দেবতা
জয়ন চট্টোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন
##
কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর। ভূত, দেবতা সব বিশ্বাসে থাকবে, আর অবিশ্বাসিদের কাছে থাকবে কিছু যুক্তির পাহাড় আর ভ্রু কোচকানো বড় বড় বক্তৃতা। আমাদের গল্পটিও এই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। দেবতা সব জায়গায় আছে, শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয়। তিনি হয়তো দেখা দেন আমাদের কিন্তু আমাদের হয়তো দেখার চোখ থাকে না।
বেশ এবার তাহলে গল্পটা শুরু করা যাক।
ঝুনকি পাহাড়ের কোলে মতিন আর ওর বাবা খাবার খাচ্ছে। সূর্য আর কিছুক্ষন পরেই ঢলে পড়বে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গল। আসন্ন রাতের অপেক্ষায় জংগলের বাসিন্দারা নিজেদের প্রস্তুত করছে, তাদের জীবন তো রাতের আধাঁরেই কাটে। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে, আকাশ রক্তাভ, যেন মেঘের জঙ্গলে দাবানল লেগেছে। মায়াবি এই লাল আলোতে জঙ্গলটাকে আরও নিবিড় আরও গভীর লাগছে। এক অদ্ভুত শান্তি চারিদিকে। ঘরফেরা পাখিদের ডাক এই গোধূলি কে পূর্ণতা দিচ্ছে। নদীর কুলকুল শব্দ আর পাখিদের কলতানের অর্কেষ্ট্রার মাঝে মতিন দাঁড়িয়ে ভাবছিল ওদের কথা। ওর মা আর ভাই কে গত বছর বাঘে খেয়েছে, মতিন খুব কেঁদেছিল সেদিন। মতিন তো তখন ছোট, সবে মায়ের দুধ ছেড়েছে, তাই মতিনের অসুবিধার কথা ভেবে ওর বাবা সৎ মা নিয়ে এসেছিল। সৎ মা বেশ ভালো, সারাদিন মতিন কে আগলে আগলে রাখত, একসাথে নুনিতে যেত, তারপর জল খেয়ে মায়ের কোলের কাছেই আরামের ঘুম। মতিনের মা মরে যাওয়ার পর মতিন টাঁড়বারোর উপর রাগ করেছিল, কেন সেদিন ওর মাকে রক্ষা করল না। কিন্তু আজ ওকে রাগ ভাঙতেই হল। নতুন মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আজ সকাল থেকে। কাল রাতে মায়ের সাথে ঝগড়া করেছিল সামান্য কারনে, তাই হয়তো মা রাগ করে চলে গেছে, নিজের উপর রাগ হল। কিন্তু তারপরেই মনে হল কাল রাতে বাঘের হুংকার শুনেছিল আর একটা ঝটাপটির শব্দ, কিন্তু জঙ্গলে ওইসব শব্দ নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর তাই মতিন চোখ খোলে নি। সকাল থেকেই মাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই মতিন প্রানপনে টাঁড়বারোকে ডাকছে।
সারাদিন ছেলেটা খায়নি তাই মতিনের বাবা হাজার চিন্তার মাঝেও ছেলেকে নিয়ে এসেছেন খাওয়াতে, এদিকে খুব কচি কচি ঘাস হয় পেট ভরে খাবে ছেলেটা। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ছেলে তখনও টাঁড়বারোকেই ডেকে চলেছে। হঠাত একটা চেনা গন্ধ নাকে আসে। মা এর গন্ধ, মা এর গন্ধ। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে সেও পেয়েছে গন্ধ টা। ওরা দুজন প্রানপনে ছুটে যায় গন্ধের উৎস খুঁজতে। গিয়ে দেখে নতুন মা এর ছিন্ন ভিন্ন দেহ পড়ে রয়েছে, আর রয়েছে বাঘের পা এর ছাপ, মতিন নিশ্চুপ হয়ে গেল, ওর সামনে সব অন্ধকার, ভাবনা শক্তি লোপ পেল, ওর বাবা ওকে ঠিলতে ঠিলতে বস্তিতে নিয়ে গেল।
বুনো মহিষদের বস্তিতে আজ শোকের ছায়া। বুনো মহিষ এর দল ছাড়াও শজারু, অন্যান্য আন্টিলোপ, হরিন, খরগোশ এবং আরো অনেকে আছে। হরিন ঘাস খাবে আর বাঘ হরিন খাবে, এটাই তো জংগলের নিয়ম, এতে আশ্চর্য কি? কিন্তু আজ সবাইকে একত্রিত করেছে ভালোবাসা। মতিন এতক্ষন চুপচাপ শুন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, এবার বলল,’দেবতা নেই গো, সব মিছে কথা’। কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। ছেলেটা শোকের মাথায় বলছে, মায়া হল সবার। ‘মানি না দেবতা, বিশ্বাস হয়না দেবতার উপর। আর যদি দেবতা থাকে তাহলে উনি অন্ধ, দেখতে পাননা, তাই আমাদের রক্ষা করেন না’। মতিন আবার বলল। সত্যিই তো ছেলে টার ভাগ্যটাই খারাপ এক বছরের মধ্যে দুজন মা কে হারালো, তাই দেবতাকে দোষারোপ করাটা কে অনেকেই মনে মনে সমর্থন করল। ‘দেবতার পুজো আর করব না আমরা, দেবতাকে ভেন্ন করব।’
‘আজে বাজে বকিস না মতিস’, একটা হালকা ধমক দিল ওদের প্রতিবেশি এক পেঁচা, সে দিনের বেলাতে পাহাড়ের গুহাতে থাকে, রাত টা জঙ্গলে কাটায়। সে এতোক্ষন শুনছিল এবার আর চুপ থাকতে পারল না।
‘না রে মতিন’, গাছ থেকে পেঁচা বলে উঠল, দেবতা আছে রে, আমাদের মধ্যেই আছে।’
‘ছাই আছে কাকা, দেবতা নেই’ রাগে মতিন দাতে দাত চিপে বলল।
‘ওরে পাগল, দেবতা আছে তাই আজ তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, না হলে এতক্ষনে বাঘের পেটে যেতিস।’ পেঁচা সহানুভূতির স্বরে বলল।
‘মানে? ‘ মতিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘কাল আমি দেবতাকে দেখেছি,’ পেঁচা বলল, ‘কাল রাতে আমি স্পষ্ট দেখলাম রে, তুই মায়ের সাথে ঝামেলা করলি দিয়ে সেগুন গাছটার তলায় শুলি, কিছুক্ষন বাদে দেখি আমাদের শেরমামা তোর দিকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে মোক্ষম ঝাঁপ টা দিতেই যাবে ঠিক সেই সময় তোর সামনে হাজির হল দেবতা, শেরমামা তাকে নিয়ে গেল, সেই দেবতা তোর মা রে।’ কথাগুলি যেন ঝড়ের মতো ঝাপটে পড়ল সবার কানে। সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল, সৎ মা নিজের সৎ ছেলেকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিল, মানুষের ঘরেও এরকম দেখা যায়না। ভাগ্যিস পশুদের মধ্যে তথাকথিত মানবিকতা নেই, না হলে আজ মতিন বাঘের পেটে যেত। সবাই এক জায়গায় গোল হয়ে বসে মতিনের মায়ের এই আত্মবলিদান কে স্মরন করল আর বলল,’মা তুমি যত দিন আছ দেবতা আমাদের রক্ষা করবে’।