বইমেলায় উপছে পড়া ভিড়, এদিকে শুনশান গ্রন্থাগারগুলি। বাঙালি কি বই পড়তে চায় না আর? কেমন আছে রাজ্যের পাঠাগারগুলি?

পলাশ মুখোপাধ্যায় ##

সে একটা সময় ছিল, যখন দুপুর হলেই গমগম করত পাড়ার গ্রন্থাগারগুলি। নানান বয়সের নানান মানুষের ভিড় তখন গ্রন্থাগারে। কেউ কমিক্স পড়ছে, কেউ পড়ছেন খবরের কাগজ, কেউ আবার সাময়িক পত্রিকা, কারও হাতে দেখা যেত গল্প বা উপন্যাসের বই। কিন্তু ধীরে ধীরে ছবিটা বদলেছে। পাড়ার গ্রন্থাগারগুলির এখন করুণ দশা। ক্রমশ কমে এসেছে পাঠক। তরুণ সমাজের হাতে বই এর বদলে উঠে এসেছে মোবাইল। তাই তো লাইব্রেরি এখন ব্রাত্য। বই পড়ার অভ্যাস কিন্তু কমে যাচ্ছে। বইমেলায় যখন উপচে পড়ে ভিড়, তখন মেলা বই মেলে যেখানে সেই গ্রন্থাগার কিন্তু শুনশান থাকে বছরভর। এখন অবশ্য বই পড়া যায় মোবাইলে অনেকে সেখান থেকেও পড়েন। কিন্তু গ্রন্থাগারে যেমন হাতের কাছেই বিভিন্ন বই চটজলদি মেলে, বিস্তৃত পরিসরে বই পড়ার মজা কি ওই ছোট্ট গ্যাজেটে মেলে? একটা সময় পাড়ার মহিলারা প্রচুর বই পড়তেন অবসর সময়ে, এখন সেই জায়গা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে টিভির সিরিয়াল। এখন ২4 ঘন্টা ধরেই নানান অনুষ্ঠান চলে টিভিতে। চালিয়ে রেখেই কাজ সারেন অনেকে। বই পড়তে গেলে সেখানেই মনোনিবেশ করতে হয়। তাই বইয়ের প্রতি ভালবাসা সেখান থেকেই কমেছে। এমন নানান কারণ, ক্রমশ বই পড়ুয়া বাঙালিকে বই বিমুখ করে তুলছে বলে অনেকের ধারণা।

কিন্তু ঠিক কেন এমন হাল, মানুষ কি সত্যিই বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন? বাঙালি এখন পড়তে ভালবাসে না? কথাটা কিছুটা ঠিক হলেও পুরোপুরি কিন্তু নয়। বাঙালির গ্রন্থাগার বিমুখতার পিছনে সরকারের অবদানও কম নয়। চলুন তাহলে একটু তলিয়ে দেখা যাক ব্যাপারটা।

সমাজ গড়ার কারিগর হিসাবে যেমন স্কুল ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবদান থাকে ঠিক তেমনই একজন পড়ুয়ার ছাত্রাবস্থায় গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা ঠিক ততটাই ৷ কিন্তু সেই সব সরকারি গ্রন্থাগারের অধিকাংশতেই ঝাঁপ খোলার কর্মী নেই এখন। রাজ্যের পালা বদলের পর দীর্ঘ এগারো বছর যাবত সেই অর্থে কোনও সরকারি গ্রন্থাগারে স্থায়ী পদের লোক নিয়োগ হয়নি। জেলা থেকে শুরু করে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও গ্রন্থাগারের শূন্য পদ পূরণ হয়নি। এসএসসি-র মাধ্যমে মাত্র দু’বার নামমাত্র নিয়োগ হয়েছে। মাদ্রাসা লাইব্রেরির ছবিও একই। দ্রুত কর্মী নিয়োগ করে গ্রন্থাগারগুলোর হাল ফেরাতে দাবি জানিয়েছে গ্রন্থাগারিকদের সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গ সাধারণ গ্রন্থাগার কর্মী সমিতির রাজ্য সম্পাদক সৌগত সাহার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলির বর্তমান হালহকিকত। এক সময় পশ্চিমবঙ্গের গ্রন্থাগার ব্যবস্থা ছিল ভারতের মধ্যে সেরা। গ্রন্থাগার নির্ভর লেখাপড়ায় যথেষ্ট জোর দেওয়া হতো। কিন্তু বছর কুড়ি ধরে ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে সাধারণের গ্রন্থাগার ব্যবস্থা। নতুন করে নিয়োগ হয়নি বললেই চলে। ৫৫২০ মোট পদ রাজ্যে তার মধ্যে ২০২২ পর্যন্ত ৪১৭৭ পদ শূন্য।তার পর আরো খালি হয়েছে।আর নিয়োগ হয়েছে ৭৩২ জন।তার মধ্যে চার জেলাতে পরীক্ষা হলেও নিয়োগ হয় নি। সম্প্রতি সামান্য কিছু কর্মী নিয়োগ হয়েছে বটে তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখে প্রায়শই অজুহাত শোনা যায়, লাইব্রেরিতে পাঠকরা আসে না তাই লাইব্রেরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে লাইব্রেরি খুললে পাঠকরা আসেন। লাইব্রেরি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে বা অনিয়মিত খোলা হলে পাঠকরা আসবেন না এটাই স্বাভাবিক।

পশ্চিমবঙ্গে ২৩ টি জেলা মিলিয়ে সরকারি গ্রন্থাগার রয়েছে ১৩টি, ২৪৬৭টি সরকার পোষিত ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সাধারণ গ্রন্থাগার রয়েছে। ১৩টি সরকারি গ্রন্থাগারের অনুমোদিত ১৬৪টি পদের মধ্যে ৮০টি শূন্যপদ। ২৪৬৭টি সরকার পোষিত ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সাধারণ গ্রন্থাগারের অনুমোদিত ৫৫২০টি পদের মধ্যে ৪২০০টি শূন্যপদ। সরকারি সূত্রে বিভিন্ন জেলাগুলিতে কর্মীর অভাবে ৩৯২টি বন্ধ গ্রন্থাগারের কথা বলা হলেও যেভাবে প্রতিদিন কর্মীদের অবসরের সঙ্গে সঙ্গে শূন্যপদ তৈরি হচ্ছে তাতে প্রায় ৮৫ শতাংশ শূন্যপদ। বাস্তবে ১৩০০ গ্রন্থাগার বন্ধ।
সরকারি স্কুল, কলেজগুলোর লাইব্রেরিতেও নিয়োগ করছে না সরকার। ফলে কর্মীর অভাবে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তে পারেন না বহু পড়ুয়া। কর্মী না থাকা এবং লাইব্রেরি বন্ধ রাখার অজুহাতে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বই কেনার টাকাও অনেক ক্ষেত্রেই দিচ্ছে না সরকার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নিয়মিত দরকার হয় লাইব্রেরি। সুতরাং লাইব্রেরিতে পাঠক আসে না সরকারের এই যুক্তি খাটে না।

রাজ্যের এমনই এক গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক কুতুব উদ্দিন মণ্ডল। উত্তর ২৪ পরগনার দুটি গ্রন্থাগারের দায়িত্ব আছনে তিনি। তার কাছ থেকে যা জানা গেল তা আরও দুশ্চিন্তার। গ্রন্থাগারগুলিতে গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক মিলিয়ে ওই সংখ্যার দ্বিগুণ থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা পঞ্চাশ শতাংশেরও অনেক কম। স্বাভাবিক ভাবেই কর্মীর অভাবে অধিকাংশ গ্রন্থাগারে তালা ঝুলছে। অধিকাংশ গ্রন্থাগারে ‌পঠনপাঠন ও বই নেওয়া-দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ। কিছু গ্রন্থাগারে অবসরপ্রাপ্ত কর্মী ও কমিটির লোক মিলে সপ্তাহে কয়েক দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য গ্রন্থাগার খুলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে অবশ্য। কিন্তু সপ্তাহে প্রতি দিন পূর্ণ সময়ের জন্য খুলে না রাখার‌ ফলে গ্রন্থাগারে পাঠক আসা ও বই নেওয়া-দেওয়া কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ, সরকারের এই নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। অধিকাংশ জায়গাতে আবার একেকজন গ্রন্থাগার কর্মীর ওপর একাধিক গ্রন্থাগারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঐ গ্রন্থাগারিক পালা করে সেই গ্রন্থাগারগুলি খোলেন। ফলে সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন করে খোলা থাকে সেই সব গ্রন্থাগার। পাঠকরা চাইলেও লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর ফলে চালু গ্রন্থাগারগুলিকেও বাস্তবে অচল করে দেওয়া হচ্ছে। একই অভিযোগ পাঠকদেরও, উত্তর ২৪ পরগনার দোগাছিয়ায় এক গ্রন্থাগারে নিয়মিত আসেন পাঠক শ্রীনাথ ঘোষ, মৌমিতা চক্রবর্তী, অঙ্কিতা চক্রবর্তী প্রমুখরা। আজকের এই মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও বই পড়তে ভালবাসেবন তারা। কিন্তু গ্রন্থাগার রোজ খোলা না থাকায় বা অনিয়মিত খোলার ফলে তাদেরও ইচ্ছে হলেই আসার উপায় নেই। গ্রন্থাগারিক কুতুব উদ্দীনের দায়িত্বে দুটি গন্থাগার, তাই তাঁকে একটি বন্ধ রেখেই অন্যটি খুলতে যেতে হয়।

বই কেনা সহ গ্রন্থাগার পরিচালনার বিভিন্ন কাজের জন্য গ্রন্থাগার-পিছু‌ সরকার থেকে সাড়ে উনত্রিশ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। শহর বা গ্রামের গ্রন্থাগারের নিরিখে এই অঙ্কটা কম বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু খুব বেশি তারতম্য নেই। বইয়ের মূল্য বর্তমানে আকাশছোঁয়া হলেও সরকার থেকে বই কেনার অনুদান এক‌ টাকাও বাড়ানো হয়নি। বাড়ানো হয়নি গ্রন্থাগারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচও। গ্রন্থাগারে বিভিন্ন মনীষীদের জন্মদিন পালন ও অনুষ্ঠান করার জন্য ১২০০ টাকা করে অনুষ্ঠান পিছু ‌দেওয়া হত। তাতে যেমন এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে সংস্কৃতি চর্চা করা যেত, তেমনই গ্রন্থাগারে বইপ্রেমী‌রা আসার‌ একটা সুযোগ পেতেন। করোনাকালীন অবস্থার পরে তা-ও বন্ধ করে দেওয়া ‌হয়েছে। রাজ্য সরকারের খেলা, মেলা, পুজোয় অনুদান দেওয়ার সময় অর্থের অভাব পড়ে না, মন্দির গড়তে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে পিছপা হয় না। কিন্তু গ্রন্থাগারগুলিতে কর্মী নিয়োগের‌‌ বেলায় এত টালবাহানা কেন? কেন গ্রন্থাগারগুলি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে না রাজ্য সরকার? সরকার কি চায় না বইপ্রেমীরা গ্রন্থাগারে নিয়মিত আসুন, তাদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠুক? পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও আরও উদ্যোগী হতে হবে, ভিড় করতে হবে গ্রন্থাগারগুলিতে। সরকারকে বোঝাতে হবে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনিয়তার কথা, মানুষের ইচ্ছা, উৎসাহ, ভালবাসাই সরকারকেও এদিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করবে। না হলে কিন্তু এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় গ্রন্থাগারগুলি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =