রাধাবল্লভের রথযাত্রা
শুভজিৎ দত্ত, আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ##
রথযাত্রা -এই দিনটা এলেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে নিজের শৈশবে,সেই বাবার সাথে দোকান থেকে রথের আগেরদিন রথ ও জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ ও সাজানোর উপকরণ কিনে বাড়ি ফেরা, রথের দিন খুড়তুতো ভাই-বোনদের সাথে সেই রথ কে সুন্দর করে সাজিয়ে সেখানে বিগ্রহ অধিষ্ঠিত করে বিকেলে হলেই মায়ের সাথে রথ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া। তারপর রথের মেলায় সুবিশাল রথ থেকে ছোড়া বাতাসা কুড়োনোর ধুম সে এক আলাদাই আনন্দ ছিল। তাই এখন অফিস ফেরত যখন ছোট ছোট শিশুদের রাস্তায় রথসহ দেখি, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই ছোটবেলায়।
শৈশবের এই আনন্দগুলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেলেও বর্তমানে জানতে ইচ্ছে করে বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন রকম রথযাত্রার সূচনালগ্নের ইতিহাস। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় রথযাত্রার সূচনা হয় সত্যযুগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এর হাত ধরে শ্রীক্ষেত্রে। তৎকালীন মালব দেশীয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী বিগ্রহ নির্মাণ করেন এবং রথযাত্রার সূচনা করেন। তবে তারও আগে ভূপর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখায় সেই সময়ের রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং এটা বোঝা যায় বৌদ্ধধর্ম থেকে বিবর্তনের মাধ্যমেই এই রথযাত্রার সূচনা। বাংলায় এই রথযাত্রার সূচনা হয় মধ্যযুগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে। বাংলায় সবচেয়ে পুরোনো রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়(1396 খ্রিস্টাব্দে) হুগলীর মাহেশে। এছাড়াও গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবন জীউয়ের রথ, মহিষাদল, রাজবলহাট, বনকাঠির পিতলের রথযাত্রা বেশ প্রসিদ্ধ।
তবে এছাড়াও বাংলায় পারিবারিক রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ পরিবারের কূলদেবতা রথের মাধ্যমে সকল ভক্তদের সামনে উপবিষ্ট হন। এরকমই এক রথ দেখার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম নৈহাটির কাঁঠালপাড়া। এই নামটা শুনেই কি আপনাদের সাহিত্যসম্রাটের জন্মভিটের কথা মনে পড়ল, হুম একদম ঠিকই ধরেছেন গতবছর উল্টোরথের দিন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের পারিবারিক রথ দেখার উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলাম কাঁঠালপাড়ায়। দুপরে নৈহাটি স্টেশনে নেমে যখন হেঁটে কাঁঠালপাড়ায় পৌঁছলাম তখন রথের মেলার দোকানীরা তাদের পসরা সাজাচ্ছেন, মেলায় তখন এক দোকানে গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে,মেলার মাঝেই রাস্তার মাঝে এক সুবিশাল কাঠের উপর পিতলের রথ দাঁড়িয়ে আছে,কিন্তু ভিতরে তখনও কোনো বিগ্রহ দেখলাম না। মূল মন্দিরে প্রবেশ করে জানলাম রথযাত্রা শুরু হতে তখনও অনেক দেরী। ভাবলাম এই সুযোগে সাহিত্যসম্রাটের বাসভবন ঘুরে দেখব, কিন্তু ভিড় দেখে এড়িয়ে গেলাম। অগত্যা মেলাতেই খানিক ঘোরাঘুরি। মেলা থেকে বেরোতে গিয়ে মূল মন্দির থেকে একটু দূরে গুন্ডিচা মন্দিরে অবশেষে দর্শন পেলাম রাধাবল্লভ ও বলরামের। তখন রথযাত্রা উপলক্ষে দুজনকেই সুসজ্জিত করা হচ্ছে দেখে বসে মুগ্ধ হয়ে বসে দেখছিলাম ভগবানের সেই মোহনরূপ। দুপুরের দিকে ভিড় কম থাকায় পুরোহিত ও স্থানীয় কিছু মানুষের থেকে শুনলাম এই রথযাত্রার ইতিহাস।
এই পারিবারিক রথযাত্রার সূচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায়। তখন তিনি ছিলেন তমলুকের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তমলুকের কারিগর দিয়ে কাঠের উপর পিতলের পাত দিয়ে তৈরী করেন এই রথ।সেই রথ নৌকা করে রূপনারায়ন ও গঙ্গা হয়ে চলে আসে এই কাঁঠালপাড়ায়। সেই থেকেই (১২৯৬ বঙ্গাব্দে) এই রথযাত্রার সূচনা। এই রথের নামকরণ হয়েছিল সাহিত্যসম্রাটের মাতা দুর্গাসুন্দরীর নামে। তিনিই প্রথমে অন্দরমহল থেকে রশিতে টান দিয়ে এই যাত্রার সূচনা করতেন। শোনা যায় সাহিত্যসম্রাটের নির্দেশে একবার এই রথযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। রথের চাকার কিছু সমস্যাজনিত কারণে তিনি সেবার এই যাত্রা স্থগিত করে দেন। আবার ১৮৭৫ সালে একবার এই মেলায় একটি বালিকা হারিয়ে যায়,তার কয়েকদিন পরেই তিনি রচনা করেন ‘রাধারানী’ উপন্যাস।
কষ্টিপাথরের রাধাবল্লভও বেশ প্রাচীন।
এই বিগ্রহের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রায় ৩০০ বছর আগে এক সন্ন্যাসী কষ্টিপাথরের রাধাবল্লভ কে দান করে যান নৈহাটির ঘোষাল বাড়িতে। পরে ওনার মৃত্যুর পর এই এই সম্পত্তির অধিকার পান রামহরি চট্টোপাধ্যায়। পরে ওনার পৌত্র যাদবচন্দ্র (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর পিতা) হন এই দেবোত্তর সম্পত্তির অধিকারী। বলরামের মূর্তিটি যদিও দারুবিগ্রহ বলেই মনে হল।
এইসব শুনতে শুনতে রাধাবল্লভ কখন যে সুসজ্জিত হয়ে রাখালবেশে আবির্ভূত হয়েছেন তা খেয়ালই করিনি।ওনার এই রূপের দর্শনে কিছুক্ষন মোহিত হয়ে গেছিলাম। এবার অপেক্ষা রাধাবল্লভের পালকিতে ও বলরামের রথে যাত্রা করার।মন্দিরের পুরোহিতের থেকে আরও জানলাম যে রথের পর উল্টোরথ পর্যন্ত এই রাধাবল্লভকে এই গুন্ডিচা মন্দিরে রেখেই বিভিন্ন বেশে সুসজ্জিত করা হয়। কখনও কালীয়দমন,কখনও কৃষ্ণকালী, কখনও গরুড়বাহন,আবার কখনও সত্যভামা রূপে তিনি আবির্ভূত হন ভক্তগনের মাঝে। সন্ধ্যে হতেই পুরো এলাকা যেন এক জনসমুদ্রে পরিণত হল।সত্যি বলতে অনেকদিন পর একটা অন্যরকম রথ দেখার অভিজ্ঞতা পেলাম। রথযাত্রা দেখে ফেরার পথে অনেকদিন পর মেলায় দেখলাম সেই কাঠের নাগরদোলা। শোনা যায় একসময় এই মেলায় পুতুলনাচ দেখানো হত। তবে সে সব এখন অতীত। তবে কাঠের নাগরদোলা আবার যেন নিজের হারানো শৈশবকে আবারও ফিরিয়ে দিয়েছিল।