মনমোহিনী মৌশুনী
পলাশ মুখোপাধ্যায় ##
অলস দুপুরে গা ছেড়ে দিন হ্যামকে। ঝাউবনের ছায়ায়, কানে কানে কথা কইবে মসলিন হাওয়া। আদুরে শব্দে উপস্থিতি জানান দেবে সাগুরে ঢেউ। হালকা দুলে আপনি তখন নিজের না প্রকৃতি; কার কথা ভাববেন তা ভেবেই মগ্ন। রোদ পড়া বিকেলে সাগর বেলায় বাধাহীন ঘোরাফেরা। ভোরের হাওয়ার ডাকে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়া মোহনার রূপের মোহে। ভাল লাগা কখন যে ভালবাসায় বদলে গেছে তা আপনি টেরও পাবেন না। মৌশুনী দ্বীপ। নিজের কাছে এনে নিজের কথা নিজের মত করে ভাবতে শেখায়।
এবারের সফরেও আমি একা নই। বরং স্ত্রী ছেলের সঙ্গে জুটেছে দিদি জামাইবাবুও। অনেক দিন ধরেই মৌশুনী দ্বীপে যাব যাব ভাবছি। কিন্তু যাওয়াটা হয়েই উঠছিল না। প্রস্তাবটা দিদিই দিল, চল মৌশুনীতে যাই। ব্যাস, নেচে উঠল মন, নেচে উঠল সকলেই। ওদিকটায় বেড়াতে যেতে হলেই যে প্রসঙ্গটা হাড়ে শিহরণ জাগায় তা হল ট্রেন জার্নি। আমি বহুবার ওদিকে গেছি বেড়াতে বা কাজে, কিন্তু কোনওদিন এমনকি জাতীয় ছুটির দিনেও নামখানা লোকাল ফাঁকা পাইনি। অসম্ভব ভিড়, বারুইপুর পার হতেই বাধ্যতামূলক উঠে দাঁড়ানো, এবং ধাক্কা খাওয়া; সে এক জটিল যন্ত্রণা। হ্যা আমি বনগাঁ লাইনের যাত্রী হয়েও এ কথা বলছি। গত বছর কালীপুজোর দিনে গঙ্গাসাগরে যাওয়ার সময়েও আমাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবারে এরা সকলেই যাচ্ছে তাই তো প্রথমেই ট্রেন যাত্রা বাতিল, বাকি রইল বাস এবং গাড়ি। শেষমেস গাড়িতেই যাওয়া হবে ঠিক হল। বুঝতেই পারছেন এ যাত্রা আমি আমার ভবঘুরের খোলস ছেড়ে বেশ জমিদার।
বছর চারেক হল বাংলাতে বা বাঙালির মধ্যে বেড়ানোর একটা সুনামি এসেছে। বিভিন্ন ফেসবুক পেজের দৌলতে এখন আর অফবিট স্পট বলে কিছু নেই। তাই বছর খানেকের মধ্যেই মৌশুনীতে গজিয়ে উঠেছে ২৬ টি ক্যাম্প বা রিসর্ট। তবে তার অধিকাংশই তেমন পাতে দেওয়ার মত না সেটা আগেই শুনেছিলাম। খোঁজ খবর করে স্যান্ড ক্যাসল্ ক্যাম্পের হদিশ মিলল। কর্ণধার অভিষেক রায়, বেশ শিক্ষিত মার্জিত ছেলে, এখানে একটা বিচ ক্যাম্প করেছেন। ছবিটবি দেখে আমাদের বেশ পছন্দই হল। অভিষেকই বলে দিল গাড়ি নিয়ে এলে রাখার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ব্যাস আর কি চিন্তা? অতএব; বেরিয়ে পড়া হল সদলবলে।
ট্রেনে গেলে সোজা নামখানা। সেখান থেকে টোটো বা ইঞ্জিন ভ্যানে দুর্গাপুর ঘাট। ঘাট পেরিয়ে আবার টোটো ধরে সোজা বালিয়াড়া বিচ ক্যাম্পগুলির কাছে পৌঁছনো যায়। গাড়ি নিয়ে গেলে নামখানা সেতু পেরিয়ে সোজা সাত মাইল মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরে হুজ্জুতের ঘাট। সেখানে গাড়ি রাখতে পারবেন। পাশেই থাকেন রবীন বর, তার উঠোনে গাড়ি রেখে ঘাট পেরিয়ে ওপারে যাওয়া। এবার টোটো ধরে বিচ ক্যাম্পে। গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে দেখতে দেখতে আধ ঘন্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। ভোর বেলা বেরিয়ে পড়েছি আমরা, ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে সোজা শিরাকোল, সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরে সটান উস্থি। উস্থি থেকে সোজা কুলপির আগে হটুগঞ্জ। এতে রাস্তাটা কিছুটা কমে যায়। আমরাও প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম হুজ্জুতের ঘাটে। রবীন বাবুর জিম্মায় গাড়ি রেখে এবার নদী পার হওয়ার পালা। নদীটা খুব বড় নয়। মিনিট পাঁচেক সময় লাগে পার হতে। হয়ে এবার টোটো ধরার পালা। একটা টোটো নিয়ে এবার মৌশুনীর অপর প্রান্তে ছুটছি আমরা।
আধঘন্টা পর একটা পাড়ার মধ্যে এসে টোটো চালক বলল এসে গেছি। সে কি, এ তো একটা পাড়া, ডোবা, হাঁস, কাঁচা রাস্তা, ছোট মুদি দোকান, সমুদ্র কোথায় গো? একটু হেসে বলল বাড়িগুলির ওপাশেই সমুদ্র, চলে যান ভাল লাগবে। এলাকাটা প্রথম দেখায় অবশ্য মনটা একটু দমে গেল। যাই হোক ক্যাম্পে ফোন করতেই আমাদের নিতে এল একজন, বাপ্পা। সেই বলল, পাড়া দিয়ে না গিয়ে বিচ দিয়ে যাওয়া যাক। তাহলে তো ভালই, দু একটা বাড়ি টপকাতেই ঝাউবনের দেখা মিলল। ঝাউবনের কাছাকাছি যেতেই সাগরের চেনা আওয়াজ, গন্ধ। এবার একটু বল পেলাম। বিচে নামতেই অবাক সকলে। ফাঁকা নির্জন সমুদ্র সৈকত, স্থানীয় কচিকাঁচারা খেলায় মত্ত। ভাল লাগা শুরু হল। পর পর ক্যাম্প, একটা একটা করে শেষ পর্যন্ত আমরা হাজির আমাদের আস্তানায়। থাকার জায়গাটা এক ঝলক দেখেই প্রেমে পড়ে গেলাম। আমি একা না সকলের চোখ মুখ দেখেই মনে হল একই অবস্থা। সমুদ্রতট থেকেই শুরু ক্যাম্পের চৌহদ্দি।
বাঁশের গেট ঠেলে বাপ্পার পিছন পিছন ঢুকতেই একটা আওয়াজ এল পিছন থেকে ওয়াও… আমার দেশী মেম দিদির গলার স্বর। চার পাঁচটি হ্যামক ঝুলছে সামনেই, সেখানে শুয়ে দোল খাওয়া মানে সৈকতে শুয়েই দোল খাওয়া। তার পিছনে বেশ কয়েকটি ছোট বড় তাবু। তারও পিছনে আমাদের থাকার জায়গা মাড হাউজ বা মাটির ঘর। না মাটির ঘর শুনে দৃষ্টি সংকুচিত করবেন না, মাটির ঘরে আছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা, শৌচাগারটি তো বাড়ির চাইতেও ভাল। কমোড, শাওয়ার, টাইলসের মেঝে দেওয়াল আর কি চাই? মাড হাউজের সামনে একটি ছোট্ট বারান্দা, সেখান থেকেও বসে সমুদ্র দেখা যায়। না হলে সামনের দিকে গিয়েও বসে বা শুয়ে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করতেই পারেন। ইতিমধ্যে হাতে এসে গিয়েছে ডাবের জল।
এখন অবশ্য বসবার সময় নেই, ছেলে তো এসে থেকেই স্নানের জন্য বায়না করছে। এবার দেখলাম অন্যরাও সেই ইচ্ছাতেই সায় দিচ্ছে। ব্যাস ক্যাম্পের গেট খুললেই তো সমুদ্র। দিলাম সকলে মিলে ঝাঁপ। ইচ্ছে করেই ছুটির দিন দেখে আসিনি। কারন এই জায়গাটা নির্জনতা দাবি করে। আমরা ছাড়া তাই সমুদ্র স্নানে আর কাউকে দেখলাম না। বেশ মজা লাগছিল, খুব বড় ঢেউ নেই, তাই ছোট বড় সকলেই বেশ মজা করে স্নান করতে পারে। ছেলে আর জামাইবাবু তো উঠতেই চাইছে না। ঘন্টা দেড়েক সমুদ্র স্নান সেরে এবার ঘরে ফেরা থুড়ি মাড হাউজে ফেরার পালা। ফিরে আবার একটু স্নান করে এবার মধ্যাহ্ন ভোজন।
পেটে সবার সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছে। দুপুরের খাওয়া তো এলাহি ব্যাপার, সরু চালের ভাত, ডাল, ভাজা, আলু মাখা বা আলুর চোখা, আলু পটলের তরকারি, কাতলা মাছের ঝাল, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, চাটনী, পাপড় শেষ পাতে আইসক্রিম। একেবারে জামাইষষ্ঠীর খাওয়া যাকে বলে। খেয়ে দেয়ে এবার বিশ্রামের পালা। বিশ্রাম নিতে কেউ চাইলে মৌশুনী দ্বীপ তার উপযুক্ত জায়গা। আমরাও এক এক জন একটি হ্যামক বা দড়ির দোলনা বেছে নিলাম। সেখানে শুয়ে দিব্যি সমুদ্র দেখা এবং আড্ডা দুটোই চলল সমানে।
বিকেলে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে পারেন নিজের মত করে। নিরিবিলি সৈকত, মাঝে মধ্যেই মৎসজীবীদের নৌকা এসে ভিড়ছে পাড়ে। দূরে সূর্য তখন লাজে রাঙা, আকাশে নানা রঙের আলপনা। সে এক মায়াময় মূহুর্ত। আমরা সকলেই হারিয়ে গিয়েছি নিজেদের মত করে। পাশাপাশি হাঁটছি বটে, কিন্তু কেউ কারও পাশে নেই। বুঝলাম মৌশুনী জাদু করেছে সকলকেই। সেই ইন্দ্রজালে মোহাবিষ্ট এক একজন নিজেদের মত করে ভালবাসতে শুরু করেছে এই ছোট্ট দ্বীপটিকে।
সন্ধের পরে আমাদের আড্ডা শুরু। এরই মাঝে বাপ্পা এসে মুড়ি পকোড়া চা দিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ বাই উঠল বারবিকিউ চিকেন হবে। অভিষেককে বলতেই হাসিমুখে জানিয়ে দিল পনেরো মিনিট সময় দিন ব্যবস্থা করছি। ব্যস, বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে জালের উপরে মাংস বিছিয়ে ঝলসানো শুরু। তারপরে সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন। দারুণ… রাতের খাওয়া আমরা আগেই বলে দিয়েছিলাম খুব বেশি কিছু না করতে। সেই মত রুটি চিকেন দিয়ে ছোট্ট ডিনার সারা হল।
পরদিন ভোরে উঠে দেখলাম আকাশের মুখ ভার। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আগের দিন রাতেই অভিষেক বলে দিয়েছিল সকালে মোহনাটা দেখে আসতে। সেই মত তৈরি সকলে। ছাতা নিয়েই বেরনো হল। সৈকত ধরেই এগোতে হবে, খুব বেশি দূর নয়, আমাদের ক্যাম্প থেকে পাঁচশো মিটার মত হবে। তবে এদিকটাতে ম্যানগ্রোভ সমুদ্র সৈকতে চলে এসেছে। তাই খানিকটা জলের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। সবে জোয়ার আসছে আমরা একটু এদিক ওদিক করে পার হয়ে গেলাম জায়গাটা।
মোহনাটিও খুব সুন্দর। এদিকটা লোকজন তেমন নেই, তাই খুব নিরিবিলি নির্জন। ম্যানগ্রোভগুলি জলের মধ্যে নেমে গিয়েছে সার দিয়ে। কিছু জলের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। নদী এসে মিশেছে সাগরের বুকে। এক কথায় অসাধারণ। পটাপট ছবি তোলা হল। বেশ খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখে এবার ফিরবার পালা। ফেরার সময় চক্ষু চড়ক গাছ আমাদের। আমরা যখন জায়গাটা পেরিয়ে ছিলাম তখন সেখানে হাঁটু জলও ছিল না। তাই সহজেই এদিক ওদিক করে গাছগাছালির ফাঁক গলে চলে আসতে পেরেছি। আমরা প্রায় আধ ঘন্টা মোহনাতে ছিলাম। এখন জোয়ারের জল বেড়ে প্রায় কোমর সমান জল। শুরু হল অ্যাডভেঞ্চার। ঠিক হল সকলে হাত ধরাধরি করে এগনো হবে। সেই ভাবে ভয়ে ভয়ে নামা হল জলে। একে একে কোনওক্রমে গাছগুলির ফাঁক গলে আসা হল নিরাপদে। প্রত্যেকেই ভিজে ন্যাতা। তবে এরও একটা মজা আছে সেটা মানতেই হবে।
যাই হোক ক্যাম্পে ফিরতেই জলখাবার রেডি। সকলেই ভিজে গিয়েছি তাই স্নান সেরে বসা পড়া খেতে। লুচি তরকারি মিস্টি ডিম সিদ্ধ দিয়ে জমজমাট প্রাতরাশ সেরে এবার ফিরবার পালা। অভিষেক সহ সকলেই বিদায় জানাতে সৈকত পর্যন্ত এল। আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই ছুটি পেলাম আমরা। মন খারাপ ওদের, তার চেয়েও মন খারাপ আমাদের। মৌশুনী যে কখন আমাদের মন কেড়ে নিয়েছে তা যেন কেউ বুঝতেই পারিনি। ঘাটের পথে ছুটছে টোটো, যতই এগিয়ে আসছে পারানির ঘাট, ততই বুকটা ভরে উঠছে মন খারাপের কুয়াশায়। কেউ বলেনি তবুও শুনতে পেলাম সকলেই বলছে আবার আসব মৌশুনী…
কয়েকটা জরুরী তথ্যঃ মৌশুনী ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিচিত। ছুটির দিনে প্রচুর মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। কিন্তু এখানে ময়লা ফেলার কোনও সুনির্দিষ্ট পন্থা নেই, তাই আপনারও চেষ্টা করবেন যতটা আবর্জনা কম ফেলা যায়। সমুদ্র তট পরিস্কার রাখুন। থাকার জন্য প্রচুর জায়গা, নেটে সার্চ করলেই পেয়ে যাবেন। খাবার জল নিয়ে খুঁতখুঁতানি থাকলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভাল। বেশ বড় গ্রাম বাজারও আছে, তবে ওষুধপত্র নিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিশ্রামের জন্য এই দ্বীপের জবাব নেই, অকারণ গিয়ে হইহল্লা না করলেই ভাল। এই দ্বীপ একটু নির্জনতা দাবি করে।
বাঃ মৌসুনি দ্বীপের বর্ণনায় মুগ্ধ হলাম।যাওয়ার ইচ্ছে রইলো।মন ছুঁয়ে গেল।