মর্গ

অনির্বাণ আচার্য ##

কদিন ধরেই খুব বৃষ্টি হচ্ছে শহর জুড়ে,কিছু কিছু জায়গায় তো জল পর্যন্ত জমতে শুরু করে দিয়েছে,ফ্ল্যাটে নিজের রুমে জানলার দিকে চেয়ে বসে আছি,কবে বৃষ্টি থামবে,এই সব ভাবছি এমন সময় মা এসে বলল “কিরে,একা একা ঘরে বসে কি করছিস?” আমি বললাম “ওই আর কি,বৃষ্টি দেখছি”

“বুঝেছি,আচ্ছা শোন,কিছু ডালের বড়া ভেজেছি যা ওপরের ফ্লোরে সুযশবাবুদের দিয়ে আয়”।আমি ভাবলাম মোক্ষম সুযোগ,এই বৃষ্টি ভেজা দিনে সু্যশবাবুর গল্প ও ডালের বড়া ,উফফ! পুর জমে ক্ষীর।

ডালের বড়া পেয়ে মহানন্দে সুযশ বাবুর ছেলে মহুল একটা মুখে পুরে দিলো,আন্টি মানে সুযশবাবুর স্ত্রী,ইতিমধ্যে সুযশবাবুর জন্য গ্রীন টি এবং আমার জন্য ব্ল্যাক কফি নিয়ে এসে ছেলেকে শোবার ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন “আজ আবার গল্পের ক্লাস শুরু হবে নিশ্চয়ই”বলে একটু মৃদু হেসে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন,সুযশবাবু যেন ছেলের দুষ্টুমি,বউ এর কৌতুক কিছুই যেন লক্ষ্য করেননি এমন ভাব।আমি বললাম “সুযশবাবু,কি হয়েছে বলুন তো আপনার?কোথায় হারিয়ে আছেন?”সুযশবাবু যেন খানিকটা ধাতস্থ হয়ে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন “আসলে কি জানতো? মানুষের জীবনের স্মৃতি একটা ডায়েরির মতোন,আচমকা কোন ঝোড়ো বাতাসে কোন পাতা টা যে উড়ে খুলে যাবে,আর তাতে  যে কিরহস্য লেখা বেড়িয়ে পড়বে বলা ভারী শক্ত”।সুযশবাবু থামলেন, তারপর গ্রীন টি র কাপে চুমুক দিয়ে বললেন “তা এতদিন কোথায় ডুব মেরে ছিলে শুনি?” আমি কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম “সে আমার কথা ছাড়ুন তো,আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছিলো আপনার জীবন স্মৃতি ডায়রির কোনো রহস্যময় পাতা খুলে গেছে,প্লিজ সেই রহস্যময় স্মৃতি টা বলুন না”। সুযশবাবু আবার একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে একটু হেসে বললেন “রহস্য বলতে পারো বটে,তবে এটা এমন একটা ঘটনা যার সাধারণ বিজ্ঞান সুলভ মানসিকতায় কোনো উত্তর মেলেনা,রিগার মর্টিস এর নাম শুনেছো মিস্টার বায়োটেকনলজি?”

আমি বললাম “হ্যাঁ, মৃত্যুর পরে মৃতদেহ মৃত্যুজনিত বিকারের কারণে আড়ষ্ট হয়ে যায় ,একেই বলে রিগার মর্টিস।কিন্তু আপনি আচমকা রিগার মর্টিস এর কথা কেন তুললেন?”

সুযশবাবু ততক্ষনে গ্রীন টি খাওয়া শেষ করে একটা ফ্লেক ধরিয়ে লম্বা সুখটান ছেড়ে বললেন “মর্গ,বা লাশঘর অনেকের কাছেই ঘেন্নার বা আতঙ্কের,চট করে সেখানে ওই খাঙ্কার কর্মীরাও যেতে চায় না,আর অত্যন্ত দুর্ভাগা না হলে কোনো মানুষ তো সেখানে যাওয়ার কথা ভাবেই না।কিন্তু……” এতটুকু বলে সুযশবাবু থামলেন ,তারপর আরেক টা লম্বা সুখটান দিয়ে সোফাড় হাতলে পিঠ ঠেকিয়ে পা দুটোটান টান করে দিয়ে বেশ আয়েশ করে আরেকটা সুখটান দিলেন,তারপর বললেন

“আমার একবার ওই লাশঘরে যাবার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো,আর সেটাও ছিলো এমনই একটা বর্ষাকাল,এমনই একটা মন খারাপের বিকেল।আমার তখন মাস্টার ডিগ্রি চলছে,এমন সময় খবর এলো আমার রুমমেট তুফান আচমকা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে দামোদরের জলে ডুবে মারা গেছে।কথাটা মেনে নিতে পারছিলাম না,কেবলই মনে হতে লাগলা ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট সুইমিং চ্যাম্পিয়ন জলে ডুবে মরে কিভাবে?কিন্তু!! নিয়তি তো নিয়তিই হয় আর তাকে কেউ খণ্ডাতে পারেনা,তাই গিয়ে ছিলাম মর্গে,দেহ শনাক্ত করতে হবে,মা বাপ মরা ছেলে ছিলো তুফান,এক পিসি ছিলো সেও আজ ছয়মাস হলো অতীত।নিজে টিউশন দিতো,আর সেই পয়সায় নিজের খরচা চালাতো।মর্গে গিয়েছি ওর বডি শনাক্ত করতে এমন সময়,মর্গের একজন স্টাফ আমার কাছে এসে বলল,ডাক্তারবাবু এখনও আসেননি,একটু নাকি অপেক্ষা করতে হবে।এমনিতেই সরকারী হাসপাতাল,তার উপর মর্গের স্টাফ,তিরিক্ষি মেজাজের তো হবেই,তাই আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না শুধু জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় বসব? তাতে সে এমন খেপে উঠল যে বাধ্য হয়ে আমাকে তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হলো।মর্গের ভেতরে ঢুকে একটা বসার বেঞ্চ পেয়ে স্বস্তি বোধ করলাম।বেঞ্চে বসে আছি,এমন সময়,একটা পরিচিত কন্ঠস্বর যেন বহুদূর থেকে আমার কানে এসে প্রবেশ করল, “ভাই,সিগারেট টা একা খাস না,কাউন্টার দিস”। আমি তো অবাক দিক বিদিক যেন আমার পাগোলের মতো লাগতে লাগল,আমার মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ বেড়োলো, “তুফান” , শুনতে পাচ্ছি আবার সেই কন্ঠস্বর,সেই যেন বহুদূর থেকে,

“আমাকে চিনতে এসেছিস ভাই?আমি যে আর তোর সেই হাসি মজা করা ক্রাইম পার্টনার তুফান নই রে,আমি যে জলে ডোবা মড়া।কিন্তু জানিস ভাই,আমার বাঁচার খুব শখ ছিলো,দুনিয়া ঘোরার শখ ছিলো,আমার সায়নীকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো।আর সেই শেষের ইচ্ছেটাই বোধহয় আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো জানিস।আমার সাথে সায়নীর সম্পর্ক ছিলো প্রায় তিন বছরের আর এই তিন বছরে আমরা অনেক কাছাকাছিও চলে এসেছিলাম।তুই জানতিস না,আমাদের রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছিলো।কিন্তু এই কদিনে আমাদের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছিলো,কারণ,আমাকে ছেড়ে ও বিজনেসম্যান সুপ্রভ রায় কে বিয়ে করতে চেয়েছিলো,তাই আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলো আমি রাজী হই নি,ও কোর্টে কেস ও করতে পারতো না কারণ কোনো উপযুক্ত প্রমাণ ছিলো না,আমি অনেক বুঝিয়ে ছিলাম ওকে ফিরে আসার জন্য,ও রাজী হয় নি। ও জানতো যে প্রতি সপ্তাহের সোমবার আমি দামোদরে সাঁতার কাটি,গ্রীষ্মকালে আর শীতকালে না হলেও বর্ষাকালে তো বটেই।আমি আমাড় রুটিন চেঞ্জ করিনি,আজও গেছিলাম সকাল বেলা,জানতাম না যে আমাকে মারার মতোন প্ল্যান ও করবে,আমার সঙ্গে আর দুজন লোক জলে নেমেছিলো,আমার সন্দেহ হয়নি তখনও ওদের উপর জলে ঝাঁপ মেরে ডূব দিয়ে মাথা তুলতে যাবো এমন সময়,ওরা জলে ঝাঁপ দিয়ে আমাকে চেপে ধরল,যাতে আমি জলথেকে মাথা না তুলতে পারি,অনেক চেষ্টা করলাম হাত পা ছুঁড়লাম,কিন্তু কিন্তু……আমি পারলাম না”।

শেষের কথা গুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো তুফান।আমিও যেন ওর কথা গুলো শুনে কেমন মোহগ্রস্ত হয়ে গেছিলাম,এমন সময় একজন গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ বলল, “ মি, সুযশ,আপনার বন্ধুর মৃতদেহ শনাক্ত করার সময় এসে গেছে, আসুন। আমিই ডা. দিব্যেন্দু রক্ষিত।কোনো ক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তার বাবু কে জোরহাত করে প্রণাম করে লাশ শনাক্ত করে বাকি ফর্মালিটিস গুলো পূর্ণ করে সবে বেড়োচ্ছি এমন সময়,আমার মনে হলো থানায় গিয়ে ব্যাপার টা জানাই,এ.এস.আই মি. চক্রবর্তী জানালেন,যে তিনি দোষীদের শাস্তির যতটা সম্ভব পাওয়ানো যায় তার চেষ্টা করবেন।বলা বাহুল্য,এরপর আমার মাষ্টার ডিগ্রি শেষ হয়ে যায়,আমিও ওই হোষ্টেল ছেড়ে দিই।আর সায়নী আর সুপ্রভর শাস্তি হলো কি না তাও জানতে পারিনি,তবে তুফানের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত আমার কাছে আজও রোমাঞ্চকর, মৃত্যুর আগেও, মৃত্যুর পরেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × one =