্রাস খেতে না খেতেই, রমেন্দ্র নিজে এসে তাঁর হাত থেকে কেড়ে ফেলে দিল সেই বাক্সটা। ছেলেটাকে মারতে মারতে বের করে দিয়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করা হল পূজার স্থান। তারপর ফের শুরু হল পাঠ।
উল্টোরথে, সেবায় তুষ্ট গুরুদেব তাঁর জগন্নাথকে নিয়ে ফিরে গেলেন মঠে। সব আবার স্বাভাবিক হয়ে এল।
মাসখানেক পরে, রমেন্দ্র বাজারে বেরিয়ে, ফের দেখতে পেল সেই ছেলেটাকে। রমেন্দ্র, প্রতি রাতে তাঁর রাধাকৃষ্ণের পূজার্চনা করবে। সেই সন্ধ্যায়, সে তাঁর কৃষ্ণপূজার জন্য, মিষ্টি আর দই নিয়ে ফিরছিল বাড়িতে। হঠাৎ কৌতূহল জাগার ফলে, ছেলেটার গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলো। নির্ঘাত ছেলেটা চোর। নইলে ওইভাবে কেউ বাড়িতে ঢুকে খেতে থাকে? ছেলেটা, তাঁর থেকে সামান্য ছোট একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একটা ঝুপড়ির ভিতর থেকে বেরোল। মেয়েটি খুব সম্ভবত, তাঁর বোন। ঝুপড়িটার দিকে তাকাল রমেন। দুই-তিনটে ত্রিপল ও প্লাস্টিকের বেষ্টনী। ফুটো হওয়া ত্রিপল দিয়ে কোনোক্রমে ছাদ করা। রমেন্দ্র ওদের পিছু নিল। তারপর যা দেখল, তাতে আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা।
বস্তির বাইরে, মাটিতে কে বা কারা, বাসি ভাত আর রুটি ফেলে গেছে। কুকুর খাচ্ছে। সেই রুটির টুকরো ছিঁড়ে, ছেলেটা মেয়েটার মুখে পুরে দিল। তারপর নিজে খেল। ওই বাসি এঁটো খেয়েও মুখে এক অনাবিল হাসি দেখা দিল। রমেন্দ্র আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। দৌড়ে গিয়ে, তাঁর হাতের মিষ্টির বাক্সটা ধরে দিল ওই বাচ্চা দুটোর হাতে। বলল খেতে। মিষ্টি পেয়ে সেই বাচ্চা দুটো মহানন্দে যেই এগতে লাগল বাড়ির দিকে, রমেন্দ্রর মনে হল, যেন মোহনচূড়া আর পীতবসন পরা ঘনশ্যাম, তাঁর রাধিকার সাথে এসে সত্যিকারের ভোগ গ্রহণ করে গেল। তাঁর এতদিনের পূজা- সেবা অসম্পূর্ণ ছিল, তা সম্পূর্ণ হল, জ্যান্ত কৃষ্ণকে পূজা করে। কোনও মানুষকে নয়, নিজের মনকে, নিজের চেতনাকে, গুরু করে। বুঝল রমেন, অর্থের জৌলুসে ঈশ্বর তুষ্ট হননা।তুষ্ট হন, তারই প্রতিমূর্তি এই যে কোটি কোটি মানুষ এই পৃথিবীর, তারা ভালভাবে বাঁচতে পারলে!!।