বাংলার ইয়াসনামা
শুভজিৎ দত্ত ##
ইয়াসের দাপটে বেসামাল বাংলার তিন জেলার সাগর লাগোয়া অঞ্চলগুলি। ভিটে মাটি সব হারানো অসহায় মানুষগুলির পাশে নিজেদের সাধ্য মত দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। প্রশাসনের পাশাপাশি বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সামিল হয়েছে ত্রাণে। এমনই এক সংস্থা স্বপ্নের সাথী। তারাও সাধ্যমত ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল সুন্দরবন লাগোয়া বিভিন্ন অঞ্চলে। তাদের অভিজ্ঞতা, মানুষগুলির অসহায়তা, দুঃসহ পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে শুভজিৎ দত্তের কলমে।
গত দেড় বছর ধরে সময়টা খুবই দুর্বিষহ। অতিমারী, লকডাউন, মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে অনেক বেশী চ্যালেঞ্জিং। আবার এরমধ্যেই বাংলার উপকূলবর্তী এলাকার মানুষদের জীবনে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এক দুশ্চিন্তা বয়ে এনে দিল গত ২৬ মে-র ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। গত বছর ঠিক এরকম সময়েই আরও এক ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ এইসব উপকূলবর্তী এলাকার মানুষদের প্রায় সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গিয়েছিল। এ যেন একটা ঝড়ের ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আবার সাইরেনে সতর্কবার্তা এসে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার। তবে এবারের ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাত উড়িষ্যার দিকে থাকলেও, ঘূর্ণিঝড়-ভরা কোটাল-চন্দ্রগ্রহণের ত্রহ্যস্পর্শে ভঙ্গুর মাটিবাঁধ ভেঙে যাওয়ার একটা আশঙ্কা দেখা দিল। তাই প্রশাসনিক সর্তকবার্তা শোনার পর থেকেই যে গ্রামবাসীরা ফ্লাড সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছিলেন,তারাই আবার গ্রামকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সহায়তার অপেক্ষা না করে হাত লাগিয়েছিলেন বাঁধ মেরামতির কাজে।
কিন্তু মানুষের সেই আশঙ্কাকে একেবারে সত্যি করেই ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের দিন জলোচ্ছ্বাসে কোথাও ভেঙে গেল বাঁধ,আবার কোথাও বাঁধের সীমানা অতিক্রম করে নদীর লবনাক্ত জল প্লাবিত করল বিস্তীর্ণ গ্রামগুলিকে। ফলস্বরূপ কোথাও জল জমল বুক সমান আবার কোথাও একতলা বাড়ির সমান। ঘোড়ামারা দ্বীপ তো সম্পুর্ন রূপে নিমজ্জিতই হয়ে গেল। কদিন পর এই দ্বীপ মানচিত্র থেকে না হারিয়েই যায়! আমফানের সাথে তুলনা করলে আমাদের বাংলায় না হয়েছে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি আর না হয়েছে মেদিনী কাঁপানো ঝড়ের তান্ডব, শুধুমাত্র জলোচ্ছ্বাসেই প্রকৃতির এক ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সাক্ষী থাকলো আমাদের রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার উপকূল ও নদীতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ। সে এক ভয়ানক রূপ প্রকৃতির। কেউ প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাড়ির একতলার কার্নিশে আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ গাছের উপর উঠে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। যে কোনও ভাবে নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বাঁধ ভেঙেছে আনুমানিক ১৩৪ টি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি মানুষ এবং শেষ সম্বল মাথার ছাদ হারিয়েছেন প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ।
গত ২৯ মে এইসব দুর্গত এলাকায় গিয়ে এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম। সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকাতেই জল এখনও নামেনি, কোথাও বুক সমান আবার কোথাও হাঁটু জল। তাই গ্রামের ভিতর প্রবেশ করা যাচ্ছে না। মানুষ বাঁধের উপরেই ত্রিপল টাঙিয়ে দিন গুজরান করছেন। আবার কোথাও নিজেরাই নেমে পড়েছেন বাঁধের মেরামতিতে। দ্বীপের ভিতরের আটকে থাকা জল বার করে দিতে কোথাও পাম্প চালানো হচ্ছে আবার কোথাও ভাটার সময় বাঁধ কিছুটা কেটে জমে থাকা জল বার করার চেষ্টা চলছে।
বেশিরভাগ পানীয় জলের উৎস ডিপ টিউবওয়েল জলের তলায় থাকায় পানীয় জলের এক বিশাল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মানুষ কলসি নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু জল পাবার আশায়। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা প্রশাসন পানীয় জলের ব্যবস্থা করলেও সমগ্র দ্বীপগুলির পানীয় জলের চাহিদা অনুযায়ী সেটা যথার্থ নয় একদমই।
এর পাশাপাশি দেখা দিয়েছে খাদ্যের সংকট। ঘরে মজুত খাদ্যের ভান্ডার সব জলের তোড়ে ভেসে গেছে। এই অবস্থায় অভুক্ত মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিছু স্বেচ্ছ্বাসেবী সংস্থা। কেউ কয়েকদিনের রেশন দিয়ে সাহায্য করছেন। আবার কেউ লঙ্গরখানা (কমিউনিটি কিচেন) থেকে অভুক্ত মানুষগুলির হাতে তুলে দিচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার রসদ। যাতে লড়াকু মানুষগুলো আবারও আগামী লড়াইগুলির জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
প্রায় চারদিন কেটে গেলেও নোনা জল জোয়ারের সময় গ্রামে ঢুকছে । বেশিরভাগ গ্রামের চাষের জমির সমূহ ক্ষতি হল, আগামী কয়েক বছর হয়ত এইসব জমিতে আর ভালো চাষই হবে না। এছাড়াও মরা গবাদি পশু এবং পুকুরের মরা মাছের দুর্গন্ধে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। অগত্যা পচা মাছ তুলে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন গ্রামবাসীরা।মাছ ছাড়াও নোনা জলে পচতে শুরু করেছে গাছ,পাতা ,আবর্জনাও। এইসব জায়গায় খুব দরকার ব্লিচিং এর। বিভিন্ন গ্রামে আন্ত্রিকের সমস্যা ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। তাই ক্ষোভ এবং আতঙ্ক বাড়ছে গ্রামবাসীদের মধ্যে। এককথায় রাজ্যের এই উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে যা ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।গ্রামবাসীরা এই ক্ষতির জন্য দায়ী করছেন প্রশাসনকে,তাদের দাবি মাটির নয়,কংক্রিটের বাঁধ হোক।
পরিশেষে বলতে চাই ,দোষ-ত্রুটি কার সেসব না ভেবে এবার ভেবে দেখার সময় এসেছে প্রকৃতির এই রোষানলের জন্য দায়ী আমরাই নই তো? পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোথাও ম্যানগ্রোভ কেটে ভেড়ি বানানো আবার কোথাও ঝাউবন সাফ করে হোটেল ব্যবসার রমরমা -এমন খবর শিরোনামে প্রায়ই দেখা যায়। ঝড়, বন্যা এসেছে, আসছে এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ ও জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনে আবারও হয়তো কয়েকমাস কাটতে না কাটতেই ওরা আবার ত্রাণ শিবিরে আসতে বাধ্য হবে। কিন্তু এই ত্রাণ নিয়েই কি ওদের বাঁচতে হবে? ওখানকার মানুষদের কি প্রতিটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে মাটি কামড়ে একফোঁটা জলের আশায় পড়ে থাকতে হবে? লাখ লাখ সুন্দরবনবাসীর ভবিষ্যৎ আজ কত বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তা ইয়াসের পরবর্তী সময়ে নিজে চোখের সামনে না দেখলে অনুভব করতে পারতাম না।