পিছুটানে ( তৃতীয় পর্ব )
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
আগের দিন পরিশ্রমের পর ক্লান্তি থাকলেও পরদিন বেশ ভোরেই ভেঙে গেল ঘুম। ভয়ে ভয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম বলে কিনা কে জানে? যশিপুরের সেই ধাবার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েই জুড়িয়ে গেল চোখ। আগের দিন রাত ছিল তাই বুঝতে পারিনি অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে আমাদের রাত্রিবাসের এই জায়গাটি। দুদিকে সুউচ্চ সবুজ পাহাড়, মাঝে এই ধাবা, একদিকে রাস্তা, আর এক দিকে পাহাড়ের খাঁদ বেয়ে নেমে গেছে সবুজের ঢাল বহুদূর পর্যন্ত। ভোরে পাখির কুজনের আবহে সেই সবুজ পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হল যেন সুখের স্বর্গে আছি। আমাদের দলের বাকি সদস্যরাও একে একে উঠে পড়েছে। তৈরি হয়ে এবার বেরোবার পালা। আমাদের গাড়ি দুটি রয়েছে থানায়। তাই সকলে জলখাবার খেয়ে যশিপুর থানায় যাওয়া হল। বড়বাবুকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ফের যাত্রা শুরু আমাদের।
যশিপুর শহর ছাড়তেই ফের শুরু হয়ে গেল পাহাড়ি পথ। পাকদণ্ডি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠছে আমাদের গাড়ি। আগের দিন পাহাড়ি পথে সুনীতের একটু অস্বস্তি থাকলেও, আজ বৃষ্টিও নেই, পাশাপাশি দিনের বেলা, তাই বেশ স্বচ্ছন্দেই গাড়ি ছোটাচ্ছে সুনীত। তবে রাস্তা বেশ বিপদ সঙ্কুল। কারন একদিকে খাঁড়া পাহাড়, অন্যদিকে সুগভীর খাঁদ। একটু অন্যমনস্ক বা বেচাল হলেই কিন্তু বিপদের চুম্বন। চোখেও পড়ল রাস্তার ধারে তেমন বিপদের দু’একটা নমুনাও।
ব্যাকগিয়ারে ভালই যাচ্ছিল সুনীত, কিন্তু অসুবিধে হচ্ছিল বাঁকগুলিতে এসে। কারন উল্টো দিক থেকে আসা অন্য গাড়িগুলি বাঁক নিয়েই সুনীতের ব্যাকগিয়ারে যাওয়া দেখে থমকে যাচ্ছিল। অবাক হয়ে কেউ কেউ তো ব্রেক কষে দাঁড়িয়েই যাচ্ছিলেন। যাই হোক যশিপুর এবং সুন্দরগড়ের মাঝে এই রাস্তাটির প্রাকৃতিক শোভা কিন্তু বড়ই চমৎকার।
প্রকৃতি প্রেমিক আমি, আমার সঙ্গে থেকে কিছুটা অন্যরাও। তাই পাহাড়ের মাঝে থামানো হল গাড়ি। বিশ্রামের অছিলায় চেটেপুটে উপভোগ করা হল সেই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চারিদিকে সবুজ পাহাড়ের রাশি, মাঝে মধ্যেই ভেসে আসছে নাম না জানা বিভিন পাখির ডাক। এত সুন্দরের মাঝে থেকে ভুলেই গিয়েছিলাম যশিপুরের বড়বাবুর সতর্ক বার্তা। বেরোবার সময় পই পই করে বলে দিয়েছিলেন “আপনাদের গাড়ির মাথায় কমলা বাতি আছে। এটা মারাত্মক রকমের বিপদের আহ্বায়ক। যাত্রাপথের প্রায় গোটাটাই মাও অধ্যুসিত এলাকা। মাওবাদীরা কমলাবাতিকে লাল বাতি ভেবে যে কোনও সময়েই আক্রমণ করতেই পারে। নির্জনে দাঁড়াবেন না।” বড়বাবুর সামনে তখন সুবোধ বালকের মত মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিলেও পরে এই প্রকৃতির রূপে সে সতর্কবাণী ভুলে মেরে দিয়েছি। রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরে বসে রীতিমত হইচই শুরু করে দিয়েছি আমরা, এমন সময় এক লরি চালকের ইশারায় সম্বিৎ ফিরল। মন খারাপও হল এত সুন্দর জায়গা এত আতঙ্কময় যে ভাল করে এর সৌন্দর্য উপভোগ করাও মুশকিল।
যাই হোক, ফের সিরিয়াস সকলে, লক্ষ্য এখনও বহুদূর। শুরু হল যাত্রা। আমাদের দুটি গাড়িই এগিয়ে চলেছে ষাট থেকে সত্তর কিমি গড় বেগে। জনপদ এলে অবশ্য গতি সামান্য কমাতে হচ্ছে সুনীতকে। ব্যাক গিয়ারে একটা গাড়িকে অত গতিতে ছুটতে দেখে প্রায়শই রাস্তার ধারের বিভিন্ন মানুষজন অবাক হয়ে যাচ্ছেন। দুপুর দুটো নাগাদ আমরা পৌঁছলাম সম্বলপুরে। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে ফের শুরু হল যাত্রা, মিনিট কুড়ির পর ফের সামান্য বিরতি। সামনেই সুবিশাল জলরাশি। বিখ্যাত হিরাকুঁদ বাঁধ। এতদূর থেকে এমন সুবিখ্যাত একটি জলাধারের সামনে দিয়ে চলে যাব অথচ দাঁড়াব না তা কি হতে পারে? না, আমাদের দলে এমন বেরসিক কেউই নেই। দাঁড়ানো হল, সকলেই ছুটল জলের দিকে। একদিকে কাজল কালো জলরাশি, অন্যদিকে পাথুরে রূপ মহানদীর। সুন্দর লাগছিল। বিশাল বাঁধ, গাড়িতে যেতেই যেতেই দেখা হয়ে যায় অনেকটা। আমাদের হাতে সময় কম, তাই অনেক সময় ধরে হিরাকুঁদের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা গেল না। কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই তাই ফের গিয়ে বসলাম গাড়িতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, রাস্তা খুব খারাপ নয়, গাড়ি ফের ছুটেছে সত্তর আশিতে।
ওড়িশার সীমানা ছাড়িয়েছি বেশ খানিকক্ষণ, সন্ধে হয় হয়, অনেকক্ষণ গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত দুটি গাড়ির চালকেরাই। সুনীতের ক্লান্তি আরও বেশি, কারন ওকে সারাক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে চালাতে হচ্ছে। তাই চা খাওয়ার বিরতি দরকার। সরায়পালি বলে একটি জায়গায় পথের ধারে একটি ধাবা দেখে দাঁড়ানো হল। সন্ধে প্রায় সাড়ে ছটা, থাকার জায়গা কি হবে তখনও ঠিক হয়নি। ধাবাতে আলোচনা করে জানা গেল ঘন্টা দুই আড়াই গেলে রায়পুর আসছে। সেখানেই রাত্রিবাস করা ভাল। তার আগে পিছে তেমন ভাল থাকার জায়গা মিলবে না। চা খেয়ে মিনিট কুড়ি পরে ফের গড়াল চাকা। রাত প্রায় সোয়া নটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম রায়পুরে। বাইপাস থেকে শহরে ঢোকার মুখেই মিলল একটি থানা, বোর্ড পরে জানলাম সেটি তেলিবান্ধা থানা। আগের দিনের মতই এখানেও প্রথমেই থানাতে গিয়ে আমাদের আসার উদ্দেশ্য বিধেয় জানিয়ে কোথায় থাকতে পারি তার একটা পরামর্শ চাইলাম। এখানকার পুলিশও কিন্তু আমাদের সাহায্যই করলেন। সব শুনে আমাদের নিকটবর্তী এম জি রোডে একটি হোটেলের ব্যবস্থাও ওরা করে দিলেন।
(ক্রমশ…)