বাবুদের বাড়ির পুজো

শুভজিৎ দত্ত, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##

হুগলী জেলার মশাট অঞ্চলের বিশ্বেশ্বরতলা। একসময় এই মশাট বেশ প্রসিদ্ধ জনপদ ছিল।সপ্তদশ শতকের শেষভাগেও এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে কুলকুল রবে বয়ে যেত কৌশিকি নদী (মায়ের কোষ থেকে সৃষ্ট)সুরধনী গঙ্গার সঙ্গে মিলনের জন্য।কিন্তু আজ তার অস্তিত্ব খুঁজেই পাওয়া যায় গ্রামের মধ্যে ছোট ছোট জলাশয়ে মধ্যে।আবার এই মশাটের নামকরণের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় একসময় এই এলাকায় এক বিশাল মোষের হাট বসত।সেই থেকেই এই এলাকার নাম মশাট।তবে আজ গন্তব্য এই এলাকার চাটুজ্যে বাড়িতে।স্থানীয় মানুষেরা এই বাড়িকে বাবু বাড়ি নামেই চেনে।

 বাবু বাড়ি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল বাড়ির সদস্য শ্রী সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। এই পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে।সেখান থেকে এই বংশের পূর্বপুরুষেরা এই এলাকায় এসে কৌশিকি নদীর তীরে বসবাস স্থাপন করেন।ধীরে ধীরে এই এলাকায় ব্যবসা করে নিজেদের সমৃদ্ধি বাড়াতে থাকেন।বর্ধমানরাজ চাঁদমাল বোরার রাজত্বে এই বংশের উপেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি জনাই জমিদারের অধীনে এই এলাকার খাজনা আদায়ের ভার পান।এই জমিদারির জন্যই স্থানীয় মানুষরা বাড়ির সব সদস্যদেরই বাবু নামে ডাকতে শুরু করে।সেই থেকেই এই বাবু বাড়ি।তিনি আরও বলেন এখন আর সেরকম বৈভব না থাকলেও গ্রামের মানুষ এখনও সম্মান করেন আমাদের।তবে ‘বাবু’ ডাকটা শুনলে বেশ অস্বস্তিই হয়।

 শ্রী সমীর চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই জানলাম এই বাড়ির পুজোর ইতিহাস ও রীতি নীতি। তিনি বলেন বাংলা ১০৬৯ বঙ্গাব্দে এই পুজো শুরু হয় মনসার থানে।সেখানেই ১০০ বছর ধরে মায়ের আরাধনার পর ১১৬৯ সনে আমাদের এই ঠাকুরদালানে মায়ের আরাধনা শুরু করেন শ্রী গৌরমোহন চট্টোপাধ্যায়।সেই থেকেই নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে প্রতি বছর এই ঠাকুরদালানেই মায়ের আরাধনা হয়ে আসছে। জন্মাষ্টমীর পরদিন হয় মায়ের কাঠামো পুজো।এরপর ধীরে ধীরে এই ঠাকুরদালানেই মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে ওঠে।একচালার প্রতিমা স্বর্ণালংকারে সজ্জিত।প্রতিপদ থেকেই শুরু হয়ে যায় কল্প। এইদিন থেকে আমিষের কোনো উপকরণ খাওয়া হয় না।শাক্ত মতে পুজো হলেও পাঠাবলীর রীতি আজ আর নেই,তবে প্রতীকী বলি হিসেবে পাঁচ রকমের ফল উৎসর্গ করা হয়।ষষ্ঠীতে বিল্বববরণ ও সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশের পরই মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়।প্রতিপদ থেকে প্রায় প্রতিদিনই পাঠ করা হয় চন্ডীপাঠ।মায়ের ভোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মোচা ও থোড়।এই দুটি প্রতিদিনই মাকে উৎসর্গ করা হয়।দশমীতে মায়ের ভোগে থাকে পান্তাভাত।

একসময় বেশ রাজকীয় ভাবে পুজো হত। বর্তমানে সেই গৌরব অনেকটা ম্লান হয়ে এলেও গ্রামের মানুষেরা বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বাড়ির পুজোয় অংশগ্রহণ করেন এখনও।নবমীতে গ্রামের সকলে নিমন্ত্রিত থাকেন।তবে নবমীর দিন এই পুজোর আরও একটি বৈশিষ্ট্য কুমারী পুজো।দশমীর দিন সুতো কাটার পর সূর্যাস্তের আগেই পরিবারের সদস্যরা মাকে কাঁধে করে বিশ্বেশ্বরতলায় দুধ পুকুরের অভিমুখে রওনা দেন।

মিত্র বাড়ির পুজো

সেখানেই আসে এই এলাকার আরও একটা সাবেকি বাড়ির (মিত্রবাড়ি)প্রতিমা।স্থানীয় মানুষেরা চ্যাটার্জী বাড়ির প্রতিমাকে বলেন বড় বোন ও মিত্র বাড়ির প্রতিমাকে ছোট বোন।দুই পরিবারের সদস্যরা মাকে বরণ করার পর প্রথমে বড় বোন এবং পরে ছোট বোন কৈলাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।তবে এই বাড়ির দুর্গাপুজোর সমাপ্তির সাথে সাথেই শুরু হয় এই ঠাকুরদালানেই পরিবারের মঙ্গল কামনায় কালিপুজোর প্রস্তুতি।তবে সাবেকি বাড়ির পুজো হলেও গোটা গ্রামের কাছে এই পুজো এক সামাজিক মেলবন্ধনের মাধ্যম।যেখানে আলোর রোশনাইয়ের আড়ম্বর না থাকলেও, আরাধনা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 4 =