রহস্যে ঘেরা হুনজা
পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসিত গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলের হুনজা উপত্যকার বাসিন্দারা শুধু সুদর্শন ও সুন্দরই নন, একইসাথে তারা দীর্ঘায়ুরও অধিকারী। গড়ে একশ বছরের বেশি বাঁচেন এই উপত্যকার বাসিন্দারা। হুনজা উপত্যকায় বাস করে বলে তাদের বলা হয় ‘হুনজা সম্প্রদায়’। হুনজা উপত্যকার অবস্থান পাকিস্তানের কারাকোরাম পর্বতমালায়। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই উপত্যকা। একইসাথে হুনজা সম্প্রদায় তাদের বেশকিছু গুণের কারণেও প্রসিদ্ধ।
হুনজারা বিশ্বের একমাত্র জনগোষ্ঠী, যারা গড়ে ১০০ বছরের বেশি বাঁচে। শরীর-চেহারা-কাজ কোথাও তাদের বয়সের ছাপ থাকে না। বিশ্বের অন্য দেশে যখন নারীদের গড় আয়ু মাত্র ৬০ বছর, সেখানে হুনজা নারীদের গড় আয়ু তার দ্বিগুণ প্রায়। সেখানকার ৬৫ বছরের নারীদের দেখলেও মনে হয়, যেন ৩০ বছরের ভরাযৌবনা তরুণী। ৭০ বছরেও সন্তান জন্ম দিতে পারেন হুনজা নারীরা। অসম্ভব মনে হলেও এটিই বাস্তব।
তাদের দীর্ঘায়ু ও চির যৌবনের পেছনের মূল রহস্যটা কি-তা জানতে আগ্রহী সবাই। এই নিয়ে প্রচুর গবেষণাও হয়েছে। গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুসারে, তারা রুটিনমাফিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দিনে মাত্র দুইবেলা খায় এবং প্রচুর কায়িক পরিশ্রম করে তারা। তারা নিয়মিত ফলের শরবত পান করে। তাদের বেশিরভাগই নাকি নিরামিষভোজী। তাদের খাদ্যের বেশিরভাগই তৈরি হয় পনির-বাদাম-দুধ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য থেকে। ঘুম থেকে ওঠার পর সকালের জলখাবার এবং সূর্য অস্ত গেলে রাতের খাবার খান তারা। এর মধ্যে আর কোনো কিছুই খান না তারা। তারা যে সব খাদ্য খায় তা সবই নিজেদের উৎপাদিত। বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদনের পর নিজ পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে সারা বছরের জন্য মজুদ করে রাখা হয়। ফসল উৎপাদনে তারা ব্যবহার করে না কোনো রাসায়নিক সার বা কোনো কিটনাশক। আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর তো প্রশ্নই আসে না।
হুনজা সম্প্রদায় খুব আমুদে। সবসময় তাদের ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে। তাদেরকে আলেকজান্ডারের বংশধারার একটি অংশ বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। বিভিন্ন উৎসবে এরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে নাচ-গান করে।
হুনজাদের সুস্থ ও সতেজ থাকার পেছনে অ্যাপ্রিকটস ফলের ভূমিকার কথা বিবেচনা করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের ত্বকের ঔজ্জ্বল্যের বিষয়ে গবেষকরা বলছেন, হিমবাহ গলা জলে স্নান এবং তা পানীয় হিসেবে ব্যবহারই এর অন্যতম কারণ। ত্বক উজ্জ্বল হওয়ার আরো বেশকিছু কারণ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তা হলো-বরফগলা জল গরম করে তার মধ্যে তুমুর নামের এক প্রকার গাছের পাতা মিশিয়ে হার্বাল-চা পান করেন তারা। শুধু সৌন্দর্য ও সুস্থতাই তারা সেরা নয়; শিক্ষার ক্ষেত্রেও তারা বেশ এগিয়ে। তাদের শিক্ষার হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। তাই তাদের মুর্খ-পাহাড়ি ভাবলে ভুল হবে; বরং শিক্ষা-আচার-ব্যবহার কিংবা সভ্যতা-সংস্কৃতি-সবদিক থেকেই অনেক উন্নত দেশের তুলনায় তারা এগিয়ে।
তবে হুনজারা আদৌ এতটা দীর্ঘজীবী কিনা তা নিয়ে আছে গবেষকদের মধ্যে মতভেদও। অনেকেই মনে করেন হুনজাদের নিয়ে এই বিশ্বাস অতিরঞ্জিত। তাদের মতে হুনজাদের কাছে বয়স মাপার কোনও সুস্থ নিয়ম নেই। কোনও নথি থাকে না, নেই কোনও ক্যালেন্ডারও। তাই এই বয়স নির্ভরযোগ্য বলা যায় না। জন ক্লার্ক নামে এক চিকিৎসক বছর দুয়েক হুনজা উপত্যকায় ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি একটি বই লিখেছিলেন যাতে হুনজাদের বিভিন্ন রোগব্যধীর উল্লেখ ছিল। তার দাবি, তিনি ওই সময় ৫৬৮৪ জন হুনজা মানুষের চিকিৎসা করেছেন বিভিন্ন রোগের। তারা অধিকাংশই নাকি ম্যালেরিয়া, কৃমি, চোখের নানা রোগে ভুগতেন। তবে এটা আশ্চর্যের তারা অতি দ্রুত চিকিৎসায় সাড়া দিতেন। অন্যান্য বড় কোনও রোগের লক্ষণ এখানে তিনি পাননি। তবে বিতর্ক থাকলেও এটা ঠিক কথা যে, অন্যদের তুলনায় হুনজাদের গড় আয়ু অনেকটাই বেশি।