পিছুটানে (প্রথম পর্ব)
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
দুর্গাপুর থেকে কলকাতা হয়ে মুম্বাই শচীন তেন্ডুলকরের বাড়ি। দুই হাজার কিলোমিটারেররও বেশি পথ ব্যাকগিয়ারে সড়কপথে। পথে নানা ধরনের ভয়, বাধা, বিপত্তি। তবুও ছয় যুবকের এক নাছোড় লড়াই। পাঁচদিনের যাত্রাপথে ভাল মন্দ মিশিয়ে নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন এই অভিযানের সদস্যরা। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু হল নতুন ধারাবাহিক পিছুটানে। এবারে প্রথম পর্ব।
১৯ জুন, ২০১১
বিকেলের অফিস, ব্যস্ততার চরম শিখরে। সন্ধ্যায় প্রাইম টাইমে পর পর খবর। এই সময়টায় আমার নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। একের পর এক খবর আসতে থাকে। সেগুলি দেখা, রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বলা, ডেস্কের সহকর্মীদের নানা নির্দেশ দেওয়া, সেগুলি চেক করা, কোন খবর কোথায় কতটা যাবে তা ঠিক করা, এক কথায় পুরো ঘেটে ঘ অবস্থা। এমন সময়ে সুনীতের ফোন, “দাদা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এবার বোম্বে যাব। শচীন তেন্ডুলকরের বাড়ি। পরশু বেরচ্ছি, তোমাকেও যেতে হবে”। সেই সময় আমার কথা বলবার মত অবস্থা নেই, দেখছি দেখব করে ফোন কেটে দিলাম। সাড়ে সাতটার পর একটু ফ্রি হতেই ফোন করলাম, কি বলছিলে যেন? সুনীতের পরিচয়টা এই বেলা একটু দিয়ে রাখি, সুনীত চক্রবর্তী দুর্গাপুরের বাসিন্দা। ব্যাকগিয়ারে গাড়ি চালিয়ে সে জাতীয় রেকর্ড করেছে। এর আগে দুর্গাপুর থেকে কলকাতা, বোলপুর থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত এবং কলকাতা থেকে ওয়াঘা সীমান্ত পর্যন্ত পিছনমুখে গাড়ি চালিয়ে সে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। ইতিমধ্যেই লিমকা বুক অফ রেকর্ডস এ তার নামও উঠেছে। ফোনে আমাকে সুনীত জানাল সদ্য ভারতীয় ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ জিতেছে সেই দলে শচীনও ছিলেন তাই তাকে সম্মান জানিয়ে মুম্বাইতে তার বাড়ি পর্যন্ত ব্যাক গিয়ারে যেতে চায় সে। আমি যদি যাই এবারে খুব ভাল হয়। আমাকে নিজের দাদার চাইতেও বেশি শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে সুনীত, তার কথাটা তাই উড়িয়ে দিতে পারলাম না। গত কয়েক মাস ভোটের জন্য ছুটিছাটা নেওয়াই হয়নি, খুব চাপ ছিল, তাই প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না। অফিসেই ছিলাম চ্যানেলের এম ডি তথা মালিককে ফোন করলাম। দিন সাতেক ছুটি চাইতেই মিলে গেল। ঠিক হল আমি আগের দিন অর্থাৎ ২০ জুন পৌঁছে যাব দুর্গাপুরে, পরদিন সকালে ওখান থেকেই রওনা হব বোম্বে থুড়ি মুম্বাই এর উদ্দেশে। বাড়ি এসে ব্যাগ গুছিয়ে পরদিনই চলে গেলাম দুর্গাপুরে।
২০ জুন, ২০১১
দেখা গেল আমি একা নয় সুনীতের সঙ্গে যাচ্ছে আরও চারজন। গোটা ঘটনার একটা ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখাও দরকার কারন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস্ থেকে বলা হয়েছে সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখিত এবং ভিডিও আকারে যেন থাকে। বাঁকুড়া থেকে বুধন এল চিত্রগ্রাহক হিসেবে। আমরা বিকেলে সকলে বৈঠকে বসলাম। কি কি নিতে হবে, তার তালিকা করা হল। ঠিক হল তিনটি গাড়ি থাকবে। সুনীত নিজে ব্যাকগিয়ারে চালাবে তার ভার্সা গাড়িটি। সঙ্গে থাকবে একটি সুমো গ্রান্ডি। তার সঙ্গে থাকবে সুনীতের আর একটি অল্টো গাড়ি, যেটা চালাব আমি। সেই মত ভার্সা ও অল্টো গাড়ির দুটি স্টেপনি ঠিক করতে দেওয়া হল সামনের গ্যারাজে। ঠিক হল সকালে বেরোবার সময় দুটি চাকাই তুলে নেওয়া হবে। রাতে শোয়ার সময় ঠিক হল তিনটি গাড়ি নেওয়ার যুক্তি নেই গাড়ি দুটিই থাক। সুনীতের গাড়িতে সুনীত এবং তার শ্যালক সুদীপ্ত, অপর গ্রান্ডিতে আমি, বুধন এবং সেই গ্রান্ডির দুই চালক। এখানে বলে রাখা দরকার সুনীতের সিদ্ধান্ত মূহুর্তে মূহুর্তে পরিবর্তন হয় এবং খুব আটঘাট বেঁধে কাজ করবার মানুষ সে নয়। প্রবল ইচ্ছে শক্তি আছে, তার জোরেই বেরিয়ে পড়ে। পথে, দেখা যাক।
২১ জুন, ২০১১
দুর্গাপুরের নেহেরু স্টেডিয়াম থেকে যাত্রা শুরু হল আমাদের। দুর্গাপুর থেকে মুম্বাই, ব্যাকগিয়ারে। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক, প্রশাসনিক কর্তা, ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটির কর্তা এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সকাল নটা নাগাদ রওনা দিলাম আমরা। ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ছুটল আমাদের গাড়ি। মাঝে হাওড়ার কাছে কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে আবার আমরা ছুটছি বোম্বে রোড ধরে। একটা নাগাদ মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য দাঁড়ানো হল কোলাঘাটে। সেখানেও কয়েকজন সাংবাদিক এসে যাওয়াতে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল। সুনীতকে জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের রুট ম্যাপটা কি ঠিক করেছ? কোথায় থাকা হবে, কোন রাস্তা দিয়ে যাওয়া হবে? সুনীত বেমালুম হাত তুলে দিয়ে জানাল এসব কিছুই সে জানে না। সব ঠিক করব আমি। আমিই নাকি এই সফরের ম্যানেজার। কি মুশকিল, আগে থেকে কিছুই জানি না। এবার তো খুব চাপে, অগত্যা আমার কাছে একটি ডায়রি ছিল তাতে একটা ভারতের ম্যাপ ছিল, সেটা দেখেই আন্দাজ করতে লাগলাম কোথা দিয়ে যাওয়া যায়। প্রসঙ্গত বলি তখন এমন জিপিএস বা গুগল ম্যাপ দেখে যাওয়া সম্বন্ধে আমাদের কারোরই কোনও ধারণা ছিল না। আমাদের স্মার্ট ফোনও ছিল না। আমি ভেবেছিলাম বোম্বে রোড বুঝি সরাসরি বোম্বে যায়, এই রাস্তা ধরে গেলেই সোজা মুম্বাই, কিন্তু পরে দেখেছিলাম এই রাস্তা মোটেই সোজা মুম্বাই যায় না, পথিমধ্যে বহুবার বহু রাস্তার সঙ্গে মিশেছে।
যাই হোক আড়াইটে নাগাদ ফের রওনা দিলাম আমরা কোলাঘাট থেকে। চারটে নাগাদ খড়গপুর চৌরঙ্গী মোড় পেরোতেই এবার রাস্তা বেশ খারাপ। বোম্বে রোড তখন ফোর লেন হয়নি, কোথাও কোথাও কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। গাড়ির গতি গেল কমে। আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি, লোধাশুলি পার হতেই কমে এল আলো একে একে আসছে ফেকো, সরডিহা। এক এক করে নামগুলি পড়ছি আর শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন যেন ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের মানুষ হিসেবে এই নামগুলি তখন আমার কাছে বিশেষ পরিচিত। রাতের বেলা তো বটেই দুপুরের পর থেকেই এই এলাকাতে মানুষজন খুব একটা বের হন না। মাও হিংসার কল্যানে প্রতিদিন সংবাদ শিরোনামে থাকে এই এলাকা। ফি দিন একাধিক খুন জখম মৃতদেহ উদ্ধার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সব এলাকায়। চারিদিক কেমন থমথমে, ঘন সবুজ অরণ্যের মাঝে চলেছি আমরা, অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি, কিন্তু সেই সুন্দরকে উপভোগ করবার উপায় নেই। মাঝে মধ্যে উল্টোদিক থেকে ছুটে আসছে দু একটি গাড়ি। এই বুঝি মনে হচ্ছে কেউ বা কারা এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। অথবা মাওবাদীদের পেতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে উড়ে গেল বুঝি আমাদের গাড়ি। অবশেষে দুরু দুরু বুকে পেরিয়ে গেলাম পশ্চিমবঙ্গের সীমানা। কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু… (ক্রমশ)