পলাশের পলাশ সফর
পলাশ মুখোপাধ্যায়
##
ভুল শুনলাম নাকি! কংক্রিটের জঙ্গলে এমন মধুর কুহু ডাকটা কানে আসতেই থমকে গেল হাতের কাজ। তবে তো বসন্ত এসেই গেছে। কলকাতার এই তিন কামরার ফ্ল্যাটে থেকে ঋতুগুলিকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। বসন্তের কথা মাথায় আসতেই মনে এল পলাশের কথা। এ তো পলাশেরও সময়। এক লহমায় চলে গেলাম বছর কুড়ি আগে, চাকরি জীবনের প্রথম দিকে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা বীরভূম, রাঢ় বাংলার এই জেলাগুলিতে সেই সময় আমার কয়েকটা বছর কেটেছিল। এই সময় সেখানে তো পলাশের পরিপাটি সংসার। মনের ক্যানভাসে ফুটে উঠল সেই রক্তিম সৌন্দর্যের একের পর এক ছবি। একটু নস্টালজিক হতেই বিদ্রোহ করে বসল মন। নাহ্ আর নয়, এই বসন্তেই যেতে হবে পলাশের খোঁজে, পলাশের কাছে, পলাশের সাম্রাজ্যে।
এমনিতে গোটা রাঢ় বাংলা জুড়েই কম বেশি পলাশের বিস্তার থাকলেও, পলাশের সব চেয়ে বেশি বাড়বাড়ন্ত বাঁকুড়া–পুরুলিয়ার উত্তর অংশে। এই এলাকার বিহারীনাথ, শুশুনিয়া, বড়ন্তি, গড় পঞ্চকোট, জয়চণ্ডী পাহাড় প্রভৃতি পর্যটন এলাকাগুলি পলাশ দেখার টানে ভরে ওঠে এই সময়ে। আমি কিন্তু ঠিক করে নিয়েছিলাম এই ভিড়ভাট্টার মধ্যে পলাশ দেখতে যাব না, তাই আমার গন্তব্য হল বান্দা।
এই পলাশ সফরের কথা শুনে চটপট জুটে গেল কয়েকজন সফরসঙ্গীও। এক বসন্তের সকালে আমরা একটি গাড়ি নিয়ে জনা আটেক পলাশপ্রেমী রওনা দিলাম আগুন সম ফাগুন শোভার সন্ধানে। প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম গড় পঞ্চকোট বা বড়ন্তিতে আমরা থাকব না। এগুলি সুন্দর জায়গা এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু প্রচুর মানুষ সেখানে আগে থাকতেই ভিড় বাড়িয়েছেন সেটা ফেসবুক খুললেই টের পাচ্ছিলাম। তাই আমরা প্রথমে গেলাম বিহারীনাথ পাহাড়ে। স্বাভাবিক সবুজ ভরা নির্জনতায় বিহারীনাথের জবাব নেই।
বিহারীনাথ বাঁকুড়া জেলার উচ্চতম পাহাড়, উচ্চতা ৪৫১ মিটার (১৪৮০ ফুট)। এই অঞ্চলটি জেলার অন্যতম গভীর বনাঞ্চলও বটে। ০.৫০ হেক্টর আয়তনের একটি ছোট জলাধারকে কেন্দ্র করে এই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিহারীনাথের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ের কোলে প্রাচীন শিবমন্দির, যেখানে শিবরাত্রি উপলক্ষে মেলাও বসে আর ভক্তসমাগমও হয়। বিহারীনাথ ধাম নামেই এই মন্দির প্রসিদ্ধ। মন্দির সংলগ্ন পুকুরটিও স্থানীয় মানুষজনের কাছে অত্যন্ত পবিত্র বলেই বিবেচিত হয়।
বিহারীনাথ পাহাড়ে ট্রেকিং করবারও ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠবার জন্য দিক নির্দেশ করে দিয়েছে বনদফতর, ফলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। পাহাড়ের ওপাশে রয়েছে একটি ছোট্ট ঝরনা। অবশ্য সেটিকে ঝরনা না বলে জলধারা বলাই সমীচীন। সেই জলধারার পাশেই থাকেন পাহাড়িবাবা। আলাপ হল তাঁর সঙ্গেও। আমাদের দলে নানান বয়সের সদস্যরা ছিলেন। তাই ধীরে সুস্থে সকলে এক সময় পাহাড়িবাবার কুটিরে এসে পৌঁছতেই জল বাতাসা দিয়ে সকলকে স্বাগত জানালেন তিনি। কথায় কথায় জানা গেল তিনি আমাদের দমদম এলাকার মানুষ। সেখান থেকে নামতে নামতেই কমে এল আলো। সন্ধে বেলায় বসা হল পাহাড়ের কোলে একটি জায়গায়। সে বড় মনোরম এলাকা, চার দিকে ছোট বড় নানা পাহাড়, মাঝে সুন্দর উপত্যকার মত জায়গাটি। সঙ্গী হল ঘরে ফেরা পাখির কলকাকলি। সন্ধে হতেই সব চুপচাপ, নির্জনতার না শোনা শব্দটুকুও চেটেপুটে উপভোগ করতে লাগল সকলেই। রাত্রিবাস বিহারীনাথেই।
বিহারীনাথ চত্বরে গ্রাম নেই কোনও, কাছাকাছি গ্রাম কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে। বন দফতরের একটি বাংলো বাদ দিয়ে এখানে হোটেলও মাত্র দুটি। তাই খুব বেশি জনসমাগমের সুযোগই নেই। রাতে পিচ ঢালা পথ ধরে হেঁটে যাওয়া যায় বহুদূর পর্যন্ত, সাক্ষী থাকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এবং দূরে বার্নপুর শহরের থেকে আসা আলোর আভা। পরদিন সকালে আমাদের গন্তব্য বান্দা। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে বান্দা গ্রামটি পলাশ দেখার জন্য একটি অসাধারণ জায়গা। গ্রাম পেরতেই একটি নির্জন প্রান্তর, কয়েক হাজার পলাশ গাছের বন, তার মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে একটি দেউল।
এমনিতে বান্দায় আমি আগে গিয়েছি। আমার সেই তখন থেকেই সাধ ছিল পলাশের সময় এই এলাকা কেমন হয় তা দেখার। এবার সেই সাধ পূরণের পালা। বিহারীনাথ থেকে ইতুড়ি মোড় হয়ে হাসডিমার মোড়, সেখান থেকে ডাইনে বেঁকে সোজা রঘুনাথপুরে থানার মোড়। বরাকর – পুরুলিয়া রোড পার করে পাড়ার দিকে এগোলে মিনিট পনেরো পরেই আসবে বান্দার মোড়। এবার ডাইনে গিয়ে গ্রাম পেরলেই গন্তব্য। বিহারীনাথ এলাকাতেও প্রচুর পলাশ গাছ, কিন্তু একটা বিষয় দেখছিলাম সব গাছেই এবার ফুল ফোটেনি। তাই বান্দায় কি দেখব তা নিয়ে একটু টেনশনেই ছিলাম। গ্রাম ছাড়িয়ে আমাদের গাড়িটা ডান দিকে ঘুরতেই আটকে গেল চোখের পাতা। একটা চরম ভাললাগা এবং তৃপ্তিতে বুকের ভিতরে যেন নিঃশ্বাসটা আটকে রইল কিছুক্ষণ। কয়েক হাজার পলাশ গাছ, সবকটিতেই শুধু ফুল। চারিদিকে যেন আগুন লেগেছে। গাড়ি থেকে নেমে কোন দিকে যাব তা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছিলাম না। অন্যদেরও একই অবস্থা, কেউ গাছে উঠছে, কেউ ফুল কুড়োচ্ছে, কেউ ছবির পর ছবি তুলছে, ঠিক যেন আত্মহারা পাগলপারা। জনহীন প্রান্তরে এই অগ্নিভ শোভার মাঝে দাঁড়িয়ে দেউল বা জৈন মন্দিরটি। প্রথমে পা বাড়ালাম সে দিকেই।
১৪ফুট X ১৪ ফুট X ৭২ ফুট আয়তনের বর্গক্ষেত্রাকার রেখদেউল এটি। দেউলের নিম্নতলের চত্বর আনুমানিক দেড়শ ফুট চওড়া ও আড়াইশো ফুট লম্বা। চত্বরের পূর্ব দিকে পাথর দিয়ে বাঁধানো সিঁড়ি ও উত্তরদিকে পাথরের স্তম্ভ হেলানো অবস্থায় রয়েছে। দেউলের সামনের দিকে আঙ্গিনায় আনুমানিক কুড়ি ফুটের একটি মন্ডপ রয়েছে, যার সামনের দিকে পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। দেউলের পশ্চিম প্রান্তে আনুমানিক চার ফুট চওড়া আঙ্গিনার প্রবেশ পথ রয়েছে। উত্তরদিকে মূল দেউলের প্রবেশ পথ। দেউলের পূর্ব দেওয়ালে পশ্চিমদিকে মুখ করে আনুমানিক দেড় ফুট উচ্চতার একটি পূর্ণাঙ্গ মকর মূর্তি এবং উপরের দিকে লতা, পাতা, ফুল ও একটি পাখির চিত্র বর্তমান। মন্দিরের চূড়ায় একটি শতদল পদ্মের ভাস্কর্য দেখা যায়।
দেউলের পাশেই পলাশ বনের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ। ফিঙে, দোয়েল, টিয়াকে সঙ্গী করে আনমনে হাঁটা দিলাম সে পথে। রাঙা আবহে সেই মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল যেন সত্যিই হারিয়ে যাই এখানে, যাতে আর ফিরতে না হয়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখলাম সামনে একটি ছোট্ট নদী, তাকে আটকে রয়েছে একটি চেক ড্যাম। সুন্দর পরিবেশে সেখানে রয়েছে একটি ছোট্ট জলাধার। পাথুরে পরিবেশ, কিন্তু এখানেও পিছু ছাড়েনি পলাশ। আশপাশে যতদূর চোখ যায় শুধুই রক্তিমাভা। আমাদের সফরসঙ্গীদের মধ্যে ১৪ বছরের কিশোরী থেকে ৬৪ বছরের বৃদ্ধ কারোরই দেখলাম ফিরে যেতে খুব একটা ইচ্ছে নেই। পলাশের আবহে ওই মন্দির প্রাঙ্গণে বসেই কেটে গেল কয়েক ঘন্টা। কিন্তু এবার ফেরার পালা। কলকাতায় ফিরতে হবে। তাই বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়তেই হল। গাড়ি থেকে যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় পলক না ফেলে শুধু পলাশের শোভা দেখে গেলাম সকলেই। মোড় ঘুরতেই উধাও পলাশ, চোখে অন্য দৃশ্যপট, কিন্তু মনে? তখনও সেই অগ্নিভ সৌন্দর্যের অনুরণন।
টুকিটাকিঃ
কলকাতা থেকে শুধু বান্দা যেতে হলে দু রকম ভাবে যাওয়া যায়। ট্রেনে আদ্রা হয়ে রঘুনাথপুর, সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে। অথবা ট্রেনে আসানসোল, সেখান থেকে আদ্রা শাখায় জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশনে নেমে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। রঘুনাথপুর থেকে পাড়া যাওয়ার বাস বা ট্রেকার বান্দা মোড় হয়ে যায়। যারা সরাসরি গাড়িতে যাবেন তারা আসানসোল হয়ে ডিশেরগড় ব্রিজ পেরিয়ে রঘুনাথপুর যেতে পারেন। বান্দায় থাকার কোন জায়গা নেই, খাওয়ার হোটেলও তেমন নেই। তাই রঘুনাথপুরে থাকার বিভিন্ন মানের হোটেল পেয়ে যাবেন, খাওয়াও রঘুনাথপুরেই সেরে নেওয়া ভাল।