বাঙালির গান (পর্ব ৬)

পার্থসারথি সরকার ##

পাঁচালিগান:

পাঁচালি শব্দের উৎপত্তি পাঞ্চালিকা বা পাঞ্চালি শব্দ থেকে বলে মনে করে পণ্ডিতরা এর বুৎপত্তি নির্দেশে তৎপর হয়েছেন। অলংকারশাস্ত্রে এই শব্দদ্বয়ের উল্লেখ আছে। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে মত দিয়েছেন যে, পাঞ্চাল দেশ থেকে আনীত গানবাজনার রীতি দেশিয় গান ও কাব্যধারায় ব্যবহৃত হয়েছিল—যার সঙ্গে পাঁচালির অনেকখানি সাদৃশ্য আছে। পাঞ্চালদেশে প্রচলিত পাঞ্চালি মূলত তৎকালে প্রচলিত চার প্রকার ক্ষুদ্র নৃত্যের একটি। রাধা ও শ্রীকৃষ্ণের আদিরসাত্মক লীলা নিয়ে গোপীদেরর কণ্ঠে যে হালকা চালের গানের প্রচলন ছিল, তাকেই বোধহয় পাঞ্চালি বলা হত। কিন্তু পাঁচালি বলে মধ্যযুগে যাকে বোঝান হত সেখানে বিষমধ্রুবা, মঙ্গলকাব্য, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি ছিল। কিন্তু উক্ত উদাহরণগুলিতে শুধুমাত্র গান নয়, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুর করে পয়ার আবৃত্তির জনপ্রিয় প্রচলন ছিল। তাই ক্ষুদ্র গীত থেকে পাঁচালির উৎপত্তি সম্ভব নয়। আবার সংস্কৃত পাঞ্চালিকার আভিধানিক অর্থ হল পুতুল, তাই পুতুলনাচের সঙ্গে ড. সুকুমার সেন পাঁচালিকে যোগ করতে চান, কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে সে মতকে গ্রহণ করতে অসুবিধা আছে। কেউ কেউ পাঁচমেশালি কিংবা পাঁচইয়ারি ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত করে তাকে মিলেমিশে গাওয়া বা পাঁচজনে গাইতে হত বলে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ ‘পদচারণা’ থেকে পায়চারি বা পাঁচালি হিসাবে ধরতে চেয়েছেন। তথাপি এ নিছক অনুমাননির্ভর তথ্য—এর কোন যথাযথ প্রমাণ নেই।

        মধ্যযুগে বাংলা কাব্যের রচনার তিনটি রীতি বর্তমান ছিল—আখ্যানরীতি, গীতিরীতি ও পাঠরীতি। আখ্যানরীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল অনুবাদ সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্য। গীতরীতির অন্তর্ভূক্ত ছিল পদাবলী সাহিত্য এবং পাঠরীতির মধ্যে ছিল বৈষ্ণব জীবনীকাব্যের তত্ত্বগ্রন্থ—যা মূলত পাঠের উদ্দেশ্যে রচিত হত, যদিও এর মধ্যে রাগতালযুক্ত গানও থাকত। এই তিন রীতির মধ্যে আখ্যানরীতি অবলম্বনকারী অর্থাৎ অনুবাদ-সাহিত্য ও আখ্যানকাব্যকে ‘পাঁচালি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

       পাঁচালিতে স্বতঃই নাট্যলক্ষণ রক্ষিত হয়, আর তাই পাঁচালিগান এককালে শ্রোতাদের কাব্য ও ভক্তিরস পরিতৃপ্ত করতে ভূমিকাগ্রহণ করেছিল অনেকখানি। মূল গায়ক ও দোহারের মিলনে পাঁচালিগান চামর, মন্দিরা ও নূপুর সহযোগে গীত হ’ত। ড. সুকুমার সেন এবং শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় পাঁচালিগানের এক নিপুন বর্ণনা দিয়েছেন। পুরানো পাঁচালির ধারাকে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন—সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী ধারা, সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীর ধারা, অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দীর ধারা ইত্যাদি। প্রথম পর্যায়ে পাঁচালির কোন সুগঠিত দল ছিল না। রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, মঙ্গলকাব্যসমূহ সহজ সুরে পরিবেশিত হ’ত। একে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন কেউ কেউ। পরবর্তীতে পাঁচালি দল প্রস্তুত হয় এবং বড় বড় অনুষ্ঠানে দল বেঁধে এই গান পরিবেশিত হতে থাকে। ক্রমে এর মধ্যে পরিবর্তন আসে এবং তা চলে তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রাক্‌ দাশরথি রায় পর্যন্ত। এ যুগ সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না।

       পাঁচালিকে জনপ্রিয় করে তোলায় দাশরথি রায়ের কৃতিত্ব অনেকটা। তবে তার সূচনা তৎপূর্বেই হয়েছিল—ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময়কালকেই পাঁচালিগানের চতুর্থ পর্ব হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনবিংশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত পাঁচালি স্বতন্ত্র শ্রেণিরূপে গণ্য করা হ’ত। এ যুগের দুজন বিখ্যাত পাঁচালির রচয়িতা ছিলেন গঙ্গানারারণ নস্কর ও লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস। গঙ্গানারায়ণের নিবাস ছিল কলকাতার শোভাবাজার এবং তিনি জাতিতে ছিলেন ব্রাহ্মণ। ড. সুশীলকুমার দে তাঁকে নব্য পাঁচালির শ্রষ্টা হিসাবে দেখিয়েছেন। তিনি পক্ষীর দলের সঙ্গে পাঁচালিগানের প্রতিযোগিতা চালাতেন, তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও তাঁর কোন পুঁথি পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে লক্ষ্মীকান্ত জাতিতে ছিলেন কায়স্থ, জন্মেছিলেন কলকাতার ঠনঠনিয়া অঞ্চলে। তিনি পেশাদারি দল করেন এবং কলকাতা ও কলকাতার বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। ওস্তাদি গানে দক্ষ লক্ষীকান্ত খেয়াল, ধ্রুপদ ভেঙে নব্য পাঁচালির সুর প্রস্তুত করেছিলেন। তাঁর এই রীতি পরবর্তীতে অনুসৃত হয়েছিল। তাঁর রচনায় প্রথম আধুনিক পাঁচালির পূর্ণরূপের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর পাশা  ও ঘুড়ির উপরে রচনা থাকলেও ঈশ্বর গুপ্ত কেবলমাত্র ‘শতরঞ্চের পাঁচালী’-ই কিয়দংশে সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। মধ্যযুগের দেবমাহাত্ম্যের খোলস ছেড়ে বাস্তব ধরণের পাঁচালির সূচনা যে দাশরথির পূর্ব থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ এখান থেকেই পাওয়া যায়। গঙ্গানারায়ণ-লক্ষীকান্ত ছাড়াও পাঁচালিকার ঠাকুরদাস দত্ত হাওড়ার ব্যাঁটরা অঞ্চলে বিখ্যাত ছিলেন। যাত্রায় তাঁর সুনাম থাকলেও তিনি পাঁচালি রচনা করে ‘পাঁচালীওয়ালা ঠাকুরদাস’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পাঁচালি গান বিশুদ্ধ মার্গরীতি অনুসারী ছিল। তিনি মূলত পৌরাণিক পাঁচালিকার হলেও স্থানে স্থানে লৌকিক উপাদানও গ্রহণ করেছিলেন।

       নব্য পাঁচালিগানের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী হলেন দাশরথি রায়। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে বাঁধমুড়া গ্রামে। যদিও মাতুলালয় পীলা গ্রামেই তিনি বড়ো হয়ে ওঠেন। পিতা দেবীপ্রসাদ এবং মা ছিলেন শ্রীমতি দেবী। বাল্যে পাঠশালায় ‘সর্দার পোড়ো’ থাকলেও তাঁর পুঁথিগত বিদ্যা তেমন ছিল না। লোকমুখে পৌরাণিক পালাকাহিনি শুনে তাকে তিনি রূপদান করেন বলে জনশ্রুতি আছে। পীলাগ্রামে থাকার সময় হরিকিশোর ভট্টাচার্যর কাছে তিনি ইংরাজী শেখেন যার কিছু কিছু প্রয়োগ তাঁর গানে দেখতে পাওয়া যায়। পীলা গ্রামের নীলকণ্ঠ হালদার অশ্লীল কুবাচ্যে মেতে ছিলেন যাকে প্রতিহত করার জন্য দাশরথি উৎসাহী হন এবং এই সময়েই তিনি অক্ষয়া বাইতিনীর দলে যোগদান করেন। ক্রমে আকাবাইয়ের সঙ্গে বাস করতে থাকেন। এখানে বাঁধনদার হবার পর থেকে তাঁর স্বাধীন রচনাশক্তির বিকাশ শুরু হয়। কিন্তু কবির লড়াইয়ে একদিন তাঁর বংশগৌরব ভুলুণ্ঠিত হওয়ায় তিনি সে দল ত্যাগ করেন এবং চলে আসেন কলকাতায়।

       কলকাতায় সেই সময় কবিগানের সভা জমজমাট হয়ে থাকলেও পাঁচালিগান ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। দাশরথি অনুপ্রাণিত হয়ে পাঁচালির দল খুললেন। পূর্বানুশীলিত কবিগানের শিক্ষাকে পাঁচালির দলের মধ্যে প্রবিষ্ট করালেন। প্রথমদিকে তাঁর গানে কবিগানের প্রভাব বেশী থাকলেও পরবর্তীতে তা খানিকটা কাটিয়ে ওঠেন, তবে কৌশল ও কুরুচির মোহ পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি নিজে পাঁচালির দল খোলেন এবং পরবর্তী বাইশ বৎসর সেই দল চালিয়ে নিয়ে যান—এতে তাঁর আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে এবং গৌরববৃদ্ধি হয়। ১৮৩৯ খ্রিস্টব্দের রাসপূর্ণিমায় তাঁর গাওনা আসে নবদ্বীপ থেকে। দাশরথি কনিষ্ঠ ভ্রাতা তিনকড়িকে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতায় পাঁচালির মহড়া করলেন। নিখুঁত বাদ্যযন্ত্রাদির ব্যবস্থা ও সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে তাঁর গান পণ্ডিতসমাজকে প্রসন্ন করল। দাশরথির পাঁচালি গানের বঙ্গে ব্যাপকভাবে প্রচলন হলেও কলকাতায় টপ্পা, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, মজলিসি গানের শ্রোতারাও এতে তেমন রস খুঁজে পাননি।

       ধর্মমতের দিক থেকে দাশরথি রায় ছিলেন উদার। ধর্মসমন্বয়কে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। যদিও তাঁর দ্বারা পাঁচালি পরিবেশনকালে বৈরাগী ও কর্তাভজারা বিদ্রুপের পাত্র হয়েছেন বারবার। সমসাময়িক বিষয়সমূহ তাঁর গানে স্থান করে নিয়েছে অনেকটা। যদিও কলকাতা থেকে দূরে থাকার কারণেই হয়তো তাঁর গানে আধুনিকতার খারাপ দিকটাই বড়ো করে দেখা দিয়েছে—ভাষাও সবক্ষেত্রে শালীনতার মাত্রা বজায় রাখতে পারেনি।

       পাঁচালি ও যাত্রাগানের জীবিকানির্বাহ করায় দাশরথি রায়ের জীবনযাত্রা-প্রণালী তাঁকে সুস্থ থাকতে দেয়নি। শেষজীবনে তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগেছিলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশিমবাজারে দুর্গাপূজা উপলক্ষে গাওনা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। দাশরথির মৃত্যুর পর তিনকড়ি তাঁর দলের হাল ধরলেও সে দল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দাশরথি জীবৎকালে তাঁর রচনাগুলি বহরা গ্রামের মুদ্রণযন্ত্র থেকে পাঁচখণ্ডে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বহুবার তাঁর পাঁচালির সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের অরুণোদয় রায়ের সম্পাদনায় তিনখণ্ডে তাঁর পাঁচালির বিশুদ্ধতর পাঠ পাওয়া যায়। তাঁর জীবৎকালে পাঁচখণ্ডে ও মৃত্যুর পরবর্তীকালে প্রকাশিত পাঁচ খণ্ড, মোট দশখণ্ডে তাঁর পালা সংখ্যা চৌষট্টি। এ-বিষয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন ড. হরিপদ চক্রবর্তী।

       দাশু রায়ের পাঁচালি সম্বন্ধে কিছু শিক্ষিত মানুষ যতই দোষ দেখুক না কেন বাংলার দেড়শত বৎসরের গানের ইতিহাস যে তাঁকে নিয়েই আবর্তিত হয়েছিল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ তো বটেই, সমগ্র সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতসমাজ তাঁর পাঁচালির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ইংরাজী কেতাবী শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরাও তাঁর কাব্যকৃতির প্রশংসা করেছেন। দাশরথির পাঁচালি উপভোগ্য হলেও ত্রুটির ঊর্ধে নয়। আসলে দাশরথির কবিত্বের মুখ্য অংশই হ’ল শব্দের কসরত (বিশেষত অনুপ্রাস অলংকারের)—যা দিয়ে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য স্বাচ্ছন্দ। অনুপ্রাস রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর গানের সহজ সুর এর আকর্ষণের এক মুখ্য কারণ ছিল। শ্যামাসংগীত রচনায় দাশু রায় হঠাৎই ধনিগম্ভীরতার মধ্যে দিয়ে এক আশ্চর্য বৈরাগ্য ও ভক্তিরসের যুগপৎ সম্মিলন ঘটিয়েছেন অসামান্য দক্ষতায়—

‘দোষ কারো নয় গো মা/আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পাঁচালির মধ্যে একটি বিশেষ কালের, বিশেষ একপ্রকার মণ্ডলীর অনুরাগ-বিরাগ, শ্রদ্ধা-বিশ্বাস এবং রুচি-কে দেখতে পেয়েছেন। শব্দের কারিকুরিতে অসামান্য দাশরথি রায় অনেকক্ষেত্রে মাত্রারক্ষা, অলংকার ইত্যাদিতে সমতা রক্ষা করতে পারতেন না—আসলে সেই অপূর্ণতা গানের সুরে ও সুরেলা আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে তার খামতি মিটে যেত।

দাশরথি রায় পরবর্তী পাঁচালি:

দাশরথি রায়ের পরবর্তী পাঁচালিকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রসিকচন্দ্র রায়, ব্রজমোহন বসু, ব্রজমোহন রায়, কৃষ্ণধন বসু প্রমুখ ব্যক্তিগণ। রসিকচন্দ্র রায় হুগলির পালাড়া গ্রামে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘হরিভক্তিচন্দ্রিকা’, ‘বৈষ্ণব মনোরঞ্জনে’র মতো অনেকগুলি কাব্য রচনা করেন। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ সমর্থনে তিনি ‘কুলীন কুলাচার’ নামে শ্লেষকাব্য প্রণয়ন করেন। বন্ধু দাশরথির প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি পাঁচালি সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রাচীনপন্থী হ’লেও মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘হরিভক্তিচন্দ্রিকা’-তে তার প্রয়োগ ঘটান। তবে তাঁর পাঁচালিতে সর্বাধিক প্রভাব ছিল দাশরথি রায়ের—তাঁর ভাষা প্রয়োগ, প্রতীক ব্যবহার সব ক্ষেত্রেই।

       ব্রজমোহন রায় ছিলেন দাশরথি-পরবর্তী অন্য একজন বিশিষ্ট পাঁচালিকার। দাশু রায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্রজমোহন পাঁচালি রচনা করেন। ঠাকুরদাস দত্ত তাঁর পাঁচালিতে যে কথকথার ঢং আমদানী করেছিলেন ব্রজমোহন তাই ‘ঋতুসংহার’-এ তা প্রয়োগ করেন। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্য করেছেন যে, খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পাঁচালি গাওনায় দুদল কবিগানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে মত্ত হতেন। কৃষ্ণধন রায় এবং নন্দলাল রায়েরাও দাশুর পাঁচালির আদর্শ গ্রহণ ক’রে গান রচনা করে গেছেন।

মনোমোহন বসুর বর্ণনা থেকে পাঁচালির শেষ পর্যায় সম্বন্ধে অনেকখানি ইতিহাস জানতে পারা যায়। খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই নব্য পাঁচালি কবিগানের মতো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি দাশু রায়ের অদর্শে গ্রামবাংলার জনপ্রিয় আবৃত্তি ও সঙ্গীতমূলক পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনিনির্ভর, এবং অন্যটি শহুরে জনপ্রিয় হাফ-আখড়াই ও দাঁড়াকবির নিকট আত্মীয় সখের পাঁচালির ধারা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ছোট জাগুলিয়ার দত্তবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত পাঁচালি-সংগ্রামে মনমোহনের সিমলার দলের বিপক্ষে ছিল বলিকুঁড়া গ্রামের শৌখিন পাঁচালির দল। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে তাঁর দলের সঙ্গে বামুনমূড়া গ্রামের শৌখিন দলের পাঁচালি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে জয়ী হয় সিমলার দল। মনমোহনকৃত সেই ছড়ার কয়েকটি মনমোহন স্বয়ং গানে রূপ দেন এবং তা মুদ্রিত হয় ‘মনমোহন গীতাবলী’তে। এখানে ছড়া ও গদ্য ‘ছুট’ রচিত হলেও ভবানী বিষয়ক ছড়া ঠাঁই পায়নি। মনমোহন গীতরসিক, এক শৌখিন পাঁচালিকার। নব্য পাঁচালিকে নব্য করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। থিয়েটারে জনপ্রিয়তায় ক্রমে পাঁচালি হারিয়ে যায়।

       পাঁচালি ও কবিগানের সংমিশ্রণে খ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে গান পল্লীর ভদ্রেতর সমাজকে মাতিয়ে রাখত তা ‘তর্জা’ হিসাবে পরিচিত। তর্জা মূলত দুই প্রতিপক্ষ গায়কের বাক্‌যুদ্ধ। সম্ভবত মুসলমান সমাজে এর প্রথম প্রচলন হয়। ভোলা ময়রা, হোসেন খাঁ-দের তর্জা থেকে অনুমেয় যে তার সঙ্গে কবিগানের আত্মীয়তা ছিল। বর্তমান সমাজেও এর ভগ্নাংশের হদিস আজও পাওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − six =