কেঁদুলির পথে

বিজয় কুমার মুখোপাধ্যায়, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা ##

১২ ই জানুয়ারী, ২০০৩, রবিবার। আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। শীতটা একটু বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে সেবার। সন্ধ্যাবেলা সাইকেলে চেপে পার্শ্ববর্তী গোবরডাঙা থেকে বাড়ি ফিরছি। মনের মধ্যে পরের দিনের কর্মসূচীর চিন্তা। রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার ইংরাজী মাষ্টারমহাশয়, রণজিৎ কর্মকারের সাথে। দেখা হওয়া মাত্রই তিনি বললেন বীরভূম যেতে হবে; কেঁদুলির জয়দেবের মেলায় এবং পরের দিনই। প্রথমটাই তো নিজের মনকে বিশ্বাসই করাতে পারছিলাম না। কোথায় ইতিহাসের পাতায় পড়েছি কেঁদুলির জয়দেবের মেলার কথা, আর কালই সেখানে যেতে হবে। যাই হোক, যথাসম্ভব গোছগাছ করে নিয়ে পরের দিন ভোরে মাকে প্রনাম করে বেরিয়ে পড়লাম। ছোট্ট মারুতি ভ্যানে আমরা পাঁচজন। পাঁচজন মানে আমি, মাষ্টার মহাশয়, বিধান কাকু, রাজাদা, আর গাড়ির চালক বাপনদা। বিধান কাকু মানে ডঃ বিধানচন্দ্র বিশ্বাস, হুগলীর হরিপাল কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক আর রাজাদা হল রাজ্বেশ্বর দাস, ইতিহাসের শিক্ষক।

কোথায় যেতে হবে সেটা জানি, কিন্তু যাত্রাপথ সম্পর্কে কারোরই পরিস্কার কোন ধারণা নেই। এখনকার মত Google Map এর সুযোগ ছিল না, ফলত পথ-জিজ্ঞাসাই ভরসা। আমি আবার এ সব ভাবার মতন অবস্থায় নেই। আমার মনের মধ্যে তখন শুধু কেঁদুলি জয়ের চিন্তা। শুধু ভাবছি আর কল্পনা করছি ‘জয়দেব’ মেলার চিত্রটি। এরই মধ্যে কখন যে আমাদের গাড়ি উত্তর ২৪ পরগণা ছাড়িয়ে নদীয়া জেলায় এসে পড়েছে তা টেরই পাইনি। অবাক বিস্ময়ে নিষ্পলক নয়নে রাস্তার দুধারের প্রাকৃতিক শোভা দেখছি আর ভাবছি বাংলা মায়ের রূপ বৈচিত্রের কথা। নদীয়া জেলার শেষ, হুগলী জেলার শুরু; মাঝে পুণ্যতোয়া নদী গঙ্গা । আমরা ঈশ্বর গুপ্ত সেতু ধরে পার হলাম। গঙ্গা পার হয়ে ওপারে বংশবাটী, অধুনা বাঁশবেড়িয়া। গঙ্গার পাশেই সুবিশাল গগনচুম্বী ঐতিহাসিক হংসেশ্বরী মন্দির। ফেরার পথে অবিশ্যি আমরা হংসেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিলাম।

হুগলী, এ এক অপূর্ব জেলা। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। শুধু আলুর ক্ষেত। সবুজ আলুর ক্ষেত যেন হুগলী জেলাকে শীতবস্ত্রের মত মুড়ে রেখেছে। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে এল। হুগলীর খন্যানে একটি নিরামিষ হোটেলে ভোজন পর্ব সেরে আবার পথ চলা শুরু হল। এত দিন পরে আর হোটেলটির নাম মনে নেই, তবে সে অপূর্ব রান্নার স্বাদ ভোলার নয়। এলাম বর্ধমান জেলায়। প্রথমেই বর্ধমানের মেমারি। তারপর হঠাৎ একজায়গায় এসে দেখি মিষ্টির দোকান গুলোর নাম সব ল্যাংচা দিয়ে, যেমন – ‘ মিঃ ল্যাংচা’,’ ল্যাংচা প্যালেস’, ‘ল্যাংচা কর্ণার’ এমনি আরোও কত কি। এসব দেখে আমি তো অবাক। বিধান কাকু বললেন এই হল শক্তিগড়, যার ল্যাংচা জগত বিখ্যাত। পরবর্তীকালে অনেকবার শক্তিগড় গিয়েছি, ল্যাংচাও খেয়েছি; কিন্তু প্রথমবারের সে স্মৃতি আজও অমলিন। আমাদের গাড়ি  এসে পৌঁছালো বর্ধমান শহরে। চারিদিকে শুধু গাড়ি আর উঁচু উঁচু বাড়ি। বর্ধমানে এসে আমরা এক ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে ‘খুঁজুটি পাড়া’ যাবার রাস্তা জেনে নিলাম। আবার চলতে শুরু করল আমাদের গাড়ি। বর্ধমান থেকে  প্রায় ৭৩ কিঃ মিঃ যেতে হবে। ওদিকে সূর্য অস্তমিত প্রায়। সন্ধ্যা হব হব। অচেনা-অজানা পথ, রাতের অন্ধকার নামার আগেই সেখানে পৌঁছাতে হবে। যাইহোক সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা খুঁজতে খুঁজতে খুজুটি পাড়া পেয়ে গেলাম। সেখানে মাষ্টারমহাশয়ের এক ছাত্রী প্রতিমাদির কোয়ার্টারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রতিমাদি ওখানকার সরকারী হাসপাতালের নার্স। সবাই অপরিচিত, কিন্তু প্রতিমাদি ও তার সঙ্গী-সাথীদের আতিথেয়তা আর সেই শীতের রাতে অপূর্ব পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে আহারাদির তুলনা কেবলমাত্র রূপকথার গল্পেই পাওয়া সম্ভব।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়লাম খুজুটি পাড়ার বিশেষত্ত্ব খুঁজতে। অদুরেই দেখতে পেলাম এক বৈষ্ণবীয় আঁখড়া। ফড়িং গোসাই এর আঁখড়া । সকাল সকাল গোসাই মাধুকরী করতে গেছেন। গোসাই  এর অনুপস্থিতিতেই আঁখড়ার চারপাশ ঘুরে দেখলাম। সেই প্রথম জানলাম বৈষ্ণবীয় মতে মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে একটু এগোতেই চক্ষু ছানা-বড়া। সকাল সকাল সব তেলে ভাজার দোকানে জটলা। আলুর চপ, পেঁয়াজি, ফুলুরি আর মুড়ি সহযোগে চলছে প্রাতরাশ পর্ব। জানলাম এটাই এখানকার খাদ্যাভ্যাস। পেঁয়াজির মায়া ত্যাগ করে কোয়ার্টারে ফিরে এসে স্নান খাওয়া করে প্রতিমাদিদের বিদায় জানিয়ে আবার যাত্রা শুরু।

যাওয়ার সময় নানুরে চণ্ডীদাসের জন্ম ভিটে দেখে যাব এই আমাদের লক্ষ্য। গাড়ি চলছে বীরভূমের চড়াই- উতরাই ভূমির উপর দিয়ে। চারিদিকে ধূ ধূ বিস্তত মাঠ, আর তার বুক চিরে চলে গেছে কালো পিচ ঢালা রাস্তা। যে দিকে তাকাই শুধু ফাঁকা মাঠ আর মাঠ। ফাঁকা মাঠের রূপ যে এত মহিমাময় হতে পারে তা আমার কল্পনাতীত। ছোটবেলায় কবিতায় পড়েছিলাম ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে’; এখানে এসে লক্ষ্য করলাম রাখালের গরু চরানো। তাদের হাতে লাঠি, আর কোমরে বাঁশি; দেখে মনে হয় তারাই যেন এক একজন বহুরূপী শ্রীকৃষ্ণ। দূরের তালগাছগুলো যেন মাঠের রিক্ততা আর শূণ্যতাকে আরোও বাড়িয়ে দিয়েছে। বহু যুগের বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে তারা আজও দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র রাখাল বালকদের মুখ চেয়ে। তার সুশীতল ছায়াতলে কখন এক শ্রান্ত রাখাল এসে বসবে ! কখন এক উড়ন্ত পাখি বসবে তার মাথার উপর! এটাই তার কাম্য।

দেখতে দেখতে নানুর চলে এল। রামী ধোপানী যে পুকুরে কাপড় কাচত তা আজও চন্ডীদাস আর রামীর স্মৃতি বুকে নিয়ে বিরাজমান। রামীর কাপড় কাচার কাঠের পাটাতন আজ প্রস্তুরীভূত। আমাদের গাড়ি নানুর থানার উত্তর দিকে একটু এগোতেই চোখে পড়ল উঁচু একটা ঢিবি। ওটাই চণ্ডীদাসের জন্মভিটে। বিশালাকায় উঁচু ঢিবির উপর বাসুলী দেবীর মন্দির। সারা মন্দির জুড়ে বাংলার প্রাচীন কারিগরদের পোড়ামাটির কারুকার্য। ঢিবির পূর্ব দিকে একটা অশ্বত্থ গাছ তার দুটো শাখা ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা দেখে যেন মনে হয়, মহাপ্রভু উদ্বাহু তুলে ‘হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ’ বলে ছুটে চলেছেন নবদ্বীপের পথে পথে। আজ যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে , প্রায় ৬৬৩ বছর পূর্বে  (১৩৬৭ খ্রীঃ) ঠিক এই জায়গাতেই  বসে কবি চণ্ডীদাস (১৩৩৯ খ্রীঃ – ১৩৯৯ খ্রীঃ) মধুর শ্রীকৃষ্ণ পদাবলীর (শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্য) অপূর্ব সব পদ রচনা করেছিলেন। প্রায় ঘন্টা খানেক সেখানে থাকার পর আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। বোলপুর ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি যখন চলতে লাগলো তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। চারদিক শুনশান, অরণ্যের মধ্যে আদিবাসী সাঁওতালদের বিচরণ। তারা তীর- ধনুক, বর্শা প্রভৃতি নিয়ে শিকার ধরায় ব্যস্ত। এইভাবে আরোও ঘন্টাখানেক গাড়ি চলার পর আমরা কেঁদুলির উপকন্ঠে এসে পৌঁছালাম। পথের মাঝে মাঝে দেখি গাড়োয়ান গরুর গাড়ি বোঝাই করে কলা নিয়ে আসছে; দেখলে মনে হয় যেন এক একটা হাতি শুয়ে আছে।

সন্ধ্যা নামার কিছু পূর্বেই আমরা মেলায় এসে উপস্থিত হলাম। জয়দেব [সর্বাধিক প্রামান্য তথ্য মতে কবি জয়দেব (১১৭০ খ্রীঃ- ১২৪৫ খ্রীঃ) তাঁর গীতগোবিন্দ কাব্য সৃষ্টি করেছিলেন এই কেঁদুলিতে] মেলার মূল মন্দিরে রাধামাধবের যুগল মূর্তির চিত্রপটে প্রনাম জানিয়ে আমরা মেলা দেখতে বের হলাম। এ আবার কি মেলা ! মেলা মানে তো  নাগরদোলা, চুড়ি-ঘুনসি, খাবারের দোকান এতদিন এসবই জেনে এসেছি। কিন্তু এ তো শুধু বাউল আর বাউল। মূল মন্দিরের পাশে প্রধান বাউল মঞ্চ। আর সারা মেলার মাঠ জুড়ে শুধু বাউলের আখঁড়া। দেশী বিদেশী সব বাউল ভক্তদের আনাগোনা এখানে।

অজয় নদের তীরে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই মেলা অবস্থিত। রাতে এক আশ্রমে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে বেরিয়ে পড়লাম বাউল গান শুনতে। রাত যত বাড়তে লাগল পাল্লা দিয়ে বাড়ল বাউলের সুর। আমার বাকি সঙ্গীরা রাতের খাবার শেষ করে গা এলিয়ে দিল; এমন একটা রাত আর হেলায় ঘুমিয়ে কাটাতে আমার মন চায়নি। কি জানি এ জীবনে আর কখনও এ মেলায় আর আশা হবে কি না ! শুরুর কিছুটা সময় রাজাদা সাথে থাকলেও শেষে সেও হাল ছেড়ে দিল। এবার একাই। একা কেন ? হাজার হাজার বাউল আর চাঁদনী রাত। রাত যত বাড়তে লাগল শীতের প্রকোপও তত বাড়তে লাগল। প্রয়োজন মত শীতের পোশাক কাছে নেই। আসলে অভিজ্ঞতার অভাব। উঃফ সে কি ঠান্ডা! হাত-পা সব বরফ হয়ে গেছে। যেন আগুনে ঝাঁপ দিতে পারলে বেঁচে যাই।  সে রাতের সেই ঠান্ডার কথা মনে পড়লে আজও আমি বৈশাখ মাসের দুপুরে কেঁপে উঠি। শেষ রাতে অজয়ের তীরে বালির উপর শুয়ে পড়লাম। মনে হতে লাগল যেন জোৎস্নায় স্নান করছি।

ক্রমে ভোর হল। এবার ফেরার পালা। ফেরার পথও একই। তাই সারা রাতের ক্লান্তিতে অধিকাংশ সময়টা ঘুমিয়েই কাটল। আজও সেই দিনগুলির কথা ভাবলে মন যেন এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। আসলে মামা-মাসি-পিসির বাড়ির বাইরে সেটাই ছিল প্রথম বেড়াতে যাওয়া। সুযোগ পেলেই আবার বেরিয়ে পড়ব প্রকৃতির রসাস্বাদনে এই বঙ্গভূমির আনাচে কানাচে। ‘দৃশ্যকল্পের’ সহযোগিতায় সে সুযোগ বারে বারেই আসবে এই আশা রাখি।

পাঠকদের প্রতি সম্পুর্ন স্মৃতি নির্ভর এই লেখা ১৭ বছর আগের এক ভ্রমন কাহিনী লিখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে Google এর সাহায্য নিতে হয়েছে কৈশোরোত্তর চোখে দেখা সেই সময়কার মেলার সাথে বর্তমানের কিছু পার্থক্য ঘটলেও আশা করি মেলার মূল সূর আজও এক আছে কৃতজ্ঞতা জানাই সিউড়ীর তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যিনি প্রয়োজনীয় ছবিগুলির যোগান দিয়েছেন।            

2 thoughts on “কেঁদুলির পথে

  • May 1, 2020 at 12:32 pm
    Permalink

    অনেক দিনের ইচ্ছে জয়দেব মেলায় যাওয়ার, লেখাটা পড়ে ইচ্ছে আরও বেড়ে গেল।বালিতে শুয়ে জ‍্যোৎস্না স্নানের লোভ জেগে গেল।

    Reply
  • May 9, 2020 at 3:03 am
    Permalink

    খুব ভালো লাগলো পড়ে।
    এখনও যযাওয়া হয়নি আমার।তাই ইচ্ছেটা আবার ‌চাগাড় দিল মনের ভিতর।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 − fifteen =