গোপালপুর ও আমরা তিনজন
মিঠুন মজুমদার ##
বুকের বামদিকে বড় ব্যথা অনুভব করছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। জানি, সে ব্যথা প্যারাসিটামলে সারবে না। শুধু পাতার মর্মর ধ্বনি আর পাখির কলতানই আমার এ বুকের ব্যথাটা কমাতে পারে। তাই সমস্ত টেনশন, দায়দায়িত্ব, পাওনাগন্ডা দুদিনের জন্য নীল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম সবুজের খোঁজে। সে সবুজ পূর্বের না পশ্চিমের, তা জানি না। তবে এটুকুই জানি, রাখালের বাঁশির সুরের মত আমায় উদাস করতে পারে রাশি রাশি ফুল আর সমুদ্রের নীল জল। তাই বেনামী চিঠির মত নিরুদ্দেশের পথে রওনা দিলাম আমি এবং আমার দুই বন্ধু। যারা প্রত্যেকই বড় সবুজের কাঙাল। সবুজের পিপাসু।।
সকাল পাঁচটা দশ। হাওড়া স্টেশন। যেন হাজার হাজার মানুষের খরস্রোতা স্রোত এখান থেকে শুরু হয়েছে। মিশছে এই মিছিল শহরের অলি গলি থেকে শুরু করে বস্তিতে বস্তিতে। আর একটা স্রোত গিয়ে মিশছে ভারতের নানা প্রান্তে।। আমাদের ট্রেন ছ’টায়। ২১ নম্বর প্লাটফর্ম, ধৌলি এক্সপ্রেস। আপাতত চিঠির ঠিকানা খুরদা রোড। শহর ছেড়ে একটা যন্ত্রের শব ধীরে ধীরে প্রকৃতের কোলে হারিয়ে যেতে বসেছে।। একের পর এক স্টেশন নীল আকাশ সঙ্গী করে উড়োচিঠির খাম আমায় নিয়ে চলেছে আরও আরও দূরে। লাল শালুকের শোভা, কাঁচা পাকা ধানের খেত, লাল মাটির পথ বেয়ে চলা কোন এক গায়ের বধূ সবুজের সাথে ছোঁয়াছুয়ি খেলতে খেলতে বহুদূর চলে গেছে।। কখন যে সময় হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না। চিঠি আপাতত খুরদা রোডে। চিঠির খাম থেকে তিন বেনামী চিঠি বেড়িয়ে পরে আবারও বেনামীর উদ্দেশ্যে হারিয়ে গেল। গন্তব্য এবার বেরহামপুর বা ব্রহ্মপুর।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে। এ শহর তখন ব্যস্ততার মধ্যে ফুরসতই পাচ্ছে না বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার। অথচ আমাদের এই গৃহী সন্ন্যাসীদের হাতে সময়ই সময়। অটোতে না উঠে ধীরে সুস্থে সরকারি বাসে উঠে সোজা গোপালপুরের সমুদ্র সৈকত। সন্ধ্যাটা ততক্ষনে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। বাস থেকে নেমেই হেঁটে চলেছি সামনের দিকে। সঙ্গে গুগল। ঠান্ডা একটা হিমেল হাওয়া মনের উপর থেকে বয়ে গেল।
সামনেই সমুদ্র। লোকজন এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো। কোন কোলাহল নেই। রাস্তার পাশে দুএকটি দোকানে ভীড়। বড় সাঁঝবাতির আলোয় দেখলাম কয়েকজন সমুদ্রের পাড়ে। আর আমাদের ঠিকানা হল সমুদ্রের পাড়ে এক হোটেলে।। হোটেলে একেবারে শেষের ঘরটা নিলাম। সামনে বড় ব্যালকনি। একটা বড় চেয়ার। ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পড়লাম রাতের খাবারের খোঁজে। ততক্ষণে ভীড়টা একটু একটু করে হাল্কা হতে শুরু করেছে।। রাত হতেই হাল্কা নিয়নের আলোয় বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলাম গোটা পরিস্থিতি। ফিরে এসে চললো আমাদের আলোচনা। যন্ত্রের কলকবজা ছেড়ে গায়ে পরে নিলাম নীলের আবরণ। তিনটি চেয়ারের আমরা তিন সবুজ সন্ধানী। অথচ উজানতলির গাঙ এসে পড়লো নীলের দেশে।।
প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক, জটিল কুটিল ফেক্টর নিয়েই আমরা বসলাম গভীর আলোচনায়। আলোচনায় মগ্ন তপস্বীর মত আমরা যখন বসে, তখন নীচে সমুদ্রের নীল জল যেন বারবার আছড়ে পরে আমাদের মগ্নতা ভঙ্গ করতে চাইছে। আমরা ধীর স্থির।
রাত বাড়ছে। চাপা পড়া আলোয় সমুদ্র সৈকত যেন আরও ছোট হতে হতে আমার সন্মুখে এসে পড়েছে। ইতি উতি কিছু লোক রাস্তা, ব্যালকনি কিংবা বে ওয়াচে বসে সমুদ্রের গর্জন উপভোগ করছে। গর্জন না ব্যথা কে জানে! কিসেরই বা এত ব্যথা তার? কি ই বা বলতে চাইছে আমায়? কাকে হারিয়ে ফেলার এত যন্ত্রনা তার? উদাস হয়ে পড়ছি আমি। আকাশ থেকে নেমে আসা ঘুম তখন আমার চোখে।
ঘুম ভাঙলো সেই গর্জনে। এক পরিতৃপ্তির ঘুম। এক দীর্ঘ নিশ্বাসে সমুদ্রের নোনা বাতাস আমার স্বাদহীন জীবন যেন আস্বাদিত করে তুলছে। দূরে তখন কুরিয়েনের মূর্তি বালির ওপর জ্বলজ্বল করছে। কি দারুণ ভাস্কর্য। অবাক হয়ে দেখছি আমি। ওদিকে মনের মধ্যে সবুজের ক্ষিধেটা বারবার করে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বলছে, চল মন তুই সবুজের খোঁজে। বেড়িয়ে পরলাম আবারও অজানার উদ্দেশ্যে। একটা গাড়ি আর আমরা তিনজন। রাস্তা আর মনের সরু গলি পেরিয়ে চলেছি শাল পিয়ালের জঙ্গলে। সঙ্গে থাকবে পাহাড় আর পাহাড়।