পতিত
ইমরান হাসান
কোশল রাজ্য ৪৫০ খ্রিস্টপূর্ব,
যাজ্ঞ্যবল্ক এর বিচারালয়,
পন্ডিত চন্দ্রদেবকে আজকে আনা হয়েছে, তার উপরে আনীত সঙ্গীন অপরাধ এর শুনানি এর জন্য। চন্দ্রদেব ব্রাহ্মণ, সে জাতে গো-মুখী ব্রাহ্মণ। তার মূল কাজ ছিল যজ্ঞ আর পবিত্রানুষ্ঠান করা।
তবে, সে যা করেছে তাতে সে পতিত হয়েছে, সে আর ব্রাহ্মণ নেই।
তার পাশে এক নারীকে বেঁধে রাখা হয়েছে।
এই নারী তার স্ত্রী, সে আর্য রক্তের অপমান করে। এখানে বসবাসকারী এই সামান্যা অপবিত্র রক্তের নারীকে বিবাহ করেছে। এই কারণে আজকে তার বিচার হবে।
তার সামনে বিচারালয়ে উপবিষ্ট অবস্থাতে আছেন যাজ্ঞবল্ক্য, ঋষি পুণ্ডরীক আর লহিত্য ঋষি।
“অভিযুক্ত চন্দ্রদেব মহাপাত্র এর উপরে আনা অভিযোগ বড় সঙ্গিন, সে আমাদের আর্য রক্তের অসম্মান করে এক অনার্য কন্যাকে বিবাহ করেছে“ বললেন উত্তরাবাদী(উকিল) ইন্দ্রায়ুধ।
অভিযুক্ত কে কোন উত্তরাবাদী প্রাপ্ত করার সুযোগ কি দেওয়া হয়েছে? বললেন যাজ্ঞ্যবল্ক।
“চন্দ্রদেব তা নিতে রাজি হয় নাই“
“ঠিক কি কারণে“ জানতে পারি কি?
“আমার আর মনুসংহিতা এর ন্যায় এর উপর বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস নেই না আছে বেদ ব্রাহ্মণে কোন ভক্তি।“
উপস্থিত সভা শিউরে উঠল তার কথা শুনে।
“কত বড় কথা বলছ সেটা জানো চন্দ্রদেব?“ যাজ্ঞ্যবল্ক বলে উঠলে।
“এতে তোমার প্রাণদণ্ড হতে পারে“ তোমার ন্যায় নাস্তিক এর সহিত থাকতে আমাদেরও ঘৃণা হচ্ছে চন্দ্রদেব“
“আর আপনাদের ন্যায় ঈশ্বরদ্রোহীদের সাথে থাকতে আমার“
“কি বললি, আমরা ঈশ্বরদ্রোহী?“
“অবশ্যই ঈশ্বরদ্রোহী“ ইশ্বর এর বাণীকে ব্রহ্ম এর শিক্ষাকে যারা শুধু নিজের জন্য ব্যবহার করে তাদেরকে আমি ইশ্বরদ্রোহী বলেই জানি।
“কি রূপে“ না হলে এই মুহূর্তে তোকে শুলে চড়ানো হবে।
“ঠিক আছে, তবে আমি বলছি“
“আমাদের বৈদিক যুগে উল্লেখ ছিল মানব সকলি সমান। যে আমি বলিবে সে পতিত। বলতে হবে আমরা।“
তাকে আপনারা কি বানিয়েছেন?
“অবশ্যই আজও আছে সকলেই সমান“
“তাই? তবে আসুন মনুসংহিতা, আপনাদের সর্বাপেক্ষা নতুন রচনার পাতা উল্টাই আমি“
দ্বিধা কৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ।
অর্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভু।।’
সেই প্রভু প্রজাপতি আপনার দেহকে দ্বিধা করে অর্ধেক অংশে পুরুষ ও অর্ধেক অংশে নারী সৃষ্টি করলেন এবং তারপর সেই নারীর গর্ভে বিরাটকে উৎপাদন করলেন।
মনু এর এই অংশমাঝেই নারী ও পুরুষ এর ঐক্য সীমিত।
এরপরেই দেখুন কি উল্লেখ আছে।
নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।’
স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা।
নারী যেখানে অর্ধ স্মৃতি এর মালিক, সেখানে নারীকে এই মন্ত্রপাঠ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। কিন্ত কেন? বেদে তো এটাই বলা রয়েছে যে আমরা সকলেই কর্ম দ্বারা সকল কিছুই করতে পারি।
সকল মানুষ শুদ্র রূপেই জন্ম নেন। কর্মেই ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠেন? তবে নারী কেন জন্মজাত শুদ্র? আজীবন শুদ্র? আবার ভোগ এর জন্য এই শুদ্রকেও বিবাহের পিড়িতে বসতেই হবে।
উৎকৃষ্টায়াভিরূপায় বরায় সদৃশায় চ।
অপ্রাপ্তামপি তাং তস্মৈ কন্যাং দদ্যাদ্ যথাবিধি।।’
উৎকৃষ্ট অভিরূপ এবং সজাতীয় বর পাওয়া গেলে কন্যা বিবাহের বয়স প্রাপ্ত না হলেও তাকে যথাবিধি সম্প্রদান করবে। (৯/৮৮)।
আর সেই কন্যার বিবাহের বয়স কি? অষ্ট গৌরি, নব রোহিণী দশ কুমারী?
যেখানে আমার স্ত্রী এর জাতে ষোড়শী এর কমে কন্যাদান করা হয় না। এই কারণে তারা অসুর? এমনকি এর থেকেও কম বয়সেও সাত বছর, তিনবছর বয়সেও কন্যাকে বিবাহ দেবার কথা আছে। আর এর ফলে সবথেকে বেশী যে লাশ পুড়াতো আর যজ্ঞ করতাম,তা ছিল অল্পবয়স্কা বধুদের, সন্তানজন্মদান করতে গিয়ে নিহত হতেন যারা।
এই কারণেই আমি শুধু, ইরাকে বিবাহই করি নাই, তাকে স্ত্রী এর মর্যাদা প্রদান করেছি।
এটা কি নতুন কিছু? আপনি ঋষি যাজ্ঞ্যবল্ক, আপনার এক শূদ্রাণী ভৈরবী আছে। যদি আমি ভুল না হই। তাহার সহিত তার রূপসুধা আপনি নিয়মিত উপভোগ করেন।
আপনারা সকলেই শূদ্রাণী, বৈশানীদের দ্বার গ্রহণ করেছেন, তবে তাদেরকে বধুর মর্যাদা প্রদান করেননি। আমি বধূর মর্যাদা দান করাতেই আজকে যদি আমাকে এখানে টেনে আনা হয় তাহলে আপনাদেরকে কি করা উচিত?
সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বজ্রাঘাত করা হয়েছে তাদেরকে ।
বলে গেল চন্দ্রদেব।
“কন্যার বিবাহে কন্যার মত নিতে হবে,এটা সর্বপ্রধান মত কিনা“?
অসুর, পিশাচ বিবাহ, এ সমস্ত তো আসলে শুধুমাত্র একটি শ্লোক ছিল, কিন্ত আজকাল প্রায় সকল ঋষি এই অসুর আর না হলে পৈশাচ বিবাহ করছেন, তারা কন্যাদের কে অচেতন করে, তাদের কে সম্ভোগ করছেন, এরপরে নিক্ষেপ করছেন তাদের কে সমাজ এর নিকট। নষ্টা ভ্রষ্টা নাম নিয়ে, আর তাদের সন্তানরা ক্ষেত্রজ বা কানীন হয়ে বেঁচে আছে।
তাদেরকে শাস্তি কেন দেওয়া হচ্ছে না।
“চন্দ্রদেব,পামর, তুই দণ্ডের যোগ্য না,তুই মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য“ এটা বলে তাকে চাবুক কশলেন প্রধান রক্ষীদের অধিনায়ক“
ব্রাহ্মণ দেবকে অপমান করছিস তুই।
ইতিমধ্যে রাজার আগমন ঘটল সেখানে, কোশল এর রাজা সেনজিৎ এসেছেন। ইনি কোশলরাজ সেনজিৎ।
“কি হয়েছে, কেন মারছ, ব্রহ্মহত্যার দায় নিজের উপরে চড়াতে চাইছ কেন“ তার অধিনায়ক কে বললেন তিনি। এত বড় সেনানায়ক সাধারণত নিজে থেকে দণ্ড দান করেন না।
“এ ব্রাহ্মণ নয়, এ এক পাষণ্ড, এ পতিত“ এ মনুসংহিতাকে অপমান করেছে মহারাজ।
“কিরূপ অপমান।“
তাকে সব শুনানো হল।
সবাই মনে করেছিল উনি ফেটে পড়বেন রাগে।
কিন্ত উনি কেন জানি নীরবতা পছন্দ করলেন।
“চন্দ্রদেবকে আমার কাছে আমার মহল এর কাল কুঠুরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক“
আমি নিজেই তার বিচার করব, পরেরদিন,আমি নিজেই শাস্ত্রজ্ঞ। সে কেন এরূপ কথা বলছে,তা জানা দরকার।
“তাকে আমার সহিত কথা বলতে অনুরোধ করছি আমি“
“তার স্ত্রী ইরাকেও ছেড়ে দেওয়া হোক“
মহারাজ এর আজ্ঞা বলে কথা। তাই করা হল।
“এবার তাদেরকে কাল কুঠুরি এর মাঝে নিয়ে যাও“
হাতে বেড়ি পরিয়ে তাদেরকে কাল কুঠুরি এর মাঝে নিয়ে যাওয়া হল।
রাজা নিজের সভা এর দিকে প্রস্থান করলেন। চন্দ্রদেব কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কেনই বা রাজা তাকে দন্ডিত করলেন না।
সে তার স্ত্রী ইরাকে বলল, “আমার জন্যই তোমাকে এই পরিস্থিতি এর মধ্যে পড়তে হল, তোমরা অসুররা অনেক সুখী নিজের ভুবন এ“
ইরা নিজের কৃষ্ণ হরিণী এর ন্যায় চোখ দুটি থেকে দু-ফোঁটা অশ্রু ফেলে বলল “নিজ পুরুষ এর সাথে, নরকবাসও স্বর্গতুল্য, আমায় এরকম কথা আর বলবেন না“
তাদের মাঝে আর কোন কথা হল না।
তাদেরকে যে কুঠুরিতে ঢুকানো হল, সেটার ভেতর আরও একজন কৃষ্ণবর্ণের অসুর গোত্রের পুরুষ বন্দি।
এমনিতে অসুররা বিশালদেহী হলেও, তাকে দেখে মনে হয় না সে অসুর, অনেকটা শীর্ণ দেহ।
“তোমার নাম কি যুবক“ চন্দ্রদেব জিজ্ঞেস করল।
“আমার নাম, বাণরাজ“
“বাণরাজ!তুমি তবে শিকারি!“
“হ্যাঁ ভদ্রে, আমি শিকারি, আপনি তো আর্য,ব্রাহ্মণ, তবে এই কুঠুরি এর মাঝে কেন আপনি?“
“আমার জন্য“ ইরা বলল।
“আপনাকে দেখে আমার ভগিনী, আমার বোন এর কথা মনে পড়ছে আমার“
“কিন্ত, ব্রাহ্মণ কেন অসুরকে বিবাহ করলেন? অসুরকে তো তারা ভোগের বস্ত ছাড়া আর কিছু মনে করেন না“।
চন্দ্রদেব বলল “আমি আমার নিত্যদিন এর কার্য শেষ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম, অন্য এক নগরে গিয়েছিলাম আমি, পথে ছিলাম আমি আর আমার তিনজন ঘোড়সওয়ার। পথ চলতে চলতে রাত হয়ে যায়, এই কারণে আমরা পথের পাশের এক ধর্মশালাতে বিশ্রাম গ্রহণ করার কথা চিন্তা করি। বিশ্রাম তো করব,কিন্ত সেটি যে আসলে ছিল দস্যুদের আস্তানা, তা যদি জানতাম। আমরা ঘুমিয়ে পড়ার পরে তারা আক্রমণ করে বসে,আমাদের দুই সঙ্গী এর গলাকাটা লাশ রেখে আমাকে পালাতে হয়। পথের মাঝখানে আমি আবারও আক্রান্ত হই, আমার ঘোড়াসহ। তবে কারো ছুড়ে দেওয়া তীর এর কারণে তাদের মাঝে দুইজন মারা পড়ে। আমি ব্রাহ্মণ, আমি অস্ত্রধারী ছিলাম না। আমার নিজের জাতি সেদিন রাক্ষস এর রূপ ধারণ করেছিল। আমাকে রক্ষা করেছিল একজন মুখ ঢেকে রাখা ব্যক্তি। সেই হচ্ছে ইরা, আমার পাশে থাকা এই রমণী। আমি জানতাম না, আমাদের আর্য রমণীরা আসলে এমন ছিল শুধু বৈদিক যুগে, বধ্রিমতি,ঊষা এ সমস্ত নারীদেরকে আমি শুধু বইতেই পড়েছি। এই কারণে এই ইরাকে লাগছিল আমার কাছে আমার সেই পুরনো দেবীদের মত। এই কারণে তার প্রেমে পড়ি আমি, আমার ন্যায় ব্রাহ্মণ এর নিকট হয়ত এটা বালখিল্যতা,তবে আমি সবেমাত্র দীক্ষা সমাপ্ত করেছিলাম। গৃহী জীবনে আমার প্রবেশ এর সময় ছিল তখন। ইরা এর সাথে তার গ্রামে যাই। সেখান থেকে ওকে দেখি,ওর সমাজ দেখি, প্রথমে আমি তাদের কে ঘৃণা করলেও, এখন আর ঘৃণা করিনা। তারা আমাদের অপেক্ষা শ্রেয়। আমাদের ন্যায় কাউকে শুদ্র মানে না। কেউ চণ্ডাল না। আর ইরা এর প্রতি প্রেমও গভীর হয়। সে থেকেই বিবাহ করি আমি।
“আপনার কথা শুনেছি, আমাকে বলেছিল এক অসুর ব্রাহ্মণ আসবে আমার সাথে “
কতদিন আগে? প্রায় দুই দিন।
“আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সাত দিন হল“ দুই দিন আগে সেনজিৎ এর রাজধানীতে এটা কি করে জানতে পারলো?“
“মূলত আপনার স্ত্রী এর জন্য, অনেক গুলো কথা বললেও, আপনি একটি কথা বলেন নি, আপনার স্ত্রী কৃষ্ণা হলেও অনিন্দ্য সুন্দরী।“
“সেনজিত ব্রাহ্মণ, তিনি আপনার স্ত্রীকে তার রক্ষিতা করতে চান, এই কারণেই তিনি এটা করেননি, আমার সমগ্র পরিবার এই ভাবেই শেষ হয়েছে।“
হয় কৃতদাস, নয়ত রক্ষিতা, এই এখন আমাদের জীবন।
“এর কি কোন, কোন প্রতিবিধান নেই?“
“আছে, কিন্ত সে পথ আপনি নিবেন না। জন্মান্তর এর ফাঁদে পড়া শুদ্ররাও এই পথ নিবে না“
মানে কোন পথ?
আছে বরেন্দ্র, আছে করতোয়া, বঙ্গ আছে কলিঙ্গ আছে।
সাথে সাথে চন্দ্রদেব এর মনে পড়ল। যে সে বৌদ্ধায়ন সুত্রে পড়েছে কয়েকদিন আগে। সে বুঝে গেল সে পারবে না। কেননা সেখানে লেখা আছে।
অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্র মগধেষু চ।
তীর্থ যাত্রাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সংস্কার মহতি
আমাদের কে এখান থেকে পালিয়ে অঙ্গ,বঙ্গ,কলিঙ্গ এর মাঝে চলে যেতে হবে।
“কিন্ত তা নরকভূমি“, চু চু শব্দে তারা কুকুর লেলিয়ে দেয়, তারা মানুষ নয় মাংসাশী পক্ষীবিশেষ। সেখানে গেলে রৌরব নরকে পড়তে হবে, অঙ্গ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
“আপনি কুরু বা পাঞ্চালে নিজের এই অচ্ছুৎ স্ত্রীকে নিয়ে যেতে পারবেন“?
সেটা অবশ্যই সম্ভব নয়, কিন্ত অচ্ছুৎ কেও তো ব্রাহ্মণ বানানো যায়।
“আচ্ছা, আপনি যেখানে দণ্ডায়মান, সেখানে কি কোন ভাবেই বলা যায় যে তা আর্য ভূমি?“
আজ থেকে একশ বছর আগেও যে আর্য ছিল সেটার কোন সত্যতা ছিল?
“অনেকটাই বিস্তৃত হলাম, তোমার কথা শুনে“ এত জানো কি করে তুমি ?
“আমিও আপনাদের ন্যায় অসুর দের পুরোহিত, আপনাদের সংস্কৃত পড়তে জানি“
“আমি চার্বাক, আমি লোকায়ত“
শিউরে উঠল, “চন্দ্রদেব, তবে কি আমি যা জানতাম, সবই ভুল?“
“আমি জানতাম তোমরা পরনারীসক্ত“ লাম্পট্যকে মনে কর ধর্ম।
“তন্ত্র,নারী, নারীর পূজন, আর লাম্পট্য দুইটি ভিন্ন কথা“
আমরা আপনাদের ন্যায় শুধু অলীক আদর্শ কে মান্য করি না। আমরা সকল দিকেই যাই, আমরা পেট ভরে মাংস ভক্ষণ করাকে ধর্ম মনে করি।
“আর প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণ করাও“
“ব্রাহ্মণ অস্ত্র ধারণ করে না“
“নিজ স্ত্রী কে সম্ভোগ এর বস্ত হতে দেখলে পারে, কি করে ব্রাহ্মণত্ব থাকবে আপনার?“
নিস্ফল রাগ ফুটে উঠল তার চোখে।
“কিন্ত কি করে রেহাই পাবো এর থেকে“
‘এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, তবে হয়ত কোন না কোন রাস্তা প্রাপ্ত হব আমরা“
“এর জন্য হয়ত আমাদের কে নিজের থেকে আরও বেশী পতিত হতে হবে“
তবে আমাদেরকে বারেন্দ্রীতে পৌছাতে হবে, সেখানে পৌঁছালে সেখানের রাজা নরাসুর আপনাদেরকে নিরাপত্তা দেবেন সেটা বলতে পারি“
“কি করতে চাও?“
“প্রহরীদের মাঝে একজন থাকে, যখন সন্ধ্যাকাল হয়ে যায়“
‘আর্য পুরুষ গণ আমাদের ন্যায়, স্বাধীন ভাবে প্রকৃতি এর সাথে বড় হয়না,তাই তারা নারীকে লালসা ছাড়া আর কিছুর মাধ্যম ধরতে পারে না“
“আপনার স্ত্রীকে দিয়ে আমরা এই কারাগার এর দ্বারকে খুলে দিতে পারি, এতকাল আমি একা থাকার কারণে এটা পারিনি“
“ঠিক কি করে“
“আপনার স্ত্রী এর সামান্য ভ্রূকুটি যে কোন আর্য পুরুষকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। “
“এই শ্যামা সুন্দরীকে দেখে, তারা কখনই স্থির থাকতে পারবে না, যদি সে হাসে, তাদেরকে ইশারা করে“
“কিন্ত নীতি যদি বাদও দেই, প্রহরীরা ভাববেই যে এটা চাল“
“সেটা ভাবতে পারে, তবে আমরা সেই সময়ে নিদ্রার ভান করব“
সে যখন তাকে বের করে নিতে চাইবে, আপনার স্ত্রী তাকে আঘাত করবে, সে যোদ্ধা, তার মাঝে আগে থেকেই জ্ঞান আছে লড়াই নিয়ে।
“আর্যরা কেও সন্দেহ করবে না, যে আপনার স্ত্রী সেই“
এই বলে শেষ হল তাদের কথা, তারা কথা বলছিল অসুর ভাষাতে, এই কারণে, তাদের সামনে থাকা রক্ষী কিছুই বুঝতে পারল না।
সকাল গড়িয়ে বিকেল হল, এরপরে আসল সন্ধ্যা, তাদেরকে জল পান করতে দেওয়া হয়নি। এই কারণে তাদের মাঝে ঝিমানি এমনিতেই ছিল। এরপরে দুইজনেই, মেঝেতে বিছিয়ে শুয়ে পড়ল।
তখন নতুন রক্ষী এসেছে, শুধুমাত্র একজন।
তাকে দেখে, তার স্ত্রী ইরা উঠে দাঁড়াল, তার চুলকে বন্ধনমুক্ত করল সে।
এরপরে তার বল্কল(বাকলের পোশাক) পরিহিত দেহমঞ্জরী নিয়ে সে আনিত হল কারাগার এর শিকের উপর।
কারাগার এর রক্ষী, জানে না, এই কন্যা কয়েকদিন পর রাজার রক্ষিতা হতে যাচ্ছে।
সে তার ভুবন ভোলানো রূপ দেখে অনেকক্ষণ চোখ ফিরাতে পারল না।
“কি দেখছ, ইরা চোখে ঢেউ তুলে বলল“
ঢোক গিলল প্রহরী
“তোমার স্বামী তো পাশে ঘুমাচ্ছে, এরূপ করছ কেন “
“আরে বাদ দাও স্বামী, অনার্য কন্যাদের কোন স্বামী থাকে না, আমি আর্য আসক্ত, আর্য পুরুষ দেখলে আমরা রক্তে বান ডাকে “
দেরী কর না, প্রিয়ে, এদিকে এসো, আমি তোমার, যতক্ষন এই কুঠুরি এর বাইরে নিয়ে আসবে।
প্রহরী এর পক্ষে এরকম আহ্বানকে রোধ করা সম্ভব ছিল না। সে দ্রুত হাতে তালা খুলে ফেলল।
“যা করার এর মাঝেই করি, ঐ দুইটা আর কি করতে পারবে?“
“আর কিছু করতে চেষ্টা করলে পারে, আমি একাই যথেষ্ট“
“হ্যাঁ যেমন তোর জন্য আমি একাই যথেষ্ট“, বলে উঠল ইরা এরপরে কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রহরীকে পিছন থেকে জাপটে ধরল চন্দ্রদেব আর বাণরাজা।
ইরা মেঝে থেকে একটা বড় পাথর তুলে নিয়ে আঘাত করল প্রহরী এর মাথাতে, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সে।
“লম্পট, কোন দিন প্রেম কি জিনিস জানতে পারবি না“ বলল ইরা।
তিনজনেই বেরিয়ে আসল, এর মাঝেই চন্দ্র দেব প্রহরি এর পোশাক পরে নিয়েছে, তারা ভীষণ সতর্ক যদিও।
“পাশ দিয়ে প্রহরীদের যাতায়াত করার একটা ছোট রাস্তা আছে“ আমাকে সেখান দিয়েই আনা হয়েছিল, আমি অচ্ছুত, এই কারণে।
তবে সেখান দিয়েই চল।
“ইরা তুমি তোমার ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে নাও“
এই সময়ে প্রহরী বেশী নেই,কিন্ত আসলে আর কোন রাস্তা নেই, লড়তে হবে।
“চল তিনজনেই“ ছুটতে শুরু করল সবাই। সামনের দিকের রাস্তাটা পার হতে হবে। সামনে কেউ থাকলে চলবে না। এটা প্রহরীদের আহার এর সময়। এই কারণে অনেকেই ব্যস্ত। কিন্ত কোন না কোন ভাবে এদের মাঝে কেউ চলে আসতে পারে।
সামনে একটা কুলুঙ্গি এর মত ছোট দরজা দেখা যাচ্ছে, এটা দিয়ে সম্ভবত বাণরাজা এর মত অচ্ছুতদেরকে আনা হয়।
তারা যখন প্রায় চলে এসেছে, তখনই যেন ভিমরুল এর চাক এ ঢিল ছুড়া এর মত করে সবাই জেগে উঠল, প্রহরীদের পদশব্দ শোনা যেতে শুরু করল।
তারা তিনজনেই ছুটে পালাতে শুরু করল। আরও গতি বাড়িয়ে দিল পায়ের।
কিন্ত শেষরক্ষা সম্ভবত হল না। কেননা সামনে থেকে দুইজন রক্ষী এসে গেছে, তাদের হাতে বর্শা।
আপনারা যান, আমি দেখছি বাণরাজা বলল। তার কাছে রক্ষী এর তীর আর ধনুক আছে, নিপুণ হাতে ধনুকে তীর পরাল সে। সামনা সামনি আসছে দুইজন, একই সরল রেখাতে। এরপরে এক আঘাতেই তাদের দুইজন এর প্রথমজনকে ফেলে দিল সে। এরপরে আরও একজন আসছিল।
বল্লম হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল চন্দ্রদেব। অতর্কিত হামলা এর শিকার হয়ে সে ভড়কে গেল। ইরা এসে নিপুণ হাতে একটা রদ্দা মারল তাকে।
দুইজনকে ফেলে রেখে তিনজনেই বেরিয়ে এল।
সামনেই, পড়েছে নদী, অজয়।
এই অজয়কে ধরে এগুতে হবে করতোয়া এর দিকে, রাতে চলতে হবে, আর দিনে লুকিয়ে থাকতে হবে।
এছাড়া আর উপায় নেই। একটা নৌকাকে খুলে নিল তারা, এরপরে সেটা ভাসিয়ে দিল।
সবাই ভাববে তারা ঐ নৌকাতে চড়ে পালিয়েছে, তবে তারা, সেটা করবে না।
তারা চলল, নদীর পারের ঝোপ এর দিকে।
সেখান থেকে নদী যেখানে চিকন হয়ে গেছে, সেখানে সাঁতরে উঠবে তারা। এরপরে সেই ধার এর গ্রাম আছে অনার্যদের,তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে সাধন। যেটা দিয়ে তারা অজয় পাড়ি দেবে।
এটাই করল তারা। এই গ্রাম বাণরাজা এর, যদিও তা ধুঁকছে এখন, এরপরেও কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।
তারা যখন গিয়ে নামল অজয় এর জলে, তখন মনে হতে শুরু করল যেন প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে সুচ ঢুকছে তাদের।
তবে হাল ছাড়ল না।
তবে অজয় এর স্রোত প্রবল।
তাদেরকে একে অপর এর কাছ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল সেটা। তারা একেবারেই অসহায় হয়ে চেয়ে রইল যেন। ক্রমে ক্রমে স্রোত তাদেরকে নিয়ে খেলছে, একবার উপরে উঠাচ্ছে একবারে নামাচ্ছে। তাদের হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। এরপরে সেই হাত পা দিয়ে আর সাঁতার কাটা যায় না।
গল গল করে নাক মুখ দিয়ে জল ঢুকছে। এখন মনে হচ্ছে যেন গরম আগুন যাচ্ছে ভিতরে তাদের । ঠেলে ঢুকছে জল ভেতরে । এরপরে অন্ধকার আর অন্ধকার।
সহসা চন্দ্র দেব এর চোখ খুলে গেল । একটা বড় নৌকা এর কোষে তিনি শুয়ে আছেন , একটা কালো মুখ তার উপরে ঝুঁকে আছে।
উঠতে গিয়ে উঠতে পারলেন না। গল গল করে জল বেরিয়ে এল।
“আ আমি কোথায়?“ বলতে গিয়েও যেন বলতে পারলেন না । অস্ফুট আওয়াজ বের হল মুখ দিয়ে ।
“আপনি আপনার ভ্রাতা আর আপনার পত্নী, সকলেই ভালো আছে। আমরা বারেন্দ্রী,বাগদী আপনাকে ছুঁতে মানা সচেতনে এই কারণে না ছুঁয়েই যা পারি সেবা করব এখন, যদিও অচেতন কালে ছুয়েছি। ঘাট হলে ক্ষমা করবেন“।
“আরে রাখুন“ সহসা যেন তার মাঝে একটা শক্তি এর বিকাশ ঘটে গেল, চন্দ্রদেব উঠে বসলেন। “আমার তুলনায় আপনি দেবতা। আপনার কর্ম আমার থেকে অনেক অনেক গুণে ভালো। সারাজীবন বর্ণাশ্রম এর কারণে যাদেরকে ছোট করেছি দেখি তাদের মাঝেই দেব । আর যাদেরকে বড় মেনেছি তারাই অসুর।“
আজ আমি আপনাকে ছুয়ে পুণ্যি পেতে চাই। বলে তার পায়ে হাত দিতে গেলেন চন্দ্র দেব। তাকে রুখে দিলেন তাকে,তার হাতে হাত ধরলেন সুশুমা।
“আজ থেকে আমার এই পতিত হওয়া গৌরব এর“ আমি আজ থেকে মানুষ। এটাই আমি বুঝতে পারছি, এতদিন কীট ছিলাম।
“আমি আপনাদের বরেন্দ্রতে যেতে চাই, আমাকে আমার স্ত্রী আর ভাই বাণরাজা এর সাথে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হোক।“
এরপরের ঘাটেই একত্রিত হলেন তারা তিনজন।
চন্দ্রদেব এরপরে এক নৌকাতে যাত্রা করলেন ওদের সাথে। তাদের হাতে খান, তাদের জন্য রান্না করেন। সেই কলুষকে অনেক দূরে ফেলে এসেছেন তিনি।
রাজা নরাসুর তাকে সসম্মানে ঠাই দেন নিজের সভাতে, আর তার জন্য বানিয়ে দেন শিবগৃহ। কেননা এই শিবকে পূজা করতে ইচ্ছুক নয় আর্যরা, তিনি শিব আর শক্তি এর মতের ব্রাহ্মণ হবেন। তার শক্তি হবে ইরা। তার বউ তার স্ত্রী।
চন্দ্রদেব এর মাধ্যমে সেইদিন বরেন্দ্রতে ব্রাহ্মণ দের এক নতুন ধারা এর উৎপত্তি ঘটে বারেন্দ্রী ব্রাহ্মণ নামে। এরা বর্ণপ্রথা মানতেন না। শক্তিপূজা করতেন। জীবন ধারণ করতেন তীর্থাঙ্করদের ন্যায়। বাণরাজা হলেন ব্যাধরাজ, তীর্থাঙ্কর। আর চন্দ্রদেব এর নাম হল চন্দ্র বারেন্দ্রী মহারাজ।
আরও অনেক পতিত যুবক ব্রাহ্মণদেরকে তারা শিক্ষা দিলেন উদার ব্রাহ্মণ বারেন্দ্রী মতবাদ। কর্ম মোক্ষ, নারী মোক্ষ,নারী মাতৃ। এরূপ ধ্বনিতে ধ্বনিত হল সমগ্র বরেন্দ্র। যার ফসল হল সাংখ্য।
আজও এই সকল না বলা নায়কদের বাণীতে ইতিহাস ধ্বনিত হয়ে চলেছে। যারা কনৌজ আর কোশল এর সামনে কখনই মাথা নোয়ান নি।