যেমন আছি বেশ আছি
চিত্রা দাশগুপ্ত, ক্যালিফোর্নিয়া ##
সে দিন কাছেই আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে গেছিলাম। লকডাউনে বাড়ি বসে থকে থেকে সবাই ক্লান্ত তিতিবিরক্ত যাকে বলে, তাই মায়া যখন ফোন করে বলল আজ—-”বিকালে চলে এস,সিঙ্গাড়া বানাচ্ছি, শীতল আর দীপ্তিবেন আসবে। এভাবে আর পারছিনা দম বন্ধ হয়ে আসছে, আজ সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব। দেরী কর না, তাড়াতাড়ি চলে এস।”
একথা শুনে আমার ও মনটা নেচে উঠল, সত্যি আর ভাল লাগছেনা এই বন্দী দশা। আর আমরা সব সিনিয়ার সিটিজেন কোথাও যাই না কেউ আমাদের কাছে আসে না। দোকান বাজার ও অন-লাইন বা বৌ, ছেলে মেয়েরা নিয়ে আসে। বেশ বেলা থাকতে থাকতে আমি কিছু পনির সিক্সটি ফাইভ বানিয়ে মুখে মাক্স বাঁধে নির্ভয়ে রওয়ানা দিলাম মায়ার বাড়ি, হাঁটা পথ।
পৌঁছে গেলাম পাঁচ মিনিটে,কিছুক্ষণের মধ্যে শীতল এসে গেল ও হাতে করে বাদাম বরফি নিয়ে এসেছে। শান্ত, স্বল্প ভাষী মহিলা, এলাহাবাদের অধিবাসী কিন্তু স্বামী মারা যাবার পর ছেলে ও মেয়ে মাকে একা থাকতে দেয় না তাই সাত বছর হয় এদেশে পাকাপাকি ভাবে আছে। ওর মেয়ে ডাক্তার,আমরা কাছাকাছি থাকি।শীতলের ছেলে একটা কম্পানির সিনিয়া-ডাইরেকটার
অন্য পাড়ায়,একটু দূরে থাকে। শীতল কখনো এখানে কখনো ওখানে পিংপং বলের মত ….
আর দীপ্তিবেন( নাম শুনে বুঝলাম গুজরাঠী )আমি ওকে আগে দেখিনি।
দামী হিরার গয়না ও দামী শাড়িতে সজ্জিত, ওর ছোটছেলের বৌ স্নেহল ওকে গাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল। উইক ডেজের মাঝে যারা চাকরি-বাকরি করে তাদের জন্য একটু মুস্কিলের ব্যাপার।
চোখে মুখে কথা বলে,হাহা করে হাসে,এসেই বলল সবার জন্য স্পেশাল ধোকলা বানিয়ে এনেছে। কিছুক্ষণর মধ্যে দীপ্তিবেন আসর জমিয়ে দিল। ওর দুছেলে। এখানে ছোটছেলের কাছে আছে। ছেলে বৌ দুজনে স্কুল টিচার,সাধারণ অবস্থা। বড় ছেলে লস এ্যনজেলাসে থাকে। একের পর এক দুটো কোম্পানি স্টার্ট করে, ( স্টার্ট আপ) যখন ঐ কোম্পানি দুটোই অন্য বড় কোম্পানি এ্যকোয়ার করে নিল তখন প্রচুর পয়সা করছে, যাকে বলে টাকার কুমির। আর বড় বৌ ডাক্তার। সেখানে নাকি এলাহি ব্যাপার স্যাপার !
প্রাথমিক আলাপ পরিচয় পর্ব সারা হলে আমরা সবাই হাতে হাতে খাবার দাবারগুলো নিয়ে বাইরে লনের পাশে মাথার উপর ঢাকা দেওয়া যে বসার জায়গা (প্যেটিও) সেখানে গিয়ে (সোশাল ডিসট্যান্ট মেনে দূরে দূর) বসলাম।কিছুক্ষণের মধ্যে আসর বেশ জমে উঠল। ছোট প্লেটে যে যার মত খাবার দাবার তুলে নিয়ে চা সহযোগে নানা রকম গল্প কথায় ডুবে গেলাম। রান্না খাওয়া,টুকটাক দেশের খবর, টিভি সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা, নাতি নাতনিদের কথা,তার সাথে কিছু অতীতের সুখ স্মৃতি রোমন্থন, একটু নিজেদের সেলাই বোনার গপ্প করতে করতে নিজেদের একাকীত্ব ও স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে না পারার জন্য অসুবিধার কথা এসে পড়ল। সবার মনেই অল্পবিস্তর ক্ষোভ, ছেলে মেয়ে যাদের কাছে আমরা থাকি তারা সবাই নিজেদের কাজ সামলাতে এত ব্যস্ত যে আমাদের দিকে ফিরে তাকাবার ও সময় নাই তাদের হাতে, সময় দেওয়া তো দূরের কথা।
উইক এন্ডেও কিছু না কিছু লেগেই থাকে তবে এখন লকডাউনের বাজার কোথাও যাওয়া আসা নেই তাই ব্যাপারটা একটু আলাদা।কিন্তু তা তে আমাদের কোন লাভ হয়নি আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরে,সব সোনার খাঁচায় বন্দী পাখির দল। আমার দিদা একটা ছড়া বলতেন “খায় দায় পাখিটি বনের দিকে আঁখিটি “আমাদের সেই হাল। আছি এখানে মন পড়ে আছে দেশে মানে ইন্ডিয়া !
আমাদের মধ্যে মায়া একমাত্র পুরোপুরি স্বাধীন মা। বিয়ের পর প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এ দেশে এসেছে। এক সময় এখানে কাজকর্ম ও করত গাড়ি চালিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। একটি ছেলে কর্ম সুত্রে দূরে থাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর মায়া একা থাকে,ছেলে মাসে একবার আসে খোঁজখবর নিয়ে দরকার মত সাহায্য করে। মায়া খুব একাকীত্বে ভোগে,একদম একলা থাকতে পারে না। সারা ক্ষণ বাড়িতে লোক ডেকে রান্না বান্না করে খাওয়াতে খুব পছন্দ করে।
আমি গত পঁচিশ বছর ধরে এ দেশ আসা-যাওয়া করি, স্বামীকে হারানোর পর ও নয়, দশ বছর একলা থেকেছি দেশে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যতের কথা চিন্তাকরে ছেলে মেয়েদের কথা মেনে গ্রীনকার্ড নিয়ে চার, পাঁচ বছর হয় একটানা বেশ কটা মাস এখানে থাকি। আমার তিনটি সন্তান ইউ এস এর তিনটে আলাদা শহরে থাকে। একজন পূর্বে, একজন পশ্চিমে ও এক জন মাঝামাঝি আর আমি ক্যারামের গুটির মত এদিক ওদিক করি।
দুটি কন্যা একটি পুত্র প্রত্যেকেই যার যার “কাজে” বেশ দায়িত্ব পূর্ণ পদে আছে। সকাল আটটাতে তাদের দিন শুরু হয কিন্তু শেষ কখন হবে বলা মুশকিল। সামনে ডেড লাইন থাকলে শনি রবি ও কাজ নিয়ে বসতে হয়। সর্বত্র এক “সিন”, ভালো না লাগলেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আমি আগে দেশে ড্রাইভ করতাম। এ দেশে লাইসেন্স নেই, যদিও পুত্র, কন্যারা বলে শিখে নাও, কিন্তু নতুন করে ওদের লেফ্ট হ্যান্ড ড্রাইভ ও নতুন আইন কানুন শিখে ওদের গাড়ি চালাতে চাই না। তাই পাড়ার বাইরে এক পা একা কোথাও যেতে পারি না। বেশির ভাগ বুড়ো বাবা মা যারা এখানে ছেলে মেয়ের কাছে থাকে তাদের এই এক অবস্থা। সুখ-সাচ্ছন্দ, আরাম,সব আছে স্বাধীনতা নেই। অন্যান্য সময় উবার নিয়ে মাঝে মধ্যে একটু এদিক ঐদিক যাই কিন্তু কোভিডের জন্য এখন সব বন্ধ। তবে যতই স্বাধীনতার অভাব ও বন্দী দশা ভোগ করি না কেন মনে প্রাণে মোটামুটি আমরা সবাই কৃতি সন্তানদের নিয়ে বেশ গর্বিত। ওদের ভালোবাসা ও নিরাপত্তার বলয়ে নির্ভয়ে দিনগুলো কেটে যায়। একা ঘরে স্বাধীনতা প্রচুর তবে রাত নামলো মনের কোনে ভয়টা চেপে বসে, যদি হঠাৎ কিছু হয় …..
আমার বন্ধুদের প্রায় সকলের ছেলে মেয়ে সব বড় বড় মাল্টি ন্যাশনাল বা আ্যামেরিকান কোম্পানির উঁচু উঁচু পদে অধিষ্ঠিত। পদ-ভার সামলাতে সামলাতে সর্বক্ষণ কর্ম-ভারে ডুবে থাকে সবাই। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হবে। সবাই আমরা যে যার মত করে মানিয়ে গুছিয়ে চলি। দাবি খাটিয়ে জোর জুলুম করি না। আমাদের প্রায় পনের ষোল জনের সর্ব ভারতীয় এক বিরাট গ্রুপ। আমরা রোজ বিকালে স্থানীয় পার্কে জমা হই, আড্ডার লোভে বেশ দূর থেকে অনেকে হেঁটে হেঁটে পার্কে আসে। দুটো ঘন্টা কোথা দিয়ে চলে যায়। আমরা বছরে একবার পট-লাক পিকনিক করি।মেয়ে বৌদের সুবিধা মত বন্ধুদের বাড়ি লাঞ্চ, টি-পার্টির আয়োজন হয় মাঝেমাঝে। এখন অবশ্য সব বন্ধ।
একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি আমাদের সকলেরই প্রায় এক ধরনের মানসিকতা। নিজেদের অসুবিধা হলেও আমরা চাই ওরা সুখে থাকুক, উন্নতি করুক। সন্তানকে দাবিয়ে নিজের সুখ কখন চাই না। যাক, আবার ফিরে আসছি আজকের আড্ডায়। মাঝ খানে মায়া উঠে আর এক রাউন্ড চা বানিয়ে আনল। আমাদের হাত মুখ দুটোই চলছে। হঠাৎ দীপ্তিবেন বলল, নেক্সট ফ্রাই ডে তোমরা চলে এসো আমার বাড়ি, ভাবছি জয়ন্তী আর রমাকে ও ডাকবো। ছ’জন হলে অসুবিধা নেই আমাদের বসার ঘরটা বিশাল, ডিসটেন্স রেখে বসা যাবে।
মায়া—-ঐদিন আমার ডেন্টিস্ট এর সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, আমি তবে ওখান থেকে সোজা চলে যাব।
আমি বললাম মেয়েকে না জিজ্ঞেস করে বলতে পারব না। তোমার বাড়িটা দূরে ওর পৌঁছাবার সময় হবে কিনা …আমার কথা শেষ হবার আগেই শীতলও একই কথা বলল।
মায়া —- যদি ওরা কেউ তোমাদের পৌঁছে দেয় আসার সময় আমার সাথে চলে আসতে পারবে।
আমাদের দুজনের একই কথা, মেয়ের সাথে কথা না বলে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।
দীপ্তিবেন একটু তির্যক হাসি হেসে বলল “কি আশ্চর্য তোমাদের নিজেদের ইচ্ছা বলে কিছু নেই ? তুমি বলবে তুমি যেতে চাও যেমন করে হোক মাকে পৌঁছানোটা ওদের ডিউটি। এত কষ্ট করে পেলে পুষে বাচ্চাদের বড় করেছি এমনি এমনি। আমাকে দেখ আমার যা দরকার আমি ঠিক আদায় করে নি। আরে বাবা বাচ্চাদের ছোট থেকে শেখাতে হয় মা-বাপের ডিমান্ড পুরো করাটা ওদের মেইন ডিউটি। এ দিক থেকে আমি খুব খুস নসিব। বড় ছেলের অনেক পয়সা আছে আর ছোট ছেলের আছে সময়। দুটোর কম্বিনেশনে আমার জীবনটা আরামসে কাটছে। এই রকমই হওয়া দরকার, বড় নিজে কিছু করতে পারে না তাই আমার দুহাত ভরে ডলার দেয় আর আমি ছোট বৌ এর হাত ভরে দি। ব্যস্,সবাই খুশ…..যদি দুটোই বড় অফিসার হত যেমন তোমাদের ছেলে পুলেরা,তাহলে আমাকেও তোমাদের মত …. না বাবা আমার এই ভালো।”
আমরা অবাক হয়ে শুনছি ওর কথা, বলে কি! এ কেমন সাইকোলজি ?
নাকি দু-ছেলের মধ্যে এতটা অর্থনৈতিক ফারাকে যে বৈষম্য সেটাকে মানিয়ে নেবার জন্য নিজেকে এই ভাবে সান্ত্বনা দেয়, নাকি সত্যি সত্যি এটাই ওর স্ট্র্যাটেজি ….
দরজার বেল বাজল। মায়া উঠে গেল দরজা খুলতে। দীপ্তিবেন হাত-ঘড়ি দেখে —-স্নেহল আমাকে নিতে এসেছে নিশ্চয়,দ্যাখ কেমন পাংচুয়াল আমার বৌমা,ঠিক সারে ছ বাজে আমাকে নিতে এসে গেছে। নিজের পজিশন নিজে বানিয়ে রাখতে হয়….” বলে হাসতে হাসতে উঠে গেল। আমি আর শীতল মুখ চাওয়া চাই করে কাপ,প্লেট,টি-পট হাতে করে নিয়ে ভেতর ঢুকে গেলাম। আমাদের ও বাড়ি ফেরার সময় হোল।
সবাইকে বাই বাই করে গাড়িতে ওঠার আগে দীপ্তিবেন আমাদের আবার মনে করিয়ে দিল ওর বাড়ি যাবার কথা আমরা যেন না ভুলি, যেন অবশ্যই ফোন করে কনফার্ম করি।
অনেক দিন পর আজ বন্ধুদের সাথে হাসি গল্প করে মনটা বেশ হালকা লাগছে। তবে থেকে থেকে দীপ্তিবেনের কথাগুলো কানে বাজছে। একজনের পয়সা আর একজনের সময় ….এ কেমন বিচার! নাকি এরাই পারবে সমাজের অবক্ষয় আটকে বৃদ্ধাবাসের দরজায় তালা লাগাতে। অবশ্য এমন উদাহরণ আমরা আগে ও চাক্ষুষ না দেখলে ও শুনেছি, এক রোজগেরে ছেলের পয়সায় চলেছে যৌথ পরিবার, সে বৌমা রাণীর মত সংসারে কর্তৃত্ব করেছে আর বাকিরা দিয়েছে কায়িক শ্রম।
টুকটাক মনোমালিন্য হলেও সংসার চলেছে মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমা,পিসিমা ছাড়াও অন্যান্য আশ্রিতদের নিয়ে। মা ঠাকুমার কথাই হত শেষ কথা। তবে কি আমরাই এই প্রজন্মকে স্বার্থপর হতে শিখিয়েছি। নানা তা কেন হবে,সময় ও সমাজ বদলেছে। গাছেরও খাব তলারও কুড়বো তা তো হয় না, তখন কি আমাদের মত ষাট সত্তর উর্দ্ধ মায়েরা একা বন্ধুর বাড়ি আড্ডা দিতে যেত, দল বেঁধে পাট-লাক পিকনিক করত, মোবাইল ফোন হাতে সেলফি তুলত, না আমাদের মত সাজসজ্জা করত….? থাক ! অত ভেবে কাজ নেই, যে যেমন আছি বেশ আছি শুধু করোনাটা গেলেই বাঁচি।