ডাউরির ডায়েরি
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
ভয়ঙ্কর সুন্দর। কথাটি অক্ষরে অক্ষরে গেঁথে আছে এখানে। দুপাশে খাঁড়া সবুজ পাহাড়। মাঝে ঝর্না নেমে এসেছে পাথরের চাতালে। অনতিদূরে গিয়ে পাহাড়ি নালার রূপ নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে ওদিক পানে। নিঃঝুম আবহে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। পরক্ষণেই ঝর্ণার স্ফটিকস্বচ্ছ জলতানে নেচে ওঠে মন। স্ববিরোধীতার চুড়ান্ত দৃষ্টান্ত যেন। এমনই এক ভীষণ সুন্দরের টানে এবারে আমরা পুরুলিয়ার পথে।
পুরুলিয়া এখন বাঙালির অন্যতম প্রিয় ডেস্টিনেশন। গত বছর তিনেক শীতের বা বসন্তের মরসুমে অযোধ্যায় গেলে মনে হয় যেন কুম্ভ মেলায় এসেছি। কিন্তু সে ভিড় শুধুই চেনা জানা কিছু জায়গাতে, বাকি পুরুলিয়া এখনও অধরা গণ ভ্রমণের বিভীষিকা থেকে। আমার পুরুলিয়ার প্রতি প্রেম আজ নয়, প্রায় ২২ বছর আগে চাকরি জীবনের প্রথম দিকে পুরুলিয়াকে দেখার সুবাদে অনুরক্ত হই। তখন অবশ্য গোটা পুরুলিয়াই ছিল অনাঘ্রাত সৌন্দর্যের আখর। জনসুনামি তো দূরের কথা, নিমন্ত্রণ করেও লোক নিয়ে আসা যেত না। সেই সময়ে ঘুরে বেড়ানো সেই ভালবাসার পুরুলিয়ার আজ দম আটকে আসা অবস্থা। আমাদের এবারের পুরুলিয়া ভ্রমণে অযোধ্যা ছিলই। সিএডিসি-র নীহারিকা বুকিং করে রেখেছিল আমার পুরুলিয়ার প্রাক্তন সাংবাদিক সহকর্মী আমজাদ কাজি। সেই মত সপরিবারে হাজির অযোধ্যায়।
কিন্তু না, অতি চেনা অযোধ্যা ভ্রমনের কাহিনী আবার বলে মোটেই বিরক্তি আনতে চাই না। আমার প্রধান গন্তব্য ডাউরি খাল। ডাউরি খাল একটি ট্রেকিং রুট হলেও মূলত বিখ্যাত হয় ২০০৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এখানে এসে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারানোর ঘটনায়। সেই থেকেই এই এলাকা আক্ষরিক অর্থেই ভয়ঙ্কর সুন্দর। বাঘমুন্ডি কাছাকাছি বড় শহর। নিশ্চয় বাঘমুন্ডিতে আসার পথনির্দেশ এখন আর কাউকে দিতে হবে না। এবার এখান থেকে একটা অটো বা গাড়ি ভাড়া করে চলুন কুদনা গ্রামে। গাড়িতে এই পর্যন্তই আসা যায়। গ্রামের শেষ প্রান্তে গাড়ি রেখে এবার শুরু হবে হাঁটা।
তবে একা হেঁটে যাওয়াটা বেশ চাপের। কোথাও কোনও দিক নির্দেশ নেই, পদে পদে পথ হারানোর ভয়। তাই আমাদের সঙ্গী হল গ্রামের যুবক ধীরেন। ওর কাছেই শুনলাম এদিকে প্রায়শই হানা দিচ্ছে হাতির পাল। ধান পেকে গেছে কি না, তাই তেনাদের আসা যাওয়া। শুনে তো বুক কাঁপতে শুরু করেছে ভয়ে। গ্রামের শেষ বাড়িটা পেছনে ফেলে হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে। পাকা ধানের মাঝখান দিয়ে আলপথ দিয়ে রাস্তা। দূর থেকে দেখা যায় চারদিক পাহাড়ে ঘেরা।
প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর ধানের জমি ছাড়িয়ে এবার পথ চলা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সরু রাস্তা একসঙ্গে দুজন যাওয়া মুশকিল। জংলি গাছের গন্ধ গায়ে মেখে এগিয়ে যাচ্ছি সকলে। ঝোপঝাড়ের আঁচড় লাগছে হাতে পায়ে। মাঝে একটি খরস্রোতা জলধারা পেরিয়ে যাওয়া হল সাবধানে। আমার ছেলেকে তো কোলেই তুলে নিল ধীরেন। আমার সত্তরোর্ধ বাবাও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। পথের পাশেই দেখি গাছের উপরে মাচা, হাতির হাত থেকে ফসল বাঁচাতে ওখানে রাত পাহারা দেওয়া হয়।
ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে এবার সিমেন্ট এর পাইপের উপর দিয়ে এক পা দু পা করে এগোতেই সামনে দেখি এক অজানা রূপের খনি সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। দুপাশে পাহাড়, তার মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে ঝর্ণা। জল পড়ছে একটা বড় পাথরের চাতালে। তারই মাঝখান দিয়ে সরু সরু জলধারা গিয়েছে বয়ে… মনটা ভরে গেলো এক অপ্রত্যাশিত আনন্দে।
প্রায় দু’কিলোমিটার হাঁটা পথ, সকলেই ক্লান্ত। তাই এবারে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পালা। পাথরের উপরে যে যার মত বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসে থেকে বা ঘাড়ে মাথায় জল দিতেই উধাও ক্লান্তি। সত্যিই অপূর্ব জায়গা। মনে হচ্ছিল সেই শিক্ষার্থীদের কথা। তারা হড়পা বানে হারিয়ে গেলেও, মনে মনে তারিফ না করে পারলাম না তাদের পছন্দকে। তবে রাতের বেলা এখানে থাকতে গেলে বেশ ভাল রকমের বুকের পাটা থাকা চাই। দিনের বেলাতেও কেমন যেন গা ছমছমে একটা ব্যাপার স্যাপার।
একটা উঁচু পাথর পেরিয়ে দেখা মেলে ‘কুমিরের হাঁ’ মুখ। পাথরের গঠনটা একদম কুমিরের খোলা মুখের মত। সেই বিখ্যাত হা মুখে একটু বসব না গিয়ে তা হয় নাকি। একটু কষ্ট করেই উঠে গেলাম সেখানে, ছবি তোলা হল স্মৃতিরক্ষার অজুহাতে। এবারে শুধু উপলব্ধির সময়। চুপ করে বসে শুধু সুন্দরকে বুঝে নেওয়ার পালা। একটু দূরে যেখানে ঝর্ণার জল জমেছে সেখানে অচেনা মাছেদের খুনসুটেমি ভাল লাগায়। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন হঠাৎই থমকে গিয়েছে সময়।
এখান থেকেই খানিক নিচে নেমে বড় বড় উপলখণ্ডের ফাঁক গলে বয়ে গিয়েছে ডাউরি নালা। ঘন্টাখানেক বসার পর এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথেও সেই কসরত করে ফিরতে হল। ধীরেন লোকটা বেশ ভাল, আমাদের সকলকেই যথেষ্ট সাহায্য করেছে সে। শান্ত সবুজ সেই সুন্দর জায়গাটা ছেড়ে আসতে চাইছিল না মন। মুখ দেখে মনে হল সকলেরই এক অবস্থা।
কুদনা থেকে ফের গাড়িতে উঠে এবার বাঘমুণ্ডি মোড়। বিকেল হয়ে গিয়েছে, খিদে তো পেয়েছেই। মোড়ের একটি দোকানে মিলল খাবার। কি একটা ভাজা হচ্ছিল কড়াইতে, চপ নাকি? উত্তর মিলল ভাবড়া। পুরুলিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুলভ একটা খাবার হল এই ভাবড়া বা ফাবড়া। সে নাম যাই হোক; কাঁচা লঙ্কা দিয়ে গরম গরম ভাবড়া খেতে কিন্তু বেশ মজাদার। বেসনের তৈরি নোনতা জিলিপি বলা যায় ভাবড়াকে। তবে জিলিপির আকার হলেও রসে চুবানো হয় না।
এবারে একটু মিষ্টিমুখ হবে না তা হয় নাকি। লওঙ্গ তো আছেই। এটিও এই অঞ্চলের অতি পরিচিত খাবার। আমাদের এখানে লবঙ্গ লতিকা নামে পরিচিত হলেও ওখানে নাম লওঙ্গ্। তবে এখানকার লবঙ্গ লতিকার স্বাদ আর লওঙ্গ্ এর স্বাদ মোটেই এক নয়।
যাই হোক সব মিলিয়ে একটা দিন কেটে গেল বেশ আনন্দে। পরের দিন অন্য জায়গায় যাওয়া, তবে সে নাম খুব অপরিচিত নয়। তাই সে গল্প এখানে নয় এখানে শুধু থাক ডাউরির কথা। এক ভয়ঙ্কর সুন্দরকে ভাল লাগা বা ভালবাসার কাহিনী।
মনে রাখবেনঃ থাকার জায়গা এখন এই অঞ্চলে অনেক আছে। নেটে সার্চ করলেই মিলবে তার সুলুক সন্ধান। তবে ডাউরি যেতে গেলে আসা যাওয়া মিলিয়ে প্রায় চার সাড়ে চার কিলোমিটার হাঁটতে হবে। এবং সেই রাস্তাও মোটেই সুগম নয়। তাই যাদের পায়ের বা হাঁটুর সমস্যা আছে তাদের যাওয়ার আগে একটু দেখে নেওয়া উচিৎ। গ্রামের কাউকে গাইড হিসেবে নিয়ে নেবেন, সামান্য কিছু টাকা ফিরে এসে দিলেই হবে। খাবার দাবার বা জল সঙ্গে নিয়ে যাবেন অবশ্যই, কিন্ত জায়গাটাকে অপরিস্কার করে আসবেন না অনুগ্রহ করে, এমনিতেই ভ্রমণ আতিশয্যে পুরুলিয়া এখন বেশ চাপে।
ভালো লাগলো।বেশ তথ্যবহুল এবং সাবলীলভাবে প্রকাশ করেছেন।তবে যোগাযোগ মাধ্যমগুলি দেওয়া উচিত। তাহলে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়।