রিইউনিয়ন
সাইনি রায় ##
ভোটের দিন , তাই রাস্তায় গাড়ি একেবারে নেই বললেই চলে । আজকের ক্লাসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই আশা বাড়ির বারণ না শুনেই বেরিয়ে পড়ে । রাস্তায় ঝাড়া আধঘন্টা দাঁড়িয়ে । না বাস না অন্যকিছু । দেরি যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে । এখন পৌঁছাতে পারলেই হল । একবার ভাবল বাড়ি ফিরে যাবে । কিন্তু ভাবল আরেকটু দেখা যাক । এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালো একটা বাইক । চালককে চেনার উপায় নেই । মুখ হেলমেটে ঢাকা । হেলমেটটা খুলেই সৌরভ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আজও বেরোচ্ছো ? তোমায় অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলাম । ক্লাসে যাচ্ছো তো ? চলো আমি দিয়ে আসছি ।
আশা অস্বস্তিতে পড়লো । না না ঠিক আছে । আমি আমার চলে যাবো । বলে রাস্তার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো । কিন্তু সৌরভ ছাড়লো না । যাবে কি করে ? গাড়ি কোথায় এখানে ? তাই বলছি উঠে পড়ো আমার বাইকে । আশা মনে মনে ভাবলো , সৌরভের সাথে যাওয়ার চেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া ভালো । কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটার কথা মাথায় আসতেই আর দেরি না করে সৌরভের বাইকে উঠে পড়লো ।
অনেকদিন পর তুমি আমার বাইকে উঠলে । সৌরভ হাসি মুখে বললো ।
আশা কোনোরকম সাড়া দিলোনা ।
আশাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে সৌরভ জানায় , তোমার ছুটি তো সাতটায় । ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করবো ।
আশা সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বলে ওঠে , না না ফেরার যাইহোক ব্যবস্থা করে নেবো , ক্লাসে বাকিরাও তো আছে। তুমি যে পৌঁছে দিয়েছো , তাই যথেষ্ট । অনেক ধন্যবাদ ।
সৌরভ আশাহত হল । একটু হতাশার সুরেই বললো ; ও ঠিক আছে তারপর আবার বলে উঠলো , কিন্তু
আজকের এই দিনে কেউ এসেছে কি ? আমি বরং তোমার ছুটির পর ওখানেই অপেক্ষা করবো । তোমার কোনো বন্ধুর সাথে ফেরার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো নাহলে আমিই তোমায় আবার নিয়ে আসবো । ঠিক আছে ? সাতটায় তাহলে দেখা হচ্ছে ।
আশাকে আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাইক নিয়ে চলে যায় সৌরভ ।
তাই তো ! জরুরি ক্লাসের তাড়ায় , বাড়ি থেকে ক্লাসে আর ক্লাস থেকে কিভাবে বাড়ি ফিরবে সে কথাই ভেবে দেখেনি আশা । আজ সৌরভই বাঁচিয়ে দিলো । যে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের জন্য আজ এত অসুবিধা করে আশা এখানে এলো , সেই ক্লাসেই সে মন বসাতে পারলো না একেবারে । পুরানো সব কথা খালি থেকে থেকে মনে পড়ে গেল । আশা আর সৌরভ একই পাড়ার বাসিন্দা । আশাদের বাড়ি সৌরভ প্রথম আসে দুর্গাপুজোর ব্যাপারে । আশার বাবা , সৌরভের বাবা , সৌরভ এরা সবাই পুজো কমিটির মেম্বার । একসাথে চাঁদাও তোলে এরা । সেই থেকে পরিচয় , তারপর ঘনিষ্ঠতা । দুজনের সম্পর্ক নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিল দুটি পরিবার । সৌরভ সুপুরুষ , নামি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে । অন্যদিকে আশাও সুন্দরী , সুশিক্ষিতা । তবুও সম্পর্কটা টিকলনা । দুতরফই বেশ আশাহত হয়েছিল । দুটো পরিবারের সম্পর্কে অবশ্য চিড় ধরেনি এজন্য । একে অপরের অভিভাবকের সাথে কথা বললেও পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়েই যেত । বিশেষ করে আশা । আজ অনেকদিন পর আবার সৌরভের সামনাসামনি হলো ।
কাজের কাজ হলোনা ক্লাসে এসে । মনই বসাতে পারলোনা । মনে মনে ভাবতে থাকলো আশা , সৌরভ
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর আগেই সে যেন বাস পেয়ে যায় । কিন্তু হায় হতভাগ্য ! আশা দূর থেকে দেখতে পেলো সৌরভ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । অন্য কোনো যে আর রাস্তা নেই , না হলে সে এপথ মাড়াতো না । কি আপদ ! পিছু ছাড়ে না । অগত্যা আবারও সৌরভই ভরসা । সৌরভ আশাকে পৌঁছে দিয়ে কাজ আছে বলে কোথায় বেরিয়ে গেল , নিজের বাড়ি গেলোনা ।
কলকাতার উষ্ণতম দিন । গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা । গরমকালে দখিনা বাতাস বয় সাধারণত , কিন্তু আশা ঘরে ঢুকেই বসন্তের হাওয়া অনুভব করলো । না এ হাওয়া বাইরে কোথাও নয় তার মনেই বইছে । হঠাৎ সাজতে ইচ্ছা করলো আশার । কাজল পেন্সিলটা চোখে বুলিয়ে নিলো । ছোট্ট কালো টিপ্ পড়লো । ছোট কালো টিপ্ সৌরভ বড় পছন্দ করে । এই রে !
খবরটা রাতের দিকে পেলো । রাত তখন দশটা , সবে রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে । এমন সময় পাশের বাড়ির কাকিমা খবর দিলেন যে সৌরভের এক্সিডেন্ট হয়েছে । সৌরভ বাইক নিয়ে ফিরছিলো আর সেইসময় একটা ম্যাটাডোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওর বাইকে সজোরে ধাক্কা মারে । সৌরভ এখন হস্পিটালাইজড । আশাও মা – বাবার সাথে ছুটে গেল সৌরভদের বাড়ি । জানতে পারলো – সৌরভের ডান পা ভেঙেছে , প্লাস্টার হয়েছে । হাতেও অল্প চোট লেগেছে । মাথায় হেলমেট ছিল বলে মাথাটা বেঁচে গেছে । বড় দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি । কালকেই ছেড়ে দেবে ।
সেই হসপিটাল থেকে সৌরভকে বাড়িতে আনা , অনেকদিন পর আবার আশার সৌরভদের বাড়িতে যাতায়াত । সেইদিন থেকে একরকম নাওয়া – খাওয়া ভুলে আশা ওদেরই বাড়িতে বেশি সময় কাটায় সৌরভের শ্রুশ্রষার পেছনে । আশার মা – বাবা অবশ্য আপত্তি করেনি । সৌরভের মা তো বলেই দিলেন , ভালোই হলো আমার কাজ হালকা হয়ে গেল । তুই বাবুকে দেখ আর আমি অন্য কাজগুলো সারি ।
কখনো কখনো আশা স্নান – খাওয়াও আজকাল ওদের বাড়িতেই সারে , সৌরভের মায়ের
পীড়াপীড়িতে । কে বলবে সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে কবে ? সেই তো সব আগের মতোই লাগে ।
লাঠির থেকে আশার উপরেই সৌরভের বেশি ভরসা । আশার উপস্থিতিতে আশাকে ধরে ধরেই
সে চলাফেরা করে ।
সৌরভ বললো , আমি মনে করি সব খারাপের পিছনে একটা ভালো কিছুও লুকিয়ে থাকে । মানে ? আশা প্রশ্ন করলো ।
এই দ্যাখো না , আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে ঠিক কথা , কিন্তু সেই কারণে তুমি কতদিন
পর আমার কাছে এলে । সৌরভ আশার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ।
আশা কোনো উত্তর না দিয়েই চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নিলো ।
সেদিন ফ্রেন্ডশিপ ডে । সৌরভ এখন পুরোপুরি সুস্থ । আশা বেশ কয়েকটা ফ্রেন্ডশিপব্যান্ড
কিনেছে । বরাবরের অভ্যাসমতো আশা তার মা – বাবাকেও ফ্রেন্ডশিপব্যান্ড পড়ায় যেমন
সৌরভের সাথে সাথে সে সৌরভের মা – বাবার হাতেও ফ্রেন্ডশিপব্যান্ড বাঁধে ।
যাক বাবা এবার আমি নিশ্চিন্ত । তুমি ঠিক হয়ে গেছো । এখন আমার ছুটি । বড্ডো খাটিয়েছো এই কদিন আমায় । ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলে আশা সৌরভকে ।
পাল্টা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সৌরভও জানায় , আমি তো তোমায় খাটতে বলিনি । তুমিই তো নিজের কষ্ট
বাড়ালে । খানিক চুপ করে আরো যোগ করলো , কি লাভ হলো ভালো হয়ে , তার থেকে বিছানায় পড়ে
থাকলে ভালো হতো । অন্তত তোমাকে কাছে পাচ্ছিলাম এতদিন ।
আশা শুধু মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে ।
সৌরভ বলতে থাকলো , দুনিয়ার সবথেকে সুন্দর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্বের সম্পর্ক । বেস্টফ্রেন্ডরা এই আড়ি করে তো এই ভাব । তাড়িয়ে ঝগড়া করার পর আবার একে অপরের কাছে ফিরে যায় । কিন্তু একবার ব্রেকআপ হয়ে গেলে প্রাক্তনেরা আর কেন কাছাকাছি আসতে পারেনা বলতো ? এইবার আশা তার নিঃস্তব্ধতা ভাঙলো । আমাকে যদি সত্যিই আরো কাছে পেতে চাও তাহলে তোমার মা -বাবাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন আমার মা – বাবার সাথে দেখা করো । বলেই আবার চুপ করে গেল ।
সকালের জলখাবার ফুলকো লুচি আর গরম গরম আলুরদম । ছেলে – মেয়ে দুটোর জন্য প্লেটে সাজিয়ে সবে সৌরভের ঘরের কাছে এসেছেন সৌরভের মা , ওদের ডাকবেন বলে , এমন সময় সৌরভ আর আশার সমস্ত কথোপকথনই ওনার কানে এলো । নিজেকে আর আটকে রাখতে না পেরে খুশিতে ডগমগ হয়ে ঘনঘন উলুধ্বনি দিতে লাগলেন । এতক্ষণ সৌরভ আশার কথায় ভারী অবাক হয়ে ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে চুপ করে দেখছিলো । মায়ের উলুধ্বনিতে যেন ওর হুঁশ ফিরলো । মায়ের এহেন কান্ডকারখানায় দুজনেই ভারী অস্বস্তিতে পড়লো । সৌরভ তো লজ্জা পেয়ে ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে বোকা বোকা দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগলো । আর আশা পড়ে গেল ফাঁপরে । সে বেচারি তো ছুট্টে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সৌরভের মায়ের উদ্দেশ্যে শুধু বললো , কাকিমা , তুমি যেন একটা কি !