বাঙালির গান (পর্ব ১০)
পার্থসারথি সরকার ##
আখড়াই ও হাফ আখড়াই:
বাঙালি জীবন চিরকালই গানসর্বস্ব। তাই গীতরচনা যেন তার এক ধরণের কুলধর্ম। ধর্মীয় উপাঙ্গ হিসাবে সে বেছে নিয়েছে গানের রচনা, যদিও ধর্মকর্ম-ব্যতীত শুধুমাত্র নিটোল আনন্দ পরিবেশনের জন্যও গানের ব্যবহার এদেশে হয়ে এসেছে বহুকাল ধ’রে; আর এক্ষেত্রে একদিকে যেমন মার্গরীতি-অনুযায়ী গানের চর্চা চলে আসছিল তেমনি অন্য ধারায় চলে আসছিল লোকসঙ্গীতের একটি সুষ্ঠু সাবলীল ধারাও। ‘চর্যাপদে’ যে বাংলা গানের শুরু সেই গান পলাশী যুদ্ধের কালে যখন এসে একাধিক বিশিষ্ট ধারায় প্রবাহিত হ’য়ে গেল। যদিও মুঘল-শাসনের অবসানকালে মানুষের চরিত্র, আদর্শ ও উপলব্ধির ক্ষেত্রেও এক হানিকর অবনমনের স্পষ্ট চিত্র লক্ষ করা যায়। এর ফলে “এই সমস্ত শাক্ত পদাবলীর স্নেহসিক্ত মর্ত্যমাধুরী নাগরিক সংস্কৃতিতে তার স্বাভাবিক স্থান থেকে বঞ্চিত হ’ল। গানের ধারা ক্ষীণ হল না বটে, কিন্তু সাদাসুরে গাওয়া প্রাণের অনাবিল আনন্দ-বেদনার সুরটি ক্রমে ক্রমে কলাবত রাগরাগিণীর কন্ঠবাদনে কিছু ম্লান হয়ে পড়ল।” এল নতুন যুগ, নতুন রাজধানী, নতুন মানুষ। সময়ের আবর্তনে শান্তিপুর যেমন এককালে সংস্কৃতির পটভূমি হয়ে উঠল, সেখান থেকে পরবর্তীতে ক্রমে তার স্থান নিল কল্লোলিনী কলকাতা। এই বদলের ইতিহাসের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে গান নাগরিক ও নাগরিক হয়ে ওঠা মনকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল, আর এই প্রেক্ষাপটেই যে সংগীত স্বমহিমায় প্রধান হয়ে সামনে উঠে এল তা হ’ল আখড়াই ও হাফ আখড়াই গান।
আখড়াই গানের উৎস নির্নয় করতে গিয়ে কেউ কেউ ‘আখড়’ শব্দের উৎপত্তি হিসাবে সংস্কৃত অক্ষবাট শব্দকে চিহ্নিত করলেন। তাঁদের মতে, সংস্কৃত ‘অক্ষবাট’ প্রাকৃত ‘অক্খবাড়’ হয়ে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক বাংলায় আখড়া (উচ্চারণভেদে আকড়া, আখরা)-তে রূপান্তরিত হয়েছে, হিন্দীতে তা ‘অখাড়া’ নামে পরিচিত হয়েছে। আখড়াই, হাফ-আখড়াই কবিগান, দাঁড়াকবি ইত্যাদি যে-সকল গান সে সময়ের কলকাতাকে বিনোদনে ভাসিয়ে দিয়েছিল, এ সবই একই গোত্রে আবির্ভূত হ’লেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম গোত্রান্তর দেখা যায়। কাগজে লেখা প্রচলন থাকলেও আখড়াই-প্রমুখ গানে সবচেয়ে প্রাধান্য পেতো গায়কের কন্ঠ। পাশাপাশি গায়কের শ্রুতি স্মৃতিই এই গীতের প্রধান আশ্রয়স্থল ছিল। ফলত, উপযুক্ত গায়ক-শ্রোতার মেলবন্ধন না হ’লে আখড়াই তার মাধুর্য্য হারাতো; আবার এ গীত ছিল পুরোদস্তুর মার্গরীতি অনুযায়ী গান এবং অত্যন্ত কঠিন গায়কিপদ্ধতির বৈঠকি সংগীত। এই দ্বৈতকারণেই ক্রমে গায়ক এবং শ্রোতা দুপক্ষই এই গীতের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে এবং আখড়াই গানের ক্রমাপসারণ এবং তৎপরে জন্ম নিল হাফ আখড়াই সঙ্গীত—যা অনেকখানি সহজ গায়নপদ্ধতি অনুসরণ করে।
‘হাফ-আখড়াই সঙ্গীত সংগ্রামের ইতিহাস’ (১৩২৬ বঙ্গাব্দ)-প্রণেতা গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর ভট্টাচার্যকে অনুসরণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, এই আখড়াই-সংগীত-সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ৮৭১ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৪৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে, শ্রীচৈতন্য আবির্ভাবের প্রায় বাইশ বৎসর পূর্বে। ‘স্বর্ণ’ নদী তীরস্থ যশোর জেলার ভাটকলাগাছি গ্রামে ওই বছর রথযাত্রার দিন যবন হরিদাস অনুচরদের দুদলে বিভক্ত ক’রে ‘সংগীত সংগ্রাম’ শুরু করেন। পরবর্তীতে সঙ্গীদেরকে নিয়ে হরিদাস যশোরের বেত্রবতী নদীতীরে নতুন আখড়া স্থাপন করেন। এরপর তাঁর গন্তব্য সপ্তগ্রামের নিকট চাঁদপুর গ্রাম। ওই চাঁদপুর গ্রামেই রঘুনাথ দাস, বলরাম আচার্য, গোবর্ধন, হিরণ্যবর্ধন, শ্রীবাসকে সংগীত সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। সেখান থেকে তিনি যান ফুলিয়া গ্রামে। সেখানে মুখুটি পরিবারের সহযোগিতায় ফুলিয়াতে এবং অদ্বৈত আচার্যের সাহায্যে শান্তিপুরে আখড়াই সংগীতের কেন্দ্র স্থাপন করেন। মুখুটি বংশের গদাধর পন্ডিত এবং শান্তিপুরের গদাধর আচার্য এই দুইজন দুই আখড়ার আখড়াধারী হন। এঁরা নাকি দরজা বন্ধ ক’রে আখড়াই গান অভাস করতেন, যা পরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত। শ্রীচৈতন্যও এঁদের কাছাকাছি ছিলেন এবং শ্রীচৈতন্য-কর্তৃক এঁদের দলের গাওনরীতি অনেকখানি পরিমার্জিত হয়।
শ্রীচৈতন্য-মার্জিত গাওনধারা পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়, এবং রুচিভ্রষ্টতার জন্য আখড়াই গান থেকে চৈতন্যভাব অন্তর্হিত হয়ে যায়। এই পরিবর্তিত যে আখড়াই গানের ক্রমাগত অনুশীলন, সেক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যায়ে শান্তিপুরই এই বৈষ্ণব ভাব বর্জিত আখড়াই সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত হ’তে শুরু করে; কিন্তু ভাগীরথী ক্রমশ ক্ষীণ হতে শুরু করলে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে সপ্তগ্রামের বিকল্প বাছার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এমতাবস্থায় সপ্তগ্রাম থেকে বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলী-চুঁচুড়ায় স’রে আসল পর্তুগীজদের সৌজন্যে। পরে আরো নীচে কলকাতাই বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালে সহচর সংগীতও ক্রমে কলকাতায় নিজের আসন পাতল। কলকাতা তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। কলকাতাবাসী ধনীদের গৃহে-গৃহে বিবাহাদি আমোদ-আহ্লাদের ক্ষেত্রে সংগীতের আহ্বান অনিবার্য হয়ে পড়ল। এই সকল ধনাঢ্য মানুষের অনেকের পৃষ্ঠপোষকতায় আখড়াই গানের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠপোষণকারীদের রুচির সঙ্গে তাল রেখে ক্রমশই আখড়াই গানের প্রকৃতিরও পরিবর্তন হ’তে শুরু করল।
তবে ঈশ্বর গুপ্ত সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন যে, শান্তিপুরই হল আখড়াই গানের উৎসভূমি। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’র অন্তর্গত ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ বিদ্যা তার গৃহগমনাভিলাষী স্বামীকে বর্ধমানে আটকে রাখার জন্য লোভ দেখিয়েছিলেন—‘নদে শান্তিপুর হতে খেঁড়ু আনাইব/ নুতন নূতন ঠাটে খেঁড়ু শুনাইব।।’ ঈশ্বর গুপ্তের মতানুযায়ী, শান্তিপুরের ভদ্র সন্তানরাই সর্বপ্রথম আখড়াই গানের সূত্রপাত করেন। শান্তিপুরে সৃষ্ট আখড়াই গানের ছিল শুধু ‘তুক’ বা কলি—খেউড় ও প্রভাতী। খেউড়ের বিষয় ছিল আদিরসে পূর্ণ কুরুচির গান আর প্রভাতীর বিষয় ছিল নায়কের অনুপস্থিতিতে নায়িকার মানভঙ্গজাত বিলাপ (খণ্ডিতা)। শান্তিপুর থেকে আখড়াই গান যখন হুগলি-চুঁচুড়ায় সম্প্রসারিত হয়, তখন এর আকার প্রকার পাল্টে যায়—এখান থেকেই সুরু হয় আখড়াই গানের দ্বিতীয় পর্যায়। নূতন কবিদের হাতে আখড়াই গান হয়ে উঠল—ভবানীবিষয়ক, খেউড় ও প্রভাতী। ভবানীবিষয়কে শ্রীদুর্গা-বন্দনা, খেউড়ে আদিরসের গান এবং নিশিজাগরণের বিষণ্ণতায় সমাপ্ত গান। এই গানের গায়কগণ তাঁদের সংগীতে বহু বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন, মায় হাঁড়ি-কলসী পর্যন্ত। অনেকে মনে করেন এঁরা বাইশ রকম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন এবং এইজন্য সংগীত রসিকেরা এঁদেরকে ‘বাইশেরা’ ব’লে ডাকতেন। চুঁচুড়ার দলের পাশাপাশি সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে কলকাতায় কয়েকটি পেশাদার আখড়াই দলের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা বেশ কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তির আনুকূল্য পেতেন। উত্তর কলকাতার হালসিবাগান ছিল এঁদের সংগীতযুদ্ধের ক্ষেত্র—এটিই আখড়াই গানের তৃতীয় পর্যায়। এই তৃতীয় পর্যায়ের রচনায় ঈশ্বর গুপ্তের বর্ণনায় বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। এই পর্যায়ের বিস্তৃতি ছিল খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত। বৈষ্ণবদাস, রামজয় সেন, রসিকচাঁদ গোস্বামী, ‘ন্যাটা’ বলাই প্রভৃতি এই পর্যায়ের প্রতিনিধিস্থানীয় সংগীত ব্যক্তিত্ব। শৌখিন আখড়াই গান যথার্থ নতুন পরিবর্তনের সামনে এসে দাঁড়াল তখন নিধুবাবুর সম্পর্কে মাতুল অথবা মাতুলপুত্র কুলুইচন্দ্র সেন এই গানের উন্নতির জন্য এগিয়ে এলেন। কুলুইচন্দ্র নিজে ছিলেন প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ। শোভাবাজারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চতর গায়নরীতির সহায়তায় তিনি আখড়াই গানকে এক নতুন মর্যাদায় স্থাপন করলেন। কুলুইচন্দ্রের হাতে আখড়াই গানের এই পরিবর্তনসাধন ঘটে গেল খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেই; আর এই পর্বই হল আখড়াই গানের চতুর্থ পর্যায়। কুলুইচন্দ্র আখড়াই গানকে নতুনভাবে সাজিয়েছিলেন। তিনি এই গানের মধ্যে নানাপ্রকার শাস্ত্রীয় রাগ-তালের প্রয়োগ করেন এবং বহুবিধ বাদ্যযন্ত্রের মেলক তৈরী ক’রে আখড়াই গানকে প্রকৃতই বৈঠকী গানে রূপান্তরিত করেন। এর ফলে আখড়াই গান টপ্পা-ঠুংরির মতই অভিজাত-শ্রেণির পর্যায়ে উন্নীত হয় রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবুর হাতে এই গানের অনেকাংশ মার্জিত হয় এবং সেই রীতিই প্রচলিত হয়, যা চূড়ান্ত রূপলাভ করে কুলুইচন্দ্রের প্রবর্তনায়। এই গানের মূল বাদ্যযন্ত্র ছিল ঢোল এবং বেহালা। এছাড়াও কুলুইচন্দ্র এর সঙ্গে খরতাল, জলতরঙ্গ, তানপুরা, বীণা, বেণু, মন্দিরা, মোচঙ্গ, সপ্তস্বরা, সিটি, সেতার প্রভৃতি বাইশটি যন্ত্রের ব্যবহার করেন।
আখড়াই সংগীতের ক্ষেত্রে সভায় মুখোমুখি দুই দল উপস্থিত হতেন, এরপর প্রথম দল একটি ভবানী বিষয়ক গান বা দুর্গাস্তোত্র গাইতেন। এই গানে প্রথমে ত্রিপদীতে মুখড়া গাওয়া হত এবং তারপরের দুটিতে ‘পাড়ঙ্গ’ বা ‘অন্তরা’ গাইবার চল ছিল। এখানে আখড়াই-গায়ক, যিনি হতেন মূলত কবি তিনি প্রথমে আদ্যাশক্তিকে স্মরণ ক’রে দেবীর প্রতি তাঁর প্রণাম নিবেদন করতেন এবং তাঁর কৃপায় যাতে ভবসমুদ্র পার হ’তে পারেন এই মর্মে প্রার্থনা জানাতেন। ভবানীবিষয়ক গানের পরেই আসত খেউড় গান। খেউড়ের যথার্থ উৎপত্তি যথাথভাবে অনুধাবন করা বিতর্কিত এবং দুঃসাধ্য। এর মধ্যে অশ্লীল ভাবের প্রাধান্য ছিল। খেউড়ের মধ্যে ছিল দুটি ক’রে পয়ার; এবং এখানেও মহড়া, চিতেন ও পরচিতেন বা পাড়ঙ্গ থাকত। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের মৃত্যুর পরে আখড়াই গানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মূলত তিন জন। এঁদের মধ্যে একজন হলেন নবকৃষ্ণের পুত্র মহারাজ রাজকৃষ্ণ শ্রীদাম দাস এবং অন্য দুজন রাম ঠাকুর এবং নসিরাম। ১৮০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে নিধুবাবুর নেতৃত্বে কলকাতায় দুটি সখের আখড়াই দলের আবির্ভাব ঘটে। এই দলের একদিকে ছিলেন বাগবাজার ও শোভাবাজারের সংগীত রসিক ব্যক্তিরা এবং অন্যদলে মনসাতলা ও পাথুরিয়াঘাটার সংগীত-রসিকেরা। নিধুবাবু স্বয়ং বাগবাজারের দলের পক্ষ নেন এবং পাথুরিয়াঘাটার দলের নেতৃত্ব সেন শ্রীদাম দাস। এরপরে ক্রমে পেশাদারি গানের স্থলে সখের আখড়াই গানের শ্রীবৃদ্ধি শুরু হয়। এসময় পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ি, জোড়াসাঁকোর সিংহবাড়ি, গরাণহাটার বসাক-পরিবার, শোভাবাজারের ঘোষ-পরিবার এবং শ্যামপুকুর-অঞ্চলের বেশ কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তি এইধরণের আখড়াই গানের দল খোলেন।
মোহনচাঁদ ছিলেন নিধুবাবুর সুযোগ্য শিষ্য। অসাধারণ প্রতিভাধর এবং দূরদৃষ্টির অধিকারী মোহনচাঁদ আখড়াই গানের দুরূহতা উপলব্ধি করেছিলেন, আর সেই কারণেই তিনি আখড়াই গানের পরিবর্তে দাঁড়াকবি গানের মতো হাফ-আখড়াই গানের প্রবর্তন করেন। আসলে আখড়াই গানের গায়নপদ্ধতি অত্যন্ত জটিল, এর সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য অন্তত ছয় মাসের অনুশীলন প্রয়োজন ছিল। এখানে যন্ত্রব্যবহারের জটিলতাও ছিল। এ সময় কলকাতাও ক্রমে নানারূপ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে নবরূপে সেজে উঠেছিল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে কলকাতায় আসতে শুরু করলো বহু লোক, যারা সুরের সূক্ষ্মতার দিকে যেতে পারত না। এখানে বহু জাতির সংমিশ্রণও ঘটতে শুরু করেছে যার ফলে আখড়াইয়ের রস উপলব্ধিতে ভাটার টানও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের দিকেই আখড়াই গান মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। এই গান শেষবারের মতো বেঁচে ওঠার চেষ্টা করে শ্যামপুকুরের যুবকদের মধ্যে দিয়ে, কিন্তু এ-প্রয়াস সার্থক হয়ে ওঠেনি। নতুন যুগের আগমনে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা চলছে, সেখানে পুরানোকে তো বিদায় নিতেই হবে। এ বিষয়ে হুতোমের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ—“পাঠক! নবাবী আমল শীতকালের সূর্য্যের মত অস্ত গ্যালো। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরাজদের প্রতাপ বেড়ে উঠ্লো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নব মুনসী, ছিরে বেণে, ও পুঁটে তেলি রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আশা-সোটা ও রাজা খেতাপ ইন্ডিয়া রবরের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মত রাস্তায়, পাঁদাড়ে ও ভাগাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগ্লো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎ শেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগ্লো, তাই দেখে হিন্দুধর্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার ও নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো। হাফ আখ্ড়াই, ফুল আকড়াই, পাঁচালি ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্লে।”
হাফ আখড়াই গানের প্রবর্তক হিসাবে মোহনচাঁদ বসুকে কেউ কেউ মানতে নারাজ, তাঁদের মতে মোহনচাঁদ আখড়াই গানে নিযুক্ত থেকেও দাঁড়াকবির গানের প্রতি বেশি উৎসাহী ছিলেন। এই সময়েই পাথুরিয়াঘাটার রামলোচন বসাক এবং জোড়াসাঁকোর রামচাঁদ মুখোপাধ্যায় দাঁড়াকবির গানে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন এবং মোহনচাঁদের পূর্বে এঁরাই হাফ-আখড়াই গানের প্রচলন করেন। যদিও ঈশ্বর গুপ্ত এই মতকে অস্বীকার করেন এবং হাফ-আখড়াইয়ের প্রবর্তক হিসাবে মোহনচাঁদকেই স্বীকৃতি দেন। তবে একথা ঠিক যে নিধুবাবুর শিষ্য মোহনচাঁদ দাঁড়াকবির গানের প্রতি বিশেষ আসক্ত ছিলেন এবং সেখান থেকে প্রেরণা নিয়েই তিনি হাফ-আখড়াই গানের প্রচলন করেন। মোহনচাঁদ বাস্তব পরিবেশের দিকে লক্ষ্য রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজে দাঁড়াকবির আদর্শই ক্রমে গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মোহনচাঁদ আখড়াই ভেঙে দাঁড়াকবির উত্তর প্রত্যুত্ত-মূলক হাফআখড়াই তৈরী করেন। এই কাজে নিধুবাবু মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না; তাই মোহনচাঁদ বসু স্বকন্ঠে গুরুকে হাফ আখড়াই গেয়ে শান্ত করেন এবং এ গান গাইবার অনুমতি চেয়ে নেন। এর পরে নিধুবাবু আরো সাত বছর বেঁচে ছিলেন; কিন্তু তখন আখড়াই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে আর সেখানে জায়গা করে নিয়েছে দাঁড়াকবি, পেশাদারি কবির আখড়াই গান।
হাফ আখড়াইয়ের এই জনপ্রিয়তা কিন্তু খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই সেখানে ভাঁটার টান শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বভবতই সেখানে নতুন বৈচিত্র্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং এদিকে লক্ষ্য রেখে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে মদনমোহন মৈত্রের বাড়িতে হাফ-আখড়াই গানের আসর অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিধবাবিবাহকে সামনে রেখে। এইরকম সমাজসমস্যামূলক বিষয় পাঁচালি ভিন্ন অন্য কোন সংগীতকলায় স্থান পায়নি। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে কার্তিকপূজার রাত্রিতে অনুষ্ঠিত হাফ-আখড়াই গানের আসরে গান রচনা করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত এবং সুরারোপ করেছিলেন মোহনচাঁদ বসু। এই অনুষ্ঠান হয়েছিল জোড়াসাঁকোস্থিত নবকুমার ও শ্যামাচরণ মল্লিকের বাটীতে। নিধুবাবুর সম্মতি পাবার পর মোহনচাঁদ বসু বাগবাজারের দলের হয়ে গান রচনা ও সুর সংযোগ ক’রে শিষ্টসমাজে পেশ করেন এবং এর পর থেকে ক্রমে ক্রমে এই গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। মোহনচাঁদের মৃত্যুর পরে মনোমোহন বসু হাফ আখড়াই গানের জনপ্রিয়তা ধ’রে রাখতে সচেষ্ট হন। রামচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে গোবিন্দ কর্মকার, গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়, নবকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্র বড়াল, ত্রৈলোক্যনাথ লাহার উদ্যোগে দ্বিতীয়বারের জন্য জোড়াসাঁকোর দল তৈরি হয়। ১২৭২ বঙ্গাব্দে কাঁসারীপাড়ার দলের উৎপত্তি হয় এবং ১২৮০ বঙ্গাব্দে জোড়াসাঁকোর সঙ্গে কাঁসারীপাড়ার পাথুরিয়াঘাটার যদুনাথ মল্লিকের বাড়িতে তুমুল সংগীত সংগ্রাম হয়।
বাংলা গানের গঠনে দেখি প্রাচীন ধ্রুপদ গানে চারটি তুক বা কলি থাকে। এগুলি হল—আস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। পরবর্তীকালে খেয়াল ও টপ্পায় শুধু দুটি ‘তুক’ আস্থায়ী ও অন্তরায় গান সমাপ্ত হত। বাংলা আখড়াই গানে তিনটি পর্ব ছিল—ভবানীবিষয়ক, খেউড় ও প্রভাতী এবং প্রতিটি পর্বে মহড়া, চিতেন ও অন্তরা এই তিনটি গায়নপদ্ধতি অনুসৃত হ’ত। হাফ-আখড়াই গানে যে রঙ্গরসিকতার বাহুল্য ছিল তার অনেকখানি পরিচয় ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’ থেকে পাওয়া যায়—“ এই সময়ে হাফ আখড়াই ও ফুল আখড়াই সৃষ্টি হয় ও সেই অবধি সহরের বড় মানুষরা হাফ আখ্ড়াইয়ে আমোদ কত্তে লাগ্লেন। শ্যামবাজার রামবাজার চক ও সাঁকোর বড় বড় নিষ্কর্মা বাবুরো এক এক হাফ আখ্ড়াই দলের মুরুব্বী হলেন। মোসাহেব, উমেদার, পাড়া ও দলস্থ গেরস্ত গোছ হাড় হাবাতেরা শৌখিন দোহারের দলে মিশলেন। অনেকের হাফ আখ্ড়াইয়ের পুণ্যে চাকরী জুটে গ্যালো। অনেকে পূজারী দাদা ঠাকুরের অবস্থা থেকে একেবারে আমীর হয়ে পড়্লেন—কিছুদিনের মধ্যে তক্মা, বাগান, জুড়ী ও বালাখানা বনে গ্যালো!”
মোহনচাঁদের হাতে যে হাফ-আখড়াইয়ের জন্ম খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে হয়েছিল তার রেশ ছিল ঐ শতাব্দীর অষ্টম-নবম দশক পর্যন্ত। হাফ-আখড়াইতে দু-দলের গাওনা এবং বাজনা বিচার করে উৎকৃষ্ট দলকে জয়পতাকা দেওয়া হ’ত; যদিও এখানে কোনো উত্তর-প্রত্যুত্তরের রীতি প্রচলিত ছিল না। ধীরে ধীরে এই গানে খেউড়ের মতো রুচিবিকার প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে গান তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। বিশ শতকেও এই গানের অনুষ্ঠান দু একবার হয়েছে, কিন্তু তা ক্রমেই বিলুপ্তির অন্তরালে চলে যায়।