পুস্তক বিভ্রাট
বিশ্বজিৎ রায় ##
প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) উপন্যাস “অগ্নি”কে অবলম্বন করিয়া অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় যে “অগ্নিশ্বর” চলচ্চিত্র নির্মাণ করিয়াছিলেন তাহাতে মহানায়ক উত্তমকুমার একদা বলিয়াছিলেন যে, ঘরের বউ আর বই – একবার বাহিরে গেলে অন্দরমহলে আসিতে চায় না। কথাটা যে কতবড় সত্যি তাহা আজ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করিতেছি। দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ হইবার পর থেকেই বাধ্যকতায় নহে, ( যদিও ‘সচ্ছলতা ‘ শব্দটিকে শৈশবে দূরবীন দিয়াও খুঁজিয়া পাই নাই) এক প্রকার অন্তরের তাগিদেই সংসারে কিছু অবদান রাখিবার নিমিত্ত গৃহ শিক্ষকের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করিয়াছিলাম। পাঠ্যদানের পাশাপাশি ছাত্রের নাক মুছাইয়া, পিঠ চুলকাইয়া, আরো নানাবিধ কর্ম সম্পাদন করিয়া মাসিক ৭০ টাকা আয় করিতাম। সে নব্বই দশকের কথা বলিতেছি। সাংসারিক অবদান বলিতে শুধু চায়ের জন্য যে কয়টি টাকা ব্যয় হইবে তাহারই গুরুদায়িত্ব বহন করিতাম। আমার মাতার নির্দেশ ছিল- আমার অর্জিত অর্থ যেন আমি নিজের পড়াশোনার কাজে ব্যয় করিয়া থাকি। মাতৃ আদেশ শীরধার্য্য করিয়া আমি তাহাই করিতাম। কিন্তু এখানেও বিশেষ সুবিধা ভোগ করিতাম। দু এক জন ব্যতীত অন্যান্য শিক্ষকগণ টিউশনির টাকা আমার নিকট হইতে লইতেন না। অতএব মাসিক আয়ের গড়ে ৩০-৩৫ টাকা অবশিষ্ট স্বরূপ আমার হাতে পড়িয়া থাকিতো। আমি বরাবরই পড়িতে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মনে পড়িতেছে, যে সময় আমরা পরিবারের সকলে মিলিয়া ভাড়া বাড়িতে দারিদ্র্যতা হেতু একসঙ্গে একটি কক্ষে রাত্রি যাপন করিতাম সেই সময় অধিক রাত অবধি বিনা কারণে আলো জ্বালাইয়া রাখিলে অন্যের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিবে বলিয়া শিয়রে টর্চের আলো ফেলিয়া আমি গল্পের বই পড়িতাম। তখন বয়স ছিল অল্প। সিদ্ধি লাভের পথ তখনও অবলম্বন করি নাই, এখনও কখনও খুঁজিবার প্রয়োজন বোধ করি নাই। সুতরাং একথা অনুমান করা যাইতে পারে যে, আমি অবশিষ্ট অর্থ দিয়া পুস্তক ক্রয় করিতাম। আমাদের পাড়াতে এক জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা সেই সময় মদ, গাঁজা অবলম্বন করিয়া সিদ্ধি লাভের সিড়ি বাহিয়া তড়তড় করিয়া উর্ধ্বমুখী গমন করিতেছিলেন। একদিন মধ্যাহ্ন তাহার বাড়িতে গিয়া দেখিলাম তিনি পুরাতন পুস্তক স্তুপীকৃত করিয়া পুস্তক বিক্রেতাকে পুস্তকগুলি কেজি দরে বিক্রয় করিতেছেন। আমি বলিলাম-
” এই বইগুলি সব বিক্রি করে দেবে দাদা ?”
সে বলিলো , ” হ্যাঁ, এগুলি আর দরকার নেই । শুধু শুধু ঘর ভরে থাকে “।
আমি মনে মনে ভাবিলাম, দরকার যে কি তুমি তাহা বুঝিবে কি করিয়া ? আমি পড়িয়াছিলাম ফরাসীরা তাহাদের সারা জীবনের অর্জিত আয়ের প্রায় ১৫% – ২০% অর্থ না কী পুস্তক ক্রয়ে ব্যয় করিয়া থাকেন । ( কথাটি সত্যই বটে- আমি এই কারণে বলিতেছি যে আমার ফেসবুক বন্ধু Rodolf Fonty একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি- সাহিত্যে এমন অবাধ বিচরণ আমি কম সংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে দেখিয়াছি । ) আমার এ কথা শুনিলে তিনি হয় তো আমাকে পন্ডিত বলিয়া ব্যাঙ্গ করিতেন। তাই নিশ্চুপ থাকিয়া পুস্তকগুলি দেখিতে লাগিলাম এবং একখানা মূল্যবান পুস্তক খুঁজিয়াও পাইলাম। পি.কে.দে সরকারের একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণীর ইংরাজি ব্যাকরণ – পুস্তকখানি হাতে লইয়া আমি বলিলাম,
” এই বইটি আমি নিতে চাই”।
তিনি আমার মুখের পানে তাকাইয়া,মাথা চুলকাইয়া আমায় বলিলেন-
“টাকার খুব দরকার রে। তুই একটা বই চাইলি আর আমি দিতে পারছি না। নিজেরই বড় খারাপ লাগছে। তুই কিছু মনে করিস না ভাই- ঐ বই আমি বিক্রি করবো।”
আমি বলিলাম –
না,না, বিনা পয়সায় নেবো কেন ? টাকা দিয়েই নেবো।”
আমার কথায় তাহার মুখে হাসি ফুটিলো। আমার হস্ত হইতে পুস্তকখানি লইয়া দুইটি পৃষ্ঠা উলটাইয়া কহিলেন-
“বইটির দাম ২২ টাকা। অর্ধেক দাম হয় ১১ টাকা। তুই কত দিবি?”
এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের নিমিত্ত আমি প্রস্তুত ছিলাম না । আমি ভাবিয়াছিলাম তিনি আমায় ভাতৃসম গন্য করিয়া থাকেন, অতএব আমি যাহা প্রদান করিবো তাহাতেই তিনি সন্তুষ্ট হইবেন। যাহা হউক, আমি পকেটে হাত দিয়া দেখিলাম তাহাতে ৫ টাকা রহিয়াছে । মুখটি কাচুমাচু করিয়া কহিলাম-
” আমার কাছে ৫ টাকা আছে । ৫ টাকা দিলে হবে ?”
আমি তাহাকে মনে হয় যেন এইবার ধর্ম সংকটে ফেলিলাম । “না” বলিতে পারিতেছেন না কারণ আমাকে ভাতৃসুলভ(?) স্নেহ করিয়া থাকেন, আবার “হ্যাঁ”ও বলিতে পারিতেছেন না কেননা তাহার হয়তো দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল যে, পুস্তক বিক্রেতাকে পুস্তকটি বিক্রয় করিলে ১১টাকার অধিক পাওয়া যাইবে, আমার নিকট বিক্রয় করিলে তাহার ৬টাকা লোকসান হইবে। তবে অস্বীকার করিবো না সেই যাত্রায় আমার প্রতি তাহার করুনা উদ্রেক হইলো এবং একটি মধ্য পন্থা অবলম্বন করিয়া আমাকে রক্ষাও করিলেন। আমায় বলিলেন-
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুই এখন ৫ টাকা দে, পরে আবার ৬ টাকা দিয়ে দিবি। পরে মনে করে দিবি কিন্তু। বিদ্যা কখনও বিনা পয়সায় নিতে নেই।”
আমি মনে মনে ভাবিলাম, সত্যই তো, বিনা পয়সায় শিক্ষা লইতে গিয়া একালব্যর কি দশা হইয়াছিল – তাহাতো ভুলিবার নয়।
এত কথা বলিবার একটাই কারণ, তাহা হইলো আমি পুস্তক অনেকটাই কিনিয়াছি এবং অদূর ভবিষ্যতেও কিনিবো। পুস্তক আমার দ্বিতীয় প্রেমিকা। অতএব পুস্তক বিচ্ছেদ প্রেমিকা বিচ্ছেদেরই সমতুল্য। আমি অভিনেতা স্বর্গীয় উৎপল দত্ত মহাশয়ের বাংলায় ভাষায় লিখিত “সেক্সপিওরের সমাজ চেতনা” নামক একটি দূর্লভ পুস্তক ক্রয় করিয়াছিলাম। সেই সময় পুস্তকটা যত পড়িয়াছি , বুঝিয়াছি তার শিকি ভাগের শিকি ভাগও না। আমার বন্ধু আজ হইতে প্রায় ১০-১২ বৎসর পূর্বে পুস্তকটি পড়িবার উদ্দেশ্যে যে উৎসাহের সহিত লইয়াছিলেন আজ ১০-১২ বৎসর ধরিয়া পুস্তকটি ফেরাইবার উৎসাহের ডেপ্রিশিয়েশন হইতে হইতে বর্তমানে তাহা শূন্যতে ঠেকিয়াছে। তাই পুস্তকটি আমি আজও ফেরত পাই নাই। গতকাল রাত্রে যখন তাহাকে হাতের কাছে পাইলাম তখন এক প্রকার লজ্জা শরম ত্যাগ করিয়া পুস্তকটি দাবী করিয়া বসিলাম। আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন বাড়িতে দুইটি কন্যা সন্তান, গৃহিনী, চারটি গরু সামলাইয়া যদি সময় বাহির করিতে পারেন তবে ফোন মারফত আমাকে সুসংবাদটি জানাইয়া দেবেন। সকাল হইতে আমি এ পর্যন্ত আট দশবার ফোন দেখিয়াছি যে তাঁহার ইন কামিং কল ভুলবশত আমার হাত ছাড়া হইয়া যাই নি তো! কিন্তু কোনো কলই আসে নাই। অতএব বন্ধুগণ আসুন, আমরা সকলে মিলিয়া সেই পরমাকাঙ্ক্ষিত সুসংবাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনিতে থাকি।
Bhaloi….kintu ekta tothyogoto bhul achhe…..”Agnishwar” cinemata Bonophul er Agniswar uponyash obolombonei toiri hoyechhe, “Agni” noye!! 1974 sale Arabinda Mukhopadhyay cinemati nirman koren, jar naam bhumikae chhilen Uttam Kumar.
মন্তব্য করবার জন্য ধন্যবাদ জানাই । আমি মূল উপন্যাসটি “অগ্নিশ্বর” বলেই জানতুম, যদিও কখনও পড়া হয়ে উঠেনি, সিনেমা দেখেছি। যখন রম্যরচনাটি তৈরি করছিলাম তখন সন্দেহ নিরসনের জন্য google search করি এবং উপন্যাসের নাম ” অগ্নি ” হিসেবেই পায়। আপনার মন্তব্যটি পড়ে আমারও সন্দেহ আরো বেড়ে গেল ।
ভালো থাকবেন অবিরত ।