নায়াগ্রার কাছে
শ্যামলী রায়, কলকাতা ##
আজ থেকে প্রায় ছবছর আগের এক ভ্রমণ কাহিনী বলতে বসেছি। বলা যায় স্মৃতি থেকে পুনর্নিমান করতে চলেছি। পুত্রের ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের সমাবর্তন উপলক্ষ্য গিয়েছিলাম পেনসিলভেনিয়া। সুতরাং মাসখানেক ওদেশে থাকার সুবাদে যতটা পারা যায় ঘোরাঘুরি করে নিয়েছিলাম। ওরই মধ্যে দুটি দিন কেটেছিল নায়াগ্রায়। বিশ্ববিখ্যাত জলপ্রপাতটি দেখার জন্য তেমন কোন উত্তেজনা কোনদিনই অনুভব করিনি। ছবিতে চলচ্চিত্রে অথবা টিভিতে তো তাকে অনেক দেখেছি। তবে চোখের সামনে তাকে দেখার অনির্বচনীয় অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত দক্ষতা নেই আমার।
জুনের একুশ তারিখ দু’হাজার চোদ্দ সকাল সকাল জলখাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস ফ্রুটজুস জল ইত্যাদি নেওয়া হল। পেনস্টেট থেকে পাঁচঘন্টার পথ। ছেলের আমার ড্রাইভিং হাত খুব ভালো দেখলাম। ঘন্টা খানেক পরে আবার জঠর বার্তা দিতে থাকে। এবার একটি রেস্টুরেন্ট এ নেমে কফি আর র্যাপ নেওয়া হল। র্যাপ মানে সোজা ভাষায় বড় মোটা রুটির মধ্যে সব্জি মাংস স্যালাড সস সব পুরে দাও আর রোল করে নীচের দিকটা কাগজে র্যাপ করে ফেল। এবার কামড়ে ছিঁড়ে খাও। একটাই আমাদের দুজনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আর কফি তো ওদেশে প্রায় এক বালতি। শেষ না করে গাড়িতে নিয়ে বসলাম আর মাঝে মাঝে চুমুক দিতে দিতে চললাম। পথের বর্ণনা বিশেষ দেব না কারণ মন ভরে দেখার কিছু ছিল না। শুধু পত্র পুষ্পহীন শুষ্ক গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে দুপাশে উঁচু জমিতে। তবে ওরা নাকি আর কিছু দিনের মধ্যেই সাজুগুজু করে নেবে নতুন জামা কাপড়ে। সে নাকি অসাধারণ দৃশ্য।
তিনটে নাগাদ নায়াগ্রায় পৌঁছে গেলাম।
সাড়ে তিনটের সময় ঢুকলাম comfort inn -এ। সহাস্যবদনে অভ্যর্থনা করলেন বয়স্ক রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোক। ঘরে ঢুকে সামান্য যা লাগেজ ছিল রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখনও রোদ ঝলমলে আকাশ, পরিপূর্ণ এক দৃষ্টিনন্দন মায়াময় প্রকৃতি। যতটা পারি তার আস্বাদে সেই পটভূমে নায়াগ্রাকে দেখতে এবার একটু উদগ্রীব হলাম বলা বাহুল্য। বিশ্বজোড়া যার খ্যাতি তার কাছে চলে এসেছি, রোমাঞ্চ তো হবেই। আর আমি ঘরকুনো না হলেও গৃহপিয়াসী বাঙালি গৃহবধূ। তাই মন চাইছে এবার সেই মানের টানে ছুটে যেতে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি ক্যামেরা হাতে ছেলের হাত ধরে….
হঠাৎ অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যের মত চোখে সামনে চলে এল সেই সবুজ সফেন বিরাট জলরাশি। যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সারা জীবনে ভুলবনা সেই প্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি দেখার অভিজ্ঞতা। ভাষায় আমার কম পড়ে যাবে তার বর্ণনা দিতে আসলে সেই যোগ্যতাই আমার নেই।
কি তার অবিরাম গর্জন আর তীব্র স্রোতধারা।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কি উন্মত্ত উল্লাস ভরে তীব্র গতিতে সে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে লেক অন্টারিওর বুকের ওপর। মনে পড়ে যাচ্ছিল “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতার কথাগুলো। পঞ্চাশ ষাট ফুট নীচে লেকের জল কখনও স্থির কখনও চঞ্চল ভাবে গায়ে মেখে নিচ্ছে দুরন্ত আদর। সাদা সবুজ বরণ জলে সাথে ভেসে আসছে জমাট বরফ, তখনও বিগলিত হয়ে মিশে যেতে পারেনি নদীতে
ভেসে আসার আনন্দে। নায়াগ্রার কাছে “নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ” আর কোথায় যাইতেছ তা আমি জানতে চাইনি! রূপে মুগ্ধ কেউ কী অন্য আর কিছু জানতে চায়? ঠিক তেমনি আমার দশা।
লেকের বুকে বহু জায়গায় জল জমে বরফ তখনও সুতরাং বোটিং বাদ গেল। নদীর তীরও তখনও বরফ মোড়া। তারই ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে নির্ভীক সমুদ্র – সারসের দল খাবারের খোঁজে। মানুষ দেখতে দেখতে ওরা আর তাদেরকে মানুষ ই মনে করেনা মনে হচ্ছে।
এবার অনেকটা হেঁটে এসে সেতু পার হয়ে ওপারে গেলাম। ওপার থেকে জলপ্রপাতটির যেন আরেক রূপ ভেসে ওঠে। একেবারে ওপর থেকে সবুজ রঙের জলের ধারা নামছে তীব্র বেগে, এবার দেখি সেযেন এসে পড়েছে বিরাট বড় গোল টেবিল এর ওপর আর সেখান থেকেও অবিরাম ঝরে যায় তার সাদা সবুজ জলধারা —কি তার প্রচন্ড গর্জন মেঘের গর্জন তার কাছে কিচ্ছুটি নয়। এই অংশটুকুর নাম bridal cave. কেন তা বুঝতে পারিনি। হয়ত সামনের অংশটুকু একটু এগিয়ে একটা গহ্বর সৃষ্টি করেছে বলে। বেলা পড়ে আসে। নায়াগ্রার পটভূমিতে নিজেদের নিয়ে একটু ফটো সেশন হল।
দিন শেষ মানে এখানে বিকেল পাঁচটাতেই। ওদিক থেকে এদিকে ফিরে এসে কাছে পিঠে কোন রেস্তোরাঁ খোলা পাওয়া গেল না কারণ এখন অফসীজন তায় সপ্তাহ মধ্য দিন। দোকান পাট বন্ধ করে চটপট ঘরে ফিরে গেছে সবাই
নায়াগ্রায় প্রপাতের দিকে যাবার সময় ডান বাম দু-দিক দিয়ে দুটো রাস্তা চলে গেছে। ডান দিকের পথটি গেছে সোজা কানাডা। কিন্তু ভিসা ছাড়া যাওয়া যায় না। যেমন আমাদের যশোর রোড। যশোর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। নদীর ওপারে টরন্টো শহরের নভরেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বাড়ি ঘরও দেখতে পেলাম নদীয়াকে পার। কত কাছে তবু কত দূরে। “কাছে থেকে দূর রচিলে”…
একটা মাত্র সুভেনির শপ খোলা ছিল সামান্য কিছু মেমেন্টো সংগ্রহ করলাম তারপর চললাম নৈশাহারের উদ্দেশ্যে। “ডোনা টেলো”-তে ডিনার করলাম শ্রিম্প আর পাস্তা জাতীয় কিছু খাদ্য সংগে স্যালাড ও সস। সসটা খারাপ ছিল। ওরা সংগে সংগে অন্যকিছু নেবার জন্য অনুরোধ করল। দরকার ছিল না আমাদের। শ্রিম্পটা ছিল চিংড়ি মাছটা পিঠের দিক দিয়ে চিরে নিয়ে মুখরোচক কোন ব্যাটারে ডুবিয়ে চ্যাপ্টা চওড়া করে ভাজা।
অর্থাৎ “চিড়েচ্যাপ্টাচিংড়ি ‘আরকি। খারাপ সসের জন্য সৌজন্যবশত রেস্তরাঁয় অর্ধেক দাম নিল। হোটেলে ফিরতে বয়স্ক রিসেপসনিসট ভদ্রলোক যথারীতি হাসিমুখে ওযেলকাম করলেন। ঘরের ওমে আশ্রয় নিলাম মা ও ছেলেতে মিলে।
আজ বিকেল থেকে হাজার বছর না হোক হাজার পা তো হেঁটেছি সেকথা হাঁটু বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছিল। ইতিমধ্যে নেটে দেখা গেল আগামী কাল বৃষ্টি হবে। মনটা দমে গেল। রাতের ঘুম নামল ক্লান্ত চোখে আর সকালে ঘুম ভাঙল রিমঝিম বৃষ্টির উদাসীন ছন্দে। দুজনেই হতাশ বৃষ্টির দাপট দেখে। জল হাওয়া র খবর ওদের ভুল হয় না কখখনো। কতটা বৃষ্টি কটা পর্যন্ত হবে তাও বলে দেবে গুনে গুনে। একটু ভুল না হয় হতই সেদিন। চতুর্দিকে কুয়াশা, বৃষ্টি পড়ে চলেছে তার মধ্যে দুএকজন ছাতা মাথায় রেনকোটে শরীর ঢেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে পরেছেন। আমরাও দেখাদেখি সাহস করে ছাতা নিয়ে গরমকোট গায়ে পা বাড়ালাম। পোড়া কপাল বেরোনোর সাথে সাথে আরো জোরে ধেয়ে এলো বৃষ্টি। আমরা দমে না গিয়ে গুটি গুটি এগোই তত বেশি বৃষ্টি নামে। জুতো মোজা ভিজে ঝুপ্পুস–জলের ছাঁটে সোয়েটার। এক হাতে ছাতা অন্য হাত ফুটানি কা ডিব্বা সামলায় পকেটে হাত ঢোকানোর উপায় নেই।। হাত দুটি জমে যায় প্রায়। যে মানুষ কলকাতার দশ-বারোতে কাঁপে তার কাছে এই ঠান্ডা যে কি ভয়ংকর সে আর কি বলি।
নায়াগ্রার ওপর ঘন কুয়াশার চাদর:কিচ্ছুটি দেখা যায় না গো মুখের সামনেটুকু ছাড়া। সেই অবস্থায় ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে ছেলের সাথে সাথে ঘুরলাম। কবচ্ছর বিদেশে থাকায় এ ঠান্ডা তাকে কাবু করে না। তাছাড়া পেনসিলভেনিয়া প্রচুর পরিমাণে ঠান্ডা এবং তুষার পড়ে। কুয়াশা র আস্তর একটুও কমে না সরেও না। কানাডা র দিকে র বাড়ি গুলোর ওপরের অংশ দেখা যায় আর নীচে সাদা কুয়াশা। বাড়ি গুলো যেন শূন্যে ভেসে আছে। ভাবলাম এই হল মেঘের ওপর মিনার।
বৃষ্টি থামার লক্ষণই নেই। জামা কাপড় ভিজিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। সকালে নায়াগ্রা হতাশ করলো। কি ভাগ্যি আগের দিনই সবটাই দেখে ফেলেছি। ঘরে ফিরে পোষাক পরিবর্তন তারপর দেখি বাইরে রোদ্দুর বৃষ্টি উধাও তবে ঘন কুয়াশা। আর একবার বেরোন হল ঘন কুয়াশায় তেমন কিছু দেখা গেল না। আস্তে আস্তে নদীর দিকে একটু গিয়ে ঝাপসা আলোয় তার দেখা না পেলে ও সগর্জন উপস্থিতি বেশ অনুভব করেছি। বেলা বেড়ে উঠছে। ফেরার পথ ধরতে হবে।
সামান্য যা কিছু তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিলাম। “রেড কোচ ইনে” লাঞ্চ করে নায়াগ্রাকে টা টা করে ফেরার পথ ধরলাম।
Khub subdor bornona diye lekha.valo laglo..👍👍
খুব ভালোলাগলো নায়গ্রা অভিজ্ঞতা কাহিনী ! আমরা যখন গেছিলাম তখন বরফ গলে গেছিল ওদেশে স্প্রিং টাইম ,সে পাগল করা রূপ ভুলব না। এমন আরো ভ্রমন কাহিনী চাই ।